প্রিয় কবি জাহিদুল হক by আনোয়ারা সৈয়দ হক
সময় কীভাবে যে গড়িয়ে যায়! মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। উনিশশ' ছিয়াত্তর সালে বিদেশ থেকে দেশে ছুটি কাটাতে এসে একদিন যখন 'সচিত্র সন্ধানী'র অফিসে বসে ছিলাম একাকী, সময়টা সকাল, একজন ছাবি্বশ-সাতাশ বছরের তরুণ সন্ধানী অফিসে এসে ঢুকলেন। পরিচিত কেউ সামনে না থাকায় আমরা নিজেরাই নিজেদের সঙ্গে পরিচিত হলাম।
আমি জানলাম, তিনি একজন কবি। জার্মানির রেডিও ডয়েচে ভেলে কাজ করতে গিয়েছিলেন। সম্প্রতি দেশে ফিরে এসেছেন।
কবিতা এবং সাহিত্য নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করলাম। সকালের সেই আলোচনা শেষ হতে দুপুর হয়ে গেল। জীবনের সেই প্রথম আমি সাহিত্যিক আড্ডার স্বাদ অনুভব করলাম এবং আমার নিজেকে পরিপূর্ণ ও শুদ্ধ মনে হলো। অচেনা একজন কবির সঙ্গে যেন মন খুলে আমি কথা বললাম, আমার সাহিত্যিক চিন্তাভাবনার দোসর করে। এমন সব মানুষ নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম, যারা তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে অচেনা। এর আগে এই সচিত্র সন্ধানী অফিসেই আমার পরিচয় হয়েছিল কবি সুরাইয়া খানমের সঙ্গে, পরিচয় হয়েছিল কবি আহসান হাবীবের সঙ্গেও। কিন্তু তাদের কারও কাছে আমি মুখ খুলতে সাহস করিনি। তখন আমিও কিছুটা তরুণ ছিলাম এবং হয়তো লাজুকও ছিলাম কিছুটা। এরপর প্রবাসে কেটে গেল বহু বছর। কবি জাহিদুল হকের আর কোনো খবর পেলাম না। নিভৃতচারী এই কবির কবিতা মাঝে মধ্যে কাগজে ছাপা হতে দেখতাম এবং আগ্রহ করে পড়তাম। দেশে ফিরে আসার পরও নানা ঝামেলায় যেন ভুলে গেলাম আবার তার সঙ্গে দেখা বা যোগাযোগের চেষ্টা করার কথা। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার স্মৃতির ভেতরে সন্ধানী অফিসের সেই দুপুরটি যেন ঠাঁই গেড়ে বসে থাকল। দেশে ফেরারও বহু বছর পর আবার জাহিদুল হকের সঙ্গে আমার দেখা হয়। ততদিনে কবি জাহিদুল হক কবিতার জগতে তার আসন পাকা করে ফেলেছেন এবং আমিও আমার সাহিত্য জগৎটিকে আমার মতো করে পরিচ্ছন্ন করে তুলতে পেরেছি। আমাদের দেখা হয় আবারও কোনো সাহিত্যের আড্ডায়, যখন কবি জাহিদুল হক সাহিত্যিক অভিজ্ঞতার প্রান্তটিতে এসে তার কবিতার ভেতরে নিজেকে থিতু করে তুলতে পেরেছেন। শুধু তা-ই নয়, এখন তার কলম থেকেও বেরোচ্ছে সুন্দর সব ছোটগল্প, যেখানে তার জীবন, স্বপ্ন এবং অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।
কবি জাহিদুল হক ষাটের দশকের কবি। একজন রোমান্টিক কবি। একজন স্বপ্ন দেখার কবি এবং একজন স্বপ্নভঙ্গের বেদনার, সন্দেহের দোদুল্যমানতার, হতাশার নীল জলে অবগাহন করারও কবি। আবার এর ভেতর থেকেই সবকিছু নতুন করে গড়ে তোলার স্বপ্নেরও কবি। যেমন_ যখন তিনি লেখেন, 'কষ্ট, তোমাতে ফের আমি আসবো হঠাৎ/যদি না আসি তো শত পূর্ণিমা শ্লোগান তুলবে/এই শহরেই/স্নায়ুকে কাটবে স্মৃতির করাত/রুনু, কোনো ত্রুটি আতিথেয়তায় ঘটেনি তোমার/ত্রুটি রক্তের, ত্রুটি জন্মের অন্ধ শিকলে/বন্ধ বলেই/চলো যাই ছাদে আকাশের নিচে/আজ পূর্ণিমা যেন অন্তত না যায় বিফলে।' কবি জাহিদুল হকের কবিতার ভেতরে সেই দ্যোতনা, উপমা এবং উৎপ্রেক্ষা বিরাজমান, যা তার কবিতা আত্মস্থ করার আগেই পাঠকের মনকে দোলা দেয়, অভিভূত করে। তিনি আশাহীনতার ভেতরেও আশা ধরে রাখেন এইভাবে, যখন তিনি বলেন, 'তুমি গেলে আসবো তো আমি কুলুকুলু করে/সে একই কুলুকুলু একই উলুঝুলু আসা যাওয়া/তার মানে আসা-যাওয়া এক/একই বস্তু, দুঃখ/দুঃখ মানে আসা/দুঃখ মানে যাওয়া/সবই আসা-যাওয়া।'
