চারদিক-‘আমি ভিক্ষা করি না’ by শারমিন নাহার

রাত আটটা বাজতেই নগরের দোকানপাট লাগানোর ধুম পড়ে। যানজটের কারণে এ সময় ধানমন্ডি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসতে হলে রিকশা পাওয়াই আরেক ঝক্কি। আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে হয়তো একটা রিকশা মিলবে। তবে সেখানে রিকশাচালকের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে আরেক বাগিবতণ্ডার পর্ব।


আটটার পর বেশ কয়েকজন রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলে যখন রিকশা মিলছে না, তখন এক রিকশাচালক বললেন, ‘আমি যাব, রিকশা ভাড়া ন্যাজ্জডা দিয়েন।’ প্রথমে ভাবলাম, রিকশাচালক হয়তো হাঁটুগেড়ে বসে আছেন। কিন্তু রিকশায় উঠতেই লক্ষ করি, দুটি পায়ের একটি হাঁটু থেকে নেই। অন্যটি গোড়ালিতেই শেষ, আর পায়ের পাতা পর্যন্ত পৌঁছাইনি। একটা ধাক্কা লাগল। নিজেকে সামলে সেই রিকশায় চেপে বসি গন্তব্যে পৌঁছানোর উদ্দেশে।
মূল গল্পের শুরুটা এখান থেকেই, চালকের নাম মোহাম্মদ খোকন। আদি বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায় হলেও বর্তমানে আবাস গেড়েছেন মোহাম্মদপুরে। মূলত জীবিকার তাগিদেই ঢাকায় আসা বললেন তিনি। এ অবস্থা কী করে হলো জানতে চাইলে একটু থমকে যান। এরপর বলেন, ‘আইজ থেইকা ১৪ বছর আগে টেরাকের হেলপারি করতাম। অ্যাকসিডেন্ট হইছিল একটা গাড়ির সঙ্গে। তখন থেইকা এমন অবস্থা।’ বয়স তাঁর বড়জোর ৩০-এর কোঠায়। তবে হাড্ডিসার শরীর জানান দিচ্ছে তিনি আজ বড়ই পরিশ্রান্ত। আট ভাইবোনের মধ্যে খোকনের অবস্থান পঞ্চম।
আর ভাইবোন? ‘বেবাকটি ভালা আছে।’ আপনার খবর নেয়? ‘যে যারে নিয়া ব্যস্ত, কার খবর কে নেয়।’
আর আপনি? আবার কিছু সময় নীরবতা। ‘আমি তো খারাপ নাই। উপর আল্লাহ তো খারাপ রাখে নাই।’ বছর পাঁচেক আগে তাঁর মালিবাগে কাঁচা সবজির ভালো ব্যবসা ছিল। তবে সেই সুখ বেশি দিন সয় নাই। ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে তা হারিয়েছেন। তবে এ নিয়ে এখন আর বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই।
এরপর থেকেই রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। ‘ধরেন খারাপ লাগে, যহন আমার রিশকায় প্যাসেঞ্জার উঠতে চায় না। আবার অনেকে ওঠে, আবার আমি চালাতে পারব কি না, ভাইবা নাইমে পড়ে। আমি তো রিশকা ভাড়া নিয়ে কথা-কাটাকাটি করি না। আমি তো ভিক্ষা করি না। গতর খাটায় কাম করি। সব ডিরাইভারেরা (রিকশাচালক) কয় বেলা রিশকা চালায়। তয় আমার সারা দিন টানতে হয়। সবাই তো আর আমার রিশকায় ওঠে না। সারা দিনের জন্য মহাজন ভাড়া নেয় ৮০ ট্যাকা। দিন শেষে ২০০ ট্যাকা থাকে। এরই মাঝে সাঁই সাঁই করে একটি বাস খোকনের রিকশাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। দুরন্ত গতির বাসকে জায়গা করে দিলেন তিনি। মোহাম্মদ খোকন তাঁর এক পায়ে রিকশার প্যাডেল ঠেলে ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। নিয়ন আলোয় যেন অন্য এক আভা খুঁজে পাচ্ছিলাম চারপাশে।
এবার প্রসঙ্গ অন্যদিকে। বাড়িতে আর কে কে আছে? আমি, বউ রেনু আর একটা মাইয়া। নিজে পড়ালেখা করি নাই, তাই মাইয়েরে পড়াইতে চাই। ও যেন বড় হয়ে বড় মানুষ হয়। আর কোনো স্বপ্ন? রিকশা চালাতে চালাতে একবার ফিরে তাকান পেছনে, তাঁর চোখ চকচক করছে। উত্তর মেলে কিছুটা অন্যভাবে। স্বপ্ন তো থাকে অনেক, সব কি পূরণ হয়? তয় ধরেন, কারও কাছে যেন হাত না পাততে হয়। আমি ভিক্ষা করতে চাই না। শরীরে যত দিন শক্তি আছে কাম করব।
তবে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই তাঁর। বড় দুর্ঘটনার পরও বেঁচে আছেন এ কারণে। এই যোদ্ধার সঙ্গে কথা শেষ হতে চায় না। গন্তব্যে পৌঁছে গেছি, তাই কথা শেষ করতেই হলো। তবে এটা বুঝতে বাকি রইল না—মোহাম্মদ খোকনের মনের জোর তাঁকে জীবনযুদ্ধে বাঁচিয়ে রেখেছে। তিনি পরাজয় বরণ করতে চান না। এক পায়ে চালিয়ে নেওয়া রিকশার মতো নিজেকে চালিয়ে নিয়ে যেতে চান বহু দূরে।
শারমিন নাহার

No comments

Powered by Blogger.