আয় বৃষ্টি ঝেঁপে by এনায়েত রসুল
মামাবাড়ি বেড়াতে আসার পর থেকে গরমটা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অঞ্জলির মনে হচ্ছে ওকে কোনো ওভেনের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে আর সে পুড়ে পুড়ে রোস্ট হচ্ছে। কিন্তু রোস্ট হওয়ার জন্য তো অঞ্জলি মামাবাড়ি আসেনিÑএসেছে বেড়াবার জন্য। সেই বেড়ানোটা হচ্ছে না। গরমের কথা বলে কেউ ওকে পাড়া বেড়াতে দিচ্ছে না।
দুপুরে লুডু খেলছিলো, মা বললেন লুডু খেলা চলবে না। এখন ঘুমোতে হবে। অঞ্জলি তাই ঘুমোতে গেল। আর তার পরপরই ঘটলো অবিশ্বাস্য ঘটনাটা। অঞ্জলির মনে হলো কেউ ওকে কিছু বলছে। কে কি বলছে তা শোনার জন্য উঠে বসলো অঞ্জলি। সে দেখতে পেল ফুটফুটে একটা ব্যাঙ উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। সেই ব্যাঙটাই ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইছে!
ঘর থেকে বেরিয়ে অঞ্জলি ব্যাঙের কাছে গেল। তারপর জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি আমাকে কিছু বলছো? ব্যাঙ বলল, কয়েক দিন ধরে দেখছি তুমি খুব একা থাকো। ব্যাপার কি বলো তো? তোমার কি কোনো বন্ধু নেই? অঞ্জলি বলল, বন্ধু আছে। তবে গরমের জন্য কেউ আমাকে সঙ্গ দিতে চাইছে না।
এ কেমন কথা! একটু না হয় গরম পড়েছেই। তা বলে বন্ধু বন্ধুকে সঙ্গ দেবে না? না ভাই, আমি মানুষদের নিয়ম-কানুন বুঝি না।একেবারে গুছিয়ে কথাগুলো বলল, ব্যাঙ। সে কথা শুনে অঞ্জলি বলল, ব্যাঙ ভাইয়া! মানুষদের কথা বাদ দাও। তুমি আমাকে সঙ্গ দেবে? ব্যাঙ বলল, স্যরি, কাউকে সঙ্গ দেয়ার মতো সময় আমার নেই। আমি ভাই কাজের ব্যাঙ। কাজ ছাড়া অন্যকিছু বুঝি না। ব্যাঙের কথা শুনে অঞ্জলির হাসি পেলÑসে নাকি কাজের ব্যাঙ! ব্যাঙরাও আবার কাজের হয় নাকি? অঞ্জলি বলল, বুঝলাম তুমি কাজের ব্যাঙ। আসলে তুমি কে? ব্যাঙ বলল, আমি ব্যাঙ রাজার ছেলে ব্যাঙ কুমার। তোমার মামাদের পুকুরপাড়ে যে কচুবন রয়েছে, সেখানে আমাদের রাজ্য। মা আছেন বাবা আছেন। আর ছোট্ট একটা বোন আছেÑবোনের নাম বেঙ্গি কুমারী। আমার কথা তো শুনলে। এবার তোমার কথা বলো। অঞ্জলি নিজের নামধাম সব বলল। আর বলল, ভীষণ গরম এখানে। ব্যাঙ কুমার বলল, শুধু গরম? বলো প্রাণ কেড়ে নেয়ার মতো গরম। একফোঁটা বৃষ্টির জন্য ব্যাঙরা ছটফট করছে। বৃষ্টি না হলে আমাদের চলে না। অঞ্জলি বলল, আমাদেরও চলে না। বৃষ্টির অভাবে নদী-নালা শুকিয়ে যাচ্ছে। মাটি ফেটে চৌচির হচ্ছেÑসে এক দুঃসহ অবস্থা! তো ব্যাঙ কুমার! এমন কাঠফাটা রোদে ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছো কেনো? তোমার মা তোমাকে শুয়ে থাকতে বলেননি?
