মনীষা-জগদীশচন্দ্র by দ্বিজেন শর্মা
ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব বেতার দিবস (১৩ ফেব্রুয়ারি) ঢাকায় পালিত হলো বেতারযন্ত্রের অন্যতম উদ্ভাবক আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসুকে স্মরণ করে। তিনজন আলোচকের মধ্যে দুজন পদার্থবিদ, একজন উদ্ভিদবিদ্যার মানুষ। অভ্রান্ত অনুপাত। জগদীশচন্দ্র মূলত পদার্থবিদ, তাঁর উদ্ভিদচর্চাও পদার্থবিদ্যা প্রভাবিত। শেষোক্ত বিষয়ের বক্তা আমি।
কাজটা আমার জন্য সহজ ছিল না। জীববিদ্যা জন্মলগ্ন থেকেই বর্ণনামূলক এবং আমি সেই জীববিদ্যা পড়েছি ও পড়িয়েছি। জীববিদেরা বরাবরই ভৌতবিজ্ঞানবিমুখ, যে জন্য জীববিদ্যার অধিকাংশ যুগান্তকারী আবিষ্কার সম্পন্ন করেছেন পদার্থবিদ ও রসায়নবিদেরা। ১৯৫৩ সালে ডিএনএর অণুকাঠামো আবিষ্কারকের দলেও কোনো জীববিদ ছিলেন না। বিজ্ঞানের ইতিহাসে জগদীশচন্দ্রের স্থানটি এ জন্যই ব্যতিক্রমী। তিনি জীববিদ্যায় পদার্থবিদ্যার অনুপ্রবেশ ঘটান এবং ভারতে, হয়তো বা বিশ্বেও প্রথম জীবপদার্থবিদ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
উদ্ভিদে প্রাণের অস্তিত্বের কথা জানতেন বৈদিক পণ্ডিতেরা এবং অ্যারিস্টটলসহ পশ্চিমের চিন্তকেরাও। জগদীশচন্দ্র আবিষ্কার করেছিলেন উদ্ভিদপ্রাণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ—বাহ্য উত্তেজকের আঘাতে উদ্ভিদের সাড়া দেওয়ার সামর্থ্য ও ধরনগুলো। দেশীয় কারিগরদের দিয়ে তৈরি তাঁর যন্ত্রগুলো ছিল নিখুঁত এবং উদ্ভিদের আত্যন্তিক সূক্ষ্ম কম্পন পরিমাপে সমর্থ। তিনি এসব যন্ত্রের সাহায্যে উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যকার তথাকথিত মৌলিক পার্থক্যের ধারণাগুলো বাতিল করেন এবং জড়েরও যে জীবের অনুরূপ সাড়া দেওয়ার সামর্থ্য আছে, তা পরীক্ষা করে দেখান। শেষোক্ত বিষয়টি ছিল অবিশ্বাস্য, তাই বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন বলেছিলেন—এটা বিজ্ঞান নয়, ভারতীয় দর্শন। জগদীশচন্দ্রের ধারণা সত্যায়নের জন্য ভাইরাস আবিষ্কার (১৮৯২, ১৯৩৫) পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। তিনি উদ্ভিদের তরল সংবহন, আলোকসংশ্লেষ, স্পন্ধ ও বৃদ্ধি, উত্তেজনার বেগ ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা ও নানা তত্ত্ব উপস্থাপন করেন, যেগুলোর অধিকাংশই পরবর্তীকালে বাতিল হয়ে যায়। এতে তাঁর গবেষণার কোনো মূল্যহানি ঘটেনি, কেননা এটাই বিজ্ঞানের নিয়ম। পরিত্যাগ ও পরিমার্জনা ছাড়া বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটে না। এ থেকে কারও রেহাই নেই, নিউটন, ডারউইনেরও না।
আমি কলকাতার সিটি কলেজে জীববিদ্যার স্নাতক কোর্স পড়েছি। একদিন ক্লাস চলছে, হঠাৎ বেজে উঠল ছুটির ঘণ্টা। জানা গেল, জগদীশচন্দ্রের সহধর্মিণী লেডি অবলা বসু প্রয়াত হয়েছেন। কাছেই ছিল বসু বিজ্ঞান মন্দির। বাড়ি ফেরার পথে ওই ভবনের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। আজও চোখে ভাসে কাঠের বিশাল বন্ধ দরজা, উঠানের কোণে বনচাড়াল গাছের ঝোপ, যার স্পন্দমান পাতার রহস্যে জগদীশচন্দ্র আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আমার একাধিক শিক্ষক প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর ছাত্র ছিলেন। তিনি পদার্থবিদ্যা ছাড়া সম্ভবত উদ্ভিদবিদ্যাও পড়াতেন। তাঁদের কাছে শুনেছি, ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁর গবেষণাকর্মে নানা বিঘ্ন সৃষ্টি করত এবং কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষ তাঁকে বিভিন্ন কলেজে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা নিতে পাঠাতেন। এই আত্মভোলা মানুষটি পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে নিজেই নাকি সেসব প্রশ্নের উত্তর বলতে থাকতেন।
