মত ও মন্তব্য-অভিবাদন : সেক্টর কমান্ডার কাজী নূরুজ্জামান by হারুন হাবীব
লে. কর্নেল (অব.) কাজী নূরুজ্জামান বীর উত্তম ৮৬ বছর বয়সে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। হাসপাতালে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। আর ঘরে ফেরা হলো না তাঁর। ২০১১ সালের ৬ মে মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখসমরের অন্যতম এই সেনাপতি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। তাঁকে সমাহিত করা হলো বনানীর সামরিক গোরস্তানে।
মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই দুজন সেক্টর কমান্ডার চলে গেলেন। কয়েক মাস আগে অকস্মাৎই বিদায় নিলেন লে. জেনারেল মীর শওকত আলী বীর উত্তম। কী সবল ও শক্তিশালী মানুষ! কিন্তু না_মৃত্যু তাঁকে কেড়ে নিল। এবার পরিণত বয়সেই চলে গেলেন কাজী নূরুজ্জামান।
জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের মূল অংশ ইতিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ চার জাতীয় নেতাকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করেছে ১৯৭৫ সালে, মুক্তিযুদ্ধের সাড়ে তিন বছরের মাথায়। অনেক আগেই চলে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী এবং উপ-অধিনায়ক জেনারেল রব। মুক্তিযুদ্ধের দুজন দুঃসাহসী এবং আত্মত্যাগী সেক্টর কমান্ডারকে জীবন দিতে হয়েছে রাজনীতিলোভী জেনারেলের বর্বরোচিত জিঘাংসায়। হত্যা করা হয়েছে ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার, যাঁর অধীনে আমি যুদ্ধ করেছি, সেই প্রবাদপ্রতিম সেনাপতি কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমকে বিচারের নামে প্রহসন করে। দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমকে হত্যা করা হয়েছে পঁচাত্তরে। নির্মমভাবে প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়েছে মেজর হায়দার বীর বিক্রমের। যে জিয়াউর রহমানের আমলে এত হত্যা সংঘটিত হয়েছে, তাঁকেও প্রাণ দিতে হয়েছে সেনা বিদ্রোহে। এ বিদ্রোহের একপর্যায়ে নিহত হয়েছেন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মঞ্জুর। বেশ আগেই পাকিস্তানের মাটিতে মৃত্যুবরণ করেছেন মেজর জলিল। বাংলাদেশের এই দুঃসহ রক্তাক্ত অধ্যায়ের শেষ হয়েছে জেনারেল এরশাদবিরোধী সফল গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে এসেছে।
কর্নেল নূরুজ্জামান পরিণত বয়সেই মৃত্যুবরণ করলেন। তবু এ মৃত্যু শোকের_এ মৃত্যুতে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কর্মকাণ্ডের আরেকজন বীর সেনাপতি বিদায় নিলেন। স্বভাবতই তাঁর মৃত্যুতে রাজনৈতিক, মুক্তিযোদ্ধা অঙ্গন এবং বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের আরো একজন অধিনায়ককে জাতি হারাল। এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের মাঠে কর্নেল নূরুজ্জামানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার ঘটেনি। আমার যুদ্ধক্ষেত্র ১১ নম্বর সেক্টরের সীমানা_ময়মনসিংহসহ সেদিনকার বৃহত্তর রংপুরের কিছু এলাকা। নূরুজ্জামান যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন রাজশাহী অঞ্চলে, ৭ নম্বর সেক্টরে। তাঁর নিজস্ব রাজনীতি-চিন্তা এবং সোচ্চার কণ্ঠস্বর ছিল অগতানুগতিক_যার খোঁজ জানতেন। সাহসী ও সোচ্চার এই মানুষটিকে প্রথম ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ ঘটে ১৯৯১ সালে। কয়েক বছর আগে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশে ফিরিয়ে এনে তার দলসহ তাকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এমন কি পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযম যখন জামায়াতে ইসলামীর আমির হিসেবে অধিষ্ঠিত হলো, তখন সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা ও সচেতন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। শুরু হলো যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের ঐতিহাসিক উদ্যোগ। এ পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন কর্নেল কাজী নূরুজ্জামানসহ বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁরই বাড়িতে বেশ কয়েকটি বৈঠকের পর গঠিত হলো 'ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'। ইতিহাসের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা এ সংগঠনটির প্রাথমিক নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন কাজী নূরুজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধপন্থী আরো অনেকের সঙ্গে আমি নিজেও জড়িয়ে পড়ি যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিতে জন্ম নেওয়া জাতীয় আন্দোলনে।
