শ্রদ্ধাঞ্জলি-আলোকিত এক মানুষ by রণজিৎ কুমার চক্রবর্তী
তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ৮০১ নম্বর কেবিনে। সঙ্গে ছিলেন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আরাস্তু খান। আমাদের সঙ্গে তাঁর যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ছেলেও ছিলেন। কাছে গিয়ে নাম বলতে এক লহমায় চিনে ফেললেন দুজনকেই। চোখ মেলে স্পষ্ট, ঋজু উচ্চারণে ছেলেকে বললেন, তাঁরা আমার সহকর্মী।
খুব সামান্য দু-একটি কথা বলে ভারাক্রান্ত আমরা সেদিন ফিরে এসেছিলাম। প্রার্থনা করেছিলাম, তিনি আবার সুস্থ হয়ে উঠুন। কিন্তু না। তিনি চলে গেলেন লোকান্তরে ১০ আগস্ট ২০১১। সেদিন আকাশজুড়ে ছিল শ্রাবণ মেঘের ঘনঘটা। বৃষ্টি হয়েছিল অঝোরে।
বলছিলাম সদ্য প্রয়াত গোলাম কিবরিয়ার কথা। তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকে। তখন তিনি বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক। এর আগে অর্থসচিবের পদও অলংকৃত করেছেন। মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। কিন্তু আমার কাছে ব্যক্তি গোলাম কিবরিয়াকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তাঁর কাছে সবারই ছিল অবাধ যাতায়াত। কর্মব্যস্ততাকে আড়াল করে কথা বলতেন। যতবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁকে কখনো বিমর্ষ কিংবা বিচলিত দেখিনি। স্থিতধী, সদাপ্রসন্ন তিনি। প্রজ্ঞার সঙ্গে বিনয়ের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। একান্ত আলাপচারিতায় তাঁর তুলনা মেলা ভার।
আমার মনে আছে, একবার তাঁকে তাঁরই অধস্তন একটি অফিসে অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে যাওয়ার প্রাক্কালে কয়েকজন কর্মকর্তার বিদায় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেদিন তিনি তাঁদের উদ্দেশে যা বলেছিলেন তা আজও আমার স্মৃতিতে অমলিন। অবসর-পরবর্তী জীবন যে আমাদের সমগ্র জীবনেরই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, তা তিনি চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। বলেছিলেন অবসর জীবনে নিজেকে পুনরাবিষ্কারের কথা, ভেতরের প্রচ্ছন্ন ক্ষমতাকে জাগিয়ে তোলার কথা।
গোলাম কিবরিয়া কখনোই উচ্চকিত স্বভাবের ছিলেন না। নীরবচারিতাই ছিল তাঁর চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য। তাই অবসরে চলে যাওয়ার পর তিনি অনেকটা নিভৃত জীবনযাপনের পথই বেছে নিয়েছিলেন। কারও কাছে তাঁর কোনো প্রত্যাশা ছিল না, ছিল না কোনো অভিমান কিংবা অনুযোগ। তাঁর পাঠরুচির বৈচিত্র্য ছিল লক্ষ করার মতো। সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি—এসব বিষয়ে আগ্রহ ও অধ্যয়ন তাঁর অবকাশকে ভরিয়ে তুলত। তাঁর বাসায় যখন গিয়েছি, তিনি তাঁর অনেক পুরোনো ছোট ছোট নোট বই আমাকে দেখিয়েছেন, যেখানে খুব সংক্ষেপে তিনি রেডিওতে বিবিসি আয়োজিত যেসব কথিকা শুনতেন তা সংক্ষেপে লিখে রাখতেন। এ রকম প্রায় ৫০টি ছোট ছোট নোট বই আমি দেখেছি।
গোলাম কিবরিয়ার চরিত্রের যে দিকটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করত, তা হলো নিজের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে আড়াল করে রাখার রুচি। জ্ঞান, অর্থ আর প্রতিপত্তি মানুষকে যেখানে অহংবোধে আচ্ছন্ন করে ফেলে, সেখানে গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম। যাঁরা তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন তাঁরা জানেন, কীভাবে তিনি তাঁর অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করতেন। বিশেষত, যারা তরুণ প্রজন্মের। তাদের ভাবনার জট খুলে দিতেন। কাউকে দীক্ষিত করতে চাইতেন না, তবে আলো ছড়াতেন। প্রশ্ন করলে জবাব দিতেন এবং তার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কোনো বই বা লেখার সূত্র উল্লেখ করতেন, যাতে জিজ্ঞাসু মন আরও তৃপ্ত হয়। তা করতেন অন্যের অনুসন্ধিৎসাকে উদ্রিক্ত করার প্রবল বাসনা থেকেই।
দেশ-বিদেশে অনেক প্রাজ্ঞজনের মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু গোলাম কিবরিয়া ছিলেন যেন একেবারেই আলাদা, ভিন্ন এক কোটিতে। তিনি একাধারে যেমন ছিলেন উঁচুস্তরের ইনটেলেকচুয়াল, তেমনি পুরোদস্তুর একজন প্রশাসকও বটে। এ দুইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর পেশাদারি। পাবলিক ফিন্যান্সের খোঁজখাঁজ ছিল তাঁর নখদর্পণে।
আমার অনুমান, গোলাম কিবরিয়া বিশ্ববীক্ষাটি গড়ে উঠেছিল তাঁর ছাত্রজীবনে বহমান প্রগতিবাদী চিন্তাধারা থেকে। সেই বিশ্ববীক্ষার আলোকেই তিনি ব্যাখ্যা করতেন জীবন ও জগৎকে। যদিও প্রকাশ্যে তিনি এ সম্পর্কে কিছু বলেননি। আপাদমস্তক কুসংস্কারহীন ও সেক্যুলার মানুষ ছিলেন তিনি। আবার যথার্থ ধার্মিকও ছিলেন।
অনুজ সহকর্মী আরাস্তু খান আমাকে একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন। ঘটনাটি এ রকম, নব্বইয়ের দশকে অর্থ বিভাগে চলমান একটি সংস্কার প্রকল্পের ইনডিপেনডেন্ট রিভিউ মিশনে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ আমন্ত্রণবার্তাটি নিয়ে গিয়েছিলেন ওই প্রকল্পের তৎকালীন পরামর্শক জাকির আহমেদ খান (যিনি পরে অর্থসচিব হয়েছিলেন) এবং অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক আরাস্তু খান। এই আমন্ত্রণের সঙ্গে প্রস্তাব ছিল ১০ দিনের মিশনে তিনি দৈনিক ৪০০ পাউন্ড স্টার্লিং হারে পারিশ্রমিক পাবেন। তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও সম্মানী গ্রহণ করেননি। যুক্তি ছিল, অডিটর জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণের পর তিনি এ অর্থ গ্রহণ করতে পারবেন না। দ্বিতীয় যে ঘটনাটি বলব, তা আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে উড়িরচরে প্রলয়ংকরী এক ঘূর্ণিঝড় হয়ে যায়। সম্ভবত এর দুই দিন পর তাঁর বেইজিং যাওয়ার কথা এক গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি পরদিন অফিসে এসে বেইজিংয়ে টেলেক্স পাঠালেন দেশের এ অবস্থায় সম্মেলনে যোগদানে অপারগতার কথা জানিয়ে।
১০ আগস্ট বাঁধ না মানা চোখের জলে তাঁকে চিরবিদায় জানিয়েছি। রবীন্দ্রপ্রজ্ঞাস্নাত ছিলেন তিনি। তাই মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে কবিগুরুর উচ্চারিত শেষ একটি পঙিক্তকে আশ্রয় করেই তাঁর জন্য প্রার্থনা জানাই, ‘তোমার হাতে যেন সে পায় শান্তির অক্ষয় অধিকার।’
রণজিৎ কুমার চক্রবর্তী
বলছিলাম সদ্য প্রয়াত গোলাম কিবরিয়ার কথা। তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকে। তখন তিনি বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক। এর আগে অর্থসচিবের পদও অলংকৃত করেছেন। মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। কিন্তু আমার কাছে ব্যক্তি গোলাম কিবরিয়াকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তাঁর কাছে সবারই ছিল অবাধ যাতায়াত। কর্মব্যস্ততাকে আড়াল করে কথা বলতেন। যতবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁকে কখনো বিমর্ষ কিংবা বিচলিত দেখিনি। স্থিতধী, সদাপ্রসন্ন তিনি। প্রজ্ঞার সঙ্গে বিনয়ের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। একান্ত আলাপচারিতায় তাঁর তুলনা মেলা ভার।
আমার মনে আছে, একবার তাঁকে তাঁরই অধস্তন একটি অফিসে অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে যাওয়ার প্রাক্কালে কয়েকজন কর্মকর্তার বিদায় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেদিন তিনি তাঁদের উদ্দেশে যা বলেছিলেন তা আজও আমার স্মৃতিতে অমলিন। অবসর-পরবর্তী জীবন যে আমাদের সমগ্র জীবনেরই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, তা তিনি চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। বলেছিলেন অবসর জীবনে নিজেকে পুনরাবিষ্কারের কথা, ভেতরের প্রচ্ছন্ন ক্ষমতাকে জাগিয়ে তোলার কথা।