বিদেশ ভ্রমণকালে ইংল্যান্ডের এক বিশ্ববিদ্যালয় জগদীশচন্দ্রকে অধ্যাপনায় আমন্ত্রণ জানালে তিনি দারুণ দোটানায় পড়েন। ভারতে গবেষণার বহুবিধ অসুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে তা ছিল এক অভাবনীয় সম্মান ও সুযোগ। অগত্যা পরামর্শ চেয়ে রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন, ‘আমি কী করিব কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। আমার সমস্ত Inspiration-এর মূলে আমার স্বদেশীয় লোকের স্নেহ। সেই স্নেহবন্ধন ছিন্ন হইলে আমার আর কী রহিল?...আমাদের হূদয়ের মূল ভারতবর্ষে, যদি সেখানে থাকিয়া কিছু করিতে পারি, তাহা হইলেই জীবন ধন্য হইবে। দেশে ফিরিয়া আসিলে যেসব বাধা পড়িবে তাহা বুঝিতে পারিতেছি না। যদি আমার অভীষ্ট অপূর্ণ থাকিয়া যায়, তাহাও সহ্য করিব।’ বলা বাহুল্য স্বদেশেরই জয় হয়েছিল, তিনি ফিরে এসেছিলেন ভারতে আপন কর্মক্ষেত্রে।
আমাদের বিদ্বৎসমাজ জগদীশচন্দ্রকে ভুলতে বসেছে। অতীতে পাঠ্যবইয়ে তাঁর জীবনী থাকত, এখন নেই। তাঁর লেখা অব্যক্ত বইটি স্কুল-কলেজ পর্যায়ে অতিরিক্ত পাঠ্য হিসেবে পড়ানোর কথা আমরা কোনো দিন ভাবিনি। তাঁর গবেষণাগুলো গুরুত্বসহ পড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে অনেক কাল আগে। আমাদের দেশে উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যা আলাদাভাবে পড়ানো হয়, যদিও জগদীশচন্দ্রই এই দুটি জীবকুলকে একটি একক হিসেবে দেখার ভিত তৈরি করেছিলেন এবং বিদেশে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে লাইফ সায়েন্স বা প্রাণবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বহুকাল আগে। নটর ডেম কলেজের লাইব্রেরিতে এমন বই ছিল অনেক, বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী গেলর্ড সিম্পসনের বইও। ভেবেছি দেশ স্বাধীন হলে আমরা এসব বই অনুবাদ করে পড়াব, আমাদের দেশীয় উপাদানের ভিত্তিতে বাংলায় এমন পাঠ্যবই লিখব। কিন্তু কিছুই হলো না।
যা- হোক, বলতে দ্বিধা নেই, সাধারণ মানুষ কিন্তু জগদীশচন্দ্রকে ভোলেননি। তাঁরা জানেন জগদীশচন্দ্রই উদ্ভিদে প্রাণ আবিষ্কার করেছিলেন, যা পশ্চিমের বিজ্ঞানীরা পারেননি। তাঁরাই বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে তাঁর পৈতৃক ভিটেমাটি আগলে রেখেছেন, তাঁর স্মরণিক একটি জাদুঘরও প্রতিষ্ঠা করেছেন।
দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গী।
উদ্ভিদে প্রাণের অস্তিত্বের কথা জানতেন বৈদিক পণ্ডিতেরা এবং অ্যারিস্টটলসহ পশ্চিমের চিন্তকেরাও। জগদীশচন্দ্র আবিষ্কার করেছিলেন উদ্ভিদপ্রাণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ—বাহ্য উত্তেজকের আঘাতে উদ্ভিদের সাড়া দেওয়ার সামর্থ্য ও ধরনগুলো। দেশীয় কারিগরদের দিয়ে তৈরি তাঁর যন্ত্রগুলো ছিল নিখুঁত এবং উদ্ভিদের আত্যন্তিক সূক্ষ্ম কম্পন পরিমাপে সমর্থ। তিনি এসব যন্ত্রের সাহায্যে উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যকার তথাকথিত মৌলিক পার্থক্যের ধারণাগুলো বাতিল করেন এবং জড়েরও যে জীবের অনুরূপ সাড়া দেওয়ার সামর্থ্য আছে, তা পরীক্ষা করে দেখান। শেষোক্ত বিষয়টি ছিল অবিশ্বাস্য, তাই বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন বলেছিলেন—এটা বিজ্ঞান নয়, ভারতীয় দর্শন। জগদীশচন্দ্রের ধারণা সত্যায়নের জন্য ভাইরাস আবিষ্কার (১৮৯২, ১৯৩৫) পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। তিনি উদ্ভিদের তরল সংবহন, আলোকসংশ্লেষ, স্পন্ধ ও বৃদ্ধি, উত্তেজনার বেগ ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা ও নানা তত্ত্ব উপস্থাপন করেন, যেগুলোর অধিকাংশই পরবর্তীকালে বাতিল হয়ে যায়। এতে তাঁর গবেষণার কোনো মূল্যহানি ঘটেনি, কেননা এটাই বিজ্ঞানের নিয়ম। পরিত্যাগ ও পরিমার্জনা ছাড়া বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটে না। এ থেকে কারও রেহাই নেই, নিউটন, ডারউইনেরও না।
