পদের মোহ-বিতর্কিত সেই আজিজ এবং ঢাকায় ঈদ by শাহ্দীন মালিক
নকল হতে সাবধান!’ এই লেখার শিরোনাম পড়ে পাঠক যাতে বিভ্রান্ত না হন, তাই আগেভাগেই বলে রাখি—অতীতে এই ঢাকা শহরে ঈদ উদ্যাপন এবং সেই ঈদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হারিয়ে যাওয়া কিন্তু মধুর অথবা বেদনাবিধুর কোনো ব্যক্তির স্মৃতিচারণা, ঢাকা শহরের ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া কোনো অধ্যায় ইত্যাদি এই লেখার বিষয়বস্তু নয়।
বিষয়বস্তু একেবারেই বর্তমানের ঘটনা ও রাজনীতি এবং আমাদের ভাগ্য নিয়ে।
এই লেখার ‘আজিজ্যা’ পুরান ঢাকার স্থানীয় কিংবদন্তির চরিত্র নয়। প্রতি জেলার বা স্থানীয় ইতিহাসে অনেক চরিত্র থাকেন, যাঁরা রাজা-বাদশাহকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চায় স্থান পান না। কিন্তু ইদানীং ইতিহাসচর্চার গতিপ্রকৃতি বা মোড় ঘুরে গিয়ে অনেক ‘সাধারণ’ মানুষও ইতিহাসে স্থান পাচ্ছেন। যাঁরা অবদান রেখেছেন কিন্তু বড় কোনো পদে আসীন ছিলেন না বলে তাঁদের অবদান এতকাল স্বীকৃতি পায়নি—আমাদের আজকের ‘আজিজ্যা’ তেমন কোনো চরিত্র নয়। ঢাকার ঈদ উদ্যাপনের সেই ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বা ইতিহাস—তার সঙ্গেও এর যোগাযোগ নেই।
২.
অতএব, আসল কথায় আসি। আজকের আজিজ্যা গত বিএনপির আমলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এম এ আজিজ, যিনি পত্রপত্রিকার কার্টুন এবং অন্যান্য কারণ ও তাঁর স্বীকৃত অবদানের জন্য ‘আজিজ্যা’ নামেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। রুহুল কুদ্দুস বনাম এম এ আজিজ মামলায়—অবশ্য তাঁর চাকরি অবসানের পর—রায় হয়েছিল যে আপিল বিভাগের বিচারপতি থাকা অবস্থায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদে শপথ নেওয়া ছিল বেআইনি।
এটা যে বেআইনি, সেটা বুঝতে তো সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বা নির্বাচন কমিশনারের মতো আইনজ্ঞান, বিদ্যাবুদ্ধি ইত্যাদির খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না। অবশ্য নিজের স্বার্থ যেখানে জড়িত, সেখানে বলতে গেলে মানুষমাত্রই অন্ধ।
তৎকালীন বিএনপি সরকার নির্বাচনটাকে গোছানোর জন্য একদিকে এক পেয়ারা বান্দা এম এ আজিজকে বানাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার। অন্যদিকে আরেক সাবেক প্রধান বিচারপতি যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন, সে জন্য সংবিধান সংশোধন করা হলো। সত্য হোক মিথ্যা হোক, সংবিধান সংশোধন হলে তার কৃতিত্বের দাবিদার হন আইনমন্ত্রী। বিচারপতিদের অবসরের বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ বছর করা হলো সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনের মাধ্যমে, যাতে কাঙ্ক্ষিত প্রধান বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পর আর কেউ পরবর্তী নির্বাচনের আগে অবসরে গিয়ে শেষ ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি’ হতে না পারেন। ফলে সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির সাহেব প্রধান বিচারপতি থাকলেন বছর তিনেক, অবসরের বয়স ৬৫ থাকলে উনি অবসরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আগে শেষ সাবেক বা অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ দখল করতে না পারেন। ওই চালাকি-সংশোধনের সময় আইনমন্ত্রী ছিলেন মওদুদ আহমদ।