আমার মনে পড়ে, যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবির প্রাথমিক পর্যায়ের সে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন কর্নেল নূরুজ্জামান। আমাদের কোনো কোনো সেক্টর কমান্ডার যখন রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে থেকে সবকিছু ভুলে যাওয়ার ভান করছিলেন, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কাজী নূরুজ্জামান ছিলেন আপসহীন, সোচ্চার কণ্ঠস্বর। এ পর্যায়ে গঠিত গণ-আদালতের অন্যতম বিচারকের দায়িত্বও তিনি পালন করেন। ৭ মে জাতীয় এই বীরের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে রাখা হয়েছিল। সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে এই বীরের প্রতি। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সেক্টর কমান্ডারকে। এর পর ঢাকা সেনানিবাসের কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।
পারিবারিক সূত্র থেকে জানতে পেরেছি, কাজী নূরুজ্জামান ১৯২৫ সালের ২৪ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সালে কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালে তাঁকে নৌবাহিনী থেকে সেনাবাহিনীতে নিয়ে আসা হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তিনি মেজর হিসেবে পদোন্নতি পান। এর পর পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসর নেন। আজীবন বামপন্থী, প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নূরুজ্জামান। সম্পৃক্ত হন দেশের প্রগতিশীল লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে। তাঁর জীবনে নতুন মোড় আনে মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ কর্নেল সফিউল্লাহর ব্যাটালিয়নে যোগ দেন তিনি। এরপর সড়ক দুর্ঘটনায় মেজর নাজমুল নিহত হলে তাঁকে ৭ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব অর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা প্রতিটি আন্দোলনে বিশেষ অবদান রাখেন তিনি। আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের নতুন পর্যায় শুরু হয় 'সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম' গঠনের সূচনাকালে। ২০০৭ সালে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা তাঁদের রাজনৈতিক বিভেদ ও মতভেদ সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এক মঞ্চে আসেন। গঠিত হয় 'সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম'_যে সংগঠনের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নতুন জাতীয় আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এ আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে কর্নেল নূরুজ্জামানের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপ আমি জানি।
সাড়া জাগানো 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়' গ্রন্থের অন্যতম সম্পাদক ছিলেন কাজী নূরুজ্জামান। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে 'মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনীতি', 'বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি' এবং 'স্বদেশ চিন্তা' উল্লেখযোগ্য। আমার বদ্ধমূল ধারণা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য জাতি তাঁকে চিরদিন স্মরণ করবে। কাজী নূরুজ্জামান বামপন্থী রাজনীতির দৃঢ় সমর্থক ছিলেন_যে চিন্তার সঙ্গে আমার জানামতে, অনেকেই শক্ত দ্বিমত পোষণ করেছেন। কিন্তু তিনি ছিলেন আপাদমস্তক প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী মানুষ, যে মানুষ সারাটি জীবন আদর্শের পক্ষে লড়াই করে গেছেন। সে লড়াই কতটা সার্থক হয়েছে, কতটা হয়নি_তা বড় নয়। বড়, লড়াকু কাজী নূরুজ্জামান আত্মলালিত আদর্শের সঙ্গে, আপন নৈতিকতার সঙ্গে আপস করেননি কখনো। সীমাবদ্ধ মানবজীবনের এই বা কম কিসে যে_যা আমি সত্য বলে জানি_সেই আমার সত্য_সেই আমার প্রেম। কে কতটা ভাবল, কতটা গ্রহণ বা বর্জন করল, তার চেয়ে বড় আমি তা কতটা ধারণ করি। জাতির মুক্তিযুদ্ধে কাজী নূরুজ্জামান যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন, আমার বিশ্বাস, জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তা মনে রাখবে।
আমি তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করি।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
e-mail : hh1971@gmail.com
জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের মূল অংশ ইতিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ চার জাতীয় নেতাকে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করেছে ১৯৭৫ সালে, মুক্তিযুদ্ধের সাড়ে তিন বছরের মাথায়। অনেক আগেই চলে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী এবং উপ-অধিনায়ক জেনারেল রব। মুক্তিযুদ্ধের দুজন দুঃসাহসী এবং আত্মত্যাগী সেক্টর কমান্ডারকে জীবন দিতে হয়েছে রাজনীতিলোভী জেনারেলের বর্বরোচিত জিঘাংসায়। হত্যা করা হয়েছে ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার, যাঁর অধীনে আমি যুদ্ধ করেছি, সেই প্রবাদপ্রতিম সেনাপতি কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমকে বিচারের নামে প্রহসন করে। দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমকে হত্যা করা হয়েছে পঁচাত্তরে। নির্মমভাবে প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়েছে মেজর হায়দার বীর বিক্রমের। যে জিয়াউর রহমানের আমলে এত হত্যা সংঘটিত হয়েছে, তাঁকেও প্রাণ দিতে হয়েছে সেনা বিদ্রোহে। এ বিদ্রোহের একপর্যায়ে নিহত হয়েছেন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মঞ্জুর। বেশ আগেই পাকিস্তানের মাটিতে মৃত্যুবরণ করেছেন মেজর জলিল। বাংলাদেশের এই দুঃসহ রক্তাক্ত অধ্যায়ের শেষ হয়েছে জেনারেল এরশাদবিরোধী সফল গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে এসেছে।
কর্নেল নূরুজ্জামান পরিণত বয়সেই মৃত্যুবরণ করলেন। তবু এ মৃত্যু শোকের_এ মৃত্যুতে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কর্মকাণ্ডের আরেকজন বীর সেনাপতি বিদায় নিলেন। স্বভাবতই তাঁর মৃত্যুতে রাজনৈতিক, মুক্তিযোদ্ধা অঙ্গন এবং বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের আরো একজন অধিনায়ককে জাতি হারাল। এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের মাঠে কর্নেল নূরুজ্জামানের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার ঘটেনি। আমার যুদ্ধক্ষেত্র ১১ নম্বর সেক্টরের সীমানা_ময়মনসিংহসহ সেদিনকার বৃহত্তর রংপুরের কিছু এলাকা। নূরুজ্জামান যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন রাজশাহী অঞ্চলে, ৭ নম্বর সেক্টরে। তাঁর নিজস্ব রাজনীতি-চিন্তা এবং সোচ্চার কণ্ঠস্বর ছিল অগতানুগতিক_যার খোঁজ জানতেন। সাহসী ও সোচ্চার এই মানুষটিকে প্রথম ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ ঘটে ১৯৯১ সালে। কয়েক বছর আগে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশে ফিরিয়ে এনে তার দলসহ তাকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এমন কি পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযম যখন জামায়াতে ইসলামীর আমির হিসেবে অধিষ্ঠিত হলো, তখন সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা ও সচেতন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। শুরু হলো যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের ঐতিহাসিক উদ্যোগ। এ পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন কর্নেল কাজী নূরুজ্জামানসহ বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁরই বাড়িতে বেশ কয়েকটি বৈঠকের পর গঠিত হলো 'ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'। ইতিহাসের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা এ সংগঠনটির প্রাথমিক নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন কাজী নূরুজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধপন্থী আরো অনেকের সঙ্গে আমি নিজেও জড়িয়ে পড়ি যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিতে জন্ম নেওয়া জাতীয় আন্দোলনে।
