বিচারকের ডায়েরি থেকে-কিশোর অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া যাবে? by মো. আকবর হোসেন মৃধা
কিশোর অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া যাবে কি না, এ নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকে মনে করেন, কিশোর অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করে আটকাদেশ দেওয়া যাবে; কোনো প্রকার শাস্তি দেওয়া যাবে না। কিশোর আইনের ১৯৭৪ অনুসারে, অপরাধের চার্জ গঠনের দিন ১৬ বছরের নিচে যেকোনো অপরাধীকে কিশোর অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হয় এবং ওই আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী তার বিচার প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিচার থেকে আলাদা করে সম্পন্ন করতে হবে।
শিশু আইনের ৫১(১) ধারার প্রথমে উল্লেখ করা আছে, কোনো শিশুকে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন বা কোনো প্রকার কারাদণ্ড দেওয়া যাবে না। তবে শর্ত থাকে, অপরাধের প্রকৃতি যদি খুব গুরুতর থাকে, কিশোর যদি জঘন্য বা মারাত্মক অপরাধ করে, শিশু আইনে প্রদত্ত অন্যান্য শাস্তি যদি আদালত পর্যাপ্ত মনে না করেন, তাহলে কিশোর অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দিতে পারেন। কারাদণ্ড বলতে যাবজ্জীবন ব্যতিরেকে অন্যান্য কারাদণ্ড বোঝানো হয়েছে। তবে কারাদণ্ডের পরিমাণ কত, তা শিশু আইনের কোথাও উল্লেখ করা নেই। তবে শিশু আইনের ৫১(১)-এর দ্বিতীয় শর্তে উল্লেখ করা আছে, আটকাদেশের (ডিটেনশন) মেয়াদ কোনোরকমেই যে অপরাধের জন্য কিশোর অপরাধীর বিচার সমাপ্ত হয়েছে, সে অপরাধের বর্ণিত শাস্তির অধিক হতে পারবে না। এ ব্যাপারে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট (হাইকোর্ট বিভাগ) মুন্না গং বনাম রাষ্ট্র মামলার নজির (যা ৭ বিএলসির পৃষ্ঠা নং ৪০৯) উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই নজিরে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ কিশোর অপরাধীর দণ্ডাদেশের ওপর আরোপিত যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ (দণ্ডবিধির ৩০২-এর ধারা মোতাবেক) সংশোধন করে ১৪ বছরের কারাদণ্ড আরোপ করেন। যদিও ৩০২ ধারায় যাবজ্জীবনের নিচে কোনো দণ্ডাদেশ প্রদানের বিধান নেই। ফাহিমা নাসরিন মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ উল্লেখ করেছেন, কোনো অবস্থাতেই কিশোর অপরাধীকে ১০ বছরের অধিক শাস্তি দেওয়া যাবে না (৬১ ডিএলআর পৃষ্ঠা নং ১৪১, প্যারা ২৯)। ৫১ ধারা অনুসারে আরোপিত আটকাদেশের মেয়াদের মধ্যে কোর্ট যদি কোনো কারণে মনে করেন, আদেশপ্রাপ্ত কিশোর অপরাধীকে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে রাখা যুক্তিযুক্ত, তবে এই মর্মে আদেশ প্রদান করতে পারেন এবং সে ক্ষেত্রেও কিশোর অপরাধীকে তার বয়স ১৮ বছর উত্তীর্ণের তারিখ থেকে মুক্তি দিতে হবে।
আমি বিগত ২৯/৭/০৯ খ্রি. তারিখে সীমা খাতুন (৭) ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় আসামি মিলনকে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ এবং কিশোর অপরাধী হানিফকে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিই। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হলো, নিহত সীমা ওই দিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে ছাগলের ঘাস কাটার জন্য একটি সারের পলিথিন ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। সীমার বাবা মামলার বাদী আনারুল ইসলাম দুপুরে খাওয়ার জন্য বাড়ি ফেরার পথে তাকে আসামি মিলনদের টিউবওয়েলের পাড়ে মিলন ও হানিফের সঙ্গে দেখতে পান। সন্ধ্যার দিকে সীমা বাড়ি না ফিরলে খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে তার উলঙ্গ রক্তাক্ত লাশ কালু উল্লার আখখেতে দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেন। পুলিশ বাদীর কথামতো আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে আসামিরা সাক্ষীদের সামনে সীমাকে ধর্ষণ এবং পরে ঘটনা যাতে জানাজানি না হয়, সে জন্য সীমাকে গলা টিপে হত্যা করার কথা স্বীকার করে। মৃতার যৌনাঙ্গ রক্তাক্ত ও কাটাছেঁড়া ছিল। আসামি মিলন ২৬/১/০৬ খ্রি. তারিখে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করে, তার মা আছে, বাপ নেই। কোনো দিন সে স্কুলে যায়নি। সে ছাগলের ঘাস কেটে বাড়ি আসার সময় সীমার সঙ্গে দেখা হয়। তখন হানিফও তার সঙ্গে ছিল। ঘটনাস্থলে যে সীমা মারা যায়, তা আসামিরা বুঝতে পারেনি। পরে আসামিরা বাড়ি চলে আসে। সে তার জবানবন্দিতে আরও বলে, সে ছোট মানুষ, খুব গরিব। লেখাপড়া জানে না, বুঝতে পারেনি। ‘ভুল হয়েছে স্যার, মাফ করে দেন স্যার।’ প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই আসামিকে এহেন অপরাধের জন্য মাফ করা যায় না এবং মাফ করার এখতিয়ার একজন বিচারকের নেই। তবে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে বোঝা যায়, আসামি খুব অনুতপ্ত। এ মামলায় অবশ্য কিশোর অপরাধী হানিফ কোনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়নি। চিকিৎসক তাঁর মতামতে উল্লেখ করেন, সীমা খাতুনকে উপর্যুপরি ধর্ষণের পর গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। মামলার আলামত ও অন্যান্য সাক্ষ্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, তারা সীমাকে হত্যার পর তাদের বাড়িতে ফিরে পরনের কাপড়চোপড় পানিতে ধুয়ে ঘরের চালের ওপর রেখে দেয়। আসামি মিলনের স্বীকারোক্তি মতে ওই আলামত তাদের বাড়ি থেকে জব্দ করা হয়। আমি আসামি মিলনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে কিশোর অপরাধী হানিফকে দোষী সাব্যস্ত করে ১৪ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করি। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ৯(৩) ধারার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন। আমিও উপরিউক্ত দুটি সিদ্ধান্ত ও শিশু আইনের ৫১ ও ৫২ ধারার আলোকে কিশোর অপরাধীকে ওই দণ্ডাদেশ প্রদান করি।
লেখক বিচারক (জেলা জজ), নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, সিরাজগঞ্জ
আমি বিগত ২৯/৭/০৯ খ্রি. তারিখে সীমা খাতুন (৭) ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় আসামি মিলনকে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ এবং কিশোর অপরাধী হানিফকে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিই। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হলো, নিহত সীমা ওই দিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে ছাগলের ঘাস কাটার জন্য একটি সারের পলিথিন ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। সীমার বাবা মামলার বাদী আনারুল ইসলাম দুপুরে খাওয়ার জন্য বাড়ি ফেরার পথে তাকে আসামি মিলনদের টিউবওয়েলের পাড়ে মিলন ও হানিফের সঙ্গে দেখতে পান। সন্ধ্যার দিকে সীমা বাড়ি না ফিরলে খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে তার উলঙ্গ রক্তাক্ত লাশ কালু উল্লার আখখেতে দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেন। পুলিশ বাদীর কথামতো আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে আসামিরা সাক্ষীদের সামনে সীমাকে ধর্ষণ এবং পরে ঘটনা যাতে জানাজানি না হয়, সে জন্য সীমাকে গলা টিপে হত্যা করার কথা স্বীকার করে। মৃতার যৌনাঙ্গ রক্তাক্ত ও কাটাছেঁড়া ছিল। আসামি মিলন ২৬/১/০৬ খ্রি. তারিখে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করে, তার মা আছে, বাপ নেই। কোনো দিন সে স্কুলে যায়নি। সে ছাগলের ঘাস কেটে বাড়ি আসার সময় সীমার সঙ্গে দেখা হয়। তখন হানিফও তার সঙ্গে ছিল। ঘটনাস্থলে যে সীমা মারা যায়, তা আসামিরা বুঝতে পারেনি। পরে আসামিরা বাড়ি চলে আসে। সে তার জবানবন্দিতে আরও বলে, সে ছোট মানুষ, খুব গরিব। লেখাপড়া জানে না, বুঝতে পারেনি। ‘ভুল হয়েছে স্যার, মাফ করে দেন স্যার।’ প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই আসামিকে এহেন অপরাধের জন্য মাফ করা যায় না এবং মাফ করার এখতিয়ার একজন বিচারকের নেই। তবে তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে বোঝা যায়, আসামি খুব অনুতপ্ত। এ মামলায় অবশ্য কিশোর অপরাধী হানিফ কোনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়নি। চিকিৎসক তাঁর মতামতে উল্লেখ করেন, সীমা খাতুনকে উপর্যুপরি ধর্ষণের পর গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। মামলার আলামত ও অন্যান্য সাক্ষ্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, তারা সীমাকে হত্যার পর তাদের বাড়িতে ফিরে পরনের কাপড়চোপড় পানিতে ধুয়ে ঘরের চালের ওপর রেখে দেয়। আসামি মিলনের স্বীকারোক্তি মতে ওই আলামত তাদের বাড়ি থেকে জব্দ করা হয়। আমি আসামি মিলনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে কিশোর অপরাধী হানিফকে দোষী সাব্যস্ত করে ১৪ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করি। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ৯(৩) ধারার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন। আমিও উপরিউক্ত দুটি সিদ্ধান্ত ও শিশু আইনের ৫১ ও ৫২ ধারার আলোকে কিশোর অপরাধীকে ওই দণ্ডাদেশ প্রদান করি।
লেখক বিচারক (জেলা জজ), নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, সিরাজগঞ্জ
No comments