যা হোক, কারও হিসাবই মেলেনি। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার সব হিসাব ওলট-পালট করে দিয়েছিল।
সেই ২০০৫-০৬-এর টানাপোড়েনে আপিল বিভাগের বিচারপতি এম এ আজিজ হয়ে পড়লেন ‘আজিজ্যা’। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এত বেশি ধিক্কৃত আর কেউ হয়েছেন কি না মনে পড়ে না। কত কার্টুন, ঝাড়ুমিছিল এবং ব্যঙ্গাত্মক আরও কত কিছু! কিন্তু উনি পদ ছাড়বেন না। তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপির হোমরা-চোমরারা—অবশ্য এটা অধমের কল্পনা, নিশ্চয় আজিজ্যাকে অহরহ সান্ত্বনা ও উৎসাহ জোগাতেন, হয়তো অনেকটা এই ভাষায়—দুষ্টলোকে তো খারাপ কথা বলবেই, অহেতুক সমালোচনা করবেই; আপনার মতো বিচক্ষণ-অভিজ্ঞ-বিজ্ঞ বিচারপতিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে পাওয়া তো এই জাতির কত বড় সৌভাগ্য, সেটা অভাগা জাতি আর এই অভাগা জাতির আরও অভাগা সংবাদমাধ্যম ঠাহরই করতে পারছে না ইত্যাদি।
এত প্রশংসাস্তুতি শুনলে কে না স্বীয় কাজে ভীষণভাবে উৎসাহিত হবে? উৎসাহের চোটে ভোটার তালিকা বানাতে গিয়ে এক কোটিরও বেশি ভুয়া ভোটারে আমাদের ভোটার তালিকা সমৃদ্ধ হয়ে গেল।
পত্রপত্রিকা, আমজনতা, বিশিষ্টজন এবং অন্য সব গোছের যত লোক যতই সমালোচনা করুক না, আজিজ সাহেব পণ করে বসে থাকলেন যে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ ছাড়বেন না।
আসলে দোষ তাঁর নয়। এ দেশে পদ একবার পেলে কেউ ছাড়ে না। বড় পদগুলো বড় মাপের লোকের জন্য। বড় মাপের লোকেরা পদ ছাড়া এমনিতেই বড়। পদ তাদের বড় করে না। আর আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, প্রায় সবাই পদ পেয়ে বড় হয়। এতএব, পদ কেমনে ছাড়ে! কেউ পদ ছাড়ে না।
৩.
লোক মরুক, দেশ রসাতলে যাক, আমি পদ ছাড়ব না।
তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর—অত্যন্ত বড় ক্ষতি। জাতির ক্ষতি। আমাদের শিল্প-সাহিত্য, সংবাদমাধ্যম—সবার ক্ষতি।
সমাজে মাঝেমধ্যে কিছু লোক পাওয়া যায়—সংখ্যায় যাঁরা সব সময় খুবই অল্প—যাঁদের কাছ থেকে অন্য অনেকেই শিখতে পারে। অধম শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সংবাদমাধ্যম জগতের লোক নয়। ওই সব বোঝার বিদ্যাবুদ্ধি, পড়াশোনা, কিছুই নেই। তবে এতটুকু বুঝি, তারেক ও মিশুক অনেক কিছু সৃষ্টি করেছিলেন। তারেকের ছবি দেখেছি, অনেক কিছু ভালো সৃষ্টি করতেন এবং সর্বোপরি তাঁদের কাছ থেকে অনেক ভালো কাজ শিখতে পারা যেত। ওঁদের এভাবে চলে যাওয়া দেশ-জাতির জন্য বিরাট ক্ষতি।
অন্যান্য শত শত হাজার হাজার মানুষ প্রায় প্রাত্যহিকভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তাদের মৃত্যু হয়তো সব ক্ষেত্রে দেশ-জাতির জন্য এত বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। কিন্তু তাদের পরিবার-পরিজনের জন্য? যে মেয়ে মা হারিয়েছে, ছেলে বাবা হারায়, স্বামী স্ত্রী হারায়—তাদের ক্ষতি?