ব্যাঙ কুমার বলল, শুয়ে থাকার মতো অবস্থা আছে নাকি? আমি ব্যাঙদের রাজপুত্র। ওদের সমস্যা দূর করার দায়িত্ব আমার। সেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অঞ্জলি জিজ্ঞেস করলো, সমস্যাটা কি? ব্যাঙ কুমার বলল, বিরাট সমস্যা। বৃষ্টি না হলে আমার প্রজারা মারা যাবে। তাই আমাকে বৃষ্টি নামাতেই হবে। নামাতে চাইলেই তো বৃষ্টি নামবে না। তুমি কেমন করে বৃষ্টি নামাবে? বলল অঞ্জলি। তা শুনে ব্যাঙ কুমার বলল, আমি বৃষ্টি নামাবো গান গেয়ে। আমার গান শুনে মেঘরাজা খুশি হয়ে বৃষ্টি ঢেলে দেবে। আমি খুব ভালো গান গাইতে পারি। তুমি গান শুনবে? অঞ্জলি বলল, গান শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। আমি তোমাকে হাতে তুলে নিচ্ছি। তুমি হাতের ওপর বসে গান গাও। জীবনে কখনো ব্যাঙ ছুঁয়ে দেখেনি অঞ্জলি। কিন্তু আজ ব্যাঙ কুমারকে হাতের তালুতে তুলে নিলো। তারপর বলল, এবার গান গাও। ব্যাঙ কুমার ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করে একটা গান গাইল। তারপর বলল, এটা বৃষ্টি নামাবার গান। কেমন লেগেছে গানটা? অঞ্জলি বলল, কথা বুঝিনি। তবে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর সুর ভালো লেগেছে। কিন্তু তোমার গান শুনে তো বৃষ্টি নামছে না! ব্যাপার কি বলো তো? ব্যাঙ কুমার বলল, তাইতো! কতো দরদ ঢেলে গাইলাম, অথচ বৃষ্টি নামার নাম-গন্ধও নেই! আসলে ছোট প্রাণীদের কথা কেউ শোনে নাÑআল্লাহও না। অঞ্জলি বলল, এবার আমাকে তোমার কথার প্রতিবাদ করতে হচ্ছে, ব্যাঙ ভাইয়া। মানুষ বলো আর ব্যাঙ বলো, সব প্রাণীকেই আল্লাহ বানিয়েছেন। তাঁর কাছে সবাই সমান।
তাই যদি হবে, তবে আমার অনুরোধে বৃষ্টি নামছে না কেনো? ঠোঁট ফুলিয়ে বলল ব্যাঙ কুমার। আর সে প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে অঞ্জলিকে ভাবতে হলো। এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে অঞ্জলি বলল, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছো আমার ভাষায়। কিন্তু গান গেয়েছো নিজের ভাষায়। কি বলেছো সেই গানে, তা তো বুঝিনি। মনে হচ্ছে তোমার গান শুনে মেঘরাজা খুশি হয়নি, তাই বৃষ্টি ঢেলে দেয়নি। ব্যাঙ কুমার বলল, হয়তো তোমার কথাই সত্য। কিন্তু বৃষ্টি না হলে তো আমরা মরে যাবো। আহা রে, এক ফোঁটা বৃষ্টিও যদি নামতো। ব্যাঙ কুমারের কথা শুনে অঞ্জলির চোখে পানি এলো। অঞ্জলি মনে মনে বলল, হে আল্লাহ! বৃষ্টি দাও। এক ফোঁটা বৃষ্টি দাও। তোমার সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বৃষ্টি দাও...বৃষ্টি দাও...এভাবে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতে করতে অঞ্জলির মনের কোণে একটি গানের কলি ভেসে এলো। অঞ্জলির মনে হলো, ওটা কোনো গান নয়Ñওটা পবিত্র এক প্রার্থনা। আর এমন ভয়াবহ দুঃসময়ের কথা ভেবেই গানটি লেখা হয়েছে। সত্য সত্যই প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাত উপরে তুলে অঞ্জলি গাইল:
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
ধান দেবো মেপে
আয় বৃষ্টি বরষার অঙ্গনে
কাঠফাটা রোদের আগুনে
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে আয়...
কি অবাক কা-! মাত্র এটুকু গেয়েছে অঞ্জলি, অমনি আকাশ কড়কড় করে ডেকে উঠল। কালো কালো মেঘ ভেসে এলো। রোদ নিভে গেল। বইলো শীতল বাতাস। আর টিনের চালে শব্দ তুলে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টিতে ভিজে গেল মামাদের গ্রাম। পথঘাটÑসব কিছু। ব্যাঙ কুমারের গায়েও বৃষ্টি পড়ল। সেই বৃষ্টির ছোঁয়ায় ব্যাঙ কুমার চনমন করে উঠল। অঞ্জলির হাত থেকে সে লাফিয়ে নামল উঠোনে। তারপর বলল, বৃষ্টি নামিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। তোমাকে মনে থাকবে আপুমণি। অঞ্জলি বলতে চেয়েছিল, তোমাকেও মনে থাকবে, কিন্তু সে কথা আর বলা হলো না। তার আগেই লাফ দিয়ে ব্যাঙ কুমার উঠোন পেরিয়ে চলে গেল। এ সময় মা এসে অঞ্জলির মাথায় হাত রাখলেন। আদুরে গলায় মা বললেন, ওঠ্ অঞ্জলি, ওঠ্। দেখ্ কেমন বৃষ্টি নেমেছে! অঞ্জলি ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইলো আর অবাক বিস্ময়ে দেখল, সত্য সত্যই বৃষ্টি নেমেছে! আকাশ ভেঙে মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে! বৃষ্টির ফোঁটা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গরমকে।
No comments