গোলাম কিবরিয়া কখনোই উচ্চকিত স্বভাবের ছিলেন না। নীরবচারিতাই ছিল তাঁর চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য। তাই অবসরে চলে যাওয়ার পর তিনি অনেকটা নিভৃত জীবনযাপনের পথই বেছে নিয়েছিলেন। কারও কাছে তাঁর কোনো প্রত্যাশা ছিল না, ছিল না কোনো অভিমান কিংবা অনুযোগ। তাঁর পাঠরুচির বৈচিত্র্য ছিল লক্ষ করার মতো। সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি—এসব বিষয়ে আগ্রহ ও অধ্যয়ন তাঁর অবকাশকে ভরিয়ে তুলত। তাঁর বাসায় যখন গিয়েছি, তিনি তাঁর অনেক পুরোনো ছোট ছোট নোট বই আমাকে দেখিয়েছেন, যেখানে খুব সংক্ষেপে তিনি রেডিওতে বিবিসি আয়োজিত যেসব কথিকা শুনতেন তা সংক্ষেপে লিখে রাখতেন। এ রকম প্রায় ৫০টি ছোট ছোট নোট বই আমি দেখেছি।
গোলাম কিবরিয়ার চরিত্রের যে দিকটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করত, তা হলো নিজের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে আড়াল করে রাখার রুচি। জ্ঞান, অর্থ আর প্রতিপত্তি মানুষকে যেখানে অহংবোধে আচ্ছন্ন করে ফেলে, সেখানে গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম। যাঁরা তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন তাঁরা জানেন, কীভাবে তিনি তাঁর অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করতেন। বিশেষত, যারা তরুণ প্রজন্মের। তাদের ভাবনার জট খুলে দিতেন। কাউকে দীক্ষিত করতে চাইতেন না, তবে আলো ছড়াতেন। প্রশ্ন করলে জবাব দিতেন এবং তার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কোনো বই বা লেখার সূত্র উল্লেখ করতেন, যাতে জিজ্ঞাসু মন আরও তৃপ্ত হয়। তা করতেন অন্যের অনুসন্ধিৎসাকে উদ্রিক্ত করার প্রবল বাসনা থেকেই।
দেশ-বিদেশে অনেক প্রাজ্ঞজনের মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু গোলাম কিবরিয়া ছিলেন যেন একেবারেই আলাদা, ভিন্ন এক কোটিতে। তিনি একাধারে যেমন ছিলেন উঁচুস্তরের ইনটেলেকচুয়াল, তেমনি পুরোদস্তুর একজন প্রশাসকও বটে। এ দুইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর পেশাদারি। পাবলিক ফিন্যান্সের খোঁজখাঁজ ছিল তাঁর নখদর্পণে।
আমার অনুমান, গোলাম কিবরিয়া বিশ্ববীক্ষাটি গড়ে উঠেছিল তাঁর ছাত্রজীবনে বহমান প্রগতিবাদী চিন্তাধারা থেকে। সেই বিশ্ববীক্ষার আলোকেই তিনি ব্যাখ্যা করতেন জীবন ও জগৎকে। যদিও প্রকাশ্যে তিনি এ সম্পর্কে কিছু বলেননি। আপাদমস্তক কুসংস্কারহীন ও সেক্যুলার মানুষ ছিলেন তিনি। আবার যথার্থ ধার্মিকও ছিলেন।
অনুজ সহকর্মী আরাস্তু খান আমাকে একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন। ঘটনাটি এ রকম, নব্বইয়ের দশকে অর্থ বিভাগে চলমান একটি সংস্কার প্রকল্পের ইনডিপেনডেন্ট রিভিউ মিশনে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ আমন্ত্রণবার্তাটি নিয়ে গিয়েছিলেন ওই প্রকল্পের তৎকালীন পরামর্শক জাকির আহমেদ খান (যিনি পরে অর্থসচিব হয়েছিলেন) এবং অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক আরাস্তু খান। এই আমন্ত্রণের সঙ্গে প্রস্তাব ছিল ১০ দিনের মিশনে তিনি দৈনিক ৪০০ পাউন্ড স্টার্লিং হারে পারিশ্রমিক পাবেন। তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও সম্মানী গ্রহণ করেননি। যুক্তি ছিল, অডিটর জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণের পর তিনি এ অর্থ গ্রহণ করতে পারবেন না। দ্বিতীয় যে ঘটনাটি বলব, তা আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে উড়িরচরে প্রলয়ংকরী এক ঘূর্ণিঝড় হয়ে যায়। সম্ভবত এর দুই দিন পর তাঁর বেইজিং যাওয়ার কথা এক গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি পরদিন অফিসে এসে বেইজিংয়ে টেলেক্স পাঠালেন দেশের এ অবস্থায় সম্মেলনে যোগদানে অপারগতার কথা জানিয়ে।
১০ আগস্ট বাঁধ না মানা চোখের জলে তাঁকে চিরবিদায় জানিয়েছি। রবীন্দ্রপ্রজ্ঞাস্নাত ছিলেন তিনি। তাই মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে কবিগুরুর উচ্চারিত শেষ একটি পঙিক্তকে আশ্রয় করেই তাঁর জন্য প্রার্থনা জানাই, ‘তোমার হাতে যেন সে পায় শান্তির অক্ষয় অধিকার।’
রণজিৎ কুমার চক্রবর্তী
No comments