থ্রি জি-মোবাইল প্রযুক্তির নবযাত্রা

মোবাইল ফোন তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপ্লব সংঘটিত করেছে। এক যুগ আগের বাংলাদেশে যা ছিল অসম্ভব কল্পনা_ আজকের বাংলাদেশে তা শুধু সম্ভব নয়, নৈমিত্তিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিটি সদস্যের হাতে হাতে মোবাইল ফোন থাকা এখন অনিবার্যতার পর্যায়ে চলেছে।


এমনকি রিকশাঅলা কিংবা দিনমজুরের হাতে মোবাইল ফোন দেখলেও কেউ বিস্মিত হন না। সরকারি উদ্যোগ ও সমর্থন সঙ্গে নিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এই বিপুল পরিবর্তনকে সম্ভব করে তুলেছে। মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশ আজ একটি অদৃশ্য সুতায় গ্রন্থিত। তথ্যবিনিময়, যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন আশা ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তারপরও এ কথা সত্য, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ পিছিয়ে। এর পেছনে যেমন আছে রক্ষণশীল মানসিকতা, তেমনি নতুন প্রযুক্তিকে আয়ত্ত করার ক্ষেত্রে স্লথগতি। ভারতে ইতিমধ্যে তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল প্রযুক্তি বেশ পরিচিত এবং জনপ্রিয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও এটি অপরিচিত। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী থ্রি-জি বা তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল প্রযুক্তি চালু করার ব্যাপারে জোর তাগিদ দিয়েছেন। কিছুটা দেরিতে হলেও এটি শুভ উদ্যোগ। শুধু সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান টেলিটক থ্রি-জি মোবাইল সেবা দেবে। পরে উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুযোগ দেওয়া হবে। আমরা মনে করি, থ্রি-জি প্রযুক্তির অনুমোদন ও অন্য প্রক্রিয়াগুলোর যথাবিহিত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হওয়া দরকার। এ প্রযুক্তি চালু হলে গ্রাহকরা মোবাইলেই টেলিভিশন দেখতে, ভিডিও কনফারেন্স করতে এবং জিপিএসের মাধ্যমে পথনির্দেশনা পাবেন। থ্রি জি সেবায় মোবাইলেই দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশে প্রচলিত মোবাইল প্রযুক্তি দ্বিতীয় প্রজন্মের। প্রযুক্তির ভাষায় এর নাম টু জি। টু জি মোবাইলেও ইন্টারনেট সেবা পাওয়া সম্ভব। মোবাইলে ইন্টারনেট সেবা আছে। কিন্তু টু-জি প্রযুক্তির বাস্তবতা মেনে নিয়েও ইন্টারনেটের গতি আদর্শ নয়। থ্রি জি প্রযুক্তি চালু করার প্রাক্কালে মোবাইল কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের সেবা দিতে যেন কার্পণ্য না করে, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা দরকার। দেখা গেছে, দ্বিতীয় প্রজন্মের মোবাইল প্রযুক্তির কিছু সুবিধা এখানে প্রচলিত হলেও বেশ কিছু সেবা থেকে বরাবরই গ্রাহকরা বঞ্চিত। উন্নত সেবা ব্যবস্থায় কেউ কাউকে ফোনে না পেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার ফোনে কলারের কথা বা তথ্য জানিয়ে আসা যায়। উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ফোন খুললে সহজেই সেই কথা শুনে নিতে পারেন। বিদেশে সাধারণ ল্যান্ডফোনেও এমন সার্ভিস আছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের মোবাইল ফোনে এ প্রযুক্তি সুলভ হলেও এ দেশে ফোন কোম্পানিগুলো এমন সেবা দেয় না। ভয়েস এসএমএস নামে একটি সার্ভিস থাকলেও এ জন্য গ্রাহককে আলাদা চার্জ দিতে হয়, সবচেয়ে বড় কথা_ এক কলেই তিনি ভয়েস এসএমএসের সুযোগ পান না। এমনকি গ্রাহকদের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় সেবা কল ব্লক, কার ট্রেকিং, এমএমএস সেবাগুলোও প্রত্যাশিত মাত্রায় সুলভ নয়। শুধু সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই যে নানা ক্ষেত্রে সেবাদানের ক্ষেত্রে কার্পণ্য করছে তা নয়, মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যবসা-বাণিজ্যভিত্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে গ্রাহকরাও পিছিয়ে আছেন। সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে যোগাযোগকে অনেক সুলভ ও গতিশীল করেছে মোবাইল প্রযুক্তি। কিন্তু মোবাইল প্রযুক্তি নিজেই যেসব ব্যবসায়িক উদ্যোগের দিগন্ত খুলে দিতে পারে সেগুলো এখানে তেমন দেখা যায় না। মোবাইলের মাধ্যমে ট্রেনের টিকিট কাটা এখানে সীমিত আকারে শুরু হয়েছে; কিন্তু এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শুধু ট্রেন কেন_ বাস, থিয়েটার, সিনেপ্লেক্সের টিকিট কাটার ব্যবস্থা চালু হতে পারে। থ্রি-জি প্রযুক্তি চালু হলে টিভি চ্যানেলগুলোর দর্শক বাড়বে। দ্রুতগতির ইন্টারনেট চালু হলে লোকে চলতি পথে মোবাইলেই পত্রিকা পড়াসহ ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ের কাজটি সেরে নেবেন। এ জন্য একদিকে যেমন মোবাইলভিত্তিক টিভি ও সংবাদসেবা বাড়াতে হবে, তেমনি মোবাইলে ইন্টারনেটকে হতে হবে দ্রুতগতিসম্পন্ন ও সুলভ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের সেবা সুলভ নয়। যোগাযোগের ক্ষেত্রে রূপান্তর আনতে হলে এবং নতুন প্রজন্মের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অর্থবহ করে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে কাজে লাগাতে হলে প্রযুক্তকে সুলভ, সহজ ও গতিশীল করতে হবে। প্রযুক্তির বিনোদনমূলক ব্যবহারের পাশাপাশি একে অর্থবহ অন্য কাজে লাগানোর জন্য মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে।
 

No comments

Powered by Blogger.