আমার মনে পড়ে, যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবির প্রাথমিক পর্যায়ের সে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন কর্নেল নূরুজ্জামান। আমাদের কোনো কোনো সেক্টর কমান্ডার যখন রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে থেকে সবকিছু ভুলে যাওয়ার ভান করছিলেন, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কাজী নূরুজ্জামান ছিলেন আপসহীন, সোচ্চার কণ্ঠস্বর। এ পর্যায়ে গঠিত গণ-আদালতের অন্যতম বিচারকের দায়িত্বও তিনি পালন করেন। ৭ মে জাতীয় এই বীরের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে রাখা হয়েছিল। সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে এই বীরের প্রতি। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সেক্টর কমান্ডারকে। এর পর ঢাকা সেনানিবাসের কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।
পারিবারিক সূত্র থেকে জানতে পেরেছি, কাজী নূরুজ্জামান ১৯২৫ সালের ২৪ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সালে কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালে তাঁকে নৌবাহিনী থেকে সেনাবাহিনীতে নিয়ে আসা হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তিনি মেজর হিসেবে পদোন্নতি পান। এর পর পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসর নেন। আজীবন বামপন্থী, প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নূরুজ্জামান। সম্পৃক্ত হন দেশের প্রগতিশীল লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে। তাঁর জীবনে নতুন মোড় আনে মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ কর্নেল সফিউল্লাহর ব্যাটালিয়নে যোগ দেন তিনি। এরপর সড়ক দুর্ঘটনায় মেজর নাজমুল নিহত হলে তাঁকে ৭ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব অর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা প্রতিটি আন্দোলনে বিশেষ অবদান রাখেন তিনি। আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের নতুন পর্যায় শুরু হয় 'সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম' গঠনের সূচনাকালে। ২০০৭ সালে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা তাঁদের রাজনৈতিক বিভেদ ও মতভেদ সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এক মঞ্চে আসেন। গঠিত হয় 'সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম'_যে সংগঠনের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নতুন জাতীয় আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এ আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে কর্নেল নূরুজ্জামানের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপ আমি জানি।
সাড়া জাগানো 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়' গ্রন্থের অন্যতম সম্পাদক ছিলেন কাজী নূরুজ্জামান। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে 'মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনীতি', 'বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি' এবং 'স্বদেশ চিন্তা' উল্লেখযোগ্য। আমার বদ্ধমূল ধারণা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য জাতি তাঁকে চিরদিন স্মরণ করবে। কাজী নূরুজ্জামান বামপন্থী রাজনীতির দৃঢ় সমর্থক ছিলেন_যে চিন্তার সঙ্গে আমার জানামতে, অনেকেই শক্ত দ্বিমত পোষণ করেছেন। কিন্তু তিনি ছিলেন আপাদমস্তক প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী মানুষ, যে মানুষ সারাটি জীবন আদর্শের পক্ষে লড়াই করে গেছেন। সে লড়াই কতটা সার্থক হয়েছে, কতটা হয়নি_তা বড় নয়। বড়, লড়াকু কাজী নূরুজ্জামান আত্মলালিত আদর্শের সঙ্গে, আপন নৈতিকতার সঙ্গে আপস করেননি কখনো। সীমাবদ্ধ মানবজীবনের এই বা কম কিসে যে_যা আমি সত্য বলে জানি_সেই আমার সত্য_সেই আমার প্রেম। কে কতটা ভাবল, কতটা গ্রহণ বা বর্জন করল, তার চেয়ে বড় আমি তা কতটা ধারণ করি। জাতির মুক্তিযুদ্ধে কাজী নূরুজ্জামান যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন, আমার বিশ্বাস, জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তা মনে রাখবে।
আমি তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করি।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
e-mail : hh1971@gmail.com
No comments