দ্রব্যমূল্য-‘রাজনৈতিক পদক্ষেপ’ আয়বৈষম্য বাড়াবে by মোহাম্মদ হেলাল
রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকার প্রতিবছর নানাবিধ বাজার নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। তার কতটা বাস্তবে কাজে আসে, তা নিয়ে সন্দিহান আমাদের অনেকেই। ব্যবসায়ীরা সরকার-গৃহীত পদক্ষেপ মানেন না কিংবা মানতে চান না বলেই গৃহীত পদক্ষেপ কাজে আসে না—এসব অভিযোগই আমরা জানি বিভিন্ন লেখালেখির
বদৌলতে। এই উপসংহারে আসার মূল ভিত্তি হলো, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারা। তবে পদক্ষেপ সঠিকভাবে না নিলে কিন্তু গৃহীত পদক্ষেপ কাজে আসেনি, ব্যবসায়ীদের না মানার কারণে এমনটি বলা ঠিক নয়। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আমাদের সবার আগে দেখতে হবে গৃহীত পদক্ষেপ পর্যাপ্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে নেওয়া হয়েছে কি না। তা না হলে গৃহীত পদক্ষেপ নিয়েও এ ধরনের আশঙ্কা দেখা দেয়। ২৬ জুন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ‘আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ ১ শতাংশ ও খুচরা ব্যবসায়ীরা ১০ শতাংশের বেশি মুনাফা করতে পারবেন না’—এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ওই দিনই ব্যবসায়ীদের চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়ে দেয়। তার পরদিন বুধবার থেকেই এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি বলেই আমরা পত্রপত্রিকায় দেখেছি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এভাবে মুনাফার সীমা নির্ধারণ করার বাস্তবতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কিসের ভিত্তিতে এই সীমা নির্ধারণ করা হলো আর কীভাবে এটি বাস্তবায়ন করা হবে, তা বোধগম্য নয়। যৌক্তিক মুনাফার পরিমাণ বা হার কত, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। ধরা যাক, একজন খুচরা বিক্রেতা প্রতিদিন ১০০ কেজি পেঁয়াজ কিনে নিয়ে এসে এর পুরোটাই ওই দিন বিক্রি করে দেন। ১০০ কেজি কিনতে তাঁর আনুমানিক লাগে এক হাজার ৫০০ টাকা। ১০ শতাংশ লাভে এক হাজার ৬৫০ টাকায় বিক্রি করেন। লাভ ১৫০ টাকা। পরদিন একইভাবে আবারও ওই এক হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে ১৫০ টাকা লাভ করেন। এভাবে এক মাসে তিনি চার হাজার ৫০০ টাকা লাভ করতে পারবেন। তার মানে মাসে ৩০০ শতাংশ লাভ। যদি এমন হয় যে তাঁর দুই দিন লাগে এই পেঁয়াজ বিক্রি করতে, তবে লাভ হবে অর্ধেক, মানে মাসে ১৫০ শতাংশ। যত বেশি দিন ধরে রাখবেন, ততই মুনাফা কমে আসবে। তিনি বাকিতে কিনে নগদে বিক্রি করলে লাভ আরও বেশি হবে। বাকিতে বিক্রি করলে লাভ আরও কম হবে। নিট মুনাফা বের করতে হলে তাঁর শ্রম, দোকান ভাড়া ইত্যাদিসহ আরও অনেক বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। এই বিবেচ্য বিষয়গুলো একেক পণ্যের ক্ষেত্রে একেক রকম। তাই মুনাফার সর্বোচ্চ সীমাও পণ্যভেদে ভিন্ন হওয়া উচিত। মুনাফার একক সর্বোচ্চ সীমা বসানোর কারণে বাস্তবে এই নিয়ন্ত্রণ খুব একটা কাজে আসবে না। রমজান মাসের আগে দাম বাড়ার প্রত্যাশাজনিত কারণে দাম কিছুটা বেশি বাড়লেও তা কিছুদিনের মধ্যে কমে আসে। এ নিয়মের ফলে তা শিগগির কমবে না। এত বিশাল হারে লাভের ধারণার কারণে ট্যাক্সের লোকজনের কাছে হয়রানির শিকার হতে পারেন অনেক ব্যবসায়ী। তাঁরা টার্নওভারের ওপর ভিত্তি করে অনেক বেশি ট্যাক্স দাবি করতে পারেন ব্যবসায়ীদের কাছে।
