দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন-আমি বরং আন্না হব না by অরুন্ধতী রায়
টেলিভিশনে যা দেখছি তা যদি সত্যিই বিপ্লব হয়, তাহলে তা সাম্প্রতিককালের অনেক বিব্রতকর ও দুর্বোধ্য এক বিপ্লব। কারণ, জন লোকপাল বিল সম্বন্ধে এখন আপনার যে প্রশ্নই থাক, যে কটি জবাব মিলবে তা হলো: সঠিক উত্তরে টিক চিহ্ন দিন—ক. বন্দে মাতরম খ. ভারত মাতা কি জয় গ. ইন্ডিয়া ইজ আন্না, আন্না ইজ ইন্ডিয়া ঘ. জয় হিন্দ।
আপনি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে ও সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে হয়তো বলতে পারেন, মাওবাদীদের সঙ্গে জন লোকপাল বিলের একটা মিল আছে। তা হলো, উভয়েই ভারতীয় রাষ্ট্রের উচ্ছেদ চায়। একপক্ষ কাজ করছে তলা থেকে, সশস্ত্র সংগ্রামের পথে। যে সংগ্রাম চালাচ্ছে মূলত আদিবাসী বাহিনী। গরিবদের ভেতরও যারা গরিব, তাদের নিয়ে এই সংগ্রাম। আর অন্য সংগ্রাম ওপর থেকে, রক্তপাতহীন গান্ধীয় অভ্যুত্থানের পথে। এর জন্ম নতুন এক সন্তের নেতৃত্বে। মূলত শহুরে আর অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মানুষের বাহিনী নিয়ে চলছে এ সংগ্রাম।
২০১১ সালের এপ্রিলে আন্না হাজারের প্রথম ‘আমরণ অনশন’ শুরুর পর কয়েক দিন অতিবাহিত হলে যখন বিশাল দুর্নীতির কালিমায় সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল, সরকার দৃষ্টি ভিন্নমুখী করার উপায় খুঁজছিল, তখন ‘টিম আন্না’কে—‘সিভিল সোসাইটি’ গোষ্ঠীটির বাছাই করা নিজেদের ব্র্যান্ড নাম—নতুন দুর্নীতিবিরোধী আইনের যৌথ খসড়া প্রণয়ন কমিটিতে শরিক হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায় সরকার। এভাবে কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এই কসরতে ক্ষান্তি দিয়ে সংসদে নিজেদের নিজস্ব বিল উত্থাপন করা হয়—বিলটা এতই ত্রুটিপূর্ণ ছিল যে একে গুরুত্বসহকারে নেওয়ার উপায় ছিল না।
তারপর ১৬ আগস্ট তাঁর দ্বিতীয় ‘আমরণ অনশন’ শুরুর দিন সকালবেলা অনশন শুরু কিংবা কোনো আইনি অপরাধ সংঘটনের আগেই আন্না হাজারেকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। জন লোকপাল বিল বাস্তবায়নের লড়াই এবার এসে মিলে যায় প্রতিবাদ করার অধিকার ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের সঙ্গে। এই ‘দ্বিতীয় মুক্তির সংগ্রাম’ শুরু করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আন্নাকে মুক্তি দেওয়া হয়। বিচক্ষণ আন্না কারাগার ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিহার জেলে থেকে যান সম্মানিত অতিথি হিসেবে। তিনি সেখানে অনশন শুরু করেন, প্রকাশ্য স্থানে অনশনের অধিকারের দাবি করেন। তিন দিন ধরে টিম আন্নার সদস্যরা কড়া নিরাপত্তা কারাগারে আনাগোনা করেন। বের হওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে আসেন আন্নার ভিডিও বার্তা জাতীয় টিভি ও অন্য সব চ্যানেলে সম্প্রচারের জন্য। কারাগারের বাইরে জনতা ও টেলিভিশন ভ্যানের ভিড়। (এই বিলাসিতা অন্য কার ভাগ্যে জুটবে?) এদিকে সপ্তাহান্তের প্রদর্শনীর জন্য রামলীলার কর্দমাক্ত মাঠকে প্রস্তুত করতে দিল্লির মিউনিসিপ্যাল কমিশনের ২৫০ জন কর্মী, ১৫টি ট্রাক ও ছয়টি আর্থ মোভার্স যান সার্বক্ষণিক কাজ করে। এখন শুরু হয়েছে আন্নার ‘আমরণ অনশনের’ তৃতীয় পর্ব—সব প্রয়োজনের ওপর দৃষ্টি রাখা হচ্ছে, ক্রেনে বসানো ক্যামেরা আর উল্লসিত জনতা সতর্ক দৃষ্টি রাখছে, ভারতের সবচেয়ে দামি চিকিৎ সকেরা খিদমতে হাজির। টিভি অ্যাঙ্কররা জানাচ্ছেন, ‘কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, সারা ভারত এক।’
