সমকালীন প্রসঙ্গ-পদ্মা সেতুর সাতকাহন by মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া
বিশ্বব্যাংকের আগের প্রস্তাব ছিল, সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরালেই সেতুর কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু মন্ত্রীকে সরানো হলেও তারা স্থগিত কার্যক্রম শুরু করেনি। তারা জানায়, কানাডায় এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে তদন্ত সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সেতুর কাজ শুরু হবে না।
আমাদের সঙ্গে কর্মরত বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তাদের অভিমত_ 'এ পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে তার স্বচ্ছতা সম্পর্কে অভিযোগ নেই'
বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ চুক্তি বাতিল এখন 'টক অব দ্য কান্ট্রি'। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব পদে দু'বছর কাজের সুবাদে আমি প্রত্যক্ষভাবে এ প্রকল্পের বিষয়ে অবহিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি।
বাংলাদেশে পদ্মা সেতুই সম্ভবত একমাত্র প্রকল্প, যাতে ঋণ চুক্তি সম্পাদনের আগেই কাজ শুরুর সম্মতি দেওয়া হয়। একদিকে ডিজাইন প্রণয়ন, অন্যদিকে জমি অধিগ্রহণ ও এর মূল্য প্রদান, ৪টি পুনর্বাসন সাইট উন্নয়ন, পরিকল্পনামাফিক রাস্তাঘাট ও ইউটিলিটি সার্ভিস স্থাপনসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধার ব্যবস্থাকরণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রম স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সঙ্গে সম্পাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এসব কাজে সরকারি বাজেটের ১০০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হয়। বিশ্বব্যাংকসহ সব উন্নয়ন সহযোগীর প্রতিনিধিরা এ কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও জাইকা প্রত্যেকেই পদ্মা সেতুর কাজের জন্য একজন করে প্রতিনিধি মনোনীত করে। সার্বিক কাজ সমন্বয়ের জন্য বিশ্বব্যাংককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাদের একজন কর্মকর্তা 'টাস্ক টিম লিডার' হিসেবে প্রকল্পের পরিচালকসহ অন্যান্য পরামর্শকের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় নিষ্পত্তি করেন। আমাদের সহায়তার জন্য প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ টিমে ছিলেন বুয়েটের চার অধ্যাপক _ প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত, ড. মু. সফিউল্লাহ, ড. ফিরোজ এবং ড. আলমগীর মুজিবুল হক। এ ছাড়া জাপান, নেদারল্যান্ডস ও নরওয়ের ৫ জন পানি বিশেষজ্ঞ এ প্যানেলে ছিলেন। মূল সেতুর ঠিকাদার প্রাক-যোগ্যতার জন্য টেন্ডার হলে বিভিন্ন দেশের ১১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। মূল্যায়ন কমিটি ৫টিকে প্রাক-যোগ্য হিসেবে নির্বাচন করে। ডিজাইন আংশিক পরিবর্তনের অজুহাতে বিশ্বব্যাংক পুনঃ টেন্ডারের প্রস্তাব দেয়। ২০১০ সালের এপ্রিলে পুনঃ টেন্ডারে আগের ৫টিসহ ১০টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয় এবং আগের ৫টি প্রতিষ্ঠানই প্রাক-যোগ্য বিবেচিত হয়।
সেতু সংশ্লিষ্ট কাজের দরপত্র মূল্যায়নের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. আইনুন নিশাত ও ড. আবু সিদ্দিকসহ ৭ জনকে নিয়ে মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়া Construction Supervision Consultant I Management Support Consultant দরপত্র মূল্যায়নের জন্য সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
মূল সেতু, নদীশাসন, সংযোগ সড়কসহ যাবতীয় নির্মাণ প্যাকেজ মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান AECOM.. এ কমিটির কোনো সিদ্ধান্ত বা মতামত সচিব কিংবা মন্ত্রী কর্তৃক কখনও অগ্রাহ্য হয়নি। বিশ্বব্যাংক টাস্ক টিম লিডার ২৯ মার্চ ও ৬ এপ্রিল ই-মেইলের মাধ্যমে চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন করপোরেশনকে (CRCC) প্রাক-যোগ্য বিবেচনার অনুরোধ করে। মূল্যায়ন কমিটি তথা সেতু বিভাগ ৭ এপ্রিল এক পত্রে এটা বিবেচনায় অসম্মতি জানায়। বিশ্বব্যাংক ১৩ এপ্রিল ই-মেইলে CRCC-এর কাছ থেকে কিছু অতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহ করে প্রস্তাব পুনর্মূল্যায়নের অনুরোধ জানায়। সেতু কর্তৃপক্ষ তাদের কাজের অভিজ্ঞতা জানাতে চিঠি দেয়। তাদের তথ্যে ডিজাইন পরামর্শক ও মূল্যায়ন কমিটি বড় রকমের অসঙ্গতি দেখতে পায়। যেমন_ অন্য প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ করা ব্রিজের ছবি পরিবর্তন করে CRCC-এর নামে জমাদান। ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলর জানান, চিঠিতে উলি্লখিত চীনা কর্মকর্তার নামের স্বাক্ষর চীনা ভাষার নকল। ৯ মে CRCC পত্র দিয়ে মূল সেতুর প্রাক-যোগ্যতার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে এবং তাদের স্থানীয় এজেন্ট Venture International Limited- -এর এজেন্সিশিপ বাতিল করে।
নদীশাসন কাজের প্রি-কোয়ালিফিকেশন টেন্ডার ২০১০ সালের ২৪ জুলাই আহ্বান করা হয়। টেন্ডার কমিটি ৬টি প্রতিষ্ঠানকে প্রি-কোয়ালিফিকেশনের জন্য বিশ্বব্যাংকে পাঠায়। তারা আরও দুটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করা যায় কিনা তা পরীক্ষা করতে বলে। ডিজাইন পরামর্শক ও মূল্যায়ন কমিটি এ প্রস্তাবে সম্মত হয়নি।
কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্সির প্যাকেজে ৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের গাইডলাইন অনুসারে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য Expression of Interest আহ্বান করা হলে ১৩টি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব দাখিল করে। মূল্যায়ন কমিটি ৫টিকে 'শর্ট লিস্টিং' করে। নির্ধারিত সময়সীমা পর্যন্ত সে ৫টি প্রতিষ্ঠানই কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব দাখিল করে। কয়েকজন সদস্যের ধারণা হয়, একটি বিশেষ কোম্পানিকে সবচেয়ে যোগ্য বিবেচনা করার চেষ্টা চলছে। বুয়েটের অধ্যাপকসহ অন্য কয়েকজন সদস্য অন্য একটি কোম্পানিকে অধিকতর যোগ্য বিবেচনা করেন, তবে কেউই চূড়ান্ত মূল্যায়ন নম্বর প্রদান করেননি। ইত্যবসরে আমার ই-মেইলে কয়েকজন সদস্য তাদের মূল্যায়ন ছেড়ে দিয়েছেন, যা উচিত হয়নি। এ অবস্থায় সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটি ভেঙে দিয়ে অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে আহ্বায়ক, ড. আইনুন নিশাত, ড. মো. সফিউল্লাহ, ড. দাউদ আহমেদ (বিশ্বব্যাংক কর্তৃক মনোনীত পরামর্শক) এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে সদস্য করে নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করি।
মূল্যায়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদন ২০১০ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বব্যাংকে প্রেরণ করলে ২০১১ সালের ১০ মার্চ সম্মতি মেলে। এতে HPR, UK প্রথম, SNC-Lavalin, Canada দ্বিতীয়, AECOM, Newzealand তৃতীয়, Halcrow, UK চতুর্থ এবং Oriental, Japan পঞ্চম স্থানে থাকে। এ সময় বিশ্বব্যাংক অনুরোধ করে, আর্থিক মূল্যায়নের স্কোর যোগ করে চূড়ান্ত মূল্যায়নের সময় যেন সর্বোচ্চ নম্বরধারী দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত পরামর্শক সদস্যদের জীবনবৃত্তান্ত পরীক্ষা করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় তিনজনের ক্ষেত্রে অসঙ্গতি পাওয়া যায়। একটি প্রতিষ্ঠান চিঠি দিয়ে ভুল স্বীকার করে। সার্বিক মূল্যায়নে এসএনসি লাভালিন প্রথম হয়। এর কারণ মূল্যায়নে প্রথম স্থান অধিকারী HPR-এর আর্থিক দর এসএনসি লাভালিনের প্রায় দ্বিগুণ। কমিটির চূড়ান্ত মূল্যায়ন ২০১১ সালের আগস্টে বিশ্বব্যাংকে প্রেরণ করা হয়। উল্লেখ্য, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ ২ জুলাই সমকালে প্রকাশিত হয়েছে।
মূল সেতুর ব্যয় ধরা হয় ১০০০ মিলিয়ন ডলার, নদীশাসন প্যাকেজ ৮৫০ মিলিয়ন ডলার এবং সুপারভিশন কনসালটেন্সি বাবদ ব্যয় মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু শেষোক্ত কাজ পেতেই প্রতিযোগিতা ছিল বেশি।
কমিটির মূল্যায়ন চলাকালে একটি মহল ই-মেইলে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকে। এর কপি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক জাপানি কর্মকর্তাকেও পাঠানো হয়। ওই ই-মেইলের ফরওয়ার্ড করা কপিতে দেখা যায়, দুটি প্রতিষ্ঠান (এসএনসি লাভালিন ও এইচপিআর) কারিগরি মূল্যায়নে বেশি নম্বর পেতে পারে বলে মহলটি আশঙ্কা করে। কোনো কোনো মেইলে ঐধষপৎড়-িএর দোষ-ত্রুটির কথা বলা হয়। ২০১১ সালে পদ্মা সেতুর কাজে আমি দু'বার বিশ্বব্যাংক সদর দফতরে যাই। প্রথমবার ইন্টিগ্রিটি বলে যে, এ পর্যায়ে কোনো কথা বলবে না। দ্বিতীয়বার ভ্রমণে অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান (পদ্মা প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজার) নেতৃত্ব দেন। তখনও কথিত অভিযোগের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মিস ইসাবেল গুরিয়ের জানান, ইন্টিগ্রিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছে রিপোর্ট করেন। তবে তদন্ত চলাকালে পদ্মা সেতুর কাজ থেমে থাকবে না। ২০১১ সালের জুলাই-আগস্টের দিকে জানানো হয়, বিশ্বব্যাংক ইন্টিগ্রিটি সুপারভিশন কনসালটেন্সি ছাড়াও মূল সেতুর টেন্ডারের অনিয়মে মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার বিষয়েও তদন্ত করছে। একপর্যায়ে কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গেছে। তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে রেখে এ প্রকল্প এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।' তাকে জানাই, যে পদ্ধতিতে পদ্মা সেতুর কাজ হচ্ছে তাতে মন্ত্রীর হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, তাকে অন্য দায়িত্ব দিলেও হবে। সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে প্রধানমন্ত্রীকে কথিত দুর্নীতির চেষ্টার বিষয়টি অবহিত করে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য বলা হয়। ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আসন্ন সভায় প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে গেলে সেখানে প্রমাণ উপস্থাপন করা হবে। তারা পরে কোনো তথ্যপ্রমাণ দেয়নি। তবে অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া একটি চিঠিতে যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছিল না। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি ও পদ্মা সেতু প্রকল্পে তাদের কার্যক্রম স্থগিতের ঘোষণা দেয়। সেতু বিভাগ তখন মূল সেতুর টেন্ডার আহ্বানের জন্য প্রস্তুত। আর সুপারভিশন কনসালটেন্সির চূড়ান্ত মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংকের বিবেচনাধীন। এ পর্যায়ে খবর প্রচারিত হয়, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতায় রয়াল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এসএনসি লাভালিনের অফিসে গিয়ে কাগজপত্র জব্দ করে। সে সময়ে সংবাদ সম্মেলনে আমি জানাই, যেভাবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে সেতুর কাজ চলছে তাতে যোগাযোগমন্ত্রী কেন, ঊর্ধ্বর্তন কর্তৃপক্ষেরও হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। তা ছাড়া যেখানে ঋণের কোনো টাকাই ছাড় হয়নি সেখানে দুর্নীতির প্রশ্নই আসে না। ইতিমধ্যে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধেও বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়া যায় এবং তাকে প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে সরানো হয়। আমাকেও সেতু বিভাগের সচিব পদ থেকে বদলি করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিশ্বব্যাংকের আগের প্রস্তাব ছিল, সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরালেই সেতুর কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু মন্ত্রীকে সরানো হলেও তারা স্থগিত কার্যক্রম শুরু করেনি। তারা জানায়, কানাডায় এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে তদন্ত সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সেতুর কাজ শুরু হবে না। আমাদের সঙ্গে কর্মরত বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তাদের অভিমত_ 'এ পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে তার স্বচ্ছতা সম্পর্কে অভিযোগ নেই।' এডিবি ও জাইকাসহ অন্য সহযোগী সংস্থা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুঃখ প্রকাশ করে। ইতিমধ্যে কথিত দুর্নীতির বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করে। এতে যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গত এপ্রিলে বিশ্বব্যাংক সরকারের কাছে এক চিঠিতে কনসালটেন্সি প্রদানের ক্ষেত্রে কথিত দুর্নীতিতে জড়িত কতিপয় সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে। কিন্তু দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছিল না। শুধু এসএনসি লাভালিনের কেসে কানাডিয়ান পুলিশের কাছে তথ্য আছে মর্মে উল্লেখ করা হয়। পত্রের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের কিছু করণীয় নির্ধারণ করে, সরকার যতটুকু মানা সম্ভব_ মেনে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখে। এ পর্যায়ে ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে প্রেসনোট জারি করে। এর ভাষা ও অভিযোগ বাংলাদেশের জন্য বিব্রতকর ও অপমানজনক। এতে গত সেপ্টেম্বরে দুটি তদন্তের সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া হয়েছে মর্মে যা উল্লেখ রয়েছে তা আদৌ সত্য নয়। গত এপ্রিলে 'ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ Corruption ConspiracyÕ সুনির্দর্িষ্ট তথ্য দিতে না পারলেও কতিপয় ব্যবস্থা নিতে বলে, যা একটি সার্বভৌম দেশের পক্ষে পালন সম্ভব নয়। তারা কথিত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের ছুটি দেওয়ার কথা বলে এবং দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংকের পূর্ণ খবরদারির ক্ষমতা চায়, যা দুদক আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তদন্ত ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি ছাড়া কাউকে বিদায় করাও অযৌক্তিক। আলোচনা চলাকালে ঋণ চুক্তি বাতিলও স্বেচ্ছাচারিতার শামিল।
কনসালটেন্সির বাজেট মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার, সেখানে এসএনসির প্রস্তাব ছিল ৪০ মিলিয়নেরও নিচে। মো. ইসমাইল নামের একজন বাংলাদেশি কানাডীয় ইঞ্জিনিয়ার এসএনসি লাভালিনের পক্ষে অন্যান্য জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে এ প্রকল্পে প্রস্তাব দাখিল করেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও একই পদ্ধতিতে বাংলাদেশে তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রস্তাব দাখিল করে। প্রস্তাব দাখিলের পর দরদাতা সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি বিভিন্ন সময়ে সেতু বিভাগে দেখা করে তাদের প্রস্তাবের শ্রেষ্ঠত্ব, প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরে। ব্রিটিশ, কানাডা ও জাপানের রাষ্ট্রদূতরা যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে অনুরূপ উদ্দেশ্যে দেখা করেন। দর প্রস্তাবের কারিগরি মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত এবং এ বিষয়ে কারও অভিযোগ নেই। বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টির অভিযোগ অবান্তর।
রমেশ সাহা নামে এসএনসির এক কর্মকর্তা তাদের প্রস্তাবের সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত ছিলেন না। কারিগরি মূল্যায়নে এসএনসি প্রথম হতে না পারায় রমেশ সাহা কৌশলে এর ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে ইসমাইলকে সরিয়ে নিজে বাংলাদেশে এসএনসির প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হন। পরে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কেভিন ওয়ালেসের সঙ্গে বাংলাদেশে আসেন। অনুরূপভাবে সম্মিলিত মূল্যায়নে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী Halcrow সিইও বাংলাদেশে আসেন।
অভিযোগকারীরা ই-মেইলে বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্বব্যাংকের মনোনীত মূল্যায়ন কমিটির একজন বিশেষজ্ঞ সদস্যের বিরুদ্ধেও বলেছে, আমাদের সঙ্গে নাকি তাদের যোগসাজশ রয়েছে। কিন্তু এসএনসি লাভালিনকে 'কাজ পাইয়ে দেওয়ার' জন্য আমরা যদি দায়ী হই তবে তাদেরও দায় থাকা উচিত। উলি্লখিত 'অপরাধের জন্য' এমনকি একটি অযোগ্য চীনা কোম্পানিকে 'কোয়ালিফাই' করার জন্য যারা চাপ প্রয়োগ করেছিল, বিশ্বব্যাংক কি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে অভিযোগকারীদের ব্যবহৃত padma_bridge@ymail.com-এ অনুসন্ধানপূর্বক অভিযোগকারীদের সঠিক পরিচয় উদ্ঘাটন আবশ্যক।
[মতামত লেখকের নিজস্ব]
মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া :সচিব ও নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ
বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ চুক্তি বাতিল এখন 'টক অব দ্য কান্ট্রি'। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব পদে দু'বছর কাজের সুবাদে আমি প্রত্যক্ষভাবে এ প্রকল্পের বিষয়ে অবহিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি।
বাংলাদেশে পদ্মা সেতুই সম্ভবত একমাত্র প্রকল্প, যাতে ঋণ চুক্তি সম্পাদনের আগেই কাজ শুরুর সম্মতি দেওয়া হয়। একদিকে ডিজাইন প্রণয়ন, অন্যদিকে জমি অধিগ্রহণ ও এর মূল্য প্রদান, ৪টি পুনর্বাসন সাইট উন্নয়ন, পরিকল্পনামাফিক রাস্তাঘাট ও ইউটিলিটি সার্ভিস স্থাপনসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধার ব্যবস্থাকরণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রম স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সঙ্গে সম্পাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এসব কাজে সরকারি বাজেটের ১০০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হয়। বিশ্বব্যাংকসহ সব উন্নয়ন সহযোগীর প্রতিনিধিরা এ কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও জাইকা প্রত্যেকেই পদ্মা সেতুর কাজের জন্য একজন করে প্রতিনিধি মনোনীত করে। সার্বিক কাজ সমন্বয়ের জন্য বিশ্বব্যাংককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাদের একজন কর্মকর্তা 'টাস্ক টিম লিডার' হিসেবে প্রকল্পের পরিচালকসহ অন্যান্য পরামর্শকের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় নিষ্পত্তি করেন। আমাদের সহায়তার জন্য প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ টিমে ছিলেন বুয়েটের চার অধ্যাপক _ প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত, ড. মু. সফিউল্লাহ, ড. ফিরোজ এবং ড. আলমগীর মুজিবুল হক। এ ছাড়া জাপান, নেদারল্যান্ডস ও নরওয়ের ৫ জন পানি বিশেষজ্ঞ এ প্যানেলে ছিলেন। মূল সেতুর ঠিকাদার প্রাক-যোগ্যতার জন্য টেন্ডার হলে বিভিন্ন দেশের ১১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। মূল্যায়ন কমিটি ৫টিকে প্রাক-যোগ্য হিসেবে নির্বাচন করে। ডিজাইন আংশিক পরিবর্তনের অজুহাতে বিশ্বব্যাংক পুনঃ টেন্ডারের প্রস্তাব দেয়। ২০১০ সালের এপ্রিলে পুনঃ টেন্ডারে আগের ৫টিসহ ১০টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয় এবং আগের ৫টি প্রতিষ্ঠানই প্রাক-যোগ্য বিবেচিত হয়।
সেতু সংশ্লিষ্ট কাজের দরপত্র মূল্যায়নের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. আইনুন নিশাত ও ড. আবু সিদ্দিকসহ ৭ জনকে নিয়ে মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়া Construction Supervision Consultant I Management Support Consultant দরপত্র মূল্যায়নের জন্য সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
মূল সেতু, নদীশাসন, সংযোগ সড়কসহ যাবতীয় নির্মাণ প্যাকেজ মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে ডিজাইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান AECOM.. এ কমিটির কোনো সিদ্ধান্ত বা মতামত সচিব কিংবা মন্ত্রী কর্তৃক কখনও অগ্রাহ্য হয়নি। বিশ্বব্যাংক টাস্ক টিম লিডার ২৯ মার্চ ও ৬ এপ্রিল ই-মেইলের মাধ্যমে চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন করপোরেশনকে (CRCC) প্রাক-যোগ্য বিবেচনার অনুরোধ করে। মূল্যায়ন কমিটি তথা সেতু বিভাগ ৭ এপ্রিল এক পত্রে এটা বিবেচনায় অসম্মতি জানায়। বিশ্বব্যাংক ১৩ এপ্রিল ই-মেইলে CRCC-এর কাছ থেকে কিছু অতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহ করে প্রস্তাব পুনর্মূল্যায়নের অনুরোধ জানায়। সেতু কর্তৃপক্ষ তাদের কাজের অভিজ্ঞতা জানাতে চিঠি দেয়। তাদের তথ্যে ডিজাইন পরামর্শক ও মূল্যায়ন কমিটি বড় রকমের অসঙ্গতি দেখতে পায়। যেমন_ অন্য প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ করা ব্রিজের ছবি পরিবর্তন করে CRCC-এর নামে জমাদান। ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলর জানান, চিঠিতে উলি্লখিত চীনা কর্মকর্তার নামের স্বাক্ষর চীনা ভাষার নকল। ৯ মে CRCC পত্র দিয়ে মূল সেতুর প্রাক-যোগ্যতার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে এবং তাদের স্থানীয় এজেন্ট Venture International Limited- -এর এজেন্সিশিপ বাতিল করে।
নদীশাসন কাজের প্রি-কোয়ালিফিকেশন টেন্ডার ২০১০ সালের ২৪ জুলাই আহ্বান করা হয়। টেন্ডার কমিটি ৬টি প্রতিষ্ঠানকে প্রি-কোয়ালিফিকেশনের জন্য বিশ্বব্যাংকে পাঠায়। তারা আরও দুটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করা যায় কিনা তা পরীক্ষা করতে বলে। ডিজাইন পরামর্শক ও মূল্যায়ন কমিটি এ প্রস্তাবে সম্মত হয়নি।
কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্সির প্যাকেজে ৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের গাইডলাইন অনুসারে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য Expression of Interest আহ্বান করা হলে ১৩টি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব দাখিল করে। মূল্যায়ন কমিটি ৫টিকে 'শর্ট লিস্টিং' করে। নির্ধারিত সময়সীমা পর্যন্ত সে ৫টি প্রতিষ্ঠানই কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব দাখিল করে। কয়েকজন সদস্যের ধারণা হয়, একটি বিশেষ কোম্পানিকে সবচেয়ে যোগ্য বিবেচনা করার চেষ্টা চলছে। বুয়েটের অধ্যাপকসহ অন্য কয়েকজন সদস্য অন্য একটি কোম্পানিকে অধিকতর যোগ্য বিবেচনা করেন, তবে কেউই চূড়ান্ত মূল্যায়ন নম্বর প্রদান করেননি। ইত্যবসরে আমার ই-মেইলে কয়েকজন সদস্য তাদের মূল্যায়ন ছেড়ে দিয়েছেন, যা উচিত হয়নি। এ অবস্থায় সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটি ভেঙে দিয়ে অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে আহ্বায়ক, ড. আইনুন নিশাত, ড. মো. সফিউল্লাহ, ড. দাউদ আহমেদ (বিশ্বব্যাংক কর্তৃক মনোনীত পরামর্শক) এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে সদস্য করে নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করি।
মূল্যায়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদন ২০১০ সালের ডিসেম্বরে বিশ্বব্যাংকে প্রেরণ করলে ২০১১ সালের ১০ মার্চ সম্মতি মেলে। এতে HPR, UK প্রথম, SNC-Lavalin, Canada দ্বিতীয়, AECOM, Newzealand তৃতীয়, Halcrow, UK চতুর্থ এবং Oriental, Japan পঞ্চম স্থানে থাকে। এ সময় বিশ্বব্যাংক অনুরোধ করে, আর্থিক মূল্যায়নের স্কোর যোগ করে চূড়ান্ত মূল্যায়নের সময় যেন সর্বোচ্চ নম্বরধারী দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত পরামর্শক সদস্যদের জীবনবৃত্তান্ত পরীক্ষা করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় তিনজনের ক্ষেত্রে অসঙ্গতি পাওয়া যায়। একটি প্রতিষ্ঠান চিঠি দিয়ে ভুল স্বীকার করে। সার্বিক মূল্যায়নে এসএনসি লাভালিন প্রথম হয়। এর কারণ মূল্যায়নে প্রথম স্থান অধিকারী HPR-এর আর্থিক দর এসএনসি লাভালিনের প্রায় দ্বিগুণ। কমিটির চূড়ান্ত মূল্যায়ন ২০১১ সালের আগস্টে বিশ্বব্যাংকে প্রেরণ করা হয়। উল্লেখ্য, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ ২ জুলাই সমকালে প্রকাশিত হয়েছে।
মূল সেতুর ব্যয় ধরা হয় ১০০০ মিলিয়ন ডলার, নদীশাসন প্যাকেজ ৮৫০ মিলিয়ন ডলার এবং সুপারভিশন কনসালটেন্সি বাবদ ব্যয় মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু শেষোক্ত কাজ পেতেই প্রতিযোগিতা ছিল বেশি।
কমিটির মূল্যায়ন চলাকালে একটি মহল ই-মেইলে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকে। এর কপি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক জাপানি কর্মকর্তাকেও পাঠানো হয়। ওই ই-মেইলের ফরওয়ার্ড করা কপিতে দেখা যায়, দুটি প্রতিষ্ঠান (এসএনসি লাভালিন ও এইচপিআর) কারিগরি মূল্যায়নে বেশি নম্বর পেতে পারে বলে মহলটি আশঙ্কা করে। কোনো কোনো মেইলে ঐধষপৎড়-িএর দোষ-ত্রুটির কথা বলা হয়। ২০১১ সালে পদ্মা সেতুর কাজে আমি দু'বার বিশ্বব্যাংক সদর দফতরে যাই। প্রথমবার ইন্টিগ্রিটি বলে যে, এ পর্যায়ে কোনো কথা বলবে না। দ্বিতীয়বার ভ্রমণে অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান (পদ্মা প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজার) নেতৃত্ব দেন। তখনও কথিত অভিযোগের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মিস ইসাবেল গুরিয়ের জানান, ইন্টিগ্রিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছে রিপোর্ট করেন। তবে তদন্ত চলাকালে পদ্মা সেতুর কাজ থেমে থাকবে না। ২০১১ সালের জুলাই-আগস্টের দিকে জানানো হয়, বিশ্বব্যাংক ইন্টিগ্রিটি সুপারভিশন কনসালটেন্সি ছাড়াও মূল সেতুর টেন্ডারের অনিয়মে মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার বিষয়েও তদন্ত করছে। একপর্যায়ে কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, 'বিশ্বব্যাংকের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গেছে। তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে রেখে এ প্রকল্প এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।' তাকে জানাই, যে পদ্ধতিতে পদ্মা সেতুর কাজ হচ্ছে তাতে মন্ত্রীর হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, তাকে অন্য দায়িত্ব দিলেও হবে। সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে প্রধানমন্ত্রীকে কথিত দুর্নীতির চেষ্টার বিষয়টি অবহিত করে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য বলা হয়। ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আসন্ন সভায় প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে গেলে সেখানে প্রমাণ উপস্থাপন করা হবে। তারা পরে কোনো তথ্যপ্রমাণ দেয়নি। তবে অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া একটি চিঠিতে যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছিল না। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি ও পদ্মা সেতু প্রকল্পে তাদের কার্যক্রম স্থগিতের ঘোষণা দেয়। সেতু বিভাগ তখন মূল সেতুর টেন্ডার আহ্বানের জন্য প্রস্তুত। আর সুপারভিশন কনসালটেন্সির চূড়ান্ত মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংকের বিবেচনাধীন। এ পর্যায়ে খবর প্রচারিত হয়, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতায় রয়াল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এসএনসি লাভালিনের অফিসে গিয়ে কাগজপত্র জব্দ করে। সে সময়ে সংবাদ সম্মেলনে আমি জানাই, যেভাবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে সেতুর কাজ চলছে তাতে যোগাযোগমন্ত্রী কেন, ঊর্ধ্বর্তন কর্তৃপক্ষেরও হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। তা ছাড়া যেখানে ঋণের কোনো টাকাই ছাড় হয়নি সেখানে দুর্নীতির প্রশ্নই আসে না। ইতিমধ্যে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধেও বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়া যায় এবং তাকে প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে সরানো হয়। আমাকেও সেতু বিভাগের সচিব পদ থেকে বদলি করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিশ্বব্যাংকের আগের প্রস্তাব ছিল, সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরালেই সেতুর কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু মন্ত্রীকে সরানো হলেও তারা স্থগিত কার্যক্রম শুরু করেনি। তারা জানায়, কানাডায় এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে তদন্ত সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সেতুর কাজ শুরু হবে না। আমাদের সঙ্গে কর্মরত বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তাদের অভিমত_ 'এ পর্যন্ত যে কাজ হয়েছে তার স্বচ্ছতা সম্পর্কে অভিযোগ নেই।' এডিবি ও জাইকাসহ অন্য সহযোগী সংস্থা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুঃখ প্রকাশ করে। ইতিমধ্যে কথিত দুর্নীতির বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করে। এতে যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গত এপ্রিলে বিশ্বব্যাংক সরকারের কাছে এক চিঠিতে কনসালটেন্সি প্রদানের ক্ষেত্রে কথিত দুর্নীতিতে জড়িত কতিপয় সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে। কিন্তু দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছিল না। শুধু এসএনসি লাভালিনের কেসে কানাডিয়ান পুলিশের কাছে তথ্য আছে মর্মে উল্লেখ করা হয়। পত্রের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের কিছু করণীয় নির্ধারণ করে, সরকার যতটুকু মানা সম্ভব_ মেনে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখে। এ পর্যায়ে ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে প্রেসনোট জারি করে। এর ভাষা ও অভিযোগ বাংলাদেশের জন্য বিব্রতকর ও অপমানজনক। এতে গত সেপ্টেম্বরে দুটি তদন্তের সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া হয়েছে মর্মে যা উল্লেখ রয়েছে তা আদৌ সত্য নয়। গত এপ্রিলে 'ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ Corruption ConspiracyÕ সুনির্দর্িষ্ট তথ্য দিতে না পারলেও কতিপয় ব্যবস্থা নিতে বলে, যা একটি সার্বভৌম দেশের পক্ষে পালন সম্ভব নয়। তারা কথিত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের ছুটি দেওয়ার কথা বলে এবং দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংকের পূর্ণ খবরদারির ক্ষমতা চায়, যা দুদক আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তদন্ত ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি ছাড়া কাউকে বিদায় করাও অযৌক্তিক। আলোচনা চলাকালে ঋণ চুক্তি বাতিলও স্বেচ্ছাচারিতার শামিল।
কনসালটেন্সির বাজেট মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার, সেখানে এসএনসির প্রস্তাব ছিল ৪০ মিলিয়নেরও নিচে। মো. ইসমাইল নামের একজন বাংলাদেশি কানাডীয় ইঞ্জিনিয়ার এসএনসি লাভালিনের পক্ষে অন্যান্য জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে এ প্রকল্পে প্রস্তাব দাখিল করেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও একই পদ্ধতিতে বাংলাদেশে তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রস্তাব দাখিল করে। প্রস্তাব দাখিলের পর দরদাতা সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি বিভিন্ন সময়ে সেতু বিভাগে দেখা করে তাদের প্রস্তাবের শ্রেষ্ঠত্ব, প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরে। ব্রিটিশ, কানাডা ও জাপানের রাষ্ট্রদূতরা যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে অনুরূপ উদ্দেশ্যে দেখা করেন। দর প্রস্তাবের কারিগরি মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত এবং এ বিষয়ে কারও অভিযোগ নেই। বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টির অভিযোগ অবান্তর।
রমেশ সাহা নামে এসএনসির এক কর্মকর্তা তাদের প্রস্তাবের সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত ছিলেন না। কারিগরি মূল্যায়নে এসএনসি প্রথম হতে না পারায় রমেশ সাহা কৌশলে এর ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে ইসমাইলকে সরিয়ে নিজে বাংলাদেশে এসএনসির প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হন। পরে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কেভিন ওয়ালেসের সঙ্গে বাংলাদেশে আসেন। অনুরূপভাবে সম্মিলিত মূল্যায়নে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী Halcrow সিইও বাংলাদেশে আসেন।
অভিযোগকারীরা ই-মেইলে বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্বব্যাংকের মনোনীত মূল্যায়ন কমিটির একজন বিশেষজ্ঞ সদস্যের বিরুদ্ধেও বলেছে, আমাদের সঙ্গে নাকি তাদের যোগসাজশ রয়েছে। কিন্তু এসএনসি লাভালিনকে 'কাজ পাইয়ে দেওয়ার' জন্য আমরা যদি দায়ী হই তবে তাদেরও দায় থাকা উচিত। উলি্লখিত 'অপরাধের জন্য' এমনকি একটি অযোগ্য চীনা কোম্পানিকে 'কোয়ালিফাই' করার জন্য যারা চাপ প্রয়োগ করেছিল, বিশ্বব্যাংক কি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে অভিযোগকারীদের ব্যবহৃত padma_bridge@ymail.com-এ অনুসন্ধানপূর্বক অভিযোগকারীদের সঠিক পরিচয় উদ্ঘাটন আবশ্যক।
[মতামত লেখকের নিজস্ব]
মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া :সচিব ও নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ
No comments