শিক্ষা-স্কুলে ঝরে পড়া প্রতিকার by মোঃ আবুল বাশার

ঝরে পড়া প্রতিকারে যেসব বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে তার অন্যতম হচ্ছে_ এক. ভৌগোলিক এলাকা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পারিবারিক অবস্থা, গ্রাম-শহর এলাকা ইত্যাদি বিবেচনা করে কোথায় ঝরে পড়ার হার বেশি এবং ঝরে পড়ার সত্যিকারের কারণ কী সে সম্পর্কে গবেষণা করে সে মোতাবেক প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সাধারণভাবে সারাদেশের জন্য


একই পদক্ষেপ সব ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ না-ও হতে  পারে  দেশে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির হার বৃদ্ধি আমাদের আশাবাদী করলেও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া শিক্ষা বিস্তারে বাধা হিসেবে কাজ করছে। শিক্ষার্থীর ঝরে পড়া প্রতিকারে নানামুখী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। যার ফলে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি না পেলেও যে মাত্রায় এ হার কমানোর চেষ্টা চলছে সে মাত্রায় তা কমছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ে কেন? ঝরে পড়ার মূল কারণ হিসেবে দারিদ্র্যকে চিহ্নিত করা হলেও এর আরও সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে, যেগুলোর দিকে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত। ঝরে পড়ার যেসব কারণ পাওয়া যায় সেগুলোকে প্রধান চারটি ক্ষেত্রে ভাগ করা যায়। এক. শিক্ষককেন্দ্রিক; দুই. পিতামাতা বা অভিভাবককেন্দ্রিক; তিন. শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও চার. পরিবেশকেন্দ্রিক। শিক্ষককেন্দ্রিক কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, শিক্ষণ কাজে অবহেলা করা, শিক্ষকদের আগ্রহের অভাব, শিক্ষকদের ভয় পাওয়া, শিক্ষকের অসদাচরণ, অনিয়মিত ক্লাস গ্রহণ, দুর্বল শিক্ষণ-শিক্ষাদান, অতিকঠোর শৃঙ্খলা, শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, শিক্ষক কর্তৃক শাস্তি বা নির্যাতন, শিক্ষকের অনুপস্থিতি, শিক্ষকস্বল্পতা ও নারী শিক্ষক না থাকা ইত্যাদি। পিতামাতা ও অভিভাবককেন্দ্রিক কারণের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে পিতামাতার আগ্রহের অভাব বা অবহেলা, পিতামাতা কর্তৃক অতিরিক্ত স্বাধীনতা প্রদান ও অতিরিক্ত স্নেহ, মেয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠাতে অস্বীকৃতির মনোভাব, পিতামাতার জুয়াখেলা, মাদকাসক্তি, পিতা বা মাতার মৃত্যু, পিতা-মাতার অনৈক্য, পিতামাতার নিরক্ষরতা, আত্মীয়ের বাসায় রেখে সন্তানকে পড়াশোনা করানো, পিতামাতার দারিদ্র্য, বাল্যবিয়ে, একই পরিবারে অধিকসংখ্যক সন্তান থাকা, পিতামাতা কর্তৃক সন্তানকে অতিরিক্ত চাপ দেওয়া, পিতামাতার আগ্রহ সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক কারণের আওতাধীন বিষয়গুলো হচ্ছে_ অস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা, খেলাধুলার প্রতি অধিক আগ্রহ থাকা, দুর্ঘটনার শিকার হওয়া বা শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা, বাল্যবিয়ে, শিক্ষার্থীর বয়স, পড়াশোনায় উদাসীনতা, হীনতা অনুভব, সমস্যামূলক আচরণ ও দুর্বল একাডেমিক কর্মক্ষমতা। পরিবেশগত কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে_ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান, অভ্যন্তরীণ অভিগমন, বন বা আদিবাসী অধ্যুষিত জীবন, হাওর বা চরাঞ্চলের জীবন, বস্তির জীবন, বদভ্যাস থেকে নেশাগ্রস্ততা, খারাপ পরিবেশে অবস্থিত বাসস্থান, খারাপ স্কুল পরিবেশ, বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব, স্কুলে যাতায়াত সমস্যা, স্কুল রক্ষণাবেক্ষণে ভালো ব্যবস্থা না থাকা, স্বাস্থ্য পরিসেবার ব্যবস্থার অভাব, কাউন্সেলিং ব্যবস্থা না থাকা, মানসম্পন্ন বিষয়বস্তুর অভাব, অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী সংবলিত শ্রেণীকক্ষ, নিরাপদ পানি সরবরাহ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, অনাকর্ষণীয় বিদ্যালয় ভবন ও প্রাঙ্গণ, খেলার সরঞ্জামের অভাব, অনিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা, লিঙ্গ সংবেদনশীল পরিবেশ না থাকা, উপস্থিতির রেকর্ড ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, বিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাইরের প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলার উপযোগী মনোসামাজিক দক্ষতা না থাকা ইত্যাদি।
ঝরে পড়া প্রতিকারে যেসব বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে তার অন্যতম হচ্ছে_ এক. ভৌগোলিক এলাকা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পারিবারিক অবস্থা, গ্রাম-শহর এলাকা ইত্যাদি বিবেচনা করে কোথায় ঝরে পড়ার হার বেশি এবং ঝরে পড়ার সত্যিকারের কারণ কী সে সম্পর্কে গবেষণা করে সে মোতাবেক প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সাধারণভাবে সারাদেশের জন্য একই পদক্ষেপ সব ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ না-ও হতে পারে। দুই. নতুন বিদ্যালয় নির্মাণ ও পুরনো বিদ্যালয় ভবন মেরামতের ক্ষেত্রে কেবল প্রকৌশলীদের মতামতের ভিত্তিতে নয়, শিক্ষা ব্যবস্থায় জড়িত বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ এবং অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে আকর্ষণীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। তিন. বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষ এবং আসবাবগুলো শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষণ পদ্ধতির উপযোগী করে গড়ে তোলা। চার. সব প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ড অবশ্যই পেশাগত প্রশিক্ষকের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া উচিত। সে লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনবল বৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী করা। পাঁচ. চাহিদা নিরূপণের মাধ্যমে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা। ছয়. ইতিমধ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো থেকে যথাযথ ফল প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত মনিটরিং ও একাডেমিক সুপারভিশন। সাত. যুগের চাহিদা অনুযায়ী এবং গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন সহায়ক শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা। উলি্লখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আরও সৃজনধর্মী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ঝরে পড়ার প্রবণতা হ্রাস পাবে এবং সে সঙ্গে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ সহজ হবে। যথাসময়ে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে।

মোঃ আবুল বাশার : বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর, বাংলাদেশ, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.