নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জাতি আপনার সঙ্গে আছে by মুহম্মদ শফিকুর রহমান
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে ঋণচুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও জাতিকে যেভাবে অপমান করল আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিক একই ভাষায় তার সমুচিত জবাব দিয়ে মর্যাদা রক্ষা করলেন। ঠিকই তো আর কতকাল আমরা বিদেশের কাছে হাত পাতব? তাই তো শেখ হাসিনাই কেবল
বলতে পারেন, ‘আমরা নিজস্ব অর্থায়ন দিয়ে পদ্মা সেতু বানাব।’ এই তো জাতির জনকের কন্যার কথা। আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা জনগণ শেখ হাসিনার এ দেশপ্রেমসুলভ ঘোষণার সাথে আছি, থাকব।
গত শনিবারের কলামে আমি বলেছিলাম বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করায় আমরা যতটা ঘাবড়ে গেছি বাংলার নেত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ঘাবড়াবার সামান্য চিহ্নও আমি দেখিনি। বরং তাঁর মধ্যে জাতির জনকের মতোই এক সাহসী আত্মপ্রত্যয়ী রাষ্ট্রনায়কের প্রতিচ্ছবি দেখেছি। এতে করে জাতি হিসেবে আমরাও আত্মপ্রত্যয়ী হয়েছি। তাই তো শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানানোর আগেই বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ, ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের।
১৯৭১ সালে যেভাবে বাংলার অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মুষ্টিমেয় রাজাকার-আলবদর-শান্তি কমিটির কুসন্তান বাদ দিয়ে গোটা বাঙালী জাতি অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এবারও দেশরতœ শেখ হাসিনার ডাকে তেমনি এক জাতীয় ঐক্যের আবহ তৈরি হয়েছে। এখন কেবল আহ্বানটি বাকি।
তবে হ্যাঁ, একাত্তরের মতো এবারও শেখ হাসিনার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা একশ্রেণীর মানুষের পছন্দ হয়নি। কেন শেখ হাসিনা আমেরিকাকে ক্ষ্যাপাতে চাচ্ছেন? এতে করে শেখ হাসিনা জাতিকে এক মহাসঙ্কটে নিপতিত করছেন। পদ্মা সেতু ছাড়াও আরও অনেক প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন চলছে, সেগুলোর কী হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ মানুষগুলোর পোশাকে অবশ্য বাম গন্ধ আছে। সুগন্ধ অবশ্যই নয়।
গত কয়েক রাতে আমি কয়েকটি মধ্যরাতের গলাবাজি টকশো দেখেছি। সাধারণত রাতের ঘুম নষ্ট করে টকশো দেখি না। কারণ এসব হাবিজাবি দেখার চেয়ে বিদেশী চ্যানেলের হিন্দী ছবি- সিরিয়াল দেখাও বেশি উপভোগ্য। কিন্তু যেহেতু পদ্মা সেতু এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু তাই স্যাটেলাইট চ্যালেন ইটিভি এবং বাংলা ভিশনের একাধিক টকশো দেখেছি। এসব চ্যানেলে খুঁজে খুঁজে এমন সব গলাজীবীকে আনা হয় যাদের কাছে আওয়ামী লীগ একটি ‘অগণতান্ত্রিক’ ‘স্বৈরাচারী’ রাজনৈতিক দল এবং এই দল তথা মহাজোট সরকার অশিক্ষিত, অযোগ্য, অদেশপ্রেমিক। এদের আমি মধ্যরাতের গলাজীবী নাম দিয়েছি। এরা সরাসরি না বললেও আকারে-ইঙ্গিতে বর্তমান সময়ের সফল রাষ্ট্রনয়ক সবচেয়ে যোগ্য সাহসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিরাকে পর্যন্ত আজেবাজে শব্দ মিশিয়ে সমালোচনা করেন। সমালোচনা করা অন্যায় নয়, কিন্তু সে সমালোচনা যদি গোষ্ঠীস্বার্থে হয় এবং রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী হয় তখন তা কোনভাবেই গ্রহণীয় হতে পারে না। যেমন আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, গণতন্ত্র, জাতির জনক, রাষ্ট্রের পরিধি এসব ব্যাপারে কোনভাবেই নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ নেই। অবশ্যই নেই।
পৃথিবীতে এ সময়ে বাংলাদেশ বোধহয় একমাত্র দেশ যেখানে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ দেশ ও জাতির স্বার্থের পক্ষে না দাঁড়িয়ে প্রকারান্তরে বিপক্ষেই দাঁড়ায়। এদের আবার নাম দেয়া হয়েছে সিভিল সোসাইটি। এদেরই একজন এককালে সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিল। তখনকার দিনে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং তাতে সে লেখালেখি করত। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও লেখালেখি ছাড়েনি। ওই সাপ্তাহিক পত্রিকাটির নাম ‘বিচিত্রা’। এটি চীনপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত হতো এবং এটা কে না জানে চীনপন্থীরা প্রয়োজনে রাজাকার-আলবদরদের সাথে হাত মেলাতেও দ্বিধা করে না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তা-ই দেখা গেছে। আরেকজন একটি পত্রিকা চালান, যে পত্রিকা ৫ কপি বিক্রি হয় কি-না সন্দেহ। আরেকজন একটি বেসকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এদের কথাবার্তা সব সময়ই চ্যানেলগুলোতে শোনা যায়। এদের যারা নিয়ে আসেন গলাবাজি করার জন্য তাদের অবস্থাও এমন যে পারলে এখনই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং অশিক্ষিত অযোগ্য চরম দুর্নীতিবাজ কাউকে এনে সিংহাসনে বসান। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মিলিটারি হলেও আপত্তি নেই বা লুটেরা হলেও দোষের কিছু নয়।
শেখ হাসিনা যখন বলেন, এই পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে জমি অধিগ্রহণে দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে, কোথাও কোন দুর্নীতি হয়নি। তথাকথিত সিভিল সোসাইটি বা গলাজীবীরাও কোন একটি উদাহরণও দেখাতে পারবে না। অথচ যেখানে এখনও বিশ্বব্যাংক একটি পয়সাও খরচ করেনি তাতেই তারা দুর্নীতি আবিষ্কার করলেন! এমনকি বিশ্বব্যাংকের গডফাদার আমেরিকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজেনাও যখন বলেন, “বাংলাদেশের জন্য এই সেতু (পদ্মা সেতু) অত্যন্ত জরুরী। বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়ায় আমি অত্যন্ত হতাশ হয়েছি। .... এ ব্যাপারে (দুর্নীতির) কোন প্রমাণ আমি দেখতে পাইনি। এ নিয়ে কানাডায় তদন্ত চলছে। আর তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করার কোন সুযোগ নেই।” (প্রথম আলো, ১১ জুলাই ২০১২)।
বাস্তব অবস্থা বলছে, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে এটি এখনও প্রমাণিত হয়নি। তার আগেই বলা হচ্ছে দুর্নীতি হয়েছে এবং অমুক অমুক জড়িত! বিশ্বব্যাংকের এই আগাম উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণায় বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের সহগামী বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত খুশি হতে পারে। কারণ তাদের এজেন্ডা আছেÑ বিএনপির এজেন্ডা হলো ক্ষমতায় যাওয়াÑসে যত রকম অপকৌশলই হোক না কেন? আর জামায়াতের এজেন্ডা হলো তাদের নেতাদের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়া থেকে মুক্ত করে আনা। সে যত অর্থ ব্যয় করে হোক না কেন? এই জামায়াতের অর্থের কোন অভাব নেই। বরং এত অর্থ তাদের হাতে আছে, যা দিয়ে দু’একটা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকও কিনতে পারে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, ওই মধ্যরাতের গলাজীবীদের এজেন্ডা কি? তাদের এজেন্ডা কি তবে জামায়াত-বিএনপির এজেন্ডার সাথে চলা? হয়ত তা-ই। যদি ভবিষ্যতে কপালে চাঁদ ওঠে?
এবার শুরুর বক্তব্যে ফিরে আসি। কেননা, এই তথাকথিত সিভিল সোসাইটির (একাংশ) কথা বলে অযথা সময় নষ্ট করা হবে, এই নিবন্ধের প্রতি সুবিচার করা হবে না। অযথা কালক্ষেপণ হবে। কেননা, পৃথিবীতে এমন কোন দেশ কি আছে সে দেশে একটি জাতীয় ইস্যুতে দেশের কোন নাগরিক অংশ নেয় না বা দূরে থাকে বা বিরোধিতা করে? আছে। সে দেশটি হলো বাংলাদেশ এবং এখানে একটি শ্রেণীর কাজই জাতীয় স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া, যেমন তারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তান-চীন ও আমেরিকার পক্ষে ছিল। আজও তেমনি বিশ্বব্যাংকের অন্যায় আচরণের পক্ষে তারা।
আমাদের মনে হয় শেখ হাসিনা বা তাঁর সরকার যদি বিশ্বব্যাংকের কথা শুনতেন, অন্যায় হলেও শুনতেন কিংবা বিশ্বব্যাংকের বাচ্চা গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে ড. মুহম্মদ ইউনূসকে রেখে দিতেন, কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু না করতেন, তা হলে হয়ত পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ হতো না। শোনা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাংক নাকি চীনের একটি অখ্যাত প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রস্তাবটি গেলানোর চেষ্টাও করেছিল কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা নাকচ করে দিয়েছিলেন বলেই তারা মনোক্ষুণœ হয়ে ঋণচুক্তি বাতিল করে দিল। নিকটঅতীতে দেখা গেছে, নির্বাচনের আগে বিশ্বব্যাংকের গডফাদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাব দিয়েছিল গ্যাস রফতানির। জবাবে শেখ হাসিনা সেদিনের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের পাশে দাঁড়িয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “আগে দেখতে হবে আমাদের কত গ্যাস আছে। সে অনুপাতে ৫০ বছরের মজুদ রেখে তবেই রফতানির প্রশ্ন আসতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশ কেন গ্যাস রফতানি করবে বরং গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন, সার কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে দেশেই আদর্শ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।” পক্ষান্তরে সেদিন খালেদা জিয়া রাজি হয়েছিলেন বলে নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে পরাজয়বরণ করতে হয়েছিল। একজন সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে মানে করি শেখ হাসিনা সেদিন হেরে গিয়েও এক বড় ধরনের বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি, অল্প দিনেই ক্ষমতায় ফিরে এসে (বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে) মাত্র তিন বছরের মাথায় দেশকে আবারও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা বছরে ৩ কোটি টনের ওপরে খাদ্যশস্য উৎপাদন, মাত্র সাড়ে ৩ বছরে ৩১০০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুত উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন করে দেশব্যাপী সরবরাহ করেন। অর্থাৎ খালেদা-নিজামীদের রেখে যাওয়া খাদ্য ঘাটতি ও বিদ্যুত ঘাটতির বাংলাদেশকে ১৯৯৬-২০০১ সময়ের মতো আবারও খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং বিদ্যুত খাতে সহনীয় অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, সেদিন যেমন বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার করেছিলেন ঠিক তেমনি আইন করে এবার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জাতির দীর্ঘদিনের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। একই সঙ্গে জাতির জন্য দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীাতর জন্য অবমাননাকর কেয়ারটেকার আইন বাতিল করে সম্মান রক্ষা করেন।
আজ বিশ্বব্যাংকের অন্যায় পদক্ষপের প্রতিবাদ করে শেখ হাসিনা জাতির মর্যাদা রক্ষা করলেন। পদ্মা সেতু এতদিন ছিল ‘স্বপ্নের সেতু’। এখন তা হয়েছে ‘মর্যাদার সেতু’। আর এ মর্যাদার পক্ষে অবস্থান নিয়ে শেখ হাসিনা তাই তো উচ্চারণ করলেন, “পদ্মা সেতু আমরা আমাদের অর্থ দিয়েই বানাব।” একশ্রেণীর তথাকথিত সিভিল সোসাইটি এতে সাড়া দিক বা না দিক ইতোমধ্যে দেশে- বিদেশে বাঙালীদের মধ্যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। নিউইয়র্কে প্রবাসী বাঙালীরা জাতিসংঘ কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভ-প্রতিবাদ করেই থেমে থাকেনি। এরই মধ্যে বিদেশে অবস্থানরত বাঙালী, দেশে অবস্থানরত সচেতন নাগরিকরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়ে ইউজিসি সংসদ সদস্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোমলমতি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা পদ্মা সেতু অর্থায়নের ঘোষণা দিয়েছে। সরকারী কর্মচারীরাও তাদের একদিনের বেতন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছ।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, এক কুঁড়েঘরবাসিনী অসহায় বৃদ্ধা বঙ্গবন্ধুকে ঘরে ডেকে নিয়ে এক গ্লাস গরম দুধ খেতে দিলেন এবং শেষে ৪ আনা পয়সা দিয়ে বলেছিলেন,“বাবা আমার তো এর চেয়ে বেশি দেবার ক্ষমতা নেই।” বঙ্গবন্ধু ৪ আনা পয়সার সাথে কিছু টাকা যোগ করে ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, আপনার দোয়াই হবে অনেক বড় পাওনা। এই বৃদ্ধারা এখনও বাংলার ঘরে ঘরে আছেন এবং আমি বিশ্বাস করি তারা বঙ্গবন্ধুর কন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করেন এবং তাঁর ওপর আস্থা রাখেন। মনে রাখতে হবে রাজাকার-আলবদর কুসন্তান সাম্রাজ্যবাদের দালালের চেয়ে জাতির জনকের আদর্শের অনুসারী দেশপ্রেমিক নাগরিকের সংখ্যা হাজারগুণ বেশি।
প্রধানমন্ত্রী কেবল কথাটা বলেছেন। তাতেই এত সাড়া পড়েছে। আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানালে বা ‘পদ্মা সেতু’ নামে ব্যাংক হিসেব খুললে অথবা একটি সংস্থার প্রস্তাব অনুযায়ী পদ্মা সেতুকে ‘পাবলিক লিং কোম্পানি’ করে বাজারে শেয়ার ছাড়া হলে আমাদের বিদেশের দিকে তাকাতে হবে না। পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ২২ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকার বেশি অর্থ এবং তা তো প্রথম বছরেই সব লাগবে না। মাননীয় শেখ হাসিনা গত ৮ জুলাই তাঁর চলতি অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনের সমাপ্তি ভাষণে সুