লিবিয়া-ইতিহাসের কোনো শেষ নেই by রবার্ট ফিস্ক
বাদবাকি আরব নৃপতি আর স্বৈরশাসকদের আরেকটি নির্ঘুম রাত গেল। কত তাড়াতাড়ি ত্রিপোলির মুক্তিদাতারা রূপান্তরিত হবে সিরিয়ার দামেস্ক ও আলেপ্পো এবং হোম শহরের মুক্তিদাতায়? অথবা তারা মুক্ত করবে জর্ডানের আম্মান? অথবা ইসরায়েলের জেরুজালেম? অথবা বাহরাইন অথবা রিয়াদ হবে মুক্ত? সব একইভাবে ঘটবে না।
আরবের বসন্ত-গ্রীষ্ম-শরৎ প্রমাণ করেছে, ঔপনিবেশিক আমলের পুরাতন সীমান্ত এখনো অটুট থাকবে, সাম্রাজ্যবাদের জঘন্য অবদান হিসেবে। একই সঙ্গে প্রমাণিত হয়েছে, সব বিপ্লবেরই থাকে নিজস্ব ধরন। সব আরব বিপ্লবেই যদি শহীদ সৃষ্টি করে তাকে, কোনো কোনো বিপ্লব অন্যগুলোর থেকে বেশি সহিংস। গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল-ইসলাম যেমন তাঁর পতনের শুরুতে বলেছিলেন, ‘লিবিয়া তিউনিসিয়া নয়, মিসর নয়...এখানে গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে। রাস্তায় রক্ত ঝরবে।’ তাঁর কথা ফলেছে।
ভবিষ্যৎ দেখার স্ফটিক গোলকে তাকিয়ে আমরা দেখতে পাই, আমরা পশ্চিমারা যদি অর্থনৈতিক দখলদারি কায়েমের উদ্দেশ্যে ন্যাটোর ‘মুক্তিকামী’ বোমাবর্ষণ না করি, তাহলে লিবিয়া হয়ে উঠবে মধ্যপ্রাচ্যের পরাশক্তি। লিবিয়ার পতনে তাই উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো খুশি হবে, তাদের চোখে গাদ্দাফি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন এবং তাদের জন্য অনিষ্টকারী। কিন্তু অনির্বাচিত শাসকদের সরিয়ে অনির্বাচিতদের শাসক হিসেবে বসানো ভারী বিপজ্জনক খেলা।
অন্যান্য আরব দেশের মতো লিবিয়াও আরব-ক্যানসারে আক্রান্ত। তাহলো অর্থনৈতিক ও নৈতিক দুর্নীতি। ভবিষ্যৎ কি তাহলে এর থেকে অন্য রকম হবে? আমরা লিবিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশংসায় অঢেল সময় খরচ করেছি, কিন্তু বিদ্রোহীদের অস্থায়ী ন্যাশনাল কাউন্সিলের চরিত্র নিয়ে আলোচনার সময় আমাদের হয়নি। এই কাউন্সিলের কথাকথিত নেতা মোস্তফা আবদুল জলিল এখনো উত্তর দিতে পারেননি, কীভাবে তাঁর ঘনিষ্ঠ লোকেরা গত মাসে বিদ্রোহীদের সামরিক কমান্ডারকে মেরে ফেলল? এরই মধ্যে পাশ্চাত্য নতুন লিবিয়াকে গণতন্ত্রের শিক্ষা দেওয়া শুরু করেছে। আগ বাড়িয়েই এর অনির্বাচিত নেতৃত্বকে শেখাচ্ছে, কীভাবে আট বছর আগে ইরাককে মুক্ত করার মাধ্যমে সেখানে আমাদের তৈরি করা নৈরাজ্যের অবস্থা এড়াতে হবে লিবিয়াকে। গণতান্ত্রিক হোক বা না হোক, নতুন শাসন কায়েম হলে পরে কে তার সুবিধাভোগী হবে? এবং সব নতুন শাসনই অতীতের অন্ধকার দিকগুলোকে রক্ষা করে, তা জার্মানির আদেনায়্যারই হোক বা হোক ইরাকের মালিকি সরকার। তাই, লিবিয়াকেও গাদ্দাফির গোত্রকে ধারণ করতে হবে। গতকাল যারা গ্রিন স্কয়ারে গাদ্দাফির নামে জিন্দাবাদ দিয়েছে, পরশু তারাই সেখানে তার বিরুদ্ধে নিন্দাবাদ দেবে।
কিন্তু সবাই তা নয়। কত শিগগিরই দুনিয়া লকারবির অভিযুক্ত বোমাবাজ আবদুল বাসেত আল-মেগরাহির দরজায় টোকা দেবে? সে হয়তো আসলেই সেই ঘটনার জন্য দায়ী নয়, তবু তারা জানতে চাইবে তার দীর্ঘজীবনের কারণ, গাদ্দাফির গোয়েন্দা বাহিনীতে তার কার্যকলাপের বিবরণ। কত তাড়াতাড়ি ত্রিপোলি মুক্তকারীরা গাদ্দাফির তেল ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফাইলপত্র ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করবে? তারা তখন জানতে পারবে ব্লেয়ার-সারকোজি-বেরলুসকোনির সঙ্গে গাদ্দাফির প্রেমের বিবরণ অথবা তার আগেই হয়তো ব্রিটিশ বা ফরাসি গোয়েন্দারা সেগুলো গায়েব করে দিতে পারে। এবং ইউরোপের মানুষ প্রশ্ন তোলার আগেই আমাদের জানতে হবে, যে ন্যাটো লিবিয়ায় এত সফল, তারা কেন সিরিয়াকে ধরছে না। কেন সাইপ্রাসকে বিমানবাহী রণপোতের আখড়া বানিয়ে সিরিয়ার আট হাজার ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানগুলো ধ্বংস করছে না, দখল করছে না দেশটিকে। নাকি আমরা ইসরায়েলের কথায় কান দেব, স্বৈরশাসকদের রক্ষার মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে গোলান উপত্যকার স্বত্ব নিয়ে শান্তি কায়েম করব? যেমনটা তারা করেছিল মিসরের স্বৈরশাসকের সঙ্গে।
