স্মরণ-সত্য প্রকাশের দায়ে by মোহাম্মদ আলী

হুমায়ুন আজাদের অভাব আজ আমরা গভীরভাবে অনুভব করি। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন, আমাদের কাঁদিয়ে গেছেন। কিন্তু তার ভাষাতত্ত্ব, প্রবন্ধ সাহিত্য, উপন্যাস, কিশোর সাহিত্যের মধ্যে তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। যখন তার কোনো রচনা পাঠ করি তাকে স্মরণ করি।


তিনি জীবন্ত হয়ে আমাদের ভেতরে ফিরে আসেন। তাকে ভীষণভাবে অনুভব করি


হুমায়ুন আজাদ জন্মেছিলেন মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের রাঢ়ীখালে। পদ্মার পিঠ ছুঁয়ে রাঢ়ীখাল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার বুকের ওপর দিয়ে একটি পিচঢালা পথ চলে গেছে। বোধহয় সেই ব্যথায় তার বুক টনটন করে।
হুমায়ুন আজাদ যেন সেই ব্যথা একসময় অনুভব করেছিলেন। তিনি তার কৈশোর ও যৌবনের কিছু অংশজুড়ে অকৃত্রিম রাঢ়ীখালকে পেয়েছিলেন। তিনি আড়িয়ল বিলের চকচকে রূপালি সরপুঁটি মাছ দেখেছেন। কচুরি ফুলের ঘ্রাণ পেয়েছেন। মাঠে মাঠে সোনালি ধানের ঢেউখেলা বাতাস দেখেছেন। শীতকালে খেজুর রসে সিক্ত পিঠে খেয়েছেন প্রাণভরে।
প্রথম জীবনে লেখাপড়া করেছেন স্যার জগদীশচন্দ্র বোস ইনস্টিটিউশনে, এরপর ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বের ওপর উচ্চতর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
চাকরি করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করা তিনি একদম পছন্দ করতেন না। অভিবাসী বাঙালিদের জীবনযাপন সম্পর্কে তিনি বলেছেন, 'নতুন কৃতদাসের জীবন।'
তাকে খুব কাছ থেকে দেখা এবং তার সঙ্গে একান্ত ঘনিষ্ঠভাবে মেশার আমার সুযোগ হয়েছে। তিনি ঘড়ির কাঁটা ধরে চলতেন। কখনও কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে তিনি পেঁৗছতেন। কাউকে কথা দিলে সে কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন।
হুমায়ুন আজাদ কেমন মানুষ ছিলেন? আমার কাছে এ প্রশ্নের উত্তর হলো_ সাধারণত কোনো ঘটনা বা বিষয় যখন আমরা চিন্তা করি তখনই একজন মানুষকে বুঝতে পারি। হুমায়ুন আজাদ চিন্তা-দর্শনের দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের ছিলেন। যেমন ধরুন, একুশে ফেব্রুয়ারি এলে বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলন করার দাবি ওঠে। তিনি বলতেন, মতিঝিলে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হয়। সচিবালয়ে বাংলা ভাষা সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন। উত্তরপাড়ায় বাংলায় ভাষা সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত। তাহলে বাংলা ভাষা কীভাবে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠালাভ করবে? যারা রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা করেন তারা যদি মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা, অবহেলা করেন, তাহলে এই ভাষা কখনও সর্বজনীন ভাষারূপে সমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করতেন পারবে না।
আমাদের প্রচলিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা এসব নিয়ে তিনি ছিলেন সমালোচনামুখর। এ দেশের বড় বড় বিদ্যাপীঠকে তিনি খেদ করে 'ফোরকানিয়া মাদ্রাসা'র সঙ্গে তুলনা করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলো যেভাবে মৌলবাদীদের আড্ডাখানায় পরিণত হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করে তিনি এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন।
হুমায়ুন আজাদ একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। শোষণহীন প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তার স্বপ্নের বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?
তিনি সে কারণে লেখার ভেতরে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ভণ্ডামি-কপটতা, স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে কলমযুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
কিন্তু ঘাতক মৌলবাদীরা তার লেখার সমালোচনা না করে তাকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করেছিল।
সত্য প্রকাশের জন্য যেভাবে ব্রুনোকে জীবন দিতে হয়েছিল, হাইফেসিয়াকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, গ্যালিলিওকে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল, তেমনি হুমায়ুন আজাদকে মৌলবাদের চাপাতির আঘাতে রক্তাক্ত হতে হয়েছে। যদিও তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিছুটা সুস্থ হওয়ার কিছুদিন পর একটি গবেষণাকাজে জার্মানিতে গিয়েছিলেন। সেখানে রহস্যজনকভাবে তার মৃত্যু হয়। ধারণা করা হয়, এর পেছনে মৌলবাদীদের হাত থাকতে পারে।
হুমায়ুন আজাদের অভাব আজ আমরা গভীরভাবে অনুভব করি। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন, আমাদের কাঁদিয়ে গেছেন। কিন্তু তার ভাষাতত্ত্ব, প্রবন্ধ সাহিত্য, উপন্যাস, কিশোর সাহিত্যের মধ্যে তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। যখন তার কোনো রচনা পাঠ করি তাকে স্মরণ করি। তিনি জীবন্ত হয়ে আমাদের ভেতরে ফিরে আসেন। তাকে ভীষণভাবে অনুভব করি। কিন্তু জীবন এবং মৃত্যু অবধারিত। তাকে ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আজ সেই অমর একটি বাণীর কথা মনে পড়ে_ 'কোনো কোনো মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী_ কোনো কোনো মৃত্যু বেলে হাঁসের পালকের চেয়েও হালকা।' হুমায়ুন আজাদের মৃত্যু থাই পাহাড়ের মতো ভারী। তার মৃত্যু বাংলাদেশকে যেভাবে কাঁদিয়েছে; খুব কম মৃত্যুই এভাবে কোনো জাতিকে কাঁদাতে পারে।
কিন্তু হুমায়ুন আজাদের মৃত্যু নেই। তিনি মৃত্যুহীন। তিনি তাঁর সাহিত্য, কর্মময় জীবনের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন।
তার হত্যা প্রচেষ্টাকারীদের একদিন শাস্তি পেতে হবে। রাষ্ট্র ও সরকার তার হত্যা প্রচেষ্টাকারীদের সত্যিকারের বিচার করবে_ এটাই জনগণের প্রত্যাশা। সাম্প্রদায়িকতা পরাস্ত হবে_ একদিন প্রগতিশীলরাই জয়ী হবে।

মোহাম্মদ আলী : সাংস্কৃতিক কর্মী
nanditaali@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.