জমির নামজারি-অহেতুক জটিলতা দূর করুন

বাংলাদেশের বিচারালয়ে চালিত মামলাগুলোর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই নাকি জমি সংক্রান্ত। গ্রামগঞ্জে কাজিয়া, ফ্যাসাদ ও খুনাখুনির প্রায় সবই হয় এই জমি সংক্রান্ত বিরোধের কারণে। জমির দলিল-দস্তাবেজ, পরচা, খতিয়ান নিয়ে যেভাবে সাধারণ মানুষকে হয়রানি পোহাতে হয়, তেমনটি আর কোনো বিষয় নিয়ে হয় না। এটা সারা বাংলাদেশের চিত্র।


শহরাঞ্চলের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখতে পাব আরো এক ডিগ্রি বাড়তি হয়রানির চিত্র। এই চিত্রের এক শহর থেকে আরেক শহরে পার্থক্য দেখা যায়। থানা-উপজেলা থেকে জেলা, এমনিভাবে রাজধানী শহরে এর মাত্রা বাড়তেই থাকে। দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদ পড়ে স্পষ্টতই মনে আসে, ঢাকার চিত্র ভয়াবহ। আমলাতান্ত্রিক জটিলতাই শুধু নয়, এখানে যে দুর্নীতিও মাথাসমান, তাও প্রমাণিত। এই চিত্র দেখেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থাটা কী। শুধু হয়রানিই নয়, সাধারণ মানুষের পকেট থেকে টাকা খসিয়ে নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। বিশেষ করে নামজারি করতে গিয়ে মানুষ সেখানে যে হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার হয়, তা বর্ণনা করার মতো নয়। এই দেশে, যেখানে প্রচলিত আমলাতান্ত্রিক জটিলতার শেষ নেই, সেখানে জটিলতা আরো বাড়ানোর মতো প্রচেষ্টা কোনোমতেই সংগত নয়। আইন অনুযায়ী, জমির নামজারি, জমা খারিজ এবং জমা একত্রীকরণের মতো কাজ করার জন্য তিনজন কর্মকর্তার টেবিলে যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার কথা। কিন্তু জটিলতা বৃদ্ধির প্রয়াস হিসেবে সেখানে ফাইল ছয়জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর টেবিল চালাচালি করা হচ্ছে। হাত ও টেবিল বাড়ানোর প্রয়োজন হচ্ছে আসলে বাড়তি আয়কে সিদ্ধ করার জন্যই।
ঢাকা শহর এবং এর আশপাশের জমির ব্যাপারে ক্রেতা-বিক্রেতাকে আইনানুগ কারণেই সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অফিসে যেতে হয়। তাঁদেরও দায়িত্ব সরকারি বিধান অনুযায়ী এসব ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। তাঁদের এই দায়িত্ব পালনে যদি অহেতুক দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্নীতির মতো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব করা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের যাওয়ার জায়গা থাকবে কোথায়!
জমির নামজারি করতে হলে মাঠ পর্যায়ের কর্মী, বিশেষ করে তহসিলদারদের মতামতকে অধিকতর গুরুত্ববহ মনে করা উচিত। তাঁরা মাঠ পর্যায়ে থাকায় কানুনগো থেকে শুরু করে এসি (ল্যান্ড) পর্যন্ত সবাইকেই মূলত তাঁদের ওপরই নির্ভর করতে হয়। কিন্তু সেখানে মধ্যস্বত্বভোগীদের মতোই আরো কিছু কর্মকর্তাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। জমির নামজারি ইত্যাদি ক্ষেত্রে এসব মধ্যস্বত্বভোগীর মতো মধ্যস্থলে অবস্থানকারী আরো কিছু কর্মকর্তাকে অন্তর্ভুক্ত করায় সময় এবং জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কাজটি হয়তো দুই দিনেই শেষ হয়ে যেত, সেখানে সময় বেড়ে যাচ্ছে হাতের সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ার কারণে।
ভূমি প্রশাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু দিক আছে, যেগুলোর পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। নীতিমালা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয় থাকার পরও ভূমি সংস্কার বোর্ডও সেখানে হস্তক্ষেপ করে বলে জানা যায়। এখানে যার যেটা কাজ নয়, সেও সেই কাজ করার জন্য আগ্রহী হয়ে থাকে। আসলে নামজারি করার মতো কিছু কাজ আছে, যেগুলোর প্রতি তাদের আকর্ষণ থাকে বেশি। আর এই অতি আকর্ষণের কারণে সাধারণ মানুষ হয়রানির মধ্যে পড়ে বেশি। অপ্রয়োজনীয় এবং অদক্ষ হাতে চালাচালির কারণে অহেতুক হয়রানি বৃদ্ধি পাচ্ছে- এটা দেখার পরও পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনার কাজটি হচ্ছে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রযুক্তিনির্ভর সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের হয়রানি বন্ধ করা যেতে পারে। আর দুর্নীতি কমিয়ে আনাটাও অপরিহার্য।

No comments

Powered by Blogger.