আরব জাগরণ নিয়ে ইসরায়েল একেবারে যাচ্ছেতাই করেছে। কেন ইসরায়েলি নেতারা মিসরের বিপ্লবকে স্বাগত জানাননি। ইসরায়েল যে গণতন্ত্রের কথা বলে, সেই গণতন্ত্রকে অভিনন্দন না জানিয়ে তাঁরা পাঁচ মিসরীয় সেনাকে গুলি করে হত্যা করেন।
বেন আলি বিদায় নিয়েছেন, মোবারক বিদায় নিয়েছেন, ইয়েমেনের সালেহ কম-বেশি বিগত, গাদ্দাফি উচ্ছেদ, আসাদ বিপদে, জর্ডানের বাদশাহ বিরোধিতার মুখে, বাইরানের সংখ্যালঘু সুন্নিরা এখনো আত্মঘাতী পথে চিরকাল শাসনক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চাইছে। এত সব ঐতিহাসিক ঘটনায় ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া ছিল হিংসাত্মক ও বৈরিতার। ওদিকে আরবরা যখন গণতান্ত্রিক ভ্রাতৃত্ব তৈরি করছে, যে ভ্রাতৃত্বের হাত হয়তো সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলকেও ডাকত, তখন ইসরায়েল আরও নতুন নতুন আরব এলাকায় উপনিবেশ কায়েম করছে। তাদের কর্মকাণ্ড যতই অবৈধতা প্রমাণ করছে, ততই তারা চেঁচাচ্ছে যে, দুনিয়া নাকি তাদের ধ্বংস করতে চায়।
এ রকম এক জটিল পরিস্থিতিতে তুরস্কের ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তাদের ক্ষমতার শীর্ষ সময়ে আপনি কোনো কাগজপত্র ছাড়াই মরক্কো থেকে কনস্টান্টিনোপল পর্যন্ত সফর করতে পারতেন। সিরিয়া ও জর্ডান মুক্ত হলে আমরা পশ্চিমারাও পারব আলজেরিয়া থেকে তুরস্ক হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত ভিসা ছাড়াই চলাচল করতে। তাহলে কি ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের পুনর্জন্ম হলো! হলো হয়তো, তবে তা আরবদের জন্য নয়, তাদের জন্য ভিসা লাগবেই।
এখনো সেই অবস্থা তৈরি হয়নি। তবে কখন বিত্তের ওপর বসে থাকা বাহরাইনের শিয়া আর সৌদি আরবের অগণিত মানুষ জিজ্ঞেস করবে, কেন তারা তাদের দেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না? এই বলে কখন তারা পুতুল শাসকদের উচ্ছেদে নামবে? কখন সিরিয়ার মাহের আল-আসাদ, প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের ভাই, কুখ্যাত চতুর্থ ব্রিগেডের কমান্ডার, গাদ্দাফির সঙ্গে আল-জাজিরার শেষ ফোনালাপ শুনতে পাবেন। ‘আমাদের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা কম ছিল’ বলছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর কথার মধ্যেই শোনা যাবে বন্দুকের শব্দ। ‘ওরা আমার বাড়িতে ঢুকে পড়েছে!’ তারপর শোনা যাবে, ‘আল্লাহ মহান’। সঙ্গে সঙ্গেই কেটে যাবে ফোন।
সব অনির্বাচিত আরব শাসক অথবা ভুয়া ভোটে নির্বাচিত যেকোনো মুসলিম শাসক সেই কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শুনতে পাবে। সত্যিই আরবে প্রজ্ঞার বিষয়টি সবচেয়ে অনুপস্থিত। আর দূরদর্শিতা হলো এমন এক গুণ, যা আরব ও পাশ্চাত্য কারওই নেই। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য—যদি এ রকম মোটা দাগে ভাগ করেও বলি—উভয়েই ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়েছে, যা ঘটবে তা আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ঘটবে। সংবাদের প্রাইমটাইমে কী বলবেন ওবামা? দুনিয়ার সামনে কোন কথা নিয়ে দাঁড়াবেন ক্যামেরন? ডোমিনো তত্ত্ব ভুয়া। আরব বসন্ত বছরের পর বছর ধরে চলবে। আমাদের এখন এটাই ভাবা উচিত। ইতিহাসের কোনো শেষ নেই।
ব্রিটেনের দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক, মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ।
No comments