মনের কোণে হীরে-মুক্তো-বেরোখা দুর্বৃত্তদের বেপরোয়া আচরণে সুস্থ নাগরিকরা উদ্বিগ্ন by ড. সা'দত হুসাইন
দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিদিন বেশ কয়েকটি খবরের কাগজ পড়া আমার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের খবরের কাগজের ভালো গুণ হচ্ছে যে নিয়মিত কয়েকটি কাগজ অভিনিবেশ সহকারে পড়লে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক পরিবৃত্তসহ অন্য সব সেক্টর সম্বন্বে একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য মানের পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া যায়।
গভীরভাবে দেখলে, ভবিষ্যৎ ঘটনাবলির আভাসও চোখে পড়ে। বিশ্লেষণ করলে এদের গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধেও মোটামুটি একটা ধারণা মেলে। সাংবাদিক ও কলামিস্টরা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, ইশারা-ইঙ্গিতে অনেক তথ্য সরবরাহ করেন, যার ভিত্তিতে বুদ্বিমান লোক ভবিষ্যতের অর্থবহ রূপকল্প বিনির্মাণ করতে পারে। কৌশল নির্ধারণ করতে পারে। কোনো অশনিসংকেত থাকলে সাংবাদিকের প্রতিবেদন এবং কলামিস্টের সংলেখে তার ছায়া ভেসে আসে।
গত কয়েক মাসের প্রতিবেদন, তথ্যচিত্র, উপসম্পাদকীয় কলাম ও নিবন্বূ পর্যালোচনা করে আমি সমাজদেহে একটি মারাত্মক সমস্যার ভ্রূণ দেখতে পাচ্ছি। বিষয়টি সরকারের, কোনো রাজনৈতিক দলের, প্রশাসনযন্ত্রের, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, কোনো পেশাগত গোষ্ঠীর কিংবা কোনো সম্প্রদায়ের একার সমস্যা নয়। সমস্যাটিকে আমি পুরো দেশের এবং গোটা সমাজের সমস্যা হিসেবে দেখতে পাচ্ছি। এর অভিঘাত তাই দেশের আপামর নাগরিকের ওপর পড়বে বলে আশঙ্কা করছি।
উপমহাদেশের এতদঞ্চলে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক এলাকায় হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ বা বড় ধরনের অর্থনৈতিক অপরাধ ছিল না এমন কথা বলা যাবে না। তবে তার পরিমাণ যে অত্যন্ত সীমিত ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্ততপক্ষে গত ৫০-৬০ বছরের অপরাধের সাধারণ চিত্র আমার চোখের সামনে স্পষ্টভাবে ভেসে আছে। খুব অল্প বয়স থেকে আমি খবরের কাগজ পড়ি। জঘন্য প্রকৃতির অপরাধের খবর কালেভদ্রে চোখে পড়ত। আমি যে শহরে বড় হয়েছি, সেখানে যত দূর মনে পড়ে, ১০ বছরে একটি হত্যার ঘটনা ঘটেছিল। শহরে যুবকদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে মারামারি হতো। এসব মারামারিতে ছুরি ও লাঠি ব্যবহৃত হতো। যারা আহত হতো তাদের শহরের হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হতো। ফুটবল খেলার মাঠে লম্বা লম্বা আখ ব্যবহার করে বিভিন্ন টিমের সমর্থকদের মধ্যে মারামারি হতো। শহরতলির গ্রুপগুলো এসব মারামারিতে বেশি পটু ছিল। তাদের একটা হাটুরে বৈশিষ্ট্য ছিল। গ্রাম বা পাড়ার প্রায় সব বাসিন্দা এসব মারামারিতে অংশ নিত। ওই পর্যন্তই। আমি এসব মারামারিতে কখনো খুনখারাবির ঘটনা ঘটতে দেখিনি। ঢাকায় এসে ছাত্ররাজনীতিভিত্তিক অনেক মারামারি দেখেছি। হকিস্টিক, লাঠি, ছুরি এবং ক্ষীণশক্তির হাতবোমার মধ্যে এসব মারামারি সীমিত ছিল। তবে মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন এনএসএফের সমর্থক খোকা, পাঁচপাততু এবং আনোয়ার আনসারীর কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল বলে শুনেছি। ব্যবহার করতে দেখিনি। আমাদের ছাত্রজীবনের জঘন্যতম ঘটনা হলো এনএসএফের কতিপয় গুণ্ডা ছাত্র কর্তৃক সে যুগের প্রখ্যাত শিক্ষক-বুদ্বিজীবী ড. আবু মাহমুদকে লাঠি এবং হকিস্টিকের আঘাতে মারাত্মক আহত করা। প্রাক-স্বাধীনতাকালে ছাত্ররাজনীতির তথা ঢাকা শহরের এটি ছিল সবচেয়ে নিন্দনীয় ঘটনা। অবশ্য এনএসএফের গুণ্ডা অর্থাৎ খোকা পাঁচপাততুর দল ঢাকা হলে নিয়ে মেয়েদের নির্যাতন করত বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাম্প্রতিককালে সারা দেশে অপরাধীদের নৃশংসতা এক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। শিশু এবং নারীর ওপর এ নৃশংসতা বেশি প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। নিরীহ প্রাণী এবং গাছপালাও নৃশংসতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ডাকাতি করতে গিয়ে আট মাসের শিশুকে অপহরণ করা হচ্ছে, চার-পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে, গরিব তরুণীকে অর্থ এবং প্রেমের লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ করে শুধু হত্যাই নয়, তার দেহকে ছাবি্বশ টুকরো করে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে, শুধু টাকা আর সম্পত্তির লোভে মাকে বেঁধে রেখে তাঁর সামনে যুবতী মেয়েকে হত্যা করা হচ্ছে, কচি শিশুকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চাওয়া হচ্ছে- না পেলে তাদের মেরে ফেলা হচ্ছে। যুগ যুগ ধরে যে গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর নুন খেয়ে জীবনধারণ করেছে, অর্থের লোভে তাঁদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হচ্ছে। শত্রুতাবশত খামারের হাঁস-মুরগি, পুকুরের মাছ বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। বিস্তীর্ণ বাগানের এত সুন্দর গাছ নিষ্ঠুরভাবে কেটে ফেলা হচ্ছে। এসব কাজ করতে দুর্বৃত্তরা যেন পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে।
এবার অর্থনৈতিক অপরাধের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। আর্থিক লাভের লোভ এ সেক্টরের অপরাধীদের যেন অন্ধ করে ফেলছে। রাষ্ট্রীয় বিবেচনা, সামাজিক বিবেচনা কিংবা অসহায় মানুষের বিবেচনা- কিছুই তাদের আর্থিক অপরাধ থেকে বারিত করতে পারছে না। অতিমাত্রায় লাভ তাদের করতেই হবে। ধনী তাদের হতেই হবে। পত্রিকার খবরে দেখা যায় যে ব্যবসায়ীরা এক শ হারে লাভ করে জিনিস বিক্রি করে। আমি নিজেও দেখেছি, কারওয়ান বাজারে এক শ গজের ব্যবধানে শাকসবজির দাম তিন শ হার বাড়িয়ে খুচরা দোকানে বিক্রি করা হয়। কয়েক মাসের মধ্যে এসব খুচরা ব্যবসায়ী ফুলে-ফেঁপে ধনী ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়। সাধারণ ক্রেতার কষ্টের সীমা থাকে না। এখন দেখা যাচ্ছে, ব্যবসায়ীরা প্রতি সপ্তাহে ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে দেয়। কাঁচামালের দাম কমে যাওয়ার পরও বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প তাদের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় অথবা বাড়ানো দাম কমায় না। শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের নির্দেশও তারা মানে না। এমনই বেরোখা ভাব। সম্প্রতি ওষুধ ব্যবসায়ীরা এক পক্ষের ব্যবধানে ওষুধের দাম দুবার বাড়িয়ে দিয়েছে। অসুস্থ মানুষের সীমিত আয় এবং কষ্টের কথা একবারও বিবেচনায় আনেনি।
সমাজের অন্যান্য পরিবৃত্তেও এরূপ বেপরোয়া, বেরোখা আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রশাসনিক বিধিনিষেধ কেউ মানতে চাচ্ছে না। পত্রিকার খবরে দেখতে পাচ্ছি, ৩৮০টি ড্রাইভিং স্কুলের মধ্যে ৩১১টিই অবৈধ। লাখ লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স ভুয়া। সিএনজি-চালক কিংবা ক্যাব ড্রাইভার মিটারে চালানোর ব্যাপারে বিআরটিএর আদেশের কোনো তোয়াক্কা করছে না। মাদক ব্যবসায়ীদের তাদের দুষ্কর্ম থেকে কোনো মতেই বিরত করা যাচ্ছে না। এয়ারপোর্টের চোরাকারবারি বারবার হাজতবাস করে আবার ব্যবসায় ফিরে আসছে। একাধিকবার উচ্ছেদের পরও দখলবাজরা আবার নতুন করে সরকারি জায়গায় ঘর তুলছে, ঘর ভাড়া দিচ্ছে, ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। নিরস্ত হচ্ছে না। বারবার লঞ্চডুবি হওয়া সত্ত্বেও লঞ্চের মালিকরা অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করছে, ট্রেনের ভেতরে জায়গা থাকার পরও লোকজন ছাদে উঠছে, মৃত্যুর ঝুঁকি নিচ্ছে। মোবাইল কোর্ট বসিয়ে শাস্তি দেওয়ার পরও ফল ও মাছে কেমিক্যাল মেশানো বন্ধ করা যাচ্ছে না। ক্রেডিট কার্ড জালিয়াত, ব্যাংক নোট জালিয়াত বেপরোয়াভাবে তাদের অপরাধমূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন তাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। সমাজের প্রতি স্তরে যখন এরূপ বেপরোয়া ভাব দেখা যায়, তখন প্রশাসন অকার্যকর হয়ে পড়ে। কিছুটা নির্লিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি প্রশাসনে জেঁকে বসে। ফলে জনজীবন হয় দুর্বিষহ।
এরূপ বেরোখা-বেপরোয়া আচরণ একটি মানসিক ব্যাধি বা 'সাইকোপ্যাথি' হতে পারে, আবার এটি সামাজিক ব্যাধিও হতে পারে। মানসিক ব্যাধি নেহাৎ ব্যক্তিপর্যায়ের, এটি ব্যক্তিকে আক্রমণ করে। জিনেটিক কারণেও ব্যক্তি এ সমস্যায় বা ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে। অবস্থার বিপাকে অথবা সুযোগের আকর্ষণে ব্যক্তির সুপ্ত বৈশিষ্ট্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। দেশে তেমন কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে কি না তা প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যেতে পারে। বর্তমানে এরূপ গবেষণা চালানোর আবশ্যকতা বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে। দ্বিতীয় ধরনের সমস্যা সামাজিক ব্যাধি বা 'সোসিওপ্যাথি' নামে পরিচিত। এ ব্যাধি একটি গোষ্ঠী, দল বা উপদলকে আক্রমণ করে, তার সদস্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
'সাব-কালচার' হিসেবে তা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। কিছু অন্যায়, অনৈতিক, নিষ্ঠুর বা দুর্নীতিমূলক কাজকে এই উপদলের সদস্যরা গ্রহণযোগ্য কাজ হিসেবে বিবেচনা করে। এ কাজ করে তারা লজ্জা বা দুঃখবোধ করে না। বরং এ কাজের জন্য তারা এক ধরনের বাহাদুরি বোধ করে। অন্য সদস্যদের কাছ থেকে বাহবা পাওয়ার আশা করে, না পেলে কিছুটা হতাশা বোধ করে। দলীয় সদস্যদের দৃষ্টিতে ন্যায্য, কিন্তু সাধারণ নাগরিকের দৃষ্টিতে অন্যায়, এমন কাজ না করলে সদস্যরা নাখোশ হয়। যেমন- সিএনজিচালক মিটারে চালালে অথবা খুচরা দোকানদার বিশ শতকরা হারে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করলে তার সহচালকরা বা বিক্রেতারা এর বিরুদ্ধেচারণ করে।
দেশে সাম্প্রতিককালে কিছু দুর্বৃত্তের মধ্যে যে বেরোখা-বেপরোয়া ভাব দেখা যাচ্ছে, এর পেছনে উপরোক্ত দুই ধরনের কারণ থাকতে পারে। শিশু হত্যা, কিশোরী ধর্ষণ-হত্যা, অপহরণ, পালিত পশু-পাখি, গাছ-পালা কর্তন বা ধ্বংস করার পেছনে সাইকোপ্যাথি বা ব্যক্তির মানসিক ব্যাধি কাজ করতে পারে। এর সংখ্যা অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ার মূলে নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশকে দায়ী করা চলে। আর্থিক অপরাধের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া 'সোসিওপ্যাথির' কুফল হতে পারে। প্রশাসনের প্রশ্রয়ে বা নিষ্ক্রিয়তায় এই বেপরোয়া ভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সাধারণ নাগরিকরা প্রতিবাদমুখর না হয়ে হতাশা প্রকাশ করছে। দুর্বৃত্তরা তাদের কাজের জন্য একে অপরকে বাহবা দিচ্ছে।
কার্যকারণ যা-ই হোক না কেন, বেরোখা দুর্বৃত্তদের বেপরোয়া আচরণের বিরুদ্বেূ কঠোর এবং কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রশাসনযন্ত্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে প্রশাসনের, যেসব কর্মকর্তা সততা এবং সাহস নিয়ে দুর্বৃত্তদের মোকাবিলা করছে, তাদের সমর্থন জোগাতে হবে। যারা নির্লিপ্ত, নিষ্ক্রিয়, তাদের সাহস জুগিয়ে, চাপ দিয়ে, শাস্তির ভয় দেখিয়ে সক্রিয় করতে হবে। সমস্বরে বলতে হবে : যার ভয়ে তুমি ভীত, সে অন্যায় ভীরু তোমার চেয়ে, যখনই জাগিবে তুমি তখনই সে পালাইবে ধেয়ে।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
গত কয়েক মাসের প্রতিবেদন, তথ্যচিত্র, উপসম্পাদকীয় কলাম ও নিবন্বূ পর্যালোচনা করে আমি সমাজদেহে একটি মারাত্মক সমস্যার ভ্রূণ দেখতে পাচ্ছি। বিষয়টি সরকারের, কোনো রাজনৈতিক দলের, প্রশাসনযন্ত্রের, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, কোনো পেশাগত গোষ্ঠীর কিংবা কোনো সম্প্রদায়ের একার সমস্যা নয়। সমস্যাটিকে আমি পুরো দেশের এবং গোটা সমাজের সমস্যা হিসেবে দেখতে পাচ্ছি। এর অভিঘাত তাই দেশের আপামর নাগরিকের ওপর পড়বে বলে আশঙ্কা করছি।
