সিঙ্গুর কি হেরে যাবে? by সুনন্দন রায় চৌধুরী

সিঙ্গুর। শহর কলকাতার প্রাণকেন্দ্র থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে আধা গ্রাম-আধা নগর এলাকা। সিঙ্গুর। টাটা শিল্পগোষ্ঠীর উদ্যোগে নির্মীয়মাণ গাড়ি তৈরির কারখানা। এক লাখ টাকায় নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার উপযোগী ছোট গাড়ির স্বপ্ন দেখালেন রতন টাটা। সিঙ্গুর।


শিল্পায়নের অঙ্গীকারবদ্ধ সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অসীম উদ্যমে কৃষকের জমি অধিগ্রহণ করলেন। সিঙ্গুর। বহু চাষি জমি দিয়ে দেওয়ার পর অনিচ্ছুক চাষিদের নিয়ে জমি আন্দোলনে নামলেন পশ্চিমবাংলার বিরোধী রাজনীতির প্রধান নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ সবই ২০০৬-এর দ্বিতীয়ার্ধের কথা। তারপর হুগলি নদীর জল ঘোলা থেকে আরো ঘোলাটে হয়েছে। রতন টাটা এক লাখ টাকায় গাড়ি দিতে পারেননি। বুদ্ধদেব জমি অধিগ্রহণ করেছেন, গাড়ির কারখানা হয়নি, হয়নি পশ্চিমবাংলায় সিপিএম সরকারশাসিত শিল্পায়ন। মমতা গাড়ির কারখানার শ্মশানের ওপর নতুন মা-মাটি-মানুষের পশ্চিমবাংলা গড়বেন বলে ভোটে লড়েছেন। সিঙ্গুরের মানুষ অধিগৃহীত এক হাজার একর জমির দিকে তাকিয়ে আছেন হতাশ দৃষ্টিতে। তাঁদের কৃষিজমি গেল, ছোট গাড়ি এল না।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসভার নির্বাচন প্রায় শেষ হলো, তবে ফল প্রকাশ এখনো বাকি। সিঙ্গুরের চাষিরা যেমন আলু ফসল বছরে তিনবার ঘরে তোলেন, ভারতের রাজনীতিকরাও ভোটার নামক জমিতে চাষ করে ভোটের ফসল পাঁচ বছর অন্তর ঘরে তোলেন। এবারের পশ্চিমবাংলায় শাসক বামফ্রন্ট আর বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস জোটের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কে জেতে বলা কঠিন। বিরোধীদের পালে যে হাওয়া, তার শুরু সিঙ্গুরে। মমতার নেতৃত্বে পশ্চিমবাংলার বহু দল, গোষ্ঠী, ব্যক্তি সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এখন কেমন আছে_এই কথাটা ২০১১-এর সিঙ্গুরে কেউ কি জানে? কলকাতার সাংস্কৃতিক বলয়ের নন্দন সিনেমা হলে মুখ্যমন্ত্রীর নিত্য যাতায়াত। প্রগতিশীল পশ্চিমী চলচ্চিত্রের দর্শক তিনি। সেই নন্দন থেকে আমাদের গাড়িটা সোজা পশ্চিম দিকে চলল। উত্তর-পশ্চিমে। হুগলি নদীর ওপর নতুন বা চকচকে সেতু পেরিয়ে দিলি্ল যাওয়ার হাইওয়ে। কলকাতা থেকে পাঁচ-দশ কিলোমিটার গেলেই দুই ধারে ধানক্ষেত। মাঝেমধ্যে শিল্পায়নের গন্ধস্বরূপ দু-চারটি ফ্ল্যাট বাড়ির বিস্তীর্ণ প্রকল্প। কিছুটা এগোনোর পর রাস্তাটা প্রায় বিদেশি কায়দায় মসৃণ, মনে হয় না পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের রাস্তা। ঝকমকে রাস্তা দিয়ে ৩৫-৪০ কিলোমিটার এলে বাঁ দিকে টাটাদের ফেলে যাওয়া কারখানা। ৯৯৭ একর জমি, দেয়াল দিয়ে ঘেরা। বিশালাকার কারখানার শেড। ২০০৮-এর অক্টোবরে রতন টাটা যখন কারখানার কাজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল। এরপর সবই প্রায় শেষ হয়ে গেছে_কারখানা বন্ধ, বাংলায় গাড়ি তৈরির আশা রতন ছেড়ে দিয়েছেন, সিঙ্গুরের মানুষ উন্নত জীবনের আশাও ছেড়ে দিয়েছেন।
ফলের দোকানের গা ঘেঁষে পরপর আলু রাখার গুদাম। সিঙ্গুর সারা পশ্চিমবাংলাকে আলু জোগান দেয়। ভারতেরও নানা জায়গায় যায়। আলুর গুদামগুলো শেষ হতে একটা তিনতলা বাড়ি। বাড়ির ওপর বড় সাইনবোর্ড 'বার ও রেস্টুরেন্ট'। অবাক লাগল। পশ্চিমবাংলার গ্রামনগর এলাকায় মদ খাওয়ার পানশালা! ১০ বছর আগেও তো দেখিনি! শহরের বিলাসিতা গ্রামকে ছুঁয়েছে। মনটা দোটানায়। বাড়িটার মধ্যে ঢুকে বাড়ির মালিকের সঙ্গে দেখা। অনিন্দ্য কুণ্ডুর বয়স ৩০ পেরোয়নি। কেমন আছেন? বললেন, ভালো নেই, টাটাদের গাড়ির কারখানা হবে বলে জমি কিনেছিলেন। তিন কাঠা জমির ওপর প্রথমে দোতলা, তার পরে আবার একটা তলা তুলেছেন। একতলায় বার-রেস্তোরাঁ, ওপরের তলায় আবাসিকদের ঘর ভাড়া দেন। ২০০৬, ২০০৭, ২০০৮-এ টাটাদের সময়ে একটা ঘর থেকে ভাড়া পেতেন তিন হাজার টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার টাকা রোজগার প্রতি মাসে। এখন সেটা নেমে এসেছে চার কি বড়জোর পাঁচ হাজারে।
গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে সিঙ্গুর স্টেশন যাই। গন্তব্য সিপিএমের সুসজ্জিত পার্টি অফিস। লোকজনে গমগম করছে। লাল পতাকার পাশাপাশি লাল প্লাস্টিকের চেয়ার। ১২-১৪ জন কমরেড। সবাইকেই তো মধ্যবিত্ত মনে হয়। কৃষক এবং শ্রমিকদরদি নিশ্চয়ই। একজন বয়স্ক কমরেড হুগলি জেলা কৃষক সভার সহসভাপতি। বলাই সামুই। বোঝালেন তাঁদের অবস্থান। ৯৯৭ একর জমির মালিকানা ছিল প্রায় ১৪ হাজার কৃষকের। টাটার কাছে জমি বিক্রি করেছে সরকার। সরকার নিয়মমাফিক নোটিশ দিয়েছে। ১৩ হাজার চাষি স্বেচ্ছায় জমি দিয়েছেন। তাঁরা যখন ব্লক অফিস থেকে চেক নিতে গেছেন, মমতার দল চেক নিতে বাধা দিয়েছে। অনিচ্ছুক চাষিদের নিয়ে হঠকারী আন্দোলন করেছে। হাইওয়ের পথের ধারে একটা মিষ্টির দোকানে দাঁড়ালাম। মিষ্টির দোকানের মালিক মুখ খুলবেন না। অন্য একজন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ভদ্রলোক জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত। এক মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। টুথপেস্ট, সাবান_এসবের পাইকারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বাইকে চড়ে ঘুরে ঘুরে মাল জোগান দেন। কারখানা হলে কি ভালো হতো? বললেন, হয়তো হতো। বললেন, ওরা জমি আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু জমি আন্দোলনের ফসল তৃণমূলের কাছাকাছি পরিবাররা পেয়েছে, পেয়েছে রেল কম্পানির চাকরি, সিঙ্গুরের সাধারণ মানুষ পায়নি। টাটার কারখানা নিয়ে, সিঙ্গুর নিয়ে রাজনীতির ময়দানে ফুটবল খেলা হয়েছে। মানুষ নির্বাক দর্শক হয়ে দেখেছে। পরেশ দাশের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আবার পরিত্যক্ত কারখানার দেয়ালের পাশে এসে দাঁড়ালাম। কারখানার বিরাট প্রান্তরে কোথাও কোথাও কাশ গজিয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীর কথা মনে পড়ে গেল। কাশবনের মধ্য দিয়ে অপু-দুর্গা রেলগাড়ি দেখছে। সিঙ্গুরের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অপু-দুর্গারা রাজনীতির হাজার একরের ফুটবল মাঠের মধ্য দিয়ে উঁকি মেরে দেখবে এক নতুন মুখ্যমন্ত্রী, একটা না হওয়া গাড়ি। ফুটবল খেলায় দুই দলই জয়ী_লাল ও সবুজ। কিন্তু সিঙ্গুর কি হেরে যাবে?
লেখক : সাংবাদিক ও প্রকাশক, কলকাতা

No comments

Powered by Blogger.