আন্নার অছিলা হয়তো গান্ধীয়, তবে তার দাবিদাওয়া একদমই নয়। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে গান্ধীজির চিন্তার বিপরীতে জন লোকপাল বিল হলো একটা অতিশয় কঠোর ও নির্মম দুর্নীতিবিরোধী আইন, যার মধ্যে সযত্নে বাছাই করা কিছু মানুষ বিশাল এক আমলাতন্ত্রকে শাসন করবে; থাকবে হাজার হাজার কর্মী বাহিনী। প্রধানমন্ত্রী, বিচার বিভাগ, সাংসদ, পুরো আমলাতন্ত্র থেকে শুরু করে সবচেয়ে নিম্নস্তরের সরকারি কর্মী পর্যন্ত সবার ওপর পুলিশিং করার কর্তৃত্ব থাকবে। তদন্ত, নজরদারি ও নালিশ করার কর্তৃত্ব থাকবে লোকপালের হাতে। তাদের নিজস্ব কারাগার থাকবে না—এই ব্যাপারটা বাদে লোকপাল কাজ করবে স্বাধীন প্রশাসনের মতো, যার লক্ষ্য আমাদের ফুলেফেঁপে ওঠা, অব্যাখ্যেয় দুর্নীতিবাজদের মোকাবিলা। এক গোষ্ঠী শাসনের বদলে দ্বিগোষ্ঠী শাসন।
এ ব্যবস্থা কাজ করবে কি করবে না, তা নির্ভর করে দুর্নীতির ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। দুর্নীতি কি শুধুই আইনের বিষয়? আর্থিক অনিয়ম ও ঘুষের বিষয়? নাকি শোচনীয় রকম অসম সমাজের—যেখানে ক্ষমতা কুক্ষিগত অতি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুর হাতে—সামাজিক লেনদেনের রেওয়াজ? উদাহরণ দেওয়া যাক। একটা শপিং মলভিত্তিক শহরের কথাই ভাবুন। এখানে রাস্তায় ফেরি করা অবৈধ। যাদের মল থেকে উচ্চমূল্যে কেনাকাটার সামর্থ্য নেই, তাদের কাছে কম দামে এক হকার মেয়ে আইন ভেঙে তার পণ্যসামগ্রী বিক্রি করবে; এ জন্য স্থানীয় বিটের পুলিশ ও পৌরসভার লোকটাকে অল্প ঘুষ দিতে হবে। এটা কি খুবই ঘোরতর ব্যাপার? ভবিষ্যতে হকার মেয়েটাকে কি লোকপাল প্রতিনিধিকেও ঘুষ দিতে হবে? সাধারণ মানুষের সমস্যার সমাধান কোথায়—কাঠামোগত অসমতাকে ধরা, নাকি আরেকটা ক্ষমতাকাঠামো তৈরির মধ্যে নিহিত?
এই রঙ্গমঞ্চের সামগ্রী, কোরিওগ্রাফি, আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ ও আন্নার বিপ্লবের পতাকা ওড়ানোর ঢং সবই ধার করা। সংরক্ষণবিরোধী বিক্ষোভ, বিশ্বকাপ জয়ের প্যারেড আর পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা উদ্যাপন থেকে নেওয়া। এসব ইঙ্গিত দেয়, যারা এই ‘অনশন’ সমর্থন করে না তারা ‘খাঁটি ভারতীয়’ নয়। টিভি চ্যানেলগুলো মীমাংসায় পৌঁছেছে যে দেশে জানানোর মতো আর কোনো খবর নেই।
এই অনশনের মানে স্বভাবতই ইরম শর্মিলার অনশন নয়। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অনশন চালিয়েছিলেন তিনি (এখন তাঁকে বল প্রয়োগে অনশন ভাঙানো হয়েছে)। তাঁর অনশন ছিল সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনের (এএফএসপিএ) বিরুদ্ধে। শুধু সন্দেহের বশে মণিপুরে ভারতীয় সেনাদের মানুষ খুনের অনুমতি দিয়েছে এ আইন। এই অনশনের মানে কুদানকুলামে পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রবিরোধী ১০ হাজার গ্রামবাসীর চলমান পর্যায়ক্রমিক অনশন নয়। টিভি চ্যানেলের ‘জনগণ’ মানে সেসব মণিপুরি নয়, যারা ইরম শর্মিলার অনশন সমর্থন করে। এই ‘জনগণ’ মানে জগৎ সিংহপুর-কালিঙ্গপুর-নিয়মগিরি-বাস্তার-জাইতাপুরের সেই হাজার হাজার মানুষ নয়, যারা সশস্ত্র পুলিশ আর খনি মাফিয়াদের দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করছে। এই ‘জনগণ’ ভোপাল গ্যাস নিঃসরণে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তরাও নয়, কিংবা নর্মদা উপত্যকায় বাঁধ নির্মাণের ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষও নয়; নইদা কিংবা পুনে কিংবা হরিয়ানা কিংবা ভারতের অন্য কোনোখানে যে কৃষকেরা ভূমি দখল প্রতিরোধে লড়াই করছে, তারাও নয়।
এই ‘জনগণ’ মানে কেবল সেসব দর্শক, যাঁরা দেখতে জড়ো হয়েছেন ৭৪ বছরের এক বৃদ্ধ হুমকি দিচ্ছেন তাঁর জন লোকপাল বিল সংসদে উত্থাপিত ও পাস না হলে তিনি না খেয়ে মারা যাবেন। ‘জনগণ’ হলো সেই হাজার হাজার মানুষ, যারা টিভি চ্যানেলগুলোর আজব কেরামতিতে হয়ে গেল লাখ লাখ মানুষ। আমরা শুনলাম, ‘শত কোটি কণ্ঠে এক আওয়াজ, আন্নাই ভারত।’
নতুন এই সন্ত, জনগণের এই কণ্ঠস্বর, আসলে কে? অতি জরুরি বিষয়াদি নিয়ে তাঁকে বিস্ময়করভাবে কোনো কথাই বলতে কখনো শুনলাম না। তাঁর ঘরের কাছে কৃষকের আত্মাহুতি দান কিংবা দূরে অপারেশন গ্রিন হার্ট নিয়ে কোনো কথা নেই; সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড় নিয়েও নয়। পসকোর ব্যাপারে, কৃষক বিক্ষোভ নিয়ে কিংবা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) তৈরির ক্ষতিকর দিক নিয়ে কোনো কথা নেই। মধ্য ভারতের জঙ্গলে ভারতীয় সেনাবাহিনী মোতায়েনের সরকারি পরিকল্পনা নিয়ে তাঁর কিছু বলার আছে বলে তো মনে হয় না।
তবে রাজ ঠাকরের ‘মারাঠি মানুষ’ নামক জাতিবিদ্বেষকে তিনি সমর্থন করেন। আর গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘উন্নয়ন মডেল’ তাঁর প্রশংসা পায়। এই সেই মোদি, যিনি ২০০২ সালে তাঁর রাজ্যে সংঘবদ্ধ মুসলমান-নিধন তদারক করেছেন। (রোল পড়ে গেলে আন্না তাঁর সেই বিবৃতি প্রত্যাহার করে নেন, তবে অনুমান করা যায়, তারিফ ফিরিয়ে নেননি।)
হইহট্টগোল সত্ত্বেও পরিমিতিবোধসম্পন্ন সাংবাদিকেরা তাঁদের কাজ করে গেছেন। তাদের কাজের ফলে এখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সঙ্গে আন্নার পুরোনো সম্পর্কের পটভূমি উঠে এসেছে। আন্নার গ্রাম রালেগাঁ সিদ্ধির সমাজ নিয়ে কাজ করেছেন মুকুল শর্মা। তিনি জানান, সেখানে গত ২৫ বছরে কোনো গ্রাম পঞ্চায়েত অথবা সমবায় সমিতি নির্বাচন হয়নি। ‘হরিজন’দের ব্যাপারে আন্নার দৃষ্টিভঙ্গি হলো: ‘মহাত্মা গান্ধীর স্বপ্ন ছিল প্রতিটি গ্রামে থাকবে একজন চামার, একজন সুনার, একজন কুমার ইত্যাদি। তারা সবাই সমাজে তাদের ভূমিকা ও বৃত্তি অনুযায়ী কাজ করবে, আর এভাবেই একেকটা গ্রাম স্বনির্ভর হবে। রালেগাঁ সিদ্ধিতে আমরা সেই চর্চাই করছি।’ টিম আন্নার সদস্যরা যে ইয়ুথ ফর ইকুয়ালিটি, সংরক্ষণবিরোধী (‘মেধা’পন্থী) আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন তা কি কোনো আশ্চর্যের ব্যাপার? আন্নার প্রচারাভিযান যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁরা একগুচ্ছ এনজিও চালান। যেগুলো কোকাকোলা ও লেম্যান ব্রাদার্সের মতো দাতাদের কাছ থেকে উদারহস্তে দান গ্রহণ করে। টিম আন্নার দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও সুনীল সিসোডিয়া পরিচালিত সংস্থা কবির গত তিন বছরে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে চার লাখ ডলার পেয়েছে। ইন্ডিয়া অ্যাগেইনস্ট করাপশন প্রচারাভিযানে অংশদাতাদের মধ্যে ছিল এমন সব ভারতীয় কোম্পানি ও ফাউন্ডেশন, যারা অ্যালুমিনিয়াম প্ল্যান্টের মালিক, বন্দর ও এসইজেডের নির্মাতা, আবাসন ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য পরিচালনাকারী রাজনীতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এদের কারও কারও বিরুদ্ধে আবার দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধের তদন্ত চলছে। এমন লোকেরা কেন দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের ব্যাপারে এত উৎ সাহী?
জন লোকপাল বিলের পক্ষে প্রচার জোরদার হয়েছিল যে সময়টাতে, তার কাছাকাছি সময়ে উইকিলিকসের দ্বারা এবং টুজি স্পেকট্রাম দুর্নীতিসহ বিব্রতকর নানা সত্য উন্মোচিত হচ্ছিল। টু-জি কলঙ্কে বৃহৎ করপোরেশন, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সরকারের মন্ত্রী এবং কংগ্রেস ও বিজেপির রাজনীতিকেরা নানাভাবে গোপন বোঝাপড়ার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি রুপি সরকারি কোষাগার থেকে তছরুপ করে। বহু বছরের মধ্যে সেবারই প্রথম সাংবাদিক-তদবিরকারীরা বেইজ্জতির শিকার হন। মনে হচ্ছিল করপোরেট ভারতের বাঘা বাঘা কিছু ক্যাপ্টেন হয়তো আসলেই কারাগারে বসতি গাড়বেন। সময়টা জনগণের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের দারুণ উপযুক্ত, নয় কি?
যে সময়ে রাষ্ট্র তার বুনিয়াদি দায়দায়িত্ব থেকে সরে আসছে আর করপোরেশন ও এনজিওগুলো সরকারি কর্মকাণ্ডের জায়গা (পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ , পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা) দখল করছে; যে সময়ে আতঙ্কজনক শক্তি এবং করপোরেট মালিকানাধীন গণমাধ্যমের বিস্তার গণমানুষের মনোজগৎ নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেই সময়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে—করপোরেশন, গণমাধ্যম, এনজিও—লোকপাল বিলের আওতাধীন রাখার বিষয়ে যে কারও ভাবার কথা। অথচ প্রস্তাবিত বিলে এদের সম্পূর্ণরূপে বাইরে রাখা হয়েছে।
এখন সবার চেয়ে উচ্চ স্বরে চিৎ কার করে, দুষ্ট রাজনীতিক ও সরকারি দুর্নীতির বিষয়ে আঘাত করার প্রচারাভিযানে তাল দিয়ে, তারা খুব কৌশলে নিজেদের বিপদ থেকে বাঁচিয়ে নিতে পেরেছে। আরও খারাপ ব্যাপার হলো, শুধু সরকারকে অশুভ হিসেবে হাজির করার মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের এমন উচ্চ আসনে আসীন করছেন, যে আসন থেকে তাঁরা রাষ্ট্রকে আরও জনপরিসর থেকে প্রত্যাহার করতে পারেন এবং দ্বিতীয় দফায় সংস্কারের আহ্বান জানাতে পারেন। এবার সংস্কারে আসবে আরও বেসরকারীকরণ, জন-অবকাঠামো ও ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদে তাদের অধিকতর প্রবেশাধিকার। হয়তো খুব বেশি দেরি নেই, যেদিন করপোরেট দুর্নীতি ‘তদবির ফি’ বা ‘লবিয়িং ফি’ নামে বৈধ হবে।
দৈনিক ২০ রুপিতে যে ৮৩ কোটি মানুষ দিন গুজরান করে, তারা কি একগুচ্ছ নীতি জোরদার করা হলে আসলেই কোনো উপকার পাবে? সেসব নীতিই তো তাদের গরিব থেকে আরও গরিব বানাচ্ছে, ভারতকে ঠেলে দিচ্ছে গৃহযুদ্ধের দিকে।
এই ঘোর সংকট তৈরি হয়েছে ভারতের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের পুরোদস্তুর ব্যর্থতার ফলে। এখানে আইন পরিষদ গড়ে ওঠে অপরাধী ও কোটিপতি রাজনীতিকদের নিয়ে। এই রাজনীতিকেরা আর জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না। এ ব্যবস্থায় একটাও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার আছে। পতাকা ওড়ানো দেখে প্রতারিত হবেন না। আমরা এখন ভারতকে ভাগাভাগি করে রাষ্ট্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ দেখছি। এটা আফগান যুদ্ধসর্দারদের যেকোনো যুদ্ধের মতোই সাংঘাতিক। তবে এ যুদ্ধে বিপন্ন আরও অনেক কিছুই।
