আরব বসন্ত-নীল নদের তীরে নতুন শঙ্কা by জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী

বহুদলীয় পদ্ধতিতে যে নবযুগের সূচনা হলো, সে পথে গণতন্ত্র বিঘি্নত হোক_ এমনি কোনো পদক্ষেপ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটাও স্বাভাবিক যে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তিই শক্তিধর হবেন প্রভাবশালী আরব দেশ মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা গ্রহণ করলেও দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনী স্বীয় কর্তৃত্ব


বজায় রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট মুরসির ক্ষমতার রাশ টানার চেষ্টা করছে। সামরিক বাহিনী নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানের কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রয়াসে লিপ্ত এবং এ ক্ষেত্রে তারা বিচার বিভাগকে পাশে পেয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। বর্তমান সময়ে মিসরের এই চিত্রটা যেন অনেকটাই পাকিস্তানের মতো এই কারণে যে, সেখানেও নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী এবং বিচার বিভাগ সংঘাতে রয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে পার্থক্যটা হলো, পাকিস্তানে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের জনপ্রিয়তা নেই বললেই চলে। অন্যদিকে মিসরে প্রথমবারের মতো একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জনপ্রিয়তার মাঝ দিয়েই বর্তমান পদে আসীন হয়েছেন এবং জনগণ তার কাছে অনেক কিছু প্রত্যাশা করছে। মাত্র কয়েকদিন হলো তিনি শপথ নিয়েছেন এবং সেটাও এমন এক পরিস্থিতির মাঝে যখন ক্ষমতাসীন সামরিক কাউন্সিল বিভিন্নভাবে তার কর্তৃত্ব খর্ব করতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ঘটনাচক্রে বিচার বিভাগও সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
সর্বশেষ জটিলতার উদ্ভব ঘটেছে নির্বাচিত পার্লামেন্টকে কেন্দ্র করে। এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট একদিকে এবং বিচার বিভাগ ও সামরিক কাউন্সিল অন্যদিকে অবস্থান নিয়েছে। তবে পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করে বৃহত্তর স্বার্থে প্রেসিডেন্ট মুরসিই নমনীয় হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টকে কেন্দ্র করে সর্বোচ্চ বিচার কাউন্সিলের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার কথাই বলেছেন। এতে করে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির প্রজ্ঞাই প্রকাশ পেয়েছে, যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে তিনি এই ক্ষমতার দৌড়ে পিছুটান দিয়েছেন।
গত ১৪ জুন সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল এক রায়ে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে নির্বাচিত পার্লামেন্ট বাতিল করে দেয়। অথচ এটাই ছিল বহুদলীয় ব্যবস্থায় মিসরের প্রথম অবাধ এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সংসদ। বিচার বিভাগের এই রায়কে স্বাগত জানায় সামরিক কাউন্সিল, যা কিনা প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পতনের পর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ক্ষমতায় ছিল। কথা ছিল যে দেশে একটি নির্বাচিত সরকার এবং সংসদ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এ কাউন্সিল ক্ষমতায় থাকবে। উল্লেখ্য, এই কাউন্সিলের প্রধান ফিল্ড মার্শাল হোসেন টানটাই এবং বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই সাবেক প্রেসিডেন্ট মোবারকের সময়ের প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাই এটা ধারণা করা কঠিন নয় যে, পতিত স্বৈরশাসকের প্রতি তাদের এখনও অনুরাগ থাকতে পারে, যদিও মোবারক বিভিন্ন অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন।
এই বিষয়টি সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বেশ প্রকট হয়ে ওঠে, যখন অনেক প্রতিদ্বন্দ্বীর মাঝে মোবারক আমলের শেষ প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিকের প্রতি সামরিক এবং বিচার বিভাগের প্রচ্ছন্ন সমর্থন প্রকাশ পায়। প্রথম দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের মোহাম্মদ মুরসি এবং আহমেদ শফিক প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করার কারণে তাদের দু'জনের মধ্যে দ্বিতীয় দফার রান-অফ নির্বাচন হয়।
