বাঘা তেঁতুল-বিকল্প পরিবহন প্রস্তাব by সৈয়দ আবুল মকসুদ

রমজানের রোজার শেষে আসছে খুশির ঈদ। তার এক মাস পরে আনন্দঘন দুর্গাপূজা। তার পরেই মহা খুশির কোরবানির ঈদ। তার পরের মাসে খ্রিষ্টানদের বড়দিন। প্রত্যেক সম্প্রদায়ই তার সবচেয়ে বড় উৎ সবটি প্রিয়জনদের নিয়ে একত্রে উদ্যাপন করতে চায়।


কর্মস্থল থেকে অনেকেরই প্রিয়জন এত দূরে থাকে যে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। যেতে হলে ট্রেনে, লঞ্চ-ইস্টিমারে বা বাসে যেতে হবে। বাস এবং গাড়িতেই যাবে বেশি লোক। গাড়ি পিচঢালা ও সমতল সড়ক ছাড়া চলতে পারে না। যে রাস্তা চাঁদের পিঠের মতো খানাখন্দে ভরপুর, সেখানে মোটরযান চলতে অক্ষম। বর্তমানে বাংলাদেশের রাস্তার দশা চাঁদের পিঠের চেয়ে শোচনীয়।
তবে ঈদের আগেই সেগুলো গাড়ি চলাচলের উপযোগী করতে তড়িঘড়ি মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। আড়াই বছর বসে থেকে হঠাৎ কেন তোড়জোড়? আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করেছেন, দুই কৃতী সন্তান সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত না হলে তড়িঘড়ি সড়ক মেরামতের উদ্যোগ সরকার নিত কি না? কিছুদিন ধরে সড়কের দুরবস্থা নিয়ে বিভিন্ন চ্যানেল প্রতিবেদন করলেও কাকপক্ষীটিরও টনক নড়েনি। এখন ঈদের ছুটির এক হপ্তা আগে কেন? তাতে কর্তাদের একটু পেরেশানি হলেও শাপে বর হয়েছে।
আমরা নাটকে দেখেছি পাত্র-পাত্রীর প্রবেশ ও প্রস্থান। নাটকের চরিত্ররা মঞ্চে প্রবেশ করে, তার ভূমিকায় সঠিক অভিনয় করতে না পারলে সঙ্গে সঙ্গে প্রস্থান করে। জীবনের নাটক, বিশেষ করে রাজনীতির নাটকে মঞ্চে প্রবেশ করে কেউ প্রস্থান করতে চান না—দায়িত্ব তিনি পালন করতে পারুন আর না-ই পারুন। তাই ১০ কোটি ভোটার তাঁর নিষ্ক্রমণ চাইলেও লাভ নেই। মঞ্চ তিনি ছাড়বেন না। মঞ্চের মধু মৌচাকের মধুর চেয়ে মিষ্টি।
বাংলার মাটিতে যোগাযোগের যাঁরা প্রভু, তাঁদের যত ব্যর্থতাই থাকুক, তাঁদের ওই পদ থেকে নড়ানোর সাধ্যি জনগণের তো নয়-ই, স্বয়ং বিধাতার কতটা আছে, তাতে সন্দেহ রয়েছে। নৌমন্ত্রী বলেছেন, যাতায়াত ও পরিবহনের সমস্যা দূর করতে এখনকার মন্ত্রণালয়গুলোই যথেষ্ট নয়, আর একটি নতুন মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তাঁর এই প্রাজ্ঞ পরামর্শ অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা উচিত বলে আমরা মনে করি। সেই মন্ত্রণালয়ের নামকরণ হোক: বিকল্প পরিবহন মন্ত্রণালয়। তাতে থাকবে দুটি ডিভিশন: এক. পালকি পরিবহন বিভাগ, দুই. প্রাণী পরিবহন বিভাগ।
মালবাহী ও যাত্রীবাহী পরিবহনের ব্যাপারে সেই বিকল্প পরিবহন সম্পর্কে কিছু প্রস্তাব সবিনয়ে পেশ করতে চাই। নতুন যেকোনো প্রকল্পের কথা শুনলে আমাদের কর্তা ও কর্মকর্তাদের চোখ চক্ চক্ করে। খুশিতে কেউ নফল নামাজ পড়েন, কেউ যান অন্য প্রার্থনালয়ে। আশা করি আমার প্রস্তাব তাঁরা প্রত্যাখ্যান করবেন না।
আমাদের শৈশব-কৈশোরে যাতায়াতে ঘোড়ার গাড়ি ও নৌকাই ছিল প্রধান বাহন। পুরুষেরা ঘোড়ায়ও যাতায়াত করতেন। বালিরটেক বা মানিকগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়িতে আমি ষাটের দশকেও কখনো ঘোড়ার পিঠে গেছি। চালক চাবুক হাতে পিছে পিছে হাঁটত। ১০ কিলোমিটার যেতে ঘোড়ার ভাড়া দুই টাকা। এখন প্রজাতি হিসেবে ঘোড়াই বিলুপ্তপ্রায়।
খালেদা জিয়ার জোট সরকারের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে মাল পরিবহনের জন্য ভারত থেকে কিছু গাধা আমদানি করা হয়। তখন জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটের নেতাদের খুশি করতে আমি আমার কলামে প্রস্তাব করেছিলাম, পাকিস্তান থেকে অবিলম্বে খচ্চর আমদানি করা হোক। গাধা আমদানিতে সব বৈদেশিক মুদ্রা ভারতে চলে গেলে পাকিস্তান পাবে কি? এখন দেখছি খালেদা জিয়াদের সব ব্যাপারে বিরোধিতা করে ভুল করেছি। ওই সময় ভারত থেকে গাধা ও পাকিস্তান থেকে খচ্চর আনা হলে আজ ঈদের আগে ঘরফেরা মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। যেসব রাস্তায় কোনো গাড়ি চলাচল করতে পারে না, সেখানে এসব প্রাণীই হতো ভরসা। এখন গাধা ও খচ্চরের সঙ্গে আর একটি প্রাণী যোগ করতে চাই—উট। ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে উট আমদানি করলে তা হবে রাষ্ট্রধর্মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। উটে সওয়ার হয়ে বাড়ি গেলে মুসলমানদের সওয়াবও হবে। বিকল্প পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এই বিভাগটির নাম হবে ‘প্রাণী পরিবহন বিভাগ’। অসুবিধা শুধু এইটুকু যে নৌ ও সড়ক পরিবহনের মতো এই বিভাগে চাঁদাবাজির সুযোগ থাকবে কম।
ছোটবেলা আত্মীয়বাড়িতে আম্মার সঙ্গে যেতাম পালকিতে। গরিব পর্দানশিনেরা যেত ডুলিতে। পালকি ও ডুলি এখন উঠে গেছে। তবে তা পুনঃপ্রবর্তনের সময় এসেছে। তাতে গ্রামীণ দারিদ্র্যও দূর হবে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যারা ভ্যান-রিকশা কিনেছিল, রাস্তাঘাটের কারণে আজ তারা বেকার। ৬৯০ কোটি টাকার একটি অংশ দিয়ে ঈদের আগে পরীক্ষামূলক পালকি পরিবহন চালু করা যেতে পারে। একজন ডিজির অধীনে এই বিভাগের নাম হবে ‘পালকি পরিবহন মহাপরিদপ্তর’।
পালকি ও প্রাণী পরিবহন প্রবর্তনের পরও যদি যাতায়াত সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বলবেন, আপনারা অন্তত একটি ঈদে বাড়ি যাবেন না, দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। প্রতিমন্ত্রী বলবেন, বাপ-মায়ের সঙ্গে বহু ঈদ করেছেন, এখন শুধু তাঁদেরই টিকিট দেওয়া হবে, যাঁরা শ্বশুরবাড়ি যাবেন।
আমরা জনগণের রক্তে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি অল্প কিছু মানুষের স্বর্গসুখ নিশ্চিত করতে ও লুটপাটের জন্য। একটি সময় পর্যন্ত জনগণ প্রতারণা বরদাশত করে, তার পরে তাদের মধ্যে জাগে প্রতিশোধস্পৃহা। ওই পরিস্থিতি কারও জন্য সুখকর নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.