দেশ, কাল, জাতি, ভবিষ্যৎ, বিদেশের প্রকৃতি, মানুষ এবং প্রেম ও প্রতীক্ষা তার কবিতার বিষয়। নীরবে-নিভৃতে বসবাসকারী এই কবির ভেতরে আমরা প্রত্যক্ষ করি সেই শক্তি, যা কালে কালে কবিতা প্রেমিকদের বুকে এঁকে দেবে ব্যথাতুর সেই স্বপ্নের ইতিহাস, যার উৎস এই পৃথিবীরই সমাজ, মানুষ ও বিশাল বিপুল ভূমণ্ডল। প্রিয় কবির এই জন্মদিনে জানাই তাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।
কবিতা এবং সাহিত্য নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করলাম। সকালের সেই আলোচনা শেষ হতে দুপুর হয়ে গেল। জীবনের সেই প্রথম আমি সাহিত্যিক আড্ডার স্বাদ অনুভব করলাম এবং আমার নিজেকে পরিপূর্ণ ও শুদ্ধ মনে হলো। অচেনা একজন কবির সঙ্গে যেন মন খুলে আমি কথা বললাম, আমার সাহিত্যিক চিন্তাভাবনার দোসর করে। এমন সব মানুষ নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম, যারা তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে অচেনা। এর আগে এই সচিত্র সন্ধানী অফিসেই আমার পরিচয় হয়েছিল কবি সুরাইয়া খানমের সঙ্গে, পরিচয় হয়েছিল কবি আহসান হাবীবের সঙ্গেও। কিন্তু তাদের কারও কাছে আমি মুখ খুলতে সাহস করিনি। তখন আমিও কিছুটা তরুণ ছিলাম এবং হয়তো লাজুকও ছিলাম কিছুটা। এরপর প্রবাসে কেটে গেল বহু বছর। কবি জাহিদুল হকের আর কোনো খবর পেলাম না। নিভৃতচারী এই কবির কবিতা মাঝে মধ্যে কাগজে ছাপা হতে দেখতাম এবং আগ্রহ করে পড়তাম। দেশে ফিরে আসার পরও নানা ঝামেলায় যেন ভুলে গেলাম আবার তার সঙ্গে দেখা বা যোগাযোগের চেষ্টা করার কথা। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার স্মৃতির ভেতরে সন্ধানী অফিসের সেই দুপুরটি যেন ঠাঁই গেড়ে বসে থাকল। দেশে ফেরারও বহু বছর পর আবার জাহিদুল হকের সঙ্গে আমার দেখা হয়। ততদিনে কবি জাহিদুল হক কবিতার জগতে তার আসন পাকা করে ফেলেছেন এবং আমিও আমার সাহিত্য জগৎটিকে আমার মতো করে পরিচ্ছন্ন করে তুলতে পেরেছি। আমাদের দেখা হয় আবারও কোনো সাহিত্যের আড্ডায়, যখন কবি জাহিদুল হক সাহিত্যিক অভিজ্ঞতার প্রান্তটিতে এসে তার কবিতার ভেতরে নিজেকে থিতু করে তুলতে পেরেছেন। শুধু তা-ই নয়, এখন তার কলম থেকেও বেরোচ্ছে সুন্দর সব ছোটগল্প, যেখানে তার জীবন, স্বপ্ন এবং অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।
কবি জাহিদুল হক ষাটের দশকের কবি। একজন রোমান্টিক কবি। একজন স্বপ্ন দেখার কবি এবং একজন স্বপ্নভঙ্গের বেদনার, সন্দেহের দোদুল্যমানতার, হতাশার নীল জলে অবগাহন করারও কবি। আবার এর ভেতর থেকেই সবকিছু নতুন করে গড়ে তোলার স্বপ্নেরও কবি। যেমন_ যখন তিনি লেখেন, 'কষ্ট, তোমাতে ফের আমি আসবো হঠাৎ/যদি না আসি তো শত পূর্ণিমা শ্লোগান তুলবে/এই শহরেই/স্নায়ুকে কাটবে স্মৃতির করাত/রুনু, কোনো ত্রুটি আতিথেয়তায় ঘটেনি তোমার/ত্রুটি রক্তের, ত্রুটি জন্মের অন্ধ শিকলে/বন্ধ বলেই/চলো যাই ছাদে আকাশের নিচে/আজ পূর্ণিমা যেন অন্তত না যায় বিফলে।' কবি জাহিদুল হকের কবিতার ভেতরে সেই দ্যোতনা, উপমা এবং উৎপ্রেক্ষা বিরাজমান, যা তার কবিতা আত্মস্থ করার আগেই পাঠকের মনকে দোলা দেয়, অভিভূত করে। তিনি আশাহীনতার ভেতরেও আশা ধরে রাখেন এইভাবে, যখন তিনি বলেন, 'তুমি গেলে আসবো তো আমি কুলুকুলু করে/সে একই কুলুকুলু একই উলুঝুলু আসা যাওয়া/তার মানে আসা-যাওয়া এক/একই বস্তু, দুঃখ/দুঃখ মানে আসা/দুঃখ মানে যাওয়া/সবই আসা-যাওয়া।'
দেশ, কাল, জাতি, ভবিষ্যৎ, বিদেশের প্রকৃতি, মানুষ এবং প্রেম ও প্রতীক্ষা তার কবিতার বিষয়। নীরবে-নিভৃতে বসবাসকারী এই কবির ভেতরে আমরা প্রত্যক্ষ করি সেই শক্তি, যা কালে কালে কবিতা প্রেমিকদের বুকে এঁকে দেবে ব্যথাতুর সেই স্বপ্নের ইতিহাস, যার উৎস এই পৃথিবীরই সমাজ, মানুষ ও বিশাল বিপুল ভূমণ্ডল। প্রিয় কবির এই জন্মদিনে জানাই তাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।
No comments