বিশেষ সাক্ষাৎকার-সুশাসনে আমরা পেছনের দিকে যাচ্ছি by আকবর আলি খান

আকবর আলি খানের জন্ম ১৯৪৪ সালে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগে সম্মানসহ মাস্টার্স করার পর ১৯৬৭ সালে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।


পরে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতিতে এমএ ও পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৫ থেকে ২০০১ সালের জুন পর্যন্ত তিনি অর্থসচিব ছিলেন। এরপর ২০০২-২০০৫ সময়কালে তিনি বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল, তাতে তিনি উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, পরে ডিসেম্বর মাসে পদত্যাগ করেন। বর্তমানে তিনি লেখালেখি ও গবেষণামূলক কাজে জড়িত রয়েছেন। গত বছর ফ্রেন্ডলি ফায়ার্স, হাম্পটি ডাম্পটি ডিজঅর্ডার, অ্যান্ড আদার এসেজ এবং অন্ধকারের উৎস হতে নামে তাঁর দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতার কাজও করে যাচ্ছেন তিনি।
 সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

প্রথম আলো  আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের আড়াই বছর পার হয়েছে। কিন্তু সুশাসনের কী অবস্থা?
আকবর আলি খান  বাংলাদেশে সুশাসনের মান এমনিতেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় নিম্ন পর্যায়ে। দেড় দশক ধরে দেখা যাচ্ছে যে এই মান আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানের কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। সুশাসনের জন্য যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার, তা দেখা যাচ্ছে না। তাই দেশে সুশাসনের নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে।
প্রথম আলো  গত দেড় দশকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগই কি ছিল না?
আকবর আলি খান  গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সুশাসন প্রতিষ্ঠার কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনগত অবস্থান ছিল প্রশ্নবিদ্ধ, জনসমর্থন প্রায় অনুপস্থিত। যে ধরনের সংস্কার কার্যক্রম সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েছিল, তা ছিল বিক্ষিপ্ত। তাই উদ্যোগ নিলেও বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সুশাসনের ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখতে পারেনি।
প্রথম আলো  সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধাটি আসলে কী?
আকবর আলি খান  সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা হলো, সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী সুশাসনের অনুপস্থিতিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া মানে এই গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিল করা কঠিন হয়ে যাওয়া। তাই সুশাসনের বিরোধিতাকারী একটি গোষ্ঠী সব সময়ই সক্রিয় থাকে। কোনো সরকার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার পর যদি সঙ্গে সঙ্গেই সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সংস্কারের উদ্যোগ না নেয়, তবে সংস্কার করার ক্ষমতা সীমিত হয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে বিলম্ব করলে তখন সরকার নিজেই কায়েমি স্বার্থবাদীদের কাছে জিন্মি হয়ে পড়ে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোনো সংস্কারকাজ চালানো তখন কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রথম আলো  বর্তমান সরকারের ক্ষেত্রে বিষয়টি কি তাই?
আকবর আলি খান  আমরা দেখতে পাচ্ছি যে দুর্ভাগ্যবশত বর্তমান সরকার গত আড়াই বছরে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এর ফলে এই মেয়াদে অবশিষ্ট যে আড়াই বছর রয়েছে, সেই সময়ে সরকারের পক্ষে আদৌ কোনো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। সামগ্রিকভাবে তাই সুশাসন পরিস্থিতির অবনতি দেখা যাচ্ছে। আমরা বর্তমানে এমন এক অবস্থায় রয়েছি, যেখানে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই আমাদের রয়েছে, কিন্তু বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই কাজ করছে না। দেশের ভৌত অবকাঠামো বিপর্যস্ত। এসব রক্ষণাবেক্ষণে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। দ্রব্যমূল্য কমানোর উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দেশের সর্বত্র সাংঘর্ষিক রাজনীতির কালো ছায়া। এ ধরনের সূচক থেকে মনে হয়, আমরা সামনের দিকে যতটুকু এগোচ্ছি, তার চেয়ে বেশি পেছনের দিকে যাচ্ছি।
প্রথম আলো  বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়েও যদি আমরা কথা বলি, তাহলে দেখব যে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় একটি পুরোনো মন্ত্রণালয়, কিন্তু দেশের সড়ক ও মহাসড়গুলোর যে অবস্থা, তাতে তো এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে এই মন্ত্রণালয়ের কোনো নজরই ছিল না এই দিকটিতে। এটা কীভাবে সম্ভব?
আকবর আলি খান  সম্প্রতি সড়কব্যবস্থায় যা ঘটেছে, তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে সড়ক বিভাগকে পাবলিক প্লেজার অ্যাকাউন্টের আওতায় জরুরি সংস্কারকাজের জন্য বাজেট-বহির্ভূত ক্ষমতা দেওয়া ছিল। উপরন্তু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মন্ত্রণালয়ের যে বাজেট থাকে, তা ছাড় করানোর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না। এই অবস্থায় বর্তমান বছরের বাজেট থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যর্থতা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হলো তার কাজের পরিধির মধ্যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং সমাধান করা। এ ক্ষেত্রে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত। সরকারের ভেতরে সফল না হলে তারা বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির নজরে আনতে পারত। এমনকি সমস্যটি নিজেরাই গণমাধ্যমের নজরে এনে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারত। সামগ্রিক বিশ্লেষণে এটা বলা যায় যে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না।
প্রথম আলো  আপনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কথা বললেন, কিন্তু এখন কী প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
আকবর আলি খান  এ ধরনের ব্যর্থতা কেন হয়েছে, তা খুঁজে বের করতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরীক্ষণ বিভাগের তত্ত্বাবধানে একটি তদন্ত হওয়া উচিত। সর্বোপরি প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে যাদের গাফিলতি রয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
প্রথম আলো  বিভিন্ন মহল থেকে এই ব্যর্থতার জন্য যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠেছে। এই দাবি কতটা যৌক্তিক বলে মনে করেন?
আকবর আলি খান  আমাদের দেশে মন্ত্রীদের পদত্যাগের রেওয়াজ নেই বললেই চলে। মন্ত্রীরা দায়িত্বে থাকলেও তাঁরা ব্যর্থতার দায় স্বীকার করতে চান না। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই রীতি রয়েছে, সেখানে মন্ত্রীরা তাঁর মন্ত্রণালয়ের কোনো কাজের ব্যর্থতার দায় নেন এবং পদত্যাগ করেন। আমাদের দেশের বর্তমান মন্ত্রিসভা গঠনের সময় বলা হয়েছিল যে মন্ত্রীদের কাজের মূল্যায়ন করা হবে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনে পরিবর্তন বা বাদ দেওয়া হবে। নৈমিত্তিকভাবেই কাজটি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে গত ২০ বছরে আমরা এমন কোনো উদাহরণ দেখিনি। ভারতের বর্তমান মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভায় এ পর্যন্ত চার দফা বড় ধরনের রদবদল হয়েছে। আমাদের দেশে গত আড়াই বছরে মূল্যায়নের ভিত্তিতে মন্ত্রিসভায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে এই সমস্যা শুধু মন্ত্রীদের কাজের মূল্যায়নের ক্ষেত্রেই নয়, প্রশাসনের সব ক্ষেত্রেই এই সমস্যা রয়েছে। এখানে ভালো কাজ করলে কোনো পুরস্কার নেই, খারাপ কাজ করলেও কাউকে শাস্তি পেতে হয় না।
প্রথম আলো  বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যে ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না, এ জন্য অনেকে মন্ত্রী ও উপদেষ্টার মধ্যে দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের প্রসঙ্গটি তুলে ধরেছেন। মন্ত্রী, না উপদেষ্টা—কে মন্ত্রণালয় চালান, সেই প্রশ্নও উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
আকবর আলি খান  সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমরা যদি সত্যি সত্যি এই নীতিতে বিশ্বাস করি, তবে আরও দুটি পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমত, আমাদের সংবিধানে মন্ত্রিসভায় ১০ শতাংশ অনির্বাচিত সদস্য রাখার বিধান রয়েছে। এ ধরনের বিধান রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। যদি অনির্বাচিতরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হতে না পারেন, তবে অনির্বাচিতরা কীভাবে মন্ত্রী হবেন? বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে মন্ত্রীর পদমর্যাদা ও ক্ষমতা দিয়ে উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শোনা যায়, মাননীয় উপদেষ্টাদের ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের চেয়ে বেশি। প্রশ্ন হলো, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও তার উপদেষ্টারা হারাম হলে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় অনির্বাচিত ব্যক্তিদের উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়টি হালাল হয় কীভাবে? তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একই মন্ত্রণালয়ের জন্য মন্ত্রী ও উপদেষ্টার কোনো দ্বৈত সত্তা থাকে না। বর্তমানে যেসব উপদেষ্টার পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে প্রশাসনে দ্বৈত শাসনের দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়া অপ্রত্যাশিত নয়।
প্রথম আলো  আপনি বলেছেন, বর্তমান সরকার শুরুতে যেহেতু সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়নি, তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আগামী আড়াই বছরে এই সরকারের পক্ষে তেমন কিছু করা সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে বর্তমান বাস্তবতায় কি করণীয় কিছু নেই?
আকবর আলি খান  বর্তমান সরকার সুশাসনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারবে, তেমন আশা করা কঠিন, সেই সম্ভাবনাও নেই। কারণ, এ জন্য যে সময় লাগবে, তা সরকারের হাতে নেই। আর আগেই বলেছি যে ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারে হাত না দেওয়া গেলে পরে তা করা কঠিন হয়ে যায়। বর্তমানে সরকারের হাতে আর আড়াই বছর সময় আছে, এই সময়ের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকার যা করতে পারে, তা হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া। এটা ঠিকমতো করতে পারলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে সবার কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। আর শুধু মূল্যায়ন নয়, সে অনুযায়ী পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বলা হয়, মন্ত্রীরা অস্থায়ী আর সচিবেরা স্থায়ী। ব্রিটেনে সে কারণে সচিবদের বলা হয় পারমানেন্ট আন্ডার-সেক্রেটারি। কিন্তু আমাদের দেশে এর উল্টোটাই চলছে। সচিবদের রদবদল হয় কিন্তু গত ২০ বছরে কোনো মন্ত্রীকে কাজের ব্যর্থতার জন্য সরে যেতে দেখলাম না। যথাযথ মূল্যায়ন ও পুরস্কার-তিরস্কারের সংস্কৃতি চালু না করলে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো যাবে না।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
আকবর আলি খান  ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.