অভিমত ॥ প্রাইভেট কোচিং বন্ধে সরকারী উদ্যোগ! by অমিত রায় চৌধুরী

নকলকে প্রশ্রয় দিয়ে ও শিক্ষাঙ্গনে মেধাবী শিক্ষকদের নিরুৎসাহিত করে নিকট অতীতের অনির্বাচিত সরকারগুলো শিক্ষার মতো একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি উদাসীনতা প্রকাশ করে প্রজন্মকে অন্তঃসারশূন্য করে রাখার ঝুঁকি নিয়েছিল; যার মাসুল এখন চড়ামূল্যে জাতিকে দিতে হচ্ছে।


গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয় হওয়ার সাথে সাথে নকল বন্ধে সরকারের উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে, ফলও হয়েছে। তদানীন্তন সরকারগুলো সমাজের কাছে দায়বদ্ধ না থাকায় শিক্ষাঙ্গনে উদ্ভূত সমস্যাগুলো সমাধানে কোন প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হয়নি। এসব সমস্যা মোকাবেলায় ধৈর্য ও সময়ের প্রয়োজন হয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নির্ভীকতারও দরকার হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের বৈষয়িক উন্নতির পাশাপাশি মূল্যবোধ অবক্ষয়ের প্রবণতা স্পষ্টভাবে অনুভূত হচ্ছে। “সর্বনিম্ন সময় ও বিনিয়োগে সর্বোচ্চ মুনাফা লাভ” এই নীতি জনপ্রিয় হয়েছে। স্বার্থপরতা, উচ্চাভিলাষ ও দুর্নীতিপরায়ণতা সমাজের প্রায় সকল ক্ষেত্রকে কলুষিত করেছে। তাৎক্ষণিক লাভের আশায় পদস্থ ব্যক্তিবর্গ দুর্নীতি করেছেন, ব্যবসায়ী খাদ্যে ও ওষুধে ভেজাল দিচ্ছেন, পেশাজীবীরা নৈতিকতার বেড়া টপকে অর্থান্বেষণে বেপরোয়া, শিক্ষার্থীও ন্যূনতম সময়ে স্বল্পায়াশে গ্রেড অর্জন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে সময় দরকার, সাহসী উদ্যোগ দরকার, সমস্যার গভীরে যাওয়া দরকার।
শ্রেণীপাঠভিত্তিক লেখাপড়ার পাশাপাশি গৃহশিক্ষকতা আমাদের সমাজে অপরিচিত নয়। শিক্ষার্থীর মেধা, চাহিদা ও অভিভাবকের সামর্থ্যÑএ দু’টি অনুষঙ্গের সাথে এ সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক পাঠদান ব্যবস্থাপনারও হয়ত সীমাবদ্ধতা ছিল। গ্রাম থেকে মফঃস্বল শহর, শহর থেকে মহানগর-গৃহশিক্ষকতার স্বরূপ ও এর বিস্তারে তারতম্য ছিল। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করেনি, শিক্ষক ক্লাসে পাঠদান করেনি; এমন কথা কদাচিৎ শোনা গেছে। খুব দুর্বল অথবা ভাল ছাত্ররা তাদের প্রয়োজনে গৃহশিক্ষকের শরণাপন্ন হতো, আর গৃহশিক্ষকও তার নৈতিক সীমানার মধ্যে থেকে তাকে সাহায্য করত। এসব খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। তবে একথা ঠিক, অভিভাবকরা যে অংশের সামর্থ্য ছিল না তারা অনেকাংশে পিছিয়েই পড়েছে। আবার শহরভিত্তিক বিত্তবানেরা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেধাবী ছাত্র অথবা নামী শিক্ষকদের বাড়িতে নিয়ে নিজের সন্তানদের সম্পূর্ণ আলাদাভাবে প্রস্তুত করতেন। প্রয়োজনে দেশের বাইরে নিয়ে গিয়েও। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান যত দ্রুত বেড়েছে এ সমস্যার ততই বিস্তৃতি ঘটেছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সামর্থ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ মননে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। একজন নিরক্ষর শ্রমিক, মেহনতি কৃষক, এমনকি একজন পরিচ্ছন্ন কর্মীও তার সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার জন্য সামর্থ্য উজাড় করতে তৈরি হয়েছে। বিত্তবানের কথা তো আগেই বলেছি। তার চাহিদার সঙ্গে বরং যোগ হয়েছে বিত্তের দাপট! তিনি তাবত ভাল শিক্ষকদের অকল্পনীয় মূল্যে তার বাসভবনে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের তরুণ শিক্ষকদের মাঝে বিত্ত অর্জনের সহজ পথ আবিষ্কৃত হচ্ছে। তিনি ক্রমশ তার আকাক্সক্ষার পরিধি বাড়িয়ে চলেছেন। একজন বা পাঁচজনের গৃহশিক্ষকতা চল্লিশ পঞ্চাশ এমনকি আশিজনের বিস্তৃতি লাভ করছে। শ্রেণীকক্ষ ফাঁকা, শিক্ষার্থী অনেকটা বাধ্য হয়েই ছুটছে গৃহশিক্ষকের কাছে। গড়ে উঠছে কোচিং সেন্টার। ভর্তি কিংবা পাবলিক পরীক্ষার প্রস্তুতি সবখানে এদের সমান আধিপত্য। এই দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে আমজনতা যার সামর্থ্য নেই। রাষ্ট্র এটা দেখবেÑ এটা সকলেই আশা করে।
অভিভাবকরাও আজ হয়ত দ্বিধান্বিত। হয়ত খানিকটা দিশেহারা। খুব স্বাভাবিকভাবে গৃহশিক্ষকের তাৎক্ষণিক অভাবে শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার গড়ার রোডম্যাপ বিপন্ন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্প্রতি প্রজ্ঞাপিত নীতিমালায় ছাত্রী-অভিভাবকের এই চাহিদাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত ক্লাসের যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার করতে হবে। প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক আন্তরিক হলে তাঁদের দুঃশ্চিন্তার কোন কারণ থাকতে পারেÑ আমি এটা বিশ্বাস করি না। একটি পুরনো সমস্যা মানুষের মনের গভীরে স্থান করে নেয় ফলে দৃষ্টিভঙ্গি ও মানস কাঠামোর পরিবর্তন প্রয়োজন। ক্লাসরুমগুলোকে প্রয়োজন মোতাবেক ব্যবহার করা গেলে এবং শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করে মেধাবী ও নিবেদিত শিক্ষকদের এ পেশায় নিয়ে আসা গেলে এই সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে উঠবে। শিক্ষক যদি সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ পান, তবে কেন তিনি তাঁর সন্তানতুল্য ছাত্রছাত্রীর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে কুণ্ঠাবোধ করবেন? আমাদের অতীত ও ঐতিহ্য সে ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল।
আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি নকল যখন বন্ধ হয়েছে, জনস্বার্থে কোচিং বাণিজ্যেরও অবসান ঘটবে। তবে তার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী জনমত গঠন, জাতীয় ঐকমত্য ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতা। শুধু স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠানবহির্ভূত বা অন্য কোন লাভজনক কাজে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা নয়, চিকিৎসক ও আইনজীবীদের জন্যও নীতিমালা প্রণয়ন জরুরী বলে মনে হয়। সর্বোপরি একজন শিক্ষার্থী শিক্ষা সমাপ্ত করে যাতে তার যোগ্যতার ভিত্তিতে বৃত্তি নির্বাচন করতে পারে এবং কোন অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপে যেন ঐ মেধাবী ও যোগ্য চাকরিপ্রার্থী ছিটকে পড়তে না পারে সে নিশ্চয়তা সমাজ ও রাষ্ট্রকেই দিতে হবে। আর তাহলেই নকল ও কোচিং বন্ধ করাসহ শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের সকল সাধু উদ্যোগ সফল হবে। সকল অসুন্দর ও অশুভের বিরুদ্ধে সত্য ও সুন্দরের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এ জাতিরাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও শক্তি এখানেই নিহিত।

লেখক : অধ্যক্ষ ফকিরহাট ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ, বাগেরহাট

No comments

Powered by Blogger.