স্মরণ-বিপ্লবী রবি নিয়োগী by হাকিম বাবুল
বিপ্লব-সংগ্রামের সমার্থক রবি নিয়োগী। শত নির্যাতন, নিপীড়ন, কারাভোগ করেও মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি ছিলেন সর্বদা লড়াকু সৈনিক। অগি্নযুগের সিংহপুরুষ বিপ্লবী রবি নিয়োগী। তিনি ছিলেন আদর্শনিষ্ঠ, সৎ, নির্লোভ, নির্ভীক ও দেশপ্রেমিক। আজীবন তিনি নিষ্ঠ ছিলেন মানুষের কল্যাণ চিন্তায়।
বাংলা পঞ্জিকার বর্ষগণনা হিসাবমতে আজ তাঁর ১০১তম জন্মবার্ষিকী (১৬ বৈশাখ মোতাবেক ৩০ এপ্রিল)। শ্রদ্ধার সঙ্গে এই দিনে স্মরণ করছি বিপ্লবী রবি নিয়োগীকে। তিনি আমাদের মাঝে না থাকলেও বেঁচে আছেন তাঁর কর্ম ও আদর্শে। জমিদার পরিবারে জন্ম হলেও তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের কাতারে। তিনি বিপ্লববাদী ছিলেন। বিভিন্ন মেয়াদে ৩৪ বছর তিনি কারাভোগ করেছেন। প্রথম তিনি গুপ্ত সমিতি যুগান্তরে দীক্ষা নিয়ে বিপ্লবীবাদী ধারায় সক্রিয় হয়েছিলেন। পরে আরো কয়েক বিপ্লবীবাদীকে নিয়ে যুগান্তরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ব্রিটিশ-ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে উদ্যোগী হন। সেই ধারায় পাকিস্তানকালে এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। বিপ্লবী রবি নিয়োগী ১৯২৬ সালে শেরপুর জি কে পাইলট হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। এখানেই মাত্র ১৬ বছর বয়সে স্বাধীনতা আন্দোলনে দীক্ষা নিয়ে যোগ দেন 'যুগান্তার' গোষ্ঠীতে।
১৯৪৬ সালে তেভাগা আন্দোলনে শেরপুরের নালিতাবাড়ী অঞ্চলে নেতৃত্ব দেন বিপ্লবী রবি নিয়োগী। ১৯৪৮ সালে ঐতিহাসিক টঙ্ক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁর নেতৃত্বে শেরপুর, শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী, ফুলপুর, হালুয়াঘাট, কমলাকান্দা এবং সুসং অঞ্চলে টঙ্ক আন্দোলন ব্যাপকভাবে গড়ে উঠেছিল। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত মিথ্যা মামলায় ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দি জীবন কাটান। এ সময় তাঁর সহধর্মিণী জ্যোৎস্না নিয়োগীও ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলে কারারুদ্ধ ছিলেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় বিপ্লবী রবি নিয়োগী বন্দি ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সময় তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে কাজ করা ও নির্বাচনে ভূমিকা রাখায় তিন মাস আটক থাকেন। ১৯৫৫ সালে পুলিশ ধর্মঘটের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ১৯৫৫-৫৬ সাল পর্যন্ত জেলে কাটান। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসক আইয়ুব খানের নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাভোগ করেন তিনি। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বাধলে নিরাপত্তা আইনে কারারুদ্ধ হন। ১৯৬৯ সালে মুক্তি লাভ করার পর ১৯৭০ সালে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের আমলে তিনি ছয় মাস বন্দি থাকেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ডালু, শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী, হালুয়াঘাট, মহেন্দ্রগঞ্জ সীমান্তে বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধা মোটিভেশন ক্যাম্পে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা সবার প্রেরণার উৎস হয়েছিল। শেরপুর অঞ্চলের ত্যাগী নেতা রবি নিয়োগী স্বাধীন বাংলাদেশে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশদের জুড়ে দেওয়া ডাবল স্টারের কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতেও ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কারাভোগ করেন তিনি। সর্বশেষ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ১৯৮৮ সালে জনসভায় প্রচারাভিযান চালানোর সময়।
বিপ্লবী রবি নিয়োগী কলমসৈনিক হিসেবেও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিষ্ঠ ছিলেন। তিনি সাপ্তাহিক একতা ও দৈনিক সংবাদের শেরপুর জেলা বার্তা পরিবেশক হিসেবে আজীবন কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন শেরপুরে প্রগতিশীল সাংবাদিকদের একটি প্রতিষ্ঠান। বিপ্লবী রবি নিয়োগীর ২০০২ সালের ১০ মে সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনের সমাপ্তি ঘটলেও কোনো বিপ্লবীরই মৃত্যু হয় না। বিপ্লবী রবি নিযোগীরও মৃত্যু নেই।
হাকিম বাবুল
No comments