১৮৭১ সাল থেকে প্রতি ১০ বছর অন্তর আদমশুমারি হয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪১ সালে হয়নি, আর গত প্রায় ১৫০ বছরে নিয়মমাফিক আদমশুমারি হয়নি ১৯৭১ সালে—মুক্তিযুদ্ধের বছর।
এবার ২০১১ সালে আদমশুমারি হলো। সরকারের কথা এখন আর কেউই তো বিশ্বাস করে না। গত আদমশুমারি ২০০১-এ হয়েছিল এই দল যখন ক্ষমতায় ছিল। যত দূর মনে পড়ে, ২০০১-এর আদমশুমারির পুরো হিসাব মেলাতে মেলাতে লেগেছিল বছর পাঁচেক।
যেই কাজ, অর্থাৎ আদমশুমারি ১৮৭১ ুেথকে হয়ে আসছিল, সেটাও এখন আমরা ঠিকমতো করতে পারি না। লোক-গণনাকারী নিয়োগে দলীয় লোকের ঠেলা সামলাতে গিয়ে দেশের জনসংখ্যা নেমে এসেছে সোয়া ১৪ কোটিতে। একইভাবে দেশে দুর্ঘটনায় কত লোক মারা যায়, কত হাজার লোক প্রতিবছর আহত, পঙ্গু হয়, তার হিসাব—যে দেশ দলীয়করণের ঠেলায় আদমশুমারিও এখন করতে পারে না—তার হিসাব কে কীভাবে রাখবে?
তবে হাজার হাজার লোক নিহত হচ্ছে, আহত হচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে। জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, নিহত-পঙ্গুদের লাখ লাখ পরিবার তছনছ হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর কাফেলা দীর্ঘতর হচ্ছে।
৪.
আর বেহায়ার মতো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা নরঘাতক তৈরির জন্য বিনা পরীক্ষায় হাজার হাজার গাড়িচালকের লাইসেন্স দিচ্ছেন। একটু তো পরীক্ষা নিচ্ছি বা আর এভাবে লাইসেন্স দেব না—মন্ত্রীরা এ ধরনের কথা বলছেন। এসব কথা পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে।
এটা যদি হবুচন্দ্র রাজার দেশ না হয়, তাহলে সেই দেশটি কোথায়?
দেশের বিশিষ্টজনেরা বলছেন যাতায়াত-সংশ্লিষ্ট উভয় মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে। মন্ত্রীদ্বয়ের নিজ দলের গণ্যমান্য-নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও বলছেন তাঁদের অকর্মণ্যতার কথা। এত কিছুর পরও যদি তাঁরা পদত্যাগ না করেন, তাহলে আমরা বুঝব যে পদ পেলে সবাই ‘আজিজ্যা’ হয়।
আজিজ্যাদের সরকারের কী পরিণতি হয়, সেটা তো সবারই মনে থাকা উচিত।
শেষে শিরোনামের ‘ঢাকায় ঈদ’। ঢাকার সঙ্গে কয়েকটি শহর-জেলার বাস পরিবহন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ভরা ‘মহাসড়কে’ বাসমালিকেরা গাড়ি চালাতে নারাজ। আমার বাস থাকলে আমিও রাস্তায় বের করতাম না। তারপর যদি মন্ত্রীদের পেয়ারা বান্দা হিসেবে পরীক্ষাবিহীন লাইসেন্সপ্রাপ্ত বাসচালককে নিয়োগ দিতে হতো। ভাগ্যিস আমার বাস নেই।
রাস্তা নেই, বাস নেই—অতএব, যাঁরা ঈদে সাধারণত দেশ-গ্রামে যান, তাঁদের এবার ঢাকায়ই থাকতে হবে। যেসব সড়ক-মহাসড়ক দুই বছর ধরে ভেঙে পড়েছে, সেগুলো এক-দুই সপ্তাহে ঠিক হবে না। অবশ্য ঈদের আগে ঠিক করতে হবে, তাড়াতাড়ি মেরামত করতে হবে বলে এই ঈদের মৌসুমে অনেকের ঝটপট অনেক আয় হয়ে যাবে।আমাদের কোনো লাভ নেই। গুণীজন মারা যাবেন; সাধারণজন বেঘোরে প্রাণ হারাবে। মন্ত্রীরা তোয়াক্কা করবেন না—নরঘাতক তৈরি করবেন। দুই হাতে পয়সা কামাবেন। আর সে জন্য পদ আঁকড়ে থাকবেন। আর আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত।