কিন্তু পতিত সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে শফিকের প্রার্থিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও বিচার বিভাগ তার পক্ষেই রায় দেন। ভোটে শফিক অল্পের জন্য হেরে যান এবং মোহাম্মদ মুরসি নির্বাচিত হন। কিন্তু ফলাফল নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার কারণে এমনি ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, মুরসির বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে শফিককে বিজয়ী করার চক্রান্ত চলছে। শেষ পর্যন্ত সেটা আর সম্ভব হয়নি। কেননা এ ধরনের সম্ভাবনা অনুধাবন করতে পেরে বিশাল জনতা সেই খ্যাতনামা 'তাহ্রির স্কয়ারে' সমবেত হয়ে যে কোনো ষড়যন্ত্রকে রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ঘোষণা করে। পূর্বে সামরিক বাহিনী ঘোষণা করেছিল যে, তারা ২০১২ সালের জুলাই মাসের এক তারিখের মধ্যে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। এটা তারা ১ জুলাই করেছে সত্য। তবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের কতটুকু ক্ষমতা আছে, তা নিয়ে সংশয় আছে। কেননা প্রেসিডেন্ট শপথ নেওয়ার আগেই সামরিক কাউন্সিল বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয় এবং তার মাঝে রয়েছে বিভিন্ন পন্থায় প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা খর্ব করা। কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ অধিনায়ক থাকবেন না এবং কোনো নতুন সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত কাউন্সিলই বিভিন্ন আইন প্রণয়নের দায়িত্বে থাকবে। বড় কথা, নির্বাচিত পার্লামেন্টকে বাতিল করা হয়েছে, যা কিনা জনগণ গ্রহণ করেনি।
মোহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই সেই পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্তকে এক ডিক্রিবলে অবৈধ ঘোষণা করেন এবং অল্প সময়ে সেই পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকেন। এতে করেই তিনি কঠিন সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন বিচার বিভাগ এবং সামরিক বাহিনীর সঙ্গে। বিচার বিভাগ প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে বাতিল ঘোষণা করেন। সঙ্গে সঙ্গে সামরিক কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট মুরসিকে বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানোর ব্যর্থতার জন্য সতর্ক করে দেয়। স্পষ্টত, বিচার বিভাগ এবং সামরিক বাহিনী যৌথভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে সরাবার পন্থা উদ্ভাবনে সক্রিয় হয়ে উঠে বলেই মনে হয়। এমনি পরিস্থিতি অনুধাবন করে বাস্তবসম্মতভাবেই মোহাম্মদ মুরসি বলেন, তিনি বিচার বিভাগের সিদ্ধান্ত সম্মান করবেন। প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্যের পর আপাতদৃষ্টিতে উত্তেজনা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। তবে ঘটনাপ্রবাহ কোনদিকে ধাবিত হয়, বলা কঠিন।
মিসরে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের পর গণতন্ত্রের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। রাজা ফারুক, জামাল আবদুল নাসের, আনোয়ার সাদাত এবং হোসনি মোবারকরা বিভিন্নভাবে খ্যাতি কিংবা অখ্যাতি অর্জন করলেও অন্তত গণতান্ত্রিক ছিলেন না। অবশেষে বহুদলীয় পদ্ধতিতে যে নবযুগের সূচনা হলো, সে পথে গণতন্ত্র বিঘি্নত হোক_ এমনি কোনো পদক্ষেপ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটাও স্বাভাবিক যে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তিই শক্তিধর হবেন। স্বার্থান্বেষী দেশি-বিদেশি মহল যদি এর ব্যত্যয় ঘটায় তাহলে নীল নদের দেশ মিসরের পরিস্থিতি জটিলতর হতে বাধ্য।

জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী :সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষক
 

No comments

Powered by Blogger.