শিবের গীত-যোগ+অযোগ by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ-ব্যবস্থার বেহাল অবস্থার জন্য কাগজে-টিভিতে প্রতিদিন দাবি উঠছে, যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই। একই সঙ্গে যেসব গাড়িচালক রাস্তায় গরু-ছাগল এবং ভেড়া দেখে চিনতে পারেন, তাঁদের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য সুপারিশ করায় নৌপরিবহনমন্ত্রীর পদত্যাগেরও দাবি করছেন অনেকেই।


১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন মারা যান। ২২ আগস্ট নৌমন্ত্রী আমাদের জানালেন, যে বাসচালককে এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছে, তিনি দক্ষ। তাঁর দক্ষতার জন্যই সব বাসযাত্রী বেঁচে গেছেন। মন্ত্রী ভুল বলেননি। ঝুম বৃষ্টিতে সত্তর মাইল গতিতে বাঁক নিয়ে অত বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে একটা আস্ত বাস সামাল দেওয়াটা দক্ষতারই কাজ। এই দক্ষতার জন্য বাসচালককে কী পুরস্কার দেওয়া হয়, সেটি এখন দেখার বিষয়।
এ দুই মন্ত্রীর যাঁরা পদত্যাগ চাইছেন, আমি তাঁদের দলে নেই। তাঁদের যে কাজ করার কথা, তাঁরা তা-ই করেছেন। তাঁরা যদি ভুল কোনো কাজ করতেন অথবা তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হতেন; অথবা তাঁদের যা বলা উচিত নয় তা বলতেন, জনগণের সেন্টিমেন্টের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো সমালোচক ও মিডিয়াকে ধমক দিতেন; মুখে হাসি নিয়ে মিডিয়ার সামনে লম্বা লম্বা সাফাই-ফিরিস্তি দিতেন; নানা অজুহাতে আড়াই বছরের ব্যর্থতা ঢাকার প্রয়াস পেতেন, তাহলে তো প্রধানমন্ত্রীই তাঁদের পদত্যাগ করতে বলতেন। প্রধানমন্ত্রী যখন তা বলেননি, বুঝতে হবে হয় তাঁরা এসব করেননি অথবা করলেও সেসব পদত্যাগ করার মতো গুরুতর কিছু নয়। পত্রপত্রিকা যা-ই লিখুক, টক শোর আলোচকেরা টক-ঝাল যা-ই বলুন, আমিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মতো তাঁদের পদত্যাগ চাই না। তবে আমার কারণগুলো একটু ভিন্ন। সেগুলোই এখন পদত্যাগ দাবিকারীদের বিবেচনার জন্য পেশ করতে চাই।
যোগাযোগমন্ত্রী যখন তাঁর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন, তখন তিনি দেশব্যাপী সড়ক ও রেল যোগাযোগের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের শপথ নেন। এই আড়াই-পৌনে তিন বছর পর একটা হিসাব নিলে আমরা দেখব, মন্ত্রী তাঁর দায়িত্ব যথাযথই পালন করেছেন। আজ যে সমস্যাটা নিয়ে এত উদ্বেগ, যা ঈদে বাড়ি যাওয়ার আশায় উৎফুল্ল মানুষের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে, সেই সমস্যা—অর্থাৎ দেশব্যাপী রাস্তাঘাটের অবর্ণনীয় দুর্দশা—মন্ত্রীর কাজেরই অংশ। সমস্যাটা তাই তাঁর মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা নয়, এটি আছে অন্যত্র। সমস্যাটা ব্যাকরণের। ‘যোগাযোগ’-এর সন্ধি বিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় যোগ+অযোগ। যোগটা না-হয় আমরা বুঝলাম, কিন্তু অযোগ? অযোগ হচ্ছে যোগের অভাব, যোগহীনতা। আপনি ময়মনসিংহে যেতে চান? পরিবারের সঙ্গে, প্রিয় শহরের সঙ্গে যোগস্থাপন করতে চান? পারছেন না, কারণ, পানিভরা খানাখন্দে বাস আটকে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে, যেমন মন্ত্রী মহোদয়ের পাজেরো আটকে পড়ে ছিল রাস্তার গর্তে। এটি অযোগের উদাহরণ। এই অযোগ যোগাযোগমন্ত্রীর দুই কাজের একটি। এবং যোগ+অযোগের কোনটা কতখানি হবে, এটি যেহেতু তাঁর শপথবাক্যের কোথাও ছিল না। অযোগের পরিমাণ ৯০ শতাংশ হলেও তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না।
একইভাবে নৌমন্ত্রী যখন ছাগল-ভেড়া চিনতে পারার প্রশ্নটি তোলেন, সেটি নিয়েও আমাদের একটু দার্শনিকভাবে ভাবতে হবে। গরু-ছাগল চেনা অত সহজ নয় যতটা আপনারা ভাবেন। স্কুলের রচনা বইতে যে গরু সম্বন্ধে আমরা পড়েছি, সে এক গরু। কিন্তু গরু তো আরও আছে এবং মনুষ্য মধ্যেই সেগুলো বিদ্যমান। তা না হলে কেন আমরা বলতাম, ‘লোকটা আস্ত একটা গরু, অথবা ছাগল? আপনারা এমএ পাস হতে পারেন, কিন্তু আপনাদের চারদিকের সব গরু-ছাগল কি চিনতে পারেন? বুদ্ধিহীন, অহংসর্বস্ব, অগ্রপশ্চাৎ-বিবেচনাহীন গরুদের? দেশের উন্নতির সব ঘাস চিবিয়ে খেয়ে মোটাতাজা হওয়া ছাগলদের? তাহলে? সেই গরু-ছাগলদের যেসব গাড়িচালক এক দর্শনে চিনতে পারেন, তাঁরা তো আপনাদের থেকেও শিক্ষিত। সমস্যাটা তাহলে কোথায়, জনাব?
পাদটীকা: যোগাযোগমন্ত্রী ও নৌপরিবহনমন্ত্রী প্রায়ই এক সঙ্গে এখানে-সেখানে কেন যান, এ প্রশ্নের উত্তরে আমার মনে হলো, তাঁদের দুই মন্ত্রণালয় যেহেতু ভবিষ্যতে একটি মন্ত্রণালয় হয়ে যাবে, সে জন্য এখন থেকেই তাদের এই যুগ্ম চলাফেরা। আমাদের রাস্তাগুলো ইদানীং প্রতি বর্ষায় নদীর রূপ নেয়। তখন বাস-ট্রাক ইত্যাদিকে নৌকার মতো পানি—এবং পানির স্রোত—মোকাবিলা করে চলতে হয়। তখন যোগাযোগমন্ত্রীকে নৌমন্ত্রীর কাজ করতে হয়। আবার দেশের সবখানে ক্রমশ শুকিয়ে যাওয়া নদীগুলোর বুক দিয়ে শুকনো মৌসুমে ট্রাক-বাস চলাচল করে, তখন নৌমন্ত্রীকে যোগাযোগমন্ত্রীর কাজ করতে হয়। ভবিষ্যতে এই ডুপ্লিকেশন যখন পরিব্যাপ্ত হবে, তখন দুই মন্ত্রণালয়কে একত্র করলে সরকারের পয়সা যেমন বাঁচবে, তেমনি বাংলাদেশও বিশ্বের প্রথম ব্যাপকভিত্তিক উভচর যানের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
রাস্তায় নদীতে হারিয়ে যাওয়া এবং ক্রমাগত হারে অধিক সংখ্যায় হারিয়ে যেতে থাকা—হাজার লক্ষ মানুষের আত্মা তাতে কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.