ড. শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট সুপ্রিম কোর্ট, অধ্যাপক ও পরিচালক স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
এই লেখার ‘আজিজ্যা’ পুরান ঢাকার স্থানীয় কিংবদন্তির চরিত্র নয়। প্রতি জেলার বা স্থানীয় ইতিহাসে অনেক চরিত্র থাকেন, যাঁরা রাজা-বাদশাহকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চায় স্থান পান না। কিন্তু ইদানীং ইতিহাসচর্চার গতিপ্রকৃতি বা মোড় ঘুরে গিয়ে অনেক ‘সাধারণ’ মানুষও ইতিহাসে স্থান পাচ্ছেন। যাঁরা অবদান রেখেছেন কিন্তু বড় কোনো পদে আসীন ছিলেন না বলে তাঁদের অবদান এতকাল স্বীকৃতি পায়নি—আমাদের আজকের ‘আজিজ্যা’ তেমন কোনো চরিত্র নয়। ঢাকার ঈদ উদ্যাপনের সেই ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বা ইতিহাস—তার সঙ্গেও এর যোগাযোগ নেই।
২.
অতএব, আসল কথায় আসি। আজকের আজিজ্যা গত বিএনপির আমলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এম এ আজিজ, যিনি পত্রপত্রিকার কার্টুন এবং অন্যান্য কারণ ও তাঁর স্বীকৃত অবদানের জন্য ‘আজিজ্যা’ নামেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। রুহুল কুদ্দুস বনাম এম এ আজিজ মামলায়—অবশ্য তাঁর চাকরি অবসানের পর—রায় হয়েছিল যে আপিল বিভাগের বিচারপতি থাকা অবস্থায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদে শপথ নেওয়া ছিল বেআইনি।
এটা যে বেআইনি, সেটা বুঝতে তো সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বা নির্বাচন কমিশনারের মতো আইনজ্ঞান, বিদ্যাবুদ্ধি ইত্যাদির খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না। অবশ্য নিজের স্বার্থ যেখানে জড়িত, সেখানে বলতে গেলে মানুষমাত্রই অন্ধ।
তৎকালীন বিএনপি সরকার নির্বাচনটাকে গোছানোর জন্য একদিকে এক পেয়ারা বান্দা এম এ আজিজকে বানাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার। অন্যদিকে আরেক সাবেক প্রধান বিচারপতি যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন, সে জন্য সংবিধান সংশোধন করা হলো। সত্য হোক মিথ্যা হোক, সংবিধান সংশোধন হলে তার কৃতিত্বের দাবিদার হন আইনমন্ত্রী। বিচারপতিদের অবসরের বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ বছর করা হলো সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনের মাধ্যমে, যাতে কাঙ্ক্ষিত প্রধান বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পর আর কেউ পরবর্তী নির্বাচনের আগে অবসরে গিয়ে শেষ ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি’ হতে না পারেন। ফলে সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির সাহেব প্রধান বিচারপতি থাকলেন বছর তিনেক, অবসরের বয়স ৬৫ থাকলে উনি অবসরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আগে শেষ সাবেক বা অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ দখল করতে না পারেন। ওই চালাকি-সংশোধনের সময় আইনমন্ত্রী ছিলেন মওদুদ আহমদ।
যা হোক, কারও হিসাবই মেলেনি। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার সব হিসাব ওলট-পালট করে দিয়েছিল।
সেই ২০০৫-০৬-এর টানাপোড়েনে আপিল বিভাগের বিচারপতি এম এ আজিজ হয়ে পড়লেন ‘আজিজ্যা’। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এত বেশি ধিক্কৃত আর কেউ হয়েছেন কি না মনে পড়ে না। কত কার্টুন, ঝাড়ুমিছিল এবং ব্যঙ্গাত্মক আরও কত কিছু! কিন্তু উনি পদ ছাড়বেন না। তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপির হোমরা-চোমরারা—অবশ্য এটা অধমের কল্পনা, নিশ্চয় আজিজ্যাকে অহরহ সান্ত্বনা ও উৎসাহ জোগাতেন, হয়তো অনেকটা এই ভাষায়—দুষ্টলোকে তো খারাপ কথা বলবেই, অহেতুক সমালোচনা করবেই; আপনার মতো বিচক্ষণ-অভিজ্ঞ-বিজ্ঞ বিচারপতিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে পাওয়া তো এই জাতির কত বড় সৌভাগ্য, সেটা অভাগা জাতি আর এই অভাগা জাতির আরও অভাগা সংবাদমাধ্যম ঠাহরই করতে পারছে না ইত্যাদি।
এত প্রশংসাস্তুতি শুনলে কে না স্বীয় কাজে ভীষণভাবে উৎসাহিত হবে? উৎসাহের চোটে ভোটার তালিকা বানাতে গিয়ে এক কোটিরও বেশি ভুয়া ভোটারে আমাদের ভোটার তালিকা সমৃদ্ধ হয়ে গেল।
পত্রপত্রিকা, আমজনতা, বিশিষ্টজন এবং অন্য সব গোছের যত লোক যতই সমালোচনা করুক না, আজিজ সাহেব পণ করে বসে থাকলেন যে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ ছাড়বেন না।
আসলে দোষ তাঁর নয়। এ দেশে পদ একবার পেলে কেউ ছাড়ে না। বড় পদগুলো বড় মাপের লোকের জন্য। বড় মাপের লোকেরা পদ ছাড়া এমনিতেই বড়। পদ তাদের বড় করে না। আর আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, প্রায় সবাই পদ পেয়ে বড় হয়। এতএব, পদ কেমনে ছাড়ে! কেউ পদ ছাড়ে না।
৩.
লোক মরুক, দেশ রসাতলে যাক, আমি পদ ছাড়ব না।
তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর—অত্যন্ত বড় ক্ষতি। জাতির ক্ষতি। আমাদের শিল্প-সাহিত্য, সংবাদমাধ্যম—সবার ক্ষতি।
সমাজে মাঝেমধ্যে কিছু লোক পাওয়া যায়—সংখ্যায় যাঁরা সব সময় খুবই অল্প—যাঁদের কাছ থেকে অন্য অনেকেই শিখতে পারে। অধম শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সংবাদমাধ্যম জগতের লোক নয়। ওই সব বোঝার বিদ্যাবুদ্ধি, পড়াশোনা, কিছুই নেই। তবে এতটুকু বুঝি, তারেক ও মিশুক অনেক কিছু সৃষ্টি করেছিলেন। তারেকের ছবি দেখেছি, অনেক কিছু ভালো সৃষ্টি করতেন এবং সর্বোপরি তাঁদের কাছ থেকে অনেক ভালো কাজ শিখতে পারা যেত। ওঁদের এভাবে চলে যাওয়া দেশ-জাতির জন্য বিরাট ক্ষতি।
অন্যান্য শত শত হাজার হাজার মানুষ প্রায় প্রাত্যহিকভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তাদের মৃত্যু হয়তো সব ক্ষেত্রে দেশ-জাতির জন্য এত বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। কিন্তু তাদের পরিবার-পরিজনের জন্য? যে মেয়ে মা হারিয়েছে, ছেলে বাবা হারায়, স্বামী স্ত্রী হারায়—তাদের ক্ষতি?
১৮৭১ সাল থেকে প্রতি ১০ বছর অন্তর আদমশুমারি হয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯৪১ সালে হয়নি, আর গত প্রায় ১৫০ বছরে নিয়মমাফিক আদমশুমারি হয়নি ১৯৭১ সালে—মুক্তিযুদ্ধের বছর।
এবার ২০১১ সালে আদমশুমারি হলো। সরকারের কথা এখন আর কেউই তো বিশ্বাস করে না। গত আদমশুমারি ২০০১-এ হয়েছিল এই দল যখন ক্ষমতায় ছিল। যত দূর মনে পড়ে, ২০০১-এর আদমশুমারির পুরো হিসাব মেলাতে মেলাতে লেগেছিল বছর পাঁচেক।
যেই কাজ, অর্থাৎ আদমশুমারি ১৮৭১ ুেথকে হয়ে আসছিল, সেটাও এখন আমরা ঠিকমতো করতে পারি না। লোক-গণনাকারী নিয়োগে দলীয় লোকের ঠেলা সামলাতে গিয়ে দেশের জনসংখ্যা নেমে এসেছে সোয়া ১৪ কোটিতে। একইভাবে দেশে দুর্ঘটনায় কত লোক মারা যায়, কত হাজার লোক প্রতিবছর আহত, পঙ্গু হয়, তার হিসাব—যে দেশ দলীয়করণের ঠেলায় আদমশুমারিও এখন করতে পারে না—তার হিসাব কে কীভাবে রাখবে?
তবে হাজার হাজার লোক নিহত হচ্ছে, আহত হচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে। জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, নিহত-পঙ্গুদের লাখ লাখ পরিবার তছনছ হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর কাফেলা দীর্ঘতর হচ্ছে।
৪.
আর বেহায়ার মতো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা নরঘাতক তৈরির জন্য বিনা পরীক্ষায় হাজার হাজার গাড়িচালকের লাইসেন্স দিচ্ছেন। একটু তো পরীক্ষা নিচ্ছি বা আর এভাবে লাইসেন্স দেব না—মন্ত্রীরা এ ধরনের কথা বলছেন। এসব কথা পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে।
এটা যদি হবুচন্দ্র রাজার দেশ না হয়, তাহলে সেই দেশটি কোথায়?
দেশের বিশিষ্টজনেরা বলছেন যাতায়াত-সংশ্লিষ্ট উভয় মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে। মন্ত্রীদ্বয়ের নিজ দলের গণ্যমান্য-নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও বলছেন তাঁদের অকর্মণ্যতার কথা। এত কিছুর পরও যদি তাঁরা পদত্যাগ না করেন, তাহলে আমরা বুঝব যে পদ পেলে সবাই ‘আজিজ্যা’ হয়।
আজিজ্যাদের সরকারের কী পরিণতি হয়, সেটা তো সবারই মনে থাকা উচিত।
শেষে শিরোনামের ‘ঢাকায় ঈদ’। ঢাকার সঙ্গে কয়েকটি শহর-জেলার বাস পরিবহন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ভরা ‘মহাসড়কে’ বাসমালিকেরা গাড়ি চালাতে নারাজ। আমার বাস থাকলে আমিও রাস্তায় বের করতাম না। তারপর যদি মন্ত্রীদের পেয়ারা বান্দা হিসেবে পরীক্ষাবিহীন লাইসেন্সপ্রাপ্ত বাসচালককে নিয়োগ দিতে হতো। ভাগ্যিস আমার বাস নেই।
রাস্তা নেই, বাস নেই—অতএব, যাঁরা ঈদে সাধারণত দেশ-গ্রামে যান, তাঁদের এবার ঢাকায়ই থাকতে হবে। যেসব সড়ক-মহাসড়ক দুই বছর ধরে ভেঙে পড়েছে, সেগুলো এক-দুই সপ্তাহে ঠিক হবে না। অবশ্য ঈদের আগে ঠিক করতে হবে, তাড়াতাড়ি মেরামত করতে হবে বলে এই ঈদের মৌসুমে অনেকের ঝটপট অনেক আয় হয়ে যাবে।আমাদের কোনো লাভ নেই। গুণীজন মারা যাবেন; সাধারণজন বেঘোরে প্রাণ হারাবে। মন্ত্রীরা তোয়াক্কা করবেন না—নরঘাতক তৈরি করবেন। দুই হাতে পয়সা কামাবেন। আর সে জন্য পদ আঁকড়ে থাকবেন। আর আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত।
ড. শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট সুপ্রিম কোর্ট, অধ্যাপক ও পরিচালক স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments