চারদিক-এখনো তুমি স্পার্টাকাস... by এম এম খালেকুজ্জামান
এ বছর ২৭ জানুয়ারি প্রথম আলোয় একটি খবর বেরিয়েছিল। ঢাকার আশুলিয়ার পাড়াগ্রাম এলাকার একটি ইটের ভাটায় ঘটছিল ভয়ংকর এক ঘটনা। এই যুগেও প্রায় দাসের জীবন কাটাচ্ছিলেন ৩০ জন মানুষ। যাঁরা ভুলে গেছেন, তাঁদের একটু মনে করিয়ে দিই ঘটনাটা।
ওই ইটভাটায় কাজ করতে এসে ৩০ জন শ্রমিকের বন্দিজীবন শুরু হয়। পারিশ্রমিক চাইলেই তাঁদের শরীরে গরম রড দিয়ে ছেঁকা দেওয়া হতো। কথায় কথায় পেটানো হতো রড ও লাঠি দিয়ে। কোনো শ্রমিক যেন পালাতে না পারেন, সে জন্য পায়ে শিকল পরিয়ে কাজ করানো হতো। র্যাবের সদস্যরা এই শ্রমিকদের উদ্ধার করেন দুটি তালাবদ্ধ ঘর থেকে।
দাস-ব্যবসা ও এর বিলোপের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস আজ। সে কথা স্মরণে রেখেই ওপরের কথাগুলো বলা।
দাসপ্রথাকে বলা যায় সভ্যতার প্রায় সমবয়সী। শুধু গ্রিক সভ্যতাই নয়, মানবসভ্যতারই অন্যতম প্রধান দার্শনিক অ্যারিস্টটল তাঁর গ্রন্থে দাসপ্রথাকে সামাজিক প্রয়োজনে বৈধ বলে রায় দিয়েছেন। তাঁর মতে, কিছু হীন ও নিকৃষ্ট ব্যক্তি পরম্পরায় দাস হয়েই জন্মগ্রহণ করে এবং দাসত্বই তাদের একমাত্র ভবিতব্য। জ্ঞান-সংস্কৃতি-শিক্ষা ইত্যাদিতে যারা হীন তাদের দায়িত্ব প্রভুর সেবাধর্ম পালন করা এবং তারা উচ্চ শ্রেণীর দ্বারা শাসিত হবে, এটাই নির্ধারিত। দাসপ্রথাকে অ্যারিস্টটল বৈধ বলে স্বীকার করলেও গ্রিকরা দাস হবে, এটা তিনি অনুমোদন করেননি। বিদেশি অন্যান্য জাতির লোকদের তিনি গ্রিকদের চেয়ে নিকৃষ্ট মনে করতেন এবং তারাই গ্রিকদের সেবা করবে—এই ছিল তাঁর মত।
খ্রিষ্টপূর্বাব্দের গ্রিসেই শুধু নয়, প্রাচীন পৃথিবীর সর্বত্রই দাস-ব্যবসা বৈধ বলে গণ্য হতো। যুদ্ধে পরাজিত পক্ষ, ঋণ শোধে ব্যর্থ ঋণগ্রহীতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল দাসত্ব বরণ। বিভিন্ন কারণে আফ্রিকার নানা উপজাতির মধ্যে দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। রোমান সভ্যতায়ও দাসপ্রথার উপস্থিতি দেখা যায়। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝিতে পর্তুগাল থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের ইউরোপের অন্যান্য দেশে পাঠানো হতো দাস হিসেবে।
ভারতবর্ষে দাসপ্রথা বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত ছিল। তবে প্রাচীন বা মধ্যযুগে ভারতবর্ষে যে ধরনের দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল, তার ধরন-ধারণে পরিবর্তন ঘটায় ইউরোপীয়রা। প্রাচীন ভারতে জাতিভেদ প্রথার মধ্যেও দাসত্বের উপস্থিতি দেখা যায়। তখনকার দিনে দাস-দাসী হাতবদল হতো, উপহার হিসেবে দেওয়া হতো। মধ্যযুগে মুসলিম শাসকদের সময় দাস বিক্রির বাজার ছিল। যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী দাস-দাসীর দাম নির্ধারিত হতো। পাঁচ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করত দাম। ইসলাম ধর্মের অনুশাসন অনুসারে একজন দাসের অধিকার অন্যান্য সাধারণ নাগরিকের মতোই স্বীকৃত ছিল। সুলতানি আমলে ক্রীতদাসদের অনেক সম্মানজনক পদেও অধিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। কিন্তু ধনতন্ত্র বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাসেরা অস্থাবর বস্তু হিসেবে বিবেচ্য হতে থাকে।
১৭১২ সালের ১ এপ্রিল স্বাক্ষরিত এক চুক্তিপত্রে দেখা যায়, এক দম্পতি ২৬২ টাকার বিনিময়ে তাদের বাড়ি, অন্যান্য সম্পত্তি, গয়না ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে দাসও বন্ধক রাখে। ১৭২৩ সালে সম্পাদিত এক বিয়ের চুক্তিতে অস্থাবর সম্পত্তির সঙ্গে ১৮ জন দাস-দাসী হস্তান্তরের কথাও উল্লেখ আছে। (বাংলায় ইউরোপীয় দাস ব্যবসা—ইতিহাস অনুসন্ধান-১২, শ্রাবণী বসু)
১৭৮৯ সালটি ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অধিকার-সচেতনতার কালপর্বেরও সূচনা করে। ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকার করে নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তখন একে একে দাস-ব্যবসা বা এই প্রথাকে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকার আইন করে দাস-ব্যবসা নিষিদ্ধ করে এবং এই ব্যবসায় নিয়োজিতদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে। এ ঘটনার পরপরই আটলান্টিকের অন্য পারে যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আব্রাহাম লিংকন। ১৮৬৩ সালে আমেরিকায় দাসপ্রথা বিলোপের কারণে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, কারণ দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলোর ব্যবসায়ীরা এতে আর্থিকভাবে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে লিংকন অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে এই বিরোধ থামাতে সক্ষম হন। ১৮৮৫ সালে বার্লিন অ্যাক্ট দ্বারা এবং ১৮৯০ সালে ব্রাসেলসে ১৮টি দেশের স্বাক্ষর নিয়ে দাসপ্রথাবিরোধী কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়। ইউনেসকো প্রতিবছর ২৩ আগস্টকে দাসপ্রথা ও এর বিলোপ দিবস হিসেবে পালন করে এই প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামকারীদের সম্মান জানায়।
স্পার্টাকাসের যুদ্ধ ছিল রোমান রিপাবলিকের বিরুদ্ধে। এখন হয়তো সে অর্থে দাসব্যবসা নেই, ওপরে বর্ণিত আশুলিয়ার সেই ঘটনার শিকার মানুষজনকেও হয়তো দাস বলা যাবে না, কিন্তু তারা কি মুক্তি পেয়েছে? প্রাচীনকালের ধারণা অনুযায়ী, শৃঙ্খলবাঁধা দাসদের যে ছবি আমাদের মনে ভেসে ওঠে, এখনকার দাসদের শরীরে তেমন কোনো শৃঙ্খল নেই। তাহলে তারা কি মুক্ত, স্বাধীন আধুনিক দাস?
এম এম খালেকুজ্জামান
দাস-ব্যবসা ও এর বিলোপের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস আজ। সে কথা স্মরণে রেখেই ওপরের কথাগুলো বলা।
দাসপ্রথাকে বলা যায় সভ্যতার প্রায় সমবয়সী। শুধু গ্রিক সভ্যতাই নয়, মানবসভ্যতারই অন্যতম প্রধান দার্শনিক অ্যারিস্টটল তাঁর গ্রন্থে দাসপ্রথাকে সামাজিক প্রয়োজনে বৈধ বলে রায় দিয়েছেন। তাঁর মতে, কিছু হীন ও নিকৃষ্ট ব্যক্তি পরম্পরায় দাস হয়েই জন্মগ্রহণ করে এবং দাসত্বই তাদের একমাত্র ভবিতব্য। জ্ঞান-সংস্কৃতি-শিক্ষা ইত্যাদিতে যারা হীন তাদের দায়িত্ব প্রভুর সেবাধর্ম পালন করা এবং তারা উচ্চ শ্রেণীর দ্বারা শাসিত হবে, এটাই নির্ধারিত। দাসপ্রথাকে অ্যারিস্টটল বৈধ বলে স্বীকার করলেও গ্রিকরা দাস হবে, এটা তিনি অনুমোদন করেননি। বিদেশি অন্যান্য জাতির লোকদের তিনি গ্রিকদের চেয়ে নিকৃষ্ট মনে করতেন এবং তারাই গ্রিকদের সেবা করবে—এই ছিল তাঁর মত।
খ্রিষ্টপূর্বাব্দের গ্রিসেই শুধু নয়, প্রাচীন পৃথিবীর সর্বত্রই দাস-ব্যবসা বৈধ বলে গণ্য হতো। যুদ্ধে পরাজিত পক্ষ, ঋণ শোধে ব্যর্থ ঋণগ্রহীতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল দাসত্ব বরণ। বিভিন্ন কারণে আফ্রিকার নানা উপজাতির মধ্যে দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। রোমান সভ্যতায়ও দাসপ্রথার উপস্থিতি দেখা যায়। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝিতে পর্তুগাল থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের ইউরোপের অন্যান্য দেশে পাঠানো হতো দাস হিসেবে।
ভারতবর্ষে দাসপ্রথা বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত ছিল। তবে প্রাচীন বা মধ্যযুগে ভারতবর্ষে যে ধরনের দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল, তার ধরন-ধারণে পরিবর্তন ঘটায় ইউরোপীয়রা। প্রাচীন ভারতে জাতিভেদ প্রথার মধ্যেও দাসত্বের উপস্থিতি দেখা যায়। তখনকার দিনে দাস-দাসী হাতবদল হতো, উপহার হিসেবে দেওয়া হতো। মধ্যযুগে মুসলিম শাসকদের সময় দাস বিক্রির বাজার ছিল। যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী দাস-দাসীর দাম নির্ধারিত হতো। পাঁচ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করত দাম। ইসলাম ধর্মের অনুশাসন অনুসারে একজন দাসের অধিকার অন্যান্য সাধারণ নাগরিকের মতোই স্বীকৃত ছিল। সুলতানি আমলে ক্রীতদাসদের অনেক সম্মানজনক পদেও অধিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। কিন্তু ধনতন্ত্র বিকশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাসেরা অস্থাবর বস্তু হিসেবে বিবেচ্য হতে থাকে।
১৭১২ সালের ১ এপ্রিল স্বাক্ষরিত এক চুক্তিপত্রে দেখা যায়, এক দম্পতি ২৬২ টাকার বিনিময়ে তাদের বাড়ি, অন্যান্য সম্পত্তি, গয়না ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে দাসও বন্ধক রাখে। ১৭২৩ সালে সম্পাদিত এক বিয়ের চুক্তিতে অস্থাবর সম্পত্তির সঙ্গে ১৮ জন দাস-দাসী হস্তান্তরের কথাও উল্লেখ আছে। (বাংলায় ইউরোপীয় দাস ব্যবসা—ইতিহাস অনুসন্ধান-১২, শ্রাবণী বসু)
১৭৮৯ সালটি ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অধিকার-সচেতনতার কালপর্বেরও সূচনা করে। ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকার করে নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তখন একে একে দাস-ব্যবসা বা এই প্রথাকে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকার আইন করে দাস-ব্যবসা নিষিদ্ধ করে এবং এই ব্যবসায় নিয়োজিতদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে। এ ঘটনার পরপরই আটলান্টিকের অন্য পারে যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আব্রাহাম লিংকন। ১৮৬৩ সালে আমেরিকায় দাসপ্রথা বিলোপের কারণে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, কারণ দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলোর ব্যবসায়ীরা এতে আর্থিকভাবে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে লিংকন অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে এই বিরোধ থামাতে সক্ষম হন। ১৮৮৫ সালে বার্লিন অ্যাক্ট দ্বারা এবং ১৮৯০ সালে ব্রাসেলসে ১৮টি দেশের স্বাক্ষর নিয়ে দাসপ্রথাবিরোধী কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়। ইউনেসকো প্রতিবছর ২৩ আগস্টকে দাসপ্রথা ও এর বিলোপ দিবস হিসেবে পালন করে এই প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামকারীদের সম্মান জানায়।
স্পার্টাকাসের যুদ্ধ ছিল রোমান রিপাবলিকের বিরুদ্ধে। এখন হয়তো সে অর্থে দাসব্যবসা নেই, ওপরে বর্ণিত আশুলিয়ার সেই ঘটনার শিকার মানুষজনকেও হয়তো দাস বলা যাবে না, কিন্তু তারা কি মুক্তি পেয়েছে? প্রাচীনকালের ধারণা অনুযায়ী, শৃঙ্খলবাঁধা দাসদের যে ছবি আমাদের মনে ভেসে ওঠে, এখনকার দাসদের শরীরে তেমন কোনো শৃঙ্খল নেই। তাহলে তারা কি মুক্ত, স্বাধীন আধুনিক দাস?
এম এম খালেকুজ্জামান
No comments