ভারতের দ্য হিন্দু থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
অরুন্ধতী রায়: বুকার পুরস্কারজয়ী ভারতীয় কথাসাহিত্যিক ও প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী।
২০১১ সালের এপ্রিলে আন্না হাজারের প্রথম ‘আমরণ অনশন’ শুরুর পর কয়েক দিন অতিবাহিত হলে যখন বিশাল দুর্নীতির কালিমায় সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল, সরকার দৃষ্টি ভিন্নমুখী করার উপায় খুঁজছিল, তখন ‘টিম আন্না’কে—‘সিভিল সোসাইটি’ গোষ্ঠীটির বাছাই করা নিজেদের ব্র্যান্ড নাম—নতুন দুর্নীতিবিরোধী আইনের যৌথ খসড়া প্রণয়ন কমিটিতে শরিক হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায় সরকার। এভাবে কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এই কসরতে ক্ষান্তি দিয়ে সংসদে নিজেদের নিজস্ব বিল উত্থাপন করা হয়—বিলটা এতই ত্রুটিপূর্ণ ছিল যে একে গুরুত্বসহকারে নেওয়ার উপায় ছিল না।
তারপর ১৬ আগস্ট তাঁর দ্বিতীয় ‘আমরণ অনশন’ শুরুর দিন সকালবেলা অনশন শুরু কিংবা কোনো আইনি অপরাধ সংঘটনের আগেই আন্না হাজারেকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। জন লোকপাল বিল বাস্তবায়নের লড়াই এবার এসে মিলে যায় প্রতিবাদ করার অধিকার ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের সঙ্গে। এই ‘দ্বিতীয় মুক্তির সংগ্রাম’ শুরু করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আন্নাকে মুক্তি দেওয়া হয়। বিচক্ষণ আন্না কারাগার ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিহার জেলে থেকে যান সম্মানিত অতিথি হিসেবে। তিনি সেখানে অনশন শুরু করেন, প্রকাশ্য স্থানে অনশনের অধিকারের দাবি করেন। তিন দিন ধরে টিম আন্নার সদস্যরা কড়া নিরাপত্তা কারাগারে আনাগোনা করেন। বের হওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে আসেন আন্নার ভিডিও বার্তা জাতীয় টিভি ও অন্য সব চ্যানেলে সম্প্রচারের জন্য। কারাগারের বাইরে জনতা ও টেলিভিশন ভ্যানের ভিড়। (এই বিলাসিতা অন্য কার ভাগ্যে জুটবে?) এদিকে সপ্তাহান্তের প্রদর্শনীর জন্য রামলীলার কর্দমাক্ত মাঠকে প্রস্তুত করতে দিল্লির মিউনিসিপ্যাল কমিশনের ২৫০ জন কর্মী, ১৫টি ট্রাক ও ছয়টি আর্থ মোভার্স যান সার্বক্ষণিক কাজ করে। এখন শুরু হয়েছে আন্নার ‘আমরণ অনশনের’ তৃতীয় পর্ব—সব প্রয়োজনের ওপর দৃষ্টি রাখা হচ্ছে, ক্রেনে বসানো ক্যামেরা আর উল্লসিত জনতা সতর্ক দৃষ্টি রাখছে, ভারতের সবচেয়ে দামি চিকিৎ সকেরা খিদমতে হাজির। টিভি অ্যাঙ্কররা জানাচ্ছেন, ‘কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, সারা ভারত এক।’
আন্নার অছিলা হয়তো গান্ধীয়, তবে তার দাবিদাওয়া একদমই নয়। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে গান্ধীজির চিন্তার বিপরীতে জন লোকপাল বিল হলো একটা অতিশয় কঠোর ও নির্মম দুর্নীতিবিরোধী আইন, যার মধ্যে সযত্নে বাছাই করা কিছু মানুষ বিশাল এক আমলাতন্ত্রকে শাসন করবে; থাকবে হাজার হাজার কর্মী বাহিনী। প্রধানমন্ত্রী, বিচার বিভাগ, সাংসদ, পুরো আমলাতন্ত্র থেকে শুরু করে সবচেয়ে নিম্নস্তরের সরকারি কর্মী পর্যন্ত সবার ওপর পুলিশিং করার কর্তৃত্ব থাকবে। তদন্ত, নজরদারি ও নালিশ করার কর্তৃত্ব থাকবে লোকপালের হাতে। তাদের নিজস্ব কারাগার থাকবে না—এই ব্যাপারটা বাদে লোকপাল কাজ করবে স্বাধীন প্রশাসনের মতো, যার লক্ষ্য আমাদের ফুলেফেঁপে ওঠা, অব্যাখ্যেয় দুর্নীতিবাজদের মোকাবিলা। এক গোষ্ঠী শাসনের বদলে দ্বিগোষ্ঠী শাসন।
এ ব্যবস্থা কাজ করবে কি করবে না, তা নির্ভর করে দুর্নীতির ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। দুর্নীতি কি শুধুই আইনের বিষয়? আর্থিক অনিয়ম ও ঘুষের বিষয়? নাকি শোচনীয় রকম অসম সমাজের—যেখানে ক্ষমতা কুক্ষিগত অতি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুর হাতে—সামাজিক লেনদেনের রেওয়াজ? উদাহরণ দেওয়া যাক। একটা শপিং মলভিত্তিক শহরের কথাই ভাবুন। এখানে রাস্তায় ফেরি করা অবৈধ। যাদের মল থেকে উচ্চমূল্যে কেনাকাটার সামর্থ্য নেই, তাদের কাছে কম দামে এক হকার মেয়ে আইন ভেঙে তার পণ্যসামগ্রী বিক্রি করবে; এ জন্য স্থানীয় বিটের পুলিশ ও পৌরসভার লোকটাকে অল্প ঘুষ দিতে হবে। এটা কি খুবই ঘোরতর ব্যাপার? ভবিষ্যতে হকার মেয়েটাকে কি লোকপাল প্রতিনিধিকেও ঘুষ দিতে হবে? সাধারণ মানুষের সমস্যার সমাধান কোথায়—কাঠামোগত অসমতাকে ধরা, নাকি আরেকটা ক্ষমতাকাঠামো তৈরির মধ্যে নিহিত?
এই রঙ্গমঞ্চের সামগ্রী, কোরিওগ্রাফি, আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ ও আন্নার বিপ্লবের পতাকা ওড়ানোর ঢং সবই ধার করা। সংরক্ষণবিরোধী বিক্ষোভ, বিশ্বকাপ জয়ের প্যারেড আর পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা উদ্যাপন থেকে নেওয়া। এসব ইঙ্গিত দেয়, যারা এই ‘অনশন’ সমর্থন করে না তারা ‘খাঁটি ভারতীয়’ নয়। টিভি চ্যানেলগুলো মীমাংসায় পৌঁছেছে যে দেশে জানানোর মতো আর কোনো খবর নেই।
এই অনশনের মানে স্বভাবতই ইরম শর্মিলার অনশন নয়। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অনশন চালিয়েছিলেন তিনি (এখন তাঁকে বল প্রয়োগে অনশন ভাঙানো হয়েছে)। তাঁর অনশন ছিল সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনের (এএফএসপিএ) বিরুদ্ধে। শুধু সন্দেহের বশে মণিপুরে ভারতীয় সেনাদের মানুষ খুনের অনুমতি দিয়েছে এ আইন। এই অনশনের মানে কুদানকুলামে পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রবিরোধী ১০ হাজার গ্রামবাসীর চলমান পর্যায়ক্রমিক অনশন নয়। টিভি চ্যানেলের ‘জনগণ’ মানে সেসব মণিপুরি নয়, যারা ইরম শর্মিলার অনশন সমর্থন করে। এই ‘জনগণ’ মানে জগৎ সিংহপুর-কালিঙ্গপুর-নিয়মগিরি-বাস্তার-জাইতাপুরের সেই হাজার হাজার মানুষ নয়, যারা সশস্ত্র পুলিশ আর খনি মাফিয়াদের দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করছে। এই ‘জনগণ’ ভোপাল গ্যাস নিঃসরণে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তরাও নয়, কিংবা নর্মদা উপত্যকায় বাঁধ নির্মাণের ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষও নয়; নইদা কিংবা পুনে কিংবা হরিয়ানা কিংবা ভারতের অন্য কোনোখানে যে কৃষকেরা ভূমি দখল প্রতিরোধে লড়াই করছে, তারাও নয়।
এই ‘জনগণ’ মানে কেবল সেসব দর্শক, যাঁরা দেখতে জড়ো হয়েছেন ৭৪ বছরের এক বৃদ্ধ হুমকি দিচ্ছেন তাঁর জন লোকপাল বিল সংসদে উত্থাপিত ও পাস না হলে তিনি না খেয়ে মারা যাবেন। ‘জনগণ’ হলো সেই হাজার হাজার মানুষ, যারা টিভি চ্যানেলগুলোর আজব কেরামতিতে হয়ে গেল লাখ লাখ মানুষ। আমরা শুনলাম, ‘শত কোটি কণ্ঠে এক আওয়াজ, আন্নাই ভারত।’
নতুন এই সন্ত, জনগণের এই কণ্ঠস্বর, আসলে কে? অতি জরুরি বিষয়াদি নিয়ে তাঁকে বিস্ময়করভাবে কোনো কথাই বলতে কখনো শুনলাম না। তাঁর ঘরের কাছে কৃষকের আত্মাহুতি দান কিংবা দূরে অপারেশন গ্রিন হার্ট নিয়ে কোনো কথা নেই; সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড় নিয়েও নয়। পসকোর ব্যাপারে, কৃষক বিক্ষোভ নিয়ে কিংবা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) তৈরির ক্ষতিকর দিক নিয়ে কোনো কথা নেই। মধ্য ভারতের জঙ্গলে ভারতীয় সেনাবাহিনী মোতায়েনের সরকারি পরিকল্পনা নিয়ে তাঁর কিছু বলার আছে বলে তো মনে হয় না।
তবে রাজ ঠাকরের ‘মারাঠি মানুষ’ নামক জাতিবিদ্বেষকে তিনি সমর্থন করেন। আর গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘উন্নয়ন মডেল’ তাঁর প্রশংসা পায়। এই সেই মোদি, যিনি ২০০২ সালে তাঁর রাজ্যে সংঘবদ্ধ মুসলমান-নিধন তদারক করেছেন। (রোল পড়ে গেলে আন্না তাঁর সেই বিবৃতি প্রত্যাহার করে নেন, তবে অনুমান করা যায়, তারিফ ফিরিয়ে নেননি।)
হইহট্টগোল সত্ত্বেও পরিমিতিবোধসম্পন্ন সাংবাদিকেরা তাঁদের কাজ করে গেছেন। তাদের কাজের ফলে এখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সঙ্গে আন্নার পুরোনো সম্পর্কের পটভূমি উঠে এসেছে। আন্নার গ্রাম রালেগাঁ সিদ্ধির সমাজ নিয়ে কাজ করেছেন মুকুল শর্মা। তিনি জানান, সেখানে গত ২৫ বছরে কোনো গ্রাম পঞ্চায়েত অথবা সমবায় সমিতি নির্বাচন হয়নি। ‘হরিজন’দের ব্যাপারে আন্নার দৃষ্টিভঙ্গি হলো: ‘মহাত্মা গান্ধীর স্বপ্ন ছিল প্রতিটি গ্রামে থাকবে একজন চামার, একজন সুনার, একজন কুমার ইত্যাদি। তারা সবাই সমাজে তাদের ভূমিকা ও বৃত্তি অনুযায়ী কাজ করবে, আর এভাবেই একেকটা গ্রাম স্বনির্ভর হবে। রালেগাঁ সিদ্ধিতে আমরা সেই চর্চাই করছি।’ টিম আন্নার সদস্যরা যে ইয়ুথ ফর ইকুয়ালিটি, সংরক্ষণবিরোধী (‘মেধা’পন্থী) আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন তা কি কোনো আশ্চর্যের ব্যাপার? আন্নার প্রচারাভিযান যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁরা একগুচ্ছ এনজিও চালান। যেগুলো কোকাকোলা ও লেম্যান ব্রাদার্সের মতো দাতাদের কাছ থেকে উদারহস্তে দান গ্রহণ করে। টিম আন্নার দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও সুনীল সিসোডিয়া পরিচালিত সংস্থা কবির গত তিন বছরে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে চার লাখ ডলার পেয়েছে। ইন্ডিয়া অ্যাগেইনস্ট করাপশন প্রচারাভিযানে অংশদাতাদের মধ্যে ছিল এমন সব ভারতীয় কোম্পানি ও ফাউন্ডেশন, যারা অ্যালুমিনিয়াম প্ল্যান্টের মালিক, বন্দর ও এসইজেডের নির্মাতা, আবাসন ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য পরিচালনাকারী রাজনীতিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এদের কারও কারও বিরুদ্ধে আবার দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধের তদন্ত চলছে। এমন লোকেরা কেন দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের ব্যাপারে এত উৎ সাহী?
জন লোকপাল বিলের পক্ষে প্রচার জোরদার হয়েছিল যে সময়টাতে, তার কাছাকাছি সময়ে উইকিলিকসের দ্বারা এবং টুজি স্পেকট্রাম দুর্নীতিসহ বিব্রতকর নানা সত্য উন্মোচিত হচ্ছিল। টু-জি কলঙ্কে বৃহৎ করপোরেশন, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সরকারের মন্ত্রী এবং কংগ্রেস ও বিজেপির রাজনীতিকেরা নানাভাবে গোপন বোঝাপড়ার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি রুপি সরকারি কোষাগার থেকে তছরুপ করে। বহু বছরের মধ্যে সেবারই প্রথম সাংবাদিক-তদবিরকারীরা বেইজ্জতির শিকার হন। মনে হচ্ছিল করপোরেট ভারতের বাঘা বাঘা কিছু ক্যাপ্টেন হয়তো আসলেই কারাগারে বসতি গাড়বেন। সময়টা জনগণের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের দারুণ উপযুক্ত, নয় কি?
যে সময়ে রাষ্ট্র তার বুনিয়াদি দায়দায়িত্ব থেকে সরে আসছে আর করপোরেশন ও এনজিওগুলো সরকারি কর্মকাণ্ডের জায়গা (পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ , পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা) দখল করছে; যে সময়ে আতঙ্কজনক শক্তি এবং করপোরেট মালিকানাধীন গণমাধ্যমের বিস্তার গণমানুষের মনোজগৎ নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেই সময়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে—করপোরেশন, গণমাধ্যম, এনজিও—লোকপাল বিলের আওতাধীন রাখার বিষয়ে যে কারও ভাবার কথা। অথচ প্রস্তাবিত বিলে এদের সম্পূর্ণরূপে বাইরে রাখা হয়েছে।
এখন সবার চেয়ে উচ্চ স্বরে চিৎ কার করে, দুষ্ট রাজনীতিক ও সরকারি দুর্নীতির বিষয়ে আঘাত করার প্রচারাভিযানে তাল দিয়ে, তারা খুব কৌশলে নিজেদের বিপদ থেকে বাঁচিয়ে নিতে পেরেছে। আরও খারাপ ব্যাপার হলো, শুধু সরকারকে অশুভ হিসেবে হাজির করার মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের এমন উচ্চ আসনে আসীন করছেন, যে আসন থেকে তাঁরা রাষ্ট্রকে আরও জনপরিসর থেকে প্রত্যাহার করতে পারেন এবং দ্বিতীয় দফায় সংস্কারের আহ্বান জানাতে পারেন। এবার সংস্কারে আসবে আরও বেসরকারীকরণ, জন-অবকাঠামো ও ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদে তাদের অধিকতর প্রবেশাধিকার। হয়তো খুব বেশি দেরি নেই, যেদিন করপোরেট দুর্নীতি ‘তদবির ফি’ বা ‘লবিয়িং ফি’ নামে বৈধ হবে।
দৈনিক ২০ রুপিতে যে ৮৩ কোটি মানুষ দিন গুজরান করে, তারা কি একগুচ্ছ নীতি জোরদার করা হলে আসলেই কোনো উপকার পাবে? সেসব নীতিই তো তাদের গরিব থেকে আরও গরিব বানাচ্ছে, ভারতকে ঠেলে দিচ্ছে গৃহযুদ্ধের দিকে।
এই ঘোর সংকট তৈরি হয়েছে ভারতের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের পুরোদস্তুর ব্যর্থতার ফলে। এখানে আইন পরিষদ গড়ে ওঠে অপরাধী ও কোটিপতি রাজনীতিকদের নিয়ে। এই রাজনীতিকেরা আর জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না। এ ব্যবস্থায় একটাও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার আছে। পতাকা ওড়ানো দেখে প্রতারিত হবেন না। আমরা এখন ভারতকে ভাগাভাগি করে রাষ্ট্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ দেখছি। এটা আফগান যুদ্ধসর্দারদের যেকোনো যুদ্ধের মতোই সাংঘাতিক। তবে এ যুদ্ধে বিপন্ন আরও অনেক কিছুই।
ভারতের দ্য হিন্দু থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
অরুন্ধতী রায়: বুকার পুরস্কারজয়ী ভারতীয় কথাসাহিত্যিক ও প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী।
No comments