অন্যদিকে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির অন্যান্য খাতকে নিয়ন্ত্রণ না করে শুধু কতিপয় দ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ ওই দ্রব্যগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পেশার লোকজনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেন, যা একেবারে কাম্য নয়। রমজান মাসে কি শুধু কতিপয় নিত্যপণ্য—যেগুলোর দাম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে—সেগুলোর দামই বাড়ে? অবশ্যই না। ঈদ এবং রমজান মাসে ভোগ করা হয় এমন অনেক জিনিস রয়েছে, যেগুলোর দাম বাড়ে লাগামহীনভাবে। রমজান মাসে এই চাল, ডাল আর তেল ব্যবসায়ীরা পরিবারের সদস্যদের জন্য যে কাপড় কিনতেন, তার দাম কী হারে বাড়ে তা আমরা জানি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের এক বন্ধু টি-শার্ট বানিয়ে বিক্রি করে। আমাকে বলল, কোনো এক ডিজাইনের একটি টি-শার্ট ৮৫ টাকায় বানিয়ে ঢাকার আজিজ মার্কেটে অন্যূন ২০০ টাকা দামে সে বিক্রি করে। একটু দামি কাপড়ের দিকে গেলে লাভের হার ঢের বেশি। এসব দামেরও নিয়ন্ত্রণ দরকার। তা না হলে নিয়ন্ত্রণ একপেশে হয়ে যাবে। এই নিয়ন্ত্রণ দরকার সারা বছর ধরে, সব দ্রব্যের জন্য। দ্রব্যমূল্য নিয়ে সাধারণ মানুষ একেবারে দিশেহারা—এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সমস্যা দ্রব্যমূল্য সাময়িক বৃদ্ধির সমস্যা নয়। এ সমস্যা উচ্চ দ্রব্যমূল্যের সমস্যা। সীমিত আয় দিয়ে জীবনযাপনের সমস্যা। শুধু রমজান মাসের সমস্যা নয়; বরং রমজান মাসের আগে কিংবা সারা বছরের সমস্যা। সারা বছর দ্রব্যমূল্য মানুষের নাগালের মধ্যে থাকলে এবং মানুষ দ্রব্যমূল্য নিয়ে স্বস্তিতে থাকলে রমজান মাসে একটু-আধটু বৃদ্ধিতে কেউ কিছু মনে করত না। ফলে আমাদের কথা বলা দরকার, কেন সারা বছর ধরেই দ্রব্যমূল্য এত বেশি।
সারা বছর ধরে আমরা দ্রব্যমূল্য নিয়ে কথা বলি না, তা কিন্তু নয়। কথা বলি চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ কতিপয় দ্রব্যের দাম নিয়ে। কোনো একটি পরিবার গড়ে সাধারণত তার মাসিক মোট খরচের মাত্র এক-দেড় শতাংশ ব্যয় করে তেলের ওপর। চিনির ওপর আরও কম। অথচ এসব দ্রব্যের দাম নিয়ে কত মাতামাতি। ফলে এসব দ্রব্য পলিটিক্যাল বিবেচনায় সংবেদনশীল দ্রব্য হয়ে গেছে। অন্যদিকে বাড়িভাড়ার মতো আইটেম—একজন নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের বেতন কিংবা উপার্জনের সিংহভাগ খরচ করতে হয় যার ওপর, তার কার্যকর নিয়ন্ত্রণের নেই কোনো বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ। আমার বাড়িওয়ালা বাড়িভাড়া বাড়িয়েছে এক বছরে ১৭ শতাংশ। আমার বেতন না বাড়লেও মূল্যস্ফীতির দোহাই দিয়ে ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে আমার বাড়িওয়ালা। তার মানে মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব কিন্তু পড়ছে না তার ওপর। সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকলে কিন্তু এমনটি ঘটত না। মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব খানিকটা বাড়িওয়ালার ঘাড়েও চাপত। সেবা খাতের কোনোটির ওপরই নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ। একজন স্কুলশিক্ষক প্রাইভেট কোচিং ফি বাড়ান ইচ্ছামাফিক। একজন অধ্যাপক চিকিৎসক ৫০০ টাকা রোগী দেখার ফি নেওয়ার পরও ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমিশন নেন বিভিন্ন টেস্ট বা পরীক্ষা থেকে। নীতি-নৈতিকতার কোনো বালাই নেই এসবে। একই ধরনের নিয়ন্ত্রণহীনতা রয়েছে সেবা খাতের আরও অনেক পেশায়।
প্রশ্ন হলো, অন্যান্য খাতের নিয়ন্ত্রণহীনতার প্রভাব তো পড়ছে চাল, ডাল আর তেল ব্যবসায়ীর ওপর। প্রভাব পড়ছে একজন কৃষকের ওপর, একজন শ্রমিকের ওপর; সর্বোপরি নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর। চালের দাম কমিয়ে রাখায় খুব একটা বাড়ছে না কৃষকের আয়। অথচ বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে তাঁকে অকৃষিপণ্য। ফলে গরিব বানিয়ে রাখছি আমরা অনেক কৃষককে। অপরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণের কারণে মূল্যস্তরের অল্পস্বল্প ওঠানামা কিন্তু দারিদ্র্যসীমার নিচে নামিয়ে নিয়ে আসে অনেক নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তকে। অতএব, আমাদের দরকার একটা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতকে নিয়ন্ত্রণ করবে, নিয়ন্ত্রণ করবে দ্রব্য ও সেবা খাত উভয়কেই। তবে অবশ্যই তা হতে হবে বাজার অর্থনীতির মূল স্পিরিটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং প্রয়োজনমাফিক। এই প্রয়োজনবোধ আসতে হবে প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থার কাঠামোগত ঘাটতি থেকে, বাজারব্যবস্থার পর্যাপ্ত বিচার-বিশ্লেষণ থেকে। আমদানি করা দ্রব্যের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের দাম, নাকি সরবরাহ চেইনে কোনো অপ্রতিযোগিতামূলক আচরণের করণে এমনটি ঘটছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরবরাহের ক্ষেত্রে খরচ বৃদ্ধি, নাকি সরবরাহ চেইনে কোনো অপ্রতিযোগিতামূলক আচরণের কারণে এমনটি ঘটছে, তা তলিয়ে দেখতে হবে।
মোহাম্মদ হেলাল: শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; রিসার্চ ফেলো, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি)।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এভাবে মুনাফার সীমা নির্ধারণ করার বাস্তবতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কিসের ভিত্তিতে এই সীমা নির্ধারণ করা হলো আর কীভাবে এটি বাস্তবায়ন করা হবে, তা বোধগম্য নয়। যৌক্তিক মুনাফার পরিমাণ বা হার কত, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। ধরা যাক, একজন খুচরা বিক্রেতা প্রতিদিন ১০০ কেজি পেঁয়াজ কিনে নিয়ে এসে এর পুরোটাই ওই দিন বিক্রি করে দেন। ১০০ কেজি কিনতে তাঁর আনুমানিক লাগে এক হাজার ৫০০ টাকা। ১০ শতাংশ লাভে এক হাজার ৬৫০ টাকায় বিক্রি করেন। লাভ ১৫০ টাকা। পরদিন একইভাবে আবারও ওই এক হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে ১৫০ টাকা লাভ করেন। এভাবে এক মাসে তিনি চার হাজার ৫০০ টাকা লাভ করতে পারবেন। তার মানে মাসে ৩০০ শতাংশ লাভ। যদি এমন হয় যে তাঁর দুই দিন লাগে এই পেঁয়াজ বিক্রি করতে, তবে লাভ হবে অর্ধেক, মানে মাসে ১৫০ শতাংশ। যত বেশি দিন ধরে রাখবেন, ততই মুনাফা কমে আসবে। তিনি বাকিতে কিনে নগদে বিক্রি করলে লাভ আরও বেশি হবে। বাকিতে বিক্রি করলে লাভ আরও কম হবে। নিট মুনাফা বের করতে হলে তাঁর শ্রম, দোকান ভাড়া ইত্যাদিসহ আরও অনেক বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। এই বিবেচ্য বিষয়গুলো একেক পণ্যের ক্ষেত্রে একেক রকম। তাই মুনাফার সর্বোচ্চ সীমাও পণ্যভেদে ভিন্ন হওয়া উচিত। মুনাফার একক সর্বোচ্চ সীমা বসানোর কারণে বাস্তবে এই নিয়ন্ত্রণ খুব একটা কাজে আসবে না। রমজান মাসের আগে দাম বাড়ার প্রত্যাশাজনিত কারণে দাম কিছুটা বেশি বাড়লেও তা কিছুদিনের মধ্যে কমে আসে। এ নিয়মের ফলে তা শিগগির কমবে না। এত বিশাল হারে লাভের ধারণার কারণে ট্যাক্সের লোকজনের কাছে হয়রানির শিকার হতে পারেন অনেক ব্যবসায়ী। তাঁরা টার্নওভারের ওপর ভিত্তি করে অনেক বেশি ট্যাক্স দাবি করতে পারেন ব্যবসায়ীদের কাছে।
অন্যদিকে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির অন্যান্য খাতকে নিয়ন্ত্রণ না করে শুধু কতিপয় দ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ ওই দ্রব্যগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পেশার লোকজনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেন, যা একেবারে কাম্য নয়। রমজান মাসে কি শুধু কতিপয় নিত্যপণ্য—যেগুলোর দাম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে—সেগুলোর দামই বাড়ে? অবশ্যই না। ঈদ এবং রমজান মাসে ভোগ করা হয় এমন অনেক জিনিস রয়েছে, যেগুলোর দাম বাড়ে লাগামহীনভাবে। রমজান মাসে এই চাল, ডাল আর তেল ব্যবসায়ীরা পরিবারের সদস্যদের জন্য যে কাপড় কিনতেন, তার দাম কী হারে বাড়ে তা আমরা জানি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের এক বন্ধু টি-শার্ট বানিয়ে বিক্রি করে। আমাকে বলল, কোনো এক ডিজাইনের একটি টি-শার্ট ৮৫ টাকায় বানিয়ে ঢাকার আজিজ মার্কেটে অন্যূন ২০০ টাকা দামে সে বিক্রি করে। একটু দামি কাপড়ের দিকে গেলে লাভের হার ঢের বেশি। এসব দামেরও নিয়ন্ত্রণ দরকার। তা না হলে নিয়ন্ত্রণ একপেশে হয়ে যাবে। এই নিয়ন্ত্রণ দরকার সারা বছর ধরে, সব দ্রব্যের জন্য। দ্রব্যমূল্য নিয়ে সাধারণ মানুষ একেবারে দিশেহারা—এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সমস্যা দ্রব্যমূল্য সাময়িক বৃদ্ধির সমস্যা নয়। এ সমস্যা উচ্চ দ্রব্যমূল্যের সমস্যা। সীমিত আয় দিয়ে জীবনযাপনের সমস্যা। শুধু রমজান মাসের সমস্যা নয়; বরং রমজান মাসের আগে কিংবা সারা বছরের সমস্যা। সারা বছর দ্রব্যমূল্য মানুষের নাগালের মধ্যে থাকলে এবং মানুষ দ্রব্যমূল্য নিয়ে স্বস্তিতে থাকলে রমজান মাসে একটু-আধটু বৃদ্ধিতে কেউ কিছু মনে করত না। ফলে আমাদের কথা বলা দরকার, কেন সারা বছর ধরেই দ্রব্যমূল্য এত বেশি।
