বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৫৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মোহাম্মদ আবদুর রব, বীর উত্তম দক্ষ এক প্রতিরোধ যোদ্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে ১৯৭০ সালে অবসর নেওয়ার পর মোহাম্মদ আবদুর রব (এম এ রব) রাজনীতিতে যুক্ত হন।
ওই বছরই অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় বৃহত্তর সিলেট জেলায় প্রতিরোধ যুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
প্রতিরোধ যুদ্ধকালে এম এ রবের ভূমিকার বর্ণনা পাওয়া যায় চিত্তরঞ্জন দত্তের (বীর উত্তম) ১৯৭৩ সালের বয়ানে। তিনি বলেন, ‘২৭ মার্চ আমার বাড়িতে (হবিগঞ্জ) কয়েকজন ছাত্র এসে আমাকে বলল, “দাদা, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।” আমি বললাম, “আমিও তাই চাই।”...আমি তাদের বললাম, কর্নেল রব (এম এ রব) এমসিএর (এমএনএ) কথা। কর্নেল রব যদি আমাকে বলেন, “তাহলে আমি এই মুহূর্তেই প্রস্তুত।”
‘সেদিনই বেলা প্রায় দুইটায় জেনারেল রব আমাকে তাঁর বাড়িতে ডেকে পাঠান। গিয়ে দেখলাম, কামরার ভেতরে বসে আছে আনসার-মুজাহিদসহ সামরিক বাহিনীর কয়েকজন। বাইরে খোলা জায়গায় অনেক ভিড়। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ১৫০ জনের মতো লোক তৈরি। কয়েকটি বাস-ট্রাক এক পাশে।
‘ঘরে ঢুকতেই জেনারেল রব আমাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করে দিয়ে বললেন, “আজই পাঁচটায় যে লোকবল আছে, তাঁদের নিয়ে সিলেটকে মুক্ত করার জন্য যাত্রা করব।” তিনি যুদ্ধ পরিচালনার ভার আমাকে দিলেন।...আমি, মানিক চৌধুরী ও জেনারেল রব একই গাড়িতে বসেছিলাম। সেদিন আমাদের গন্তব্য ছিল রশীদপুর চা-বাগান। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় ১১টা বেজেছিল।’
শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, শেরপুর-সাদিপুর, সিলেটসহ আরও কয়েক স্থানে তখন প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে এম এ রব সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তাঁর প্রত্যক্ষ পরামর্শ ও পরিচালনায়ই বেশির ভাগ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ সময় (৪ ও ১০ এপ্রিল) হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় প্রতিরোধ যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক দলনেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠক আয়োজনে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ক্রমে সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে উঠতে থাকে। এরপর মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন কর্নেল এম এ জি ওসমানী (পরে জেনারেল)। তাঁর অধীনে চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পান এম এ রব। তিনি পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাঁর সদর দপ্তর ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায়।
১৪ ডিসেম্বর এম এ জি ওসমানী ও তিনি হেলিকপ্টারে সিলেটে যুদ্ধ এলাকা পরিদর্শনকালে ফেঞ্চুগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি করে। তখন তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। তাঁর পায়ে গুলি লাগে। পরে আগরতলায় তাঁর চিকিৎসা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ পরিকল্পনা ও পরিচালনায় দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য এম এ রবকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর সনদ নম্বর ১।
এম এ রবকে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সম্মানিত মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে অবসর প্রদান করা হয়। পরে তিনি কয়েক বছর বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অবৈতনিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধাহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে রাষ্ট্রীয় নানা সুবিধা প্রদানে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। ১৯৭৫ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি মারা যান। এম এ রব চিরকুমার ছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার কুর্শা-খাগাউড়া গ্রামে। বাবার নাম মনোয়ার আলী, মা রাশিদা বেগম।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
প্রতিরোধ যুদ্ধকালে এম এ রবের ভূমিকার বর্ণনা পাওয়া যায় চিত্তরঞ্জন দত্তের (বীর উত্তম) ১৯৭৩ সালের বয়ানে। তিনি বলেন, ‘২৭ মার্চ আমার বাড়িতে (হবিগঞ্জ) কয়েকজন ছাত্র এসে আমাকে বলল, “দাদা, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।” আমি বললাম, “আমিও তাই চাই।”...আমি তাদের বললাম, কর্নেল রব (এম এ রব) এমসিএর (এমএনএ) কথা। কর্নেল রব যদি আমাকে বলেন, “তাহলে আমি এই মুহূর্তেই প্রস্তুত।”
‘সেদিনই বেলা প্রায় দুইটায় জেনারেল রব আমাকে তাঁর বাড়িতে ডেকে পাঠান। গিয়ে দেখলাম, কামরার ভেতরে বসে আছে আনসার-মুজাহিদসহ সামরিক বাহিনীর কয়েকজন। বাইরে খোলা জায়গায় অনেক ভিড়। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ১৫০ জনের মতো লোক তৈরি। কয়েকটি বাস-ট্রাক এক পাশে।
‘ঘরে ঢুকতেই জেনারেল রব আমাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করে দিয়ে বললেন, “আজই পাঁচটায় যে লোকবল আছে, তাঁদের নিয়ে সিলেটকে মুক্ত করার জন্য যাত্রা করব।” তিনি যুদ্ধ পরিচালনার ভার আমাকে দিলেন।...আমি, মানিক চৌধুরী ও জেনারেল রব একই গাড়িতে বসেছিলাম। সেদিন আমাদের গন্তব্য ছিল রশীদপুর চা-বাগান। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় ১১টা বেজেছিল।’
শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, শেরপুর-সাদিপুর, সিলেটসহ আরও কয়েক স্থানে তখন প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে এম এ রব সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তাঁর প্রত্যক্ষ পরামর্শ ও পরিচালনায়ই বেশির ভাগ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ সময় (৪ ও ১০ এপ্রিল) হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় প্রতিরোধ যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক দলনেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠক আয়োজনে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ক্রমে সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে উঠতে থাকে। এরপর মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন কর্নেল এম এ জি ওসমানী (পরে জেনারেল)। তাঁর অধীনে চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পান এম এ রব। তিনি পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাঁর সদর দপ্তর ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায়।
১৪ ডিসেম্বর এম এ জি ওসমানী ও তিনি হেলিকপ্টারে সিলেটে যুদ্ধ এলাকা পরিদর্শনকালে ফেঞ্চুগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি করে। তখন তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। তাঁর পায়ে গুলি লাগে। পরে আগরতলায় তাঁর চিকিৎসা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ পরিকল্পনা ও পরিচালনায় দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য এম এ রবকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর সনদ নম্বর ১।
এম এ রবকে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সম্মানিত মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে অবসর প্রদান করা হয়। পরে তিনি কয়েক বছর বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অবৈতনিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধাহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে রাষ্ট্রীয় নানা সুবিধা প্রদানে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। ১৯৭৫ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি মারা যান। এম এ রব চিরকুমার ছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার কুর্শা-খাগাউড়া গ্রামে। বাবার নাম মনোয়ার আলী, মা রাশিদা বেগম।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments