লন্ডনে দাঙ্গা-সামাজিক বৈষম্যের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রকাশ by সুভাষ সাহা
লন্ডনে গত বৃহস্পতিবার পুলিশের গুলিতে ২৯ বছরের এক যুবকের মৃত্যু হলো। আমাদের পুলিশের মতো লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশও তাদের সঙ্গে গুলিবিনিময়ের সময় ওই ব্যক্তি মারা যায় বলে দাবি করেছিল। কিন্তু তাদের সেই দাবি ধোপে টেকেনি।
স্বভাবতই এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সেখানকার তরুণ-যুবাদের মধ্যে বিক্ষোভ সঞ্চারিত হয়ে থাকবে। তারা এ ঘটনার প্রতিবাদে দু'দিন পর রাস্তায় মিছিল বের করেছিল। মিছিলটি প্রথমদিকে একেবারেই শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু এই শান্তিপূর্ণ মিছিলই কিছুক্ষণ পর উগ্রমূর্তি ধারণ করে সহিংস হয়ে উঠল। প্রাইভেট কার, দোকান, বাড়ির ক্ষতিসাধন, লুটপাট, অগি্নসংযোগ চলল অবাধে। সেই থেকে শুরু হয়ে এটি এখন নটিংহ্যাম ছাড়িয়ে বার্মিংহ্যাম, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার, ব্রিস্টলে বিস্তৃত হয়েছে। সহিংসতার এই ধারা ইংল্যান্ডের কোন পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হয় তা কেউই হলফ করে বলতে পারছেন না। বলা যায়, এখন একদিকে সহিংস দরিদ্র ও কর্মহীন তরুণ-যুবশক্তি চরম ক্রোধে সবকিছু তছনছ করে দিতে উদ্যত, অন্যদিকে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সমাজের উপরতলার মুষ্টিমেয় মানুষ তাদের অর্জিত ধনসম্পদ ও ক্ষমতা রক্ষায় দিশেহারার মতো আচরণ করছে। সরকার এটাকে সমাজের একশ্রেণীর উচ্ছৃঙ্খল যুবকের লুটেরা ও আইন অমান্যের মানসিকতাপ্রসূত বলে দাবি করলেও বিদ্যুৎগতিতে সহিংসতা ও লুটপাট একের পর এক ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা সামাজিক দুষ্ট ব্যামোকেই কি নির্দেশ করছে না!
মার্কিন রেটিং এজেন্সি মোদি অবশ্য আরও এক বছরেরও বেশি সময় আগে গত বছরের মার্চে বিশ্বের পাঁচটি ট্রিপল-এ রেটেড দেশের ক্রমবর্ধমান ঋণ ও রাজস্ব ঘাটতি হ্রাসের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় সংকোচন নীতি কার্যকর করতে গিয়ে দেশগুলোর সামাজিক স্থিতি ও সম্প্রীতি হুমকিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিল। ওই পাঁচটি দেশের মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স ও স্পেন। লন্ডনের চলমান ঘটনাবলি কি তার প্রমাণ নয়!
এসব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাটা কী এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে সরকারগুলোকে কীভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি ও সামাজিক নানা সুবিধা কাটছাঁট করে ব্যয় সংকোচন করতে হচ্ছে তা তো এখন বিশ্ব অর্থনীতি সম্পর্কে যারা সামান্য খোঁজখবর রাখেন তাদের অজ্ঞাত নয়।
এখন মার্কিন অর্থনীতির বেহাল দশাটা বারাক ওবামার জাদুকরী বক্তৃতা-বিবৃতিও ঢেকে রাখতে পারছে না। বিশ্বের পহেলা নম্বরের শক্তির এহেন দুর্দশা তারই অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুগামী ব্রিটেনের নাজুক অবস্থাকে আরও নাজুক করে তুলবে নিশ্চয়ই। ব্রিটিশ অর্থনীতি ইতিমধ্যেই দীর্ঘস্থায়ী মন্দার ফাঁদে আটকা পড়ে হাঁসফাঁস করছে। তারাও মার্কিন অর্থনীতির মতো এক কঠিন সংকটকাল অতিক্রম করছে। এখানে বেকার সমস্যা সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে ৪০ বছরের কম বয়সী চাকরিপ্রত্যাশী এবং কর্মরতদের। যাদের চাকরি ছিল তাদের একটি বিরাট অংশ রাতারাতি কর্মহীন হয়ে পড়ল এবং যারা চাকরিপ্রত্যাশী তাদের জন্যও নতুন চাকরির বাজার সংকুচিত হয়ে গেল। অন্যদিকে ক্যামেরনের নেতৃত্বাধীন টোরি-লিবারেল ডেমোক্র্যাট কোয়ালিশন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেওয়া সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে সংকুচিত করে ফেলায় শিশু, বয়স্ক থেকে শুরু করে সমাজের মধ্যবিত্ত স্তর পর্যন্ত সব শ্রেণীর মানুষকে কষ্টকর অনিশ্চিত ভবিষ্যতে নিক্ষেপ করে। দেশে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি বৃদ্ধির সরকারি ঘোষণা থেকেই এর কিঞ্চিৎ প্রমাণ পাওয়া যায়। তখন সাধারণ পড়ূয়ারা এর বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডজুড়ে কী ধরনের প্রতিবাদ-বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে আসে তা টিভি ও সংবাদপত্রের কল্যাণে সবাই জেনে থাকবেন। তখন সরকার তাদের সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে। তারা পুলিশ দিয়ে ছাত্রদের ঠেঙিয়ে আপাতত বিক্ষোভকে আঁতুড়ঘরেই স্তব্ধ করে দিতে পেরেছেন বলে মনে করে থাকবেন। তাছাড়া ব্রিটেনের মতো একটা নিয়মানুবর্তী দেশে বিক্ষোভ আর কতদূরই-বা যেতে পারবে_ এমন একটা ভাব শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে জাগ্রত হয়ে থাকবে। কিন্তু ব্রিটেনের সামাজিক শ্রেণীগুলো যে ভেতরে ভেতরে তেতে উঠেছে তা তারা ঠাহর করে উঠতে পারেননি। হয়তো ভেবেছেন লৌহমানবী থ্যাচার যখন শ্রমিক-কর্মচারী আন্দোলনকে চাকরিচ্যুতির দাওয়াই প্রয়োগ করে সফল হয়েছিলেন তখন তার উত্তরসূরি কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনও যে কোনো আন্দোলনকে সামাল দিতে পারবেন। কিন্তু তীব্র সামাজিক শ্রেণী-বৈষম্য থেকে জন্ম নেওয়া ক্ষোভের প্রশমন হবে কী করে?
ব্রিটেনে বড়লোকদের আরও সম্পদশালী হওয়ার বিপরীতে সর্বনিম্ন আয়ের লোকেদের আয় হ্রাস পাওয়ার অবস্থা বড় রকমের সামাজিক বৈষম্যের জন্ম দেয়। শুধু তাই নয়, বিশ্ব ও স্বদেশের চরম আর্থিক সংকটের মধ্যেও বিত্তবানদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সত্যিই স্তম্ভিত হওয়ার মতো। আর রাজনৈতিক দলের সরকারগুলো বিত্তবানদের চেয়ে বেশি হারে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর কর হার বৃদ্ধি করে নিজেদের বিত্তবানদের তল্পিবাহক ও তাদের সারিভুক্ত প্রমাণ করে। এতে প্রচলিত রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা অনেক কমে যায়। এ অবস্থায় লন্ডনে যে হিংসার আগুন প্রজ্বলিত হয়েছে সরকার ও রাজনৈতিক নেতাদের আবেদন বা আহ্বানে তা সহজে নিভবার নয়। এ কারণেই শেষ পর্যন্ত রায়ট পুলিশের সংখ্যাবৃদ্ধি করে উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের একটি সরকারকে অর্ডার প্রতিষ্ঠার কসরত করতে হচ্ছে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক রোডনি বারকারের মতে, ইরান বা সিরিয়া অথবা যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেন_ যেখানেই জনবিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছে সেখানেই সরকারগুলো এটাকে বিক্ষোভকারীদের একটা ক্ষুদ্র গ্রুপ, অপরাধী ব্যক্তিবর্গ, সন্ত্রাসীদের কাজ বলে প্রায় একই ভাষায় চিত্রিত করার প্রয়াস পায়। তবে এটা আসলে অপরাধীদের ষড়যন্ত্র নয়। যে কোনো নাগরিক বিক্ষোভে জনগণের সব অংশেরই উদ্দেশ্যভিত্তিক অংশগ্রহণ থাকে। বৃহস্পতিবার একজনের নিহত হওয়ার ঘটনাটি ছিল জনমনে ধূমায়িত ক্ষোভ বিক্ষোভে পরিণত হয়ে ফেটে পড়ার উপলক্ষ মাত্র। মন্দার সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচন নীতি মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। অধ্যাপক বারকারের বক্তব্যে আংশিক সত্য প্রকাশ পেয়েছে মাত্র। দীর্ঘদিন ধরে চলা ধনী-দরিদ্র্রের আয় ব্যবধান বৃদ্ধি পাওয়া এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর ধনী তোষণ নীতির কারণে মানুষের মধ্যে সামাজিক শ্রেণী-বৈষম্য চেতনাও বৈরী অবস্থানে চলে গেছে। অথচ শ্রেণী চেতনাকে ইতিবাচক পথে গাইড করার মতো শক্তি সেখানে নেই। এ কারণেই তার বিকৃত প্রকাশ আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন ভালো ভালো দোকানপাট, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং সুন্দর বাড়িঘর লুটপাট ও অগি্নসংযোগের ঘটনায়।
বর্তমানে ব্রিটেনের অর্থনীতির যে হাল তাতে অন্তত দেড় থেকে দুই দশক লেগে যেতে পারে তাদের অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে। তাদের হাতে তো আর আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ বা গৌরী সেনের বিরাট অর্থভাণ্ডার নেই যে তারা তাদের এই মন্দা থেকে উদ্ধার করতে পারবে। সুতরাং ভবিষ্যতে আরও অনেক দাঙ্গা-হাঙ্গামা আমাদের মাঝে মধ্যেই দেখতে হতে পারে। তবে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করার থ্যাচারীয় নীতি নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এমনকি বিশ্বে অগ্রগামী গণতান্ত্রিক দেশের প্রতিষ্ঠিত মর্যাদাটিও ভূলুণ্ঠিত হতে পারে।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
subashsaha@gmail.com
মার্কিন রেটিং এজেন্সি মোদি অবশ্য আরও এক বছরেরও বেশি সময় আগে গত বছরের মার্চে বিশ্বের পাঁচটি ট্রিপল-এ রেটেড দেশের ক্রমবর্ধমান ঋণ ও রাজস্ব ঘাটতি হ্রাসের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় সংকোচন নীতি কার্যকর করতে গিয়ে দেশগুলোর সামাজিক স্থিতি ও সম্প্রীতি হুমকিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিল। ওই পাঁচটি দেশের মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স ও স্পেন। লন্ডনের চলমান ঘটনাবলি কি তার প্রমাণ নয়!
এসব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাটা কী এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে সরকারগুলোকে কীভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি ও সামাজিক নানা সুবিধা কাটছাঁট করে ব্যয় সংকোচন করতে হচ্ছে তা তো এখন বিশ্ব অর্থনীতি সম্পর্কে যারা সামান্য খোঁজখবর রাখেন তাদের অজ্ঞাত নয়।
এখন মার্কিন অর্থনীতির বেহাল দশাটা বারাক ওবামার জাদুকরী বক্তৃতা-বিবৃতিও ঢেকে রাখতে পারছে না। বিশ্বের পহেলা নম্বরের শক্তির এহেন দুর্দশা তারই অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুগামী ব্রিটেনের নাজুক অবস্থাকে আরও নাজুক করে তুলবে নিশ্চয়ই। ব্রিটিশ অর্থনীতি ইতিমধ্যেই দীর্ঘস্থায়ী মন্দার ফাঁদে আটকা পড়ে হাঁসফাঁস করছে। তারাও মার্কিন অর্থনীতির মতো এক কঠিন সংকটকাল অতিক্রম করছে। এখানে বেকার সমস্যা সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে ৪০ বছরের কম বয়সী চাকরিপ্রত্যাশী এবং কর্মরতদের। যাদের চাকরি ছিল তাদের একটি বিরাট অংশ রাতারাতি কর্মহীন হয়ে পড়ল এবং যারা চাকরিপ্রত্যাশী তাদের জন্যও নতুন চাকরির বাজার সংকুচিত হয়ে গেল। অন্যদিকে ক্যামেরনের নেতৃত্বাধীন টোরি-লিবারেল ডেমোক্র্যাট কোয়ালিশন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেওয়া সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে সংকুচিত করে ফেলায় শিশু, বয়স্ক থেকে শুরু করে সমাজের মধ্যবিত্ত স্তর পর্যন্ত সব শ্রেণীর মানুষকে কষ্টকর অনিশ্চিত ভবিষ্যতে নিক্ষেপ করে। দেশে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি বৃদ্ধির সরকারি ঘোষণা থেকেই এর কিঞ্চিৎ প্রমাণ পাওয়া যায়। তখন সাধারণ পড়ূয়ারা এর বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডজুড়ে কী ধরনের প্রতিবাদ-বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে আসে তা টিভি ও সংবাদপত্রের কল্যাণে সবাই জেনে থাকবেন। তখন সরকার তাদের সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে। তারা পুলিশ দিয়ে ছাত্রদের ঠেঙিয়ে আপাতত বিক্ষোভকে আঁতুড়ঘরেই স্তব্ধ করে দিতে পেরেছেন বলে মনে করে থাকবেন। তাছাড়া ব্রিটেনের মতো একটা নিয়মানুবর্তী দেশে বিক্ষোভ আর কতদূরই-বা যেতে পারবে_ এমন একটা ভাব শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে জাগ্রত হয়ে থাকবে। কিন্তু ব্রিটেনের সামাজিক শ্রেণীগুলো যে ভেতরে ভেতরে তেতে উঠেছে তা তারা ঠাহর করে উঠতে পারেননি। হয়তো ভেবেছেন লৌহমানবী থ্যাচার যখন শ্রমিক-কর্মচারী আন্দোলনকে চাকরিচ্যুতির দাওয়াই প্রয়োগ করে সফল হয়েছিলেন তখন তার উত্তরসূরি কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনও যে কোনো আন্দোলনকে সামাল দিতে পারবেন। কিন্তু তীব্র সামাজিক শ্রেণী-বৈষম্য থেকে জন্ম নেওয়া ক্ষোভের প্রশমন হবে কী করে?
ব্রিটেনে বড়লোকদের আরও সম্পদশালী হওয়ার বিপরীতে সর্বনিম্ন আয়ের লোকেদের আয় হ্রাস পাওয়ার অবস্থা বড় রকমের সামাজিক বৈষম্যের জন্ম দেয়। শুধু তাই নয়, বিশ্ব ও স্বদেশের চরম আর্থিক সংকটের মধ্যেও বিত্তবানদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সত্যিই স্তম্ভিত হওয়ার মতো। আর রাজনৈতিক দলের সরকারগুলো বিত্তবানদের চেয়ে বেশি হারে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর কর হার বৃদ্ধি করে নিজেদের বিত্তবানদের তল্পিবাহক ও তাদের সারিভুক্ত প্রমাণ করে। এতে প্রচলিত রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা অনেক কমে যায়। এ অবস্থায় লন্ডনে যে হিংসার আগুন প্রজ্বলিত হয়েছে সরকার ও রাজনৈতিক নেতাদের আবেদন বা আহ্বানে তা সহজে নিভবার নয়। এ কারণেই শেষ পর্যন্ত রায়ট পুলিশের সংখ্যাবৃদ্ধি করে উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের একটি সরকারকে অর্ডার প্রতিষ্ঠার কসরত করতে হচ্ছে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক রোডনি বারকারের মতে, ইরান বা সিরিয়া অথবা যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেন_ যেখানেই জনবিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছে সেখানেই সরকারগুলো এটাকে বিক্ষোভকারীদের একটা ক্ষুদ্র গ্রুপ, অপরাধী ব্যক্তিবর্গ, সন্ত্রাসীদের কাজ বলে প্রায় একই ভাষায় চিত্রিত করার প্রয়াস পায়। তবে এটা আসলে অপরাধীদের ষড়যন্ত্র নয়। যে কোনো নাগরিক বিক্ষোভে জনগণের সব অংশেরই উদ্দেশ্যভিত্তিক অংশগ্রহণ থাকে। বৃহস্পতিবার একজনের নিহত হওয়ার ঘটনাটি ছিল জনমনে ধূমায়িত ক্ষোভ বিক্ষোভে পরিণত হয়ে ফেটে পড়ার উপলক্ষ মাত্র। মন্দার সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচন নীতি মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। অধ্যাপক বারকারের বক্তব্যে আংশিক সত্য প্রকাশ পেয়েছে মাত্র। দীর্ঘদিন ধরে চলা ধনী-দরিদ্র্রের আয় ব্যবধান বৃদ্ধি পাওয়া এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর ধনী তোষণ নীতির কারণে মানুষের মধ্যে সামাজিক শ্রেণী-বৈষম্য চেতনাও বৈরী অবস্থানে চলে গেছে। অথচ শ্রেণী চেতনাকে ইতিবাচক পথে গাইড করার মতো শক্তি সেখানে নেই। এ কারণেই তার বিকৃত প্রকাশ আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন ভালো ভালো দোকানপাট, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং সুন্দর বাড়িঘর লুটপাট ও অগি্নসংযোগের ঘটনায়।
বর্তমানে ব্রিটেনের অর্থনীতির যে হাল তাতে অন্তত দেড় থেকে দুই দশক লেগে যেতে পারে তাদের অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে। তাদের হাতে তো আর আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ বা গৌরী সেনের বিরাট অর্থভাণ্ডার নেই যে তারা তাদের এই মন্দা থেকে উদ্ধার করতে পারবে। সুতরাং ভবিষ্যতে আরও অনেক দাঙ্গা-হাঙ্গামা আমাদের মাঝে মধ্যেই দেখতে হতে পারে। তবে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করার থ্যাচারীয় নীতি নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এমনকি বিশ্বে অগ্রগামী গণতান্ত্রিক দেশের প্রতিষ্ঠিত মর্যাদাটিও ভূলুণ্ঠিত হতে পারে।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
subashsaha@gmail.com
No comments