তথ্য অধিকার আইন-তিন বছরে আমরা কতটা এগিয়েছি? by শামসুল বারি, সুরাইয়া বেগম ও উৎপল কান্তি খীসা
তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ কার্যকর হওয়ার পর তিন বছর পূর্ণ হয়েছে ১ জুলাই ২০১২। এই সময়ে ঐতিহাসিক এই আইনের লক্ষ্য কতখানি অর্জিত হয়েছে, তা গণতন্ত্রকামী ও সরকারি কাজে স্বচ্ছতা-প্রত্যাশী সব নাগরিকের জানা একান্ত প্রয়োজন।
তথ্য অধিকার আইনের সাফল্য বিচারের সহজ মাপকাঠি হচ্ছে, দেশের কতজন নাগরিক আইনটি ব্যবহার করে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চেয়ে আবেদন করে কাঙ্ক্ষিত তথ্য পেয়েছে; বা তথ্য না পেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করেছে; বা তাতেও বিফল হয়ে তথ্য কমিশনে অভিযোগ করেছে; কতগুলো অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে; এর ফলে সার্বিকভাবে সরকারি কাজে কতখানি স্বচ্ছতা এসেছে এবং দুর্নীতি হ্রাস পেয়েছে। তথ্য কমিশনের সদ্য প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১১ থেকে আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করব।
এবারের প্রতিবেদনটি আগের বছরের চেয়ে কলেবরে বড়; প্রতিবেদনের সিংহভাগ জায়গা নিয়েছে কমিশনের সারা বছরের কর্মকাণ্ডের বিবরণী। জনসাধারণ কী ধরনের তথ্যের জন্য আবেদন করেছে এবং তা আইনটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, কোন ধরনের তথ্য জনগণ সহজে পেয়েছে বা পায়নি, আপিল বা অভিযোগের সংখ্যা থেকে আইনটির সাফল্য সম্পর্কে কী ধারণা করা যায়, সে সম্বন্ধে বিশ্লেষণধর্মী লেখা থাকলে ভালো হতো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে ‘দেশের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিলকৃত ৭৮০৮টি আবেদনের মধ্যে ৭৬১৬টি, অর্থাৎ ৯৭.৫৪% আবেদনে যাচিত তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। সারা দেশে মোট ১০৪টি (১.৩৩%) আবেদন অনিষ্পন্ন রয়েছে এবং মোট ৮৮টি (১.১৩%) আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। প্রত্যাখ্যাত আবেদনগুলোর অধিকাংশই তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর ৭ ধারার বিধানমতে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে বা কোনো জবাবই দেওয়া হয়নি।’
সাত হাজার ৮০৮টি আবেদনের মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তথ্য সরবরাহ করে ১৯ লাখ টাকার বেশি অর্জন করেছে এবং এক হাজার ৮৩১টি আবেদনের মধ্যে মাত্র দুটিতে তথ্য সরবরাহ করা হয়নি এবং সে ব্যাপারে কোনো আপিল বা অভিযোগ করা হয়নি। এ থেকে ধরে নেওয়া যায়, আবেদনকারীদের কাঙ্ক্ষিত তথ্য সরবরাহ করতে কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হয়নি। অর্থাৎ কোনো গোপন তথ্য উন্মোচন করতে হয়নি। তথ্যগুলো জনগণকে সরবরাহ করার জন্য প্রস্তুতই ছিল। তথ্যের এই সহজলভ্যতার কারণেই যে আবেদনকারীদের আপিল বা তথ্য কমিশনে কোনো অভিযোগ করতে হয়নি, তা-ও বোঝা যায়। রেল মন্ত্রণালয়েও ৫৯৮টি আবেদনের মধ্যে সবগুলোতেই তথ্য প্রদান করা হয়েছে। হতে পারে আবেদনগুলোর বেশির ভাগই ট্রেনের সময়সূচি বা ট্রেন চলাচল-সংক্রান্ত।
আমাদের এই ধারণা ঠিক হলে, এই পরিসংখ্যান কি আইনটির অগ্রগতির পরিচয় দেয়? আইনটির মূল উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে বিচার করলে অবশ্যই উত্তরটি হবে নেতিবাচক। কারণ, আইনটির উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারি কাজে স্বচ্ছতা আনা এবং জনগণের কাছে সরকারি কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি স্থাপন করতে সহায়তা করা। তাই আইনটি জনগণ কেবল উন্মুক্ত তথ্য পাওয়ার জন্য ব্যবহার করলে এর আসল উদ্দেশ্যের কোনো অগ্রগতি হবে না। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং বিশেষ করে তথ্য কমিশনকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমেই দেখতে হবে যে কেন আবেদনের সিংহভাগই সাধারণ উন্মুক্ত তথ্য পাওয়ার জন্য, যার সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি স্থাপনের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। এর একটি উত্তর হতে পারে যে যারা তথ্য কমিশনকে এই পরিসংখ্যান পাঠিয়েছে, তারা হয়তো আইনটির উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ভালোভাবে জানে না। তাই বাছবিচার না করে তাদের কাছে আসা সব ধরনের আবেদনই একত্র করে ফেলেছে। অথবা হতে পারে তথ্য কমিশনই কর্তৃপক্ষগুলোকে ঠিকভাবে বোঝাতে পারেনি যে তারা প্রতিবেদনের জন্য কী ধরনের তথ্য চেয়েছে।
তবে এ ব্যাপারে একেবারে হতাশ হওয়ার কারণ নেই। তথ্য কমিশনের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি সে রকম অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্ন ধরনের ও আশাব্যঞ্জক অন্য চিত্র পাওয়া যায়। আরআইবি নামের একটি বেসরকারি সংস্থার অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, ২০১১ সালে তাদের সহায়তায় আবেদন করা ৪৯৬টি আবেদনের মধ্যে মাত্র ২২৩টি আবেদনের তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে, বাকিগুলো বিভিন্ন কারণে করা হয়নি। আরও অনেক সংস্থা যেমন: নিজেরা করি, টিআইবি, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহায়তাপুষ্ট আরও অনেক এনজিওর অভিজ্ঞতাও এ রকম। অনেক ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ তথ্য প্রদান করছে না বা করতে চাইছে না। তার কারণ, স্পর্শকাতর অনেক তথ্যই প্রকাশ করতে তারা ভয় পায় বা দ্বিধাগ্রস্ত হয়। প্রথম দিকে এটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এর থেকে অন্তত এটা বোঝা যায় যে জনগণ স্বচ্ছতা-সম্পর্কিত তথ্য চাইছে।
বার্ষিক প্রতিবেদনে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যেসব কেসস্টাডি সন্নিবিষ্ট হয়েছে, তা একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত শ্রেণীর লোকজন তাদের জীবনে আইনটির প্রাসঙ্গিকতা উপলব্ধি করে আইনটির সঠিক প্রয়োগ শুরু করেছে। আগে যারা শত চেষ্টা করেও সরকার-প্রদত্ত ভিজিএফ, ভিজিডি কার্ড, বিধবাভাতা, বয়স্কভাতা, আবাসন-সহায়তা ইত্যাদি পেত না, প্রধানত দুর্নীতির কারণে, তাদের অনেকেই এখন তথ্য আইন প্রয়োগ করে প্রাপ্য অধিকার অর্জন করছে। এ পর্যন্ত তথ্য কমিশনে যতগুলো অভিযোগপত্র জমা পড়েছে এবং যেসব অভিযোগের শুনানি সমাপ্ত হয়েছে, তার সিংহভাগই এসেছে এসব জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে। এ ব্যাপারে এনজিওগুলোর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তারা এ ব্যাপারে আরও এগিয়ে এলে আইনটির প্রয়োগ আরও অনেক বাড়বে।
বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী, বিভিন্ন পেশার ব্যক্তি বা গণমাধ্যম এখনো আইনটি ব্যবহারে আগ্রহী নয়। অনেকেরই আইনটি সম্বন্ধে সম্যক ধারণা নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সিংহভাগ আবেদনই আসে সরকারি চাকরিজীবীদের কাছ থেকে; বেশির ভাগই বদলি, পদোন্নতি, পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড ইত্যাদি সংক্রান্ত। আমাদের দেশেও সরকারি কর্মকর্তারা তথ্য চেয়ে আবেদন করা শুরু করলে অবস্থার পরিবর্তন হবে আশা করা যায়।
গত তিন বছরে তথ্য কমিশনে মাত্র ১০৪টি অভিযোগপত্র জমা পড়েছে। যে দেশে জনগণ অন্যায়-অবিচারের ব্যাপারে এত সোচ্চার, বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যাদের অভিযোগের অন্ত নেই, সেই দেশে অভিযোগ করার সুযোগ থাকলেও এত কম অভিযোগ আসার কী কারণ, তা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। তথ্য কমিশন গত তিন বছরে ১০৪টি অভিযোগের মধ্যে আমলে নিয়েছে মাত্র ৪৪টি, নিষ্পত্তি করেছে ৪১টি। এ ছাড়া খারিজ বা স্থগিত করা হয়েছে ৬০টি। জরিমানা করা হয়েছে মাত্র একটি। এই রেকর্ড হতাশাব্যঞ্জক।
তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের এই শ্লথগতি দূর করতে হলে সরকারকে যেমন আরও মনোযোগী হতে হবে, তেমনি নাগরিক সমাজকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। এনজিও সমাজ তৃণমূল মানুষের ক্ষেত্রে আইনটির প্রাসঙ্গিকতা যেমন তুলে ধরতে শুরু করেছে, সেভাবে মধ্যবিত্ত সমাজও যদি এটির ব্যবহার শুরু করে, তবেই আইনটির অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোও আইনটি কাজে লাগাতে পারে।
তবে প্রাথমিক পর্যায়ে তথ্য কমিশনের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আবেদন, আপিল ও অভিযোগের প্রক্রিয়াকে জনগণের কাছে সহজ করার অনেক সুযোগ আছে। কমিশন ১০৪টি অভিযোগের মধ্যে ৬০টিই খারিজ বা স্থগিত করেছে। অভিযোগ আমলে না নেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, আইন যথাযথভাবে অনুসরণপূর্বক নির্ধারিত ফরম্যাট অনুযায়ী দাখিল না করা; আপিল দায়ের না করে কমিশনে অভিযোগ দায়ের করা; কাঙ্ক্ষিত তথ্য আবেদনকৃত প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত না থাকা; আবেদনের বিষয় সুস্পষ্ট না হওয়া; আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতামত গ্রহণের প্রয়োজন থাকা ইত্যাদি। এসব ব্যাপারে কমিশন সহায়ক ভূমিকা পালন করলে হয়তো অবস্থার পরিবর্তন হতো। কারণ, আবেদন খারিজ হলে অনেক আবেদনকারী উৎসাহ হারায়। ফরম বা ফরম্যাট ব্যবহারের ব্যাপারে কমিশন একটু নমনীয়তা দেখালে অনেকেই আইনটি ব্যবহারে উৎসাহিত হবে। আইনে উল্লেখ আছে, মুদ্রিত ফরম সহজলভ্য না হলে আইনে বর্ণিত বিষয়গুলো উল্লেখপূর্বক আবেদন করা যায়। ভারতের কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ফরমবিহীন পোস্টকার্ডে কাঙ্ক্ষিত তথ্যের সঠিক বর্ণনা থাকলে আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে। নাগরিকবান্ধব কোনো তথ্য কমিশনের কাছে এটাই কাম্য। আমাদের তথ্য কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নামেই আবেদন পাঠাতে হবে, তাঁর পদের উল্লেখ যথেষ্ট নয়। অথচ আইনের কোথাও পরিষ্কার করে এই বিধান নেই। তা ছাড়া, অনেক কর্তৃপক্ষ আইন প্রণয়নের তিন বছর পরও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। পরিশেষে আমরা বলতে চাই, তথ্য অধিকার আইনের সাফল্য সরকার ও জনগণ সবারই কাম্য। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় ও সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নে আইনটির সঠিক ব্যবহার আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অপরিহার্য।
শামসুল বারি, সুরাইয়া বেগম ও উৎপল কান্তি খীসা: তথ্য অধিকার টিম-রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ, বাংলাদেশ।
এবারের প্রতিবেদনটি আগের বছরের চেয়ে কলেবরে বড়; প্রতিবেদনের সিংহভাগ জায়গা নিয়েছে কমিশনের সারা বছরের কর্মকাণ্ডের বিবরণী। জনসাধারণ কী ধরনের তথ্যের জন্য আবেদন করেছে এবং তা আইনটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, কোন ধরনের তথ্য জনগণ সহজে পেয়েছে বা পায়নি, আপিল বা অভিযোগের সংখ্যা থেকে আইনটির সাফল্য সম্পর্কে কী ধারণা করা যায়, সে সম্বন্ধে বিশ্লেষণধর্মী লেখা থাকলে ভালো হতো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে ‘দেশের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিলকৃত ৭৮০৮টি আবেদনের মধ্যে ৭৬১৬টি, অর্থাৎ ৯৭.৫৪% আবেদনে যাচিত তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। সারা দেশে মোট ১০৪টি (১.৩৩%) আবেদন অনিষ্পন্ন রয়েছে এবং মোট ৮৮টি (১.১৩%) আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। প্রত্যাখ্যাত আবেদনগুলোর অধিকাংশই তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর ৭ ধারার বিধানমতে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে বা কোনো জবাবই দেওয়া হয়নি।’
সাত হাজার ৮০৮টি আবেদনের মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তথ্য সরবরাহ করে ১৯ লাখ টাকার বেশি অর্জন করেছে এবং এক হাজার ৮৩১টি আবেদনের মধ্যে মাত্র দুটিতে তথ্য সরবরাহ করা হয়নি এবং সে ব্যাপারে কোনো আপিল বা অভিযোগ করা হয়নি। এ থেকে ধরে নেওয়া যায়, আবেদনকারীদের কাঙ্ক্ষিত তথ্য সরবরাহ করতে কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হয়নি। অর্থাৎ কোনো গোপন তথ্য উন্মোচন করতে হয়নি। তথ্যগুলো জনগণকে সরবরাহ করার জন্য প্রস্তুতই ছিল। তথ্যের এই সহজলভ্যতার কারণেই যে আবেদনকারীদের আপিল বা তথ্য কমিশনে কোনো অভিযোগ করতে হয়নি, তা-ও বোঝা যায়। রেল মন্ত্রণালয়েও ৫৯৮টি আবেদনের মধ্যে সবগুলোতেই তথ্য প্রদান করা হয়েছে। হতে পারে আবেদনগুলোর বেশির ভাগই ট্রেনের সময়সূচি বা ট্রেন চলাচল-সংক্রান্ত।
আমাদের এই ধারণা ঠিক হলে, এই পরিসংখ্যান কি আইনটির অগ্রগতির পরিচয় দেয়? আইনটির মূল উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে বিচার করলে অবশ্যই উত্তরটি হবে নেতিবাচক। কারণ, আইনটির উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারি কাজে স্বচ্ছতা আনা এবং জনগণের কাছে সরকারি কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি স্থাপন করতে সহায়তা করা। তাই আইনটি জনগণ কেবল উন্মুক্ত তথ্য পাওয়ার জন্য ব্যবহার করলে এর আসল উদ্দেশ্যের কোনো অগ্রগতি হবে না। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং বিশেষ করে তথ্য কমিশনকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমেই দেখতে হবে যে কেন আবেদনের সিংহভাগই সাধারণ উন্মুক্ত তথ্য পাওয়ার জন্য, যার সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি স্থাপনের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। এর একটি উত্তর হতে পারে যে যারা তথ্য কমিশনকে এই পরিসংখ্যান পাঠিয়েছে, তারা হয়তো আইনটির উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ভালোভাবে জানে না। তাই বাছবিচার না করে তাদের কাছে আসা সব ধরনের আবেদনই একত্র করে ফেলেছে। অথবা হতে পারে তথ্য কমিশনই কর্তৃপক্ষগুলোকে ঠিকভাবে বোঝাতে পারেনি যে তারা প্রতিবেদনের জন্য কী ধরনের তথ্য চেয়েছে।
তবে এ ব্যাপারে একেবারে হতাশ হওয়ার কারণ নেই। তথ্য কমিশনের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি সে রকম অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্ন ধরনের ও আশাব্যঞ্জক অন্য চিত্র পাওয়া যায়। আরআইবি নামের একটি বেসরকারি সংস্থার অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, ২০১১ সালে তাদের সহায়তায় আবেদন করা ৪৯৬টি আবেদনের মধ্যে মাত্র ২২৩টি আবেদনের তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে, বাকিগুলো বিভিন্ন কারণে করা হয়নি। আরও অনেক সংস্থা যেমন: নিজেরা করি, টিআইবি, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহায়তাপুষ্ট আরও অনেক এনজিওর অভিজ্ঞতাও এ রকম। অনেক ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ তথ্য প্রদান করছে না বা করতে চাইছে না। তার কারণ, স্পর্শকাতর অনেক তথ্যই প্রকাশ করতে তারা ভয় পায় বা দ্বিধাগ্রস্ত হয়। প্রথম দিকে এটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এর থেকে অন্তত এটা বোঝা যায় যে জনগণ স্বচ্ছতা-সম্পর্কিত তথ্য চাইছে।
বার্ষিক প্রতিবেদনে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যেসব কেসস্টাডি সন্নিবিষ্ট হয়েছে, তা একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত শ্রেণীর লোকজন তাদের জীবনে আইনটির প্রাসঙ্গিকতা উপলব্ধি করে আইনটির সঠিক প্রয়োগ শুরু করেছে। আগে যারা শত চেষ্টা করেও সরকার-প্রদত্ত ভিজিএফ, ভিজিডি কার্ড, বিধবাভাতা, বয়স্কভাতা, আবাসন-সহায়তা ইত্যাদি পেত না, প্রধানত দুর্নীতির কারণে, তাদের অনেকেই এখন তথ্য আইন প্রয়োগ করে প্রাপ্য অধিকার অর্জন করছে। এ পর্যন্ত তথ্য কমিশনে যতগুলো অভিযোগপত্র জমা পড়েছে এবং যেসব অভিযোগের শুনানি সমাপ্ত হয়েছে, তার সিংহভাগই এসেছে এসব জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে। এ ব্যাপারে এনজিওগুলোর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তারা এ ব্যাপারে আরও এগিয়ে এলে আইনটির প্রয়োগ আরও অনেক বাড়বে।
বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী, বিভিন্ন পেশার ব্যক্তি বা গণমাধ্যম এখনো আইনটি ব্যবহারে আগ্রহী নয়। অনেকেরই আইনটি সম্বন্ধে সম্যক ধারণা নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সিংহভাগ আবেদনই আসে সরকারি চাকরিজীবীদের কাছ থেকে; বেশির ভাগই বদলি, পদোন্নতি, পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড ইত্যাদি সংক্রান্ত। আমাদের দেশেও সরকারি কর্মকর্তারা তথ্য চেয়ে আবেদন করা শুরু করলে অবস্থার পরিবর্তন হবে আশা করা যায়।
গত তিন বছরে তথ্য কমিশনে মাত্র ১০৪টি অভিযোগপত্র জমা পড়েছে। যে দেশে জনগণ অন্যায়-অবিচারের ব্যাপারে এত সোচ্চার, বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যাদের অভিযোগের অন্ত নেই, সেই দেশে অভিযোগ করার সুযোগ থাকলেও এত কম অভিযোগ আসার কী কারণ, তা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। তথ্য কমিশন গত তিন বছরে ১০৪টি অভিযোগের মধ্যে আমলে নিয়েছে মাত্র ৪৪টি, নিষ্পত্তি করেছে ৪১টি। এ ছাড়া খারিজ বা স্থগিত করা হয়েছে ৬০টি। জরিমানা করা হয়েছে মাত্র একটি। এই রেকর্ড হতাশাব্যঞ্জক।
তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের এই শ্লথগতি দূর করতে হলে সরকারকে যেমন আরও মনোযোগী হতে হবে, তেমনি নাগরিক সমাজকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। এনজিও সমাজ তৃণমূল মানুষের ক্ষেত্রে আইনটির প্রাসঙ্গিকতা যেমন তুলে ধরতে শুরু করেছে, সেভাবে মধ্যবিত্ত সমাজও যদি এটির ব্যবহার শুরু করে, তবেই আইনটির অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোও আইনটি কাজে লাগাতে পারে।
তবে প্রাথমিক পর্যায়ে তথ্য কমিশনের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আবেদন, আপিল ও অভিযোগের প্রক্রিয়াকে জনগণের কাছে সহজ করার অনেক সুযোগ আছে। কমিশন ১০৪টি অভিযোগের মধ্যে ৬০টিই খারিজ বা স্থগিত করেছে। অভিযোগ আমলে না নেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, আইন যথাযথভাবে অনুসরণপূর্বক নির্ধারিত ফরম্যাট অনুযায়ী দাখিল না করা; আপিল দায়ের না করে কমিশনে অভিযোগ দায়ের করা; কাঙ্ক্ষিত তথ্য আবেদনকৃত প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত না থাকা; আবেদনের বিষয় সুস্পষ্ট না হওয়া; আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতামত গ্রহণের প্রয়োজন থাকা ইত্যাদি। এসব ব্যাপারে কমিশন সহায়ক ভূমিকা পালন করলে হয়তো অবস্থার পরিবর্তন হতো। কারণ, আবেদন খারিজ হলে অনেক আবেদনকারী উৎসাহ হারায়। ফরম বা ফরম্যাট ব্যবহারের ব্যাপারে কমিশন একটু নমনীয়তা দেখালে অনেকেই আইনটি ব্যবহারে উৎসাহিত হবে। আইনে উল্লেখ আছে, মুদ্রিত ফরম সহজলভ্য না হলে আইনে বর্ণিত বিষয়গুলো উল্লেখপূর্বক আবেদন করা যায়। ভারতের কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ফরমবিহীন পোস্টকার্ডে কাঙ্ক্ষিত তথ্যের সঠিক বর্ণনা থাকলে আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে। নাগরিকবান্ধব কোনো তথ্য কমিশনের কাছে এটাই কাম্য। আমাদের তথ্য কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নামেই আবেদন পাঠাতে হবে, তাঁর পদের উল্লেখ যথেষ্ট নয়। অথচ আইনের কোথাও পরিষ্কার করে এই বিধান নেই। তা ছাড়া, অনেক কর্তৃপক্ষ আইন প্রণয়নের তিন বছর পরও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। পরিশেষে আমরা বলতে চাই, তথ্য অধিকার আইনের সাফল্য সরকার ও জনগণ সবারই কাম্য। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় ও সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নে আইনটির সঠিক ব্যবহার আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অপরিহার্য।
শামসুল বারি, সুরাইয়া বেগম ও উৎপল কান্তি খীসা: তথ্য অধিকার টিম-রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ, বাংলাদেশ।
No comments