সারা বছর ধরে আমরা দ্রব্যমূল্য নিয়ে কথা বলি না, তা কিন্তু নয়। কথা বলি চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ কতিপয় দ্রব্যের দাম নিয়ে। কোনো একটি পরিবার গড়ে সাধারণত তার মাসিক মোট খরচের মাত্র এক-দেড় শতাংশ ব্যয় করে তেলের ওপর। চিনির ওপর আরও কম। অথচ এসব দ্রব্যের দাম নিয়ে কত মাতামাতি। ফলে এসব দ্রব্য পলিটিক্যাল বিবেচনায় সংবেদনশীল দ্রব্য হয়ে গেছে। অন্যদিকে বাড়িভাড়ার মতো আইটেম—একজন নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের বেতন কিংবা উপার্জনের সিংহভাগ খরচ করতে হয় যার ওপর, তার কার্যকর নিয়ন্ত্রণের নেই কোনো বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ। আমার বাড়িওয়ালা বাড়িভাড়া বাড়িয়েছে এক বছরে ১৭ শতাংশ। আমার বেতন না বাড়লেও মূল্যস্ফীতির দোহাই দিয়ে ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে আমার বাড়িওয়ালা। তার মানে মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব কিন্তু পড়ছে না তার ওপর। সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকলে কিন্তু এমনটি ঘটত না। মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব খানিকটা বাড়িওয়ালার ঘাড়েও চাপত। সেবা খাতের কোনোটির ওপরই নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ। একজন স্কুলশিক্ষক প্রাইভেট কোচিং ফি বাড়ান ইচ্ছামাফিক। একজন অধ্যাপক চিকিৎসক ৫০০ টাকা রোগী দেখার ফি নেওয়ার পরও ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমিশন নেন বিভিন্ন টেস্ট বা পরীক্ষা থেকে। নীতি-নৈতিকতার কোনো বালাই নেই এসবে। একই ধরনের নিয়ন্ত্রণহীনতা রয়েছে সেবা খাতের আরও অনেক পেশায়।
প্রশ্ন হলো, অন্যান্য খাতের নিয়ন্ত্রণহীনতার প্রভাব তো পড়ছে চাল, ডাল আর তেল ব্যবসায়ীর ওপর। প্রভাব পড়ছে একজন কৃষকের ওপর, একজন শ্রমিকের ওপর; সর্বোপরি নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর। চালের দাম কমিয়ে রাখায় খুব একটা বাড়ছে না কৃষকের আয়। অথচ বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে তাঁকে অকৃষিপণ্য। ফলে গরিব বানিয়ে রাখছি আমরা অনেক কৃষককে। অপরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণের কারণে মূল্যস্তরের অল্পস্বল্প ওঠানামা কিন্তু দারিদ্র্যসীমার নিচে নামিয়ে নিয়ে আসে অনেক নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তকে। অতএব, আমাদের দরকার একটা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতকে নিয়ন্ত্রণ করবে, নিয়ন্ত্রণ করবে দ্রব্য ও সেবা খাত উভয়কেই। তবে অবশ্যই তা হতে হবে বাজার অর্থনীতির মূল স্পিরিটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং প্রয়োজনমাফিক। এই প্রয়োজনবোধ আসতে হবে প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থার কাঠামোগত ঘাটতি থেকে, বাজারব্যবস্থার পর্যাপ্ত বিচার-বিশ্লেষণ থেকে। আমদানি করা দ্রব্যের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের দাম, নাকি সরবরাহ চেইনে কোনো অপ্রতিযোগিতামূলক আচরণের করণে এমনটি ঘটছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরবরাহের ক্ষেত্রে খরচ বৃদ্ধি, নাকি সরবরাহ চেইনে কোনো অপ্রতিযোগিতামূলক আচরণের কারণে এমনটি ঘটছে, তা তলিয়ে দেখতে হবে।
মোহাম্মদ হেলাল: শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; রিসার্চ ফেলো, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি)।
No comments