আমি কলকাতার সিটি কলেজে জীববিদ্যার স্নাতক কোর্স পড়েছি। একদিন ক্লাস চলছে, হঠাৎ বেজে উঠল ছুটির ঘণ্টা। জানা গেল, জগদীশচন্দ্রের সহধর্মিণী লেডি অবলা বসু প্রয়াত হয়েছেন। কাছেই ছিল বসু বিজ্ঞান মন্দির। বাড়ি ফেরার পথে ওই ভবনের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। আজও চোখে ভাসে কাঠের বিশাল বন্ধ দরজা, উঠানের কোণে বনচাড়াল গাছের ঝোপ, যার স্পন্দমান পাতার রহস্যে জগদীশচন্দ্র আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আমার একাধিক শিক্ষক প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর ছাত্র ছিলেন। তিনি পদার্থবিদ্যা ছাড়া সম্ভবত উদ্ভিদবিদ্যাও পড়াতেন। তাঁদের কাছে শুনেছি, ব্রিটিশ শাসকেরা তাঁর গবেষণাকর্মে নানা বিঘ্ন সৃষ্টি করত এবং কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষ তাঁকে বিভিন্ন কলেজে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা নিতে পাঠাতেন। এই আত্মভোলা মানুষটি পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে নিজেই নাকি সেসব প্রশ্নের উত্তর বলতে থাকতেন।
বিদেশ ভ্রমণকালে ইংল্যান্ডের এক বিশ্ববিদ্যালয় জগদীশচন্দ্রকে অধ্যাপনায় আমন্ত্রণ জানালে তিনি দারুণ দোটানায় পড়েন। ভারতে গবেষণার বহুবিধ অসুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে তা ছিল এক অভাবনীয় সম্মান ও সুযোগ। অগত্যা পরামর্শ চেয়ে রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন, ‘আমি কী করিব কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। আমার সমস্ত Inspiration-এর মূলে আমার স্বদেশীয় লোকের স্নেহ। সেই স্নেহবন্ধন ছিন্ন হইলে আমার আর কী রহিল?...আমাদের হূদয়ের মূল ভারতবর্ষে, যদি সেখানে থাকিয়া কিছু করিতে পারি, তাহা হইলেই জীবন ধন্য হইবে। দেশে ফিরিয়া আসিলে যেসব বাধা পড়িবে তাহা বুঝিতে পারিতেছি না। যদি আমার অভীষ্ট অপূর্ণ থাকিয়া যায়, তাহাও সহ্য করিব।’ বলা বাহুল্য স্বদেশেরই জয় হয়েছিল, তিনি ফিরে এসেছিলেন ভারতে আপন কর্মক্ষেত্রে।
আমাদের বিদ্বৎসমাজ জগদীশচন্দ্রকে ভুলতে বসেছে। অতীতে পাঠ্যবইয়ে তাঁর জীবনী থাকত, এখন নেই। তাঁর লেখা অব্যক্ত বইটি স্কুল-কলেজ পর্যায়ে অতিরিক্ত পাঠ্য হিসেবে পড়ানোর কথা আমরা কোনো দিন ভাবিনি। তাঁর গবেষণাগুলো গুরুত্বসহ পড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে অনেক কাল আগে। আমাদের দেশে উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যা আলাদাভাবে পড়ানো হয়, যদিও জগদীশচন্দ্রই এই দুটি জীবকুলকে একটি একক হিসেবে দেখার ভিত তৈরি করেছিলেন এবং বিদেশে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে লাইফ সায়েন্স বা প্রাণবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বহুকাল আগে। নটর ডেম কলেজের লাইব্রেরিতে এমন বই ছিল অনেক, বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী গেলর্ড সিম্পসনের বইও। ভেবেছি দেশ স্বাধীন হলে আমরা এসব বই অনুবাদ করে পড়াব, আমাদের দেশীয় উপাদানের ভিত্তিতে বাংলায় এমন পাঠ্যবই লিখব। কিন্তু কিছুই হলো না।
যা- হোক, বলতে দ্বিধা নেই, সাধারণ মানুষ কিন্তু জগদীশচন্দ্রকে ভোলেননি। তাঁরা জানেন জগদীশচন্দ্রই উদ্ভিদে প্রাণ আবিষ্কার করেছিলেন, যা পশ্চিমের বিজ্ঞানীরা পারেননি। তাঁরাই বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে তাঁর পৈতৃক ভিটেমাটি আগলে রেখেছেন, তাঁর স্মরণিক একটি জাদুঘরও প্রতিষ্ঠা করেছেন।
দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গী।
No comments