উপমহাদেশের এতদঞ্চলে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক এলাকায় হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ বা বড় ধরনের অর্থনৈতিক অপরাধ ছিল না এমন কথা বলা যাবে না। তবে তার পরিমাণ যে অত্যন্ত সীমিত ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্ততপক্ষে গত ৫০-৬০ বছরের অপরাধের সাধারণ চিত্র আমার চোখের সামনে স্পষ্টভাবে ভেসে আছে। খুব অল্প বয়স থেকে আমি খবরের কাগজ পড়ি। জঘন্য প্রকৃতির অপরাধের খবর কালেভদ্রে চোখে পড়ত। আমি যে শহরে বড় হয়েছি, সেখানে যত দূর মনে পড়ে, ১০ বছরে একটি হত্যার ঘটনা ঘটেছিল। শহরে যুবকদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে মারামারি হতো। এসব মারামারিতে ছুরি ও লাঠি ব্যবহৃত হতো। যারা আহত হতো তাদের শহরের হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হতো। ফুটবল খেলার মাঠে লম্বা লম্বা আখ ব্যবহার করে বিভিন্ন টিমের সমর্থকদের মধ্যে মারামারি হতো। শহরতলির গ্রুপগুলো এসব মারামারিতে বেশি পটু ছিল। তাদের একটা হাটুরে বৈশিষ্ট্য ছিল। গ্রাম বা পাড়ার প্রায় সব বাসিন্দা এসব মারামারিতে অংশ নিত। ওই পর্যন্তই। আমি এসব মারামারিতে কখনো খুনখারাবির ঘটনা ঘটতে দেখিনি। ঢাকায় এসে ছাত্ররাজনীতিভিত্তিক অনেক মারামারি দেখেছি। হকিস্টিক, লাঠি, ছুরি এবং ক্ষীণশক্তির হাতবোমার মধ্যে এসব মারামারি সীমিত ছিল। তবে মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন এনএসএফের সমর্থক খোকা, পাঁচপাততু এবং আনোয়ার আনসারীর কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল বলে শুনেছি। ব্যবহার করতে দেখিনি। আমাদের ছাত্রজীবনের জঘন্যতম ঘটনা হলো এনএসএফের কতিপয় গুণ্ডা ছাত্র কর্তৃক সে যুগের প্রখ্যাত শিক্ষক-বুদ্বিজীবী ড. আবু মাহমুদকে লাঠি এবং হকিস্টিকের আঘাতে মারাত্মক আহত করা। প্রাক-স্বাধীনতাকালে ছাত্ররাজনীতির তথা ঢাকা শহরের এটি ছিল সবচেয়ে নিন্দনীয় ঘটনা। অবশ্য এনএসএফের গুণ্ডা অর্থাৎ খোকা পাঁচপাততুর দল ঢাকা হলে নিয়ে মেয়েদের নির্যাতন করত বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাম্প্রতিককালে সারা দেশে অপরাধীদের নৃশংসতা এক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। শিশু এবং নারীর ওপর এ নৃশংসতা বেশি প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। নিরীহ প্রাণী এবং গাছপালাও নৃশংসতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ডাকাতি করতে গিয়ে আট মাসের শিশুকে অপহরণ করা হচ্ছে, চার-পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে, গরিব তরুণীকে অর্থ এবং প্রেমের লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ করে শুধু হত্যাই নয়, তার দেহকে ছাবি্বশ টুকরো করে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে, শুধু টাকা আর সম্পত্তির লোভে মাকে বেঁধে রেখে তাঁর সামনে যুবতী মেয়েকে হত্যা করা হচ্ছে, কচি শিশুকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চাওয়া হচ্ছে- না পেলে তাদের মেরে ফেলা হচ্ছে। যুগ যুগ ধরে যে গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর নুন খেয়ে জীবনধারণ করেছে, অর্থের লোভে তাঁদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হচ্ছে। শত্রুতাবশত খামারের হাঁস-মুরগি, পুকুরের মাছ বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। বিস্তীর্ণ বাগানের এত সুন্দর গাছ নিষ্ঠুরভাবে কেটে ফেলা হচ্ছে। এসব কাজ করতে দুর্বৃত্তরা যেন পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে।
এবার অর্থনৈতিক অপরাধের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। আর্থিক লাভের লোভ এ সেক্টরের অপরাধীদের যেন অন্ধ করে ফেলছে। রাষ্ট্রীয় বিবেচনা, সামাজিক বিবেচনা কিংবা অসহায় মানুষের বিবেচনা- কিছুই তাদের আর্থিক অপরাধ থেকে বারিত করতে পারছে না। অতিমাত্রায় লাভ তাদের করতেই হবে। ধনী তাদের হতেই হবে। পত্রিকার খবরে দেখা যায় যে ব্যবসায়ীরা এক শ হারে লাভ করে জিনিস বিক্রি করে। আমি নিজেও দেখেছি, কারওয়ান বাজারে এক শ গজের ব্যবধানে শাকসবজির দাম তিন শ হার বাড়িয়ে খুচরা দোকানে বিক্রি করা হয়। কয়েক মাসের মধ্যে এসব খুচরা ব্যবসায়ী ফুলে-ফেঁপে ধনী ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়। সাধারণ ক্রেতার কষ্টের সীমা থাকে না। এখন দেখা যাচ্ছে, ব্যবসায়ীরা প্রতি সপ্তাহে ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে দেয়। কাঁচামালের দাম কমে যাওয়ার পরও বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প তাদের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় অথবা বাড়ানো দাম কমায় না। শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের নির্দেশও তারা মানে না। এমনই বেরোখা ভাব। সম্প্রতি ওষুধ ব্যবসায়ীরা এক পক্ষের ব্যবধানে ওষুধের দাম দুবার বাড়িয়ে দিয়েছে। অসুস্থ মানুষের সীমিত আয় এবং কষ্টের কথা একবারও বিবেচনায় আনেনি।
সমাজের অন্যান্য পরিবৃত্তেও এরূপ বেপরোয়া, বেরোখা আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রশাসনিক বিধিনিষেধ কেউ মানতে চাচ্ছে না। পত্রিকার খবরে দেখতে পাচ্ছি, ৩৮০টি ড্রাইভিং স্কুলের মধ্যে ৩১১টিই অবৈধ। লাখ লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স ভুয়া। সিএনজি-চালক কিংবা ক্যাব ড্রাইভার মিটারে চালানোর ব্যাপারে বিআরটিএর আদেশের কোনো তোয়াক্কা করছে না। মাদক ব্যবসায়ীদের তাদের দুষ্কর্ম থেকে কোনো মতেই বিরত করা যাচ্ছে না। এয়ারপোর্টের চোরাকারবারি বারবার হাজতবাস করে আবার ব্যবসায় ফিরে আসছে। একাধিকবার উচ্ছেদের পরও দখলবাজরা আবার নতুন করে সরকারি জায়গায় ঘর তুলছে, ঘর ভাড়া দিচ্ছে, ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। নিরস্ত হচ্ছে না। বারবার লঞ্চডুবি হওয়া সত্ত্বেও লঞ্চের মালিকরা অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করছে, ট্রেনের ভেতরে জায়গা থাকার পরও লোকজন ছাদে উঠছে, মৃত্যুর ঝুঁকি নিচ্ছে। মোবাইল কোর্ট বসিয়ে শাস্তি দেওয়ার পরও ফল ও মাছে কেমিক্যাল মেশানো বন্ধ করা যাচ্ছে না। ক্রেডিট কার্ড জালিয়াত, ব্যাংক নোট জালিয়াত বেপরোয়াভাবে তাদের অপরাধমূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন তাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। সমাজের প্রতি স্তরে যখন এরূপ বেপরোয়া ভাব দেখা যায়, তখন প্রশাসন অকার্যকর হয়ে পড়ে। কিছুটা নির্লিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি প্রশাসনে জেঁকে বসে। ফলে জনজীবন হয় দুর্বিষহ।
এরূপ বেরোখা-বেপরোয়া আচরণ একটি মানসিক ব্যাধি বা 'সাইকোপ্যাথি' হতে পারে, আবার এটি সামাজিক ব্যাধিও হতে পারে। মানসিক ব্যাধি নেহাৎ ব্যক্তিপর্যায়ের, এটি ব্যক্তিকে আক্রমণ করে। জিনেটিক কারণেও ব্যক্তি এ সমস্যায় বা ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে। অবস্থার বিপাকে অথবা সুযোগের আকর্ষণে ব্যক্তির সুপ্ত বৈশিষ্ট্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। দেশে তেমন কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে কি না তা প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যেতে পারে। বর্তমানে এরূপ গবেষণা চালানোর আবশ্যকতা বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে। দ্বিতীয় ধরনের সমস্যা সামাজিক ব্যাধি বা 'সোসিওপ্যাথি' নামে পরিচিত। এ ব্যাধি একটি গোষ্ঠী, দল বা উপদলকে আক্রমণ করে, তার সদস্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
'সাব-কালচার' হিসেবে তা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। কিছু অন্যায়, অনৈতিক, নিষ্ঠুর বা দুর্নীতিমূলক কাজকে এই উপদলের সদস্যরা গ্রহণযোগ্য কাজ হিসেবে বিবেচনা করে। এ কাজ করে তারা লজ্জা বা দুঃখবোধ করে না। বরং এ কাজের জন্য তারা এক ধরনের বাহাদুরি বোধ করে। অন্য সদস্যদের কাছ থেকে বাহবা পাওয়ার আশা করে, না পেলে কিছুটা হতাশা বোধ করে। দলীয় সদস্যদের দৃষ্টিতে ন্যায্য, কিন্তু সাধারণ নাগরিকের দৃষ্টিতে অন্যায়, এমন কাজ না করলে সদস্যরা নাখোশ হয়। যেমন- সিএনজিচালক মিটারে চালালে অথবা খুচরা দোকানদার বিশ শতকরা হারে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করলে তার সহচালকরা বা বিক্রেতারা এর বিরুদ্ধেচারণ করে।
দেশে সাম্প্রতিককালে কিছু দুর্বৃত্তের মধ্যে যে বেরোখা-বেপরোয়া ভাব দেখা যাচ্ছে, এর পেছনে উপরোক্ত দুই ধরনের কারণ থাকতে পারে। শিশু হত্যা, কিশোরী ধর্ষণ-হত্যা, অপহরণ, পালিত পশু-পাখি, গাছ-পালা কর্তন বা ধ্বংস করার পেছনে সাইকোপ্যাথি বা ব্যক্তির মানসিক ব্যাধি কাজ করতে পারে। এর সংখ্যা অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ার মূলে নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশকে দায়ী করা চলে। আর্থিক অপরাধের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া 'সোসিওপ্যাথির' কুফল হতে পারে। প্রশাসনের প্রশ্রয়ে বা নিষ্ক্রিয়তায় এই বেপরোয়া ভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সাধারণ নাগরিকরা প্রতিবাদমুখর না হয়ে হতাশা প্রকাশ করছে। দুর্বৃত্তরা তাদের কাজের জন্য একে অপরকে বাহবা দিচ্ছে।
কার্যকারণ যা-ই হোক না কেন, বেরোখা দুর্বৃত্তদের বেপরোয়া আচরণের বিরুদ্বেূ কঠোর এবং কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রশাসনযন্ত্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে প্রশাসনের, যেসব কর্মকর্তা সততা এবং সাহস নিয়ে দুর্বৃত্তদের মোকাবিলা করছে, তাদের সমর্থন জোগাতে হবে। যারা নির্লিপ্ত, নিষ্ক্রিয়, তাদের সাহস জুগিয়ে, চাপ দিয়ে, শাস্তির ভয় দেখিয়ে সক্রিয় করতে হবে। সমস্বরে বলতে হবে : যার ভয়ে তুমি ভীত, সে অন্যায় ভীরু তোমার চেয়ে, যখনই জাগিবে তুমি তখনই সে পালাইবে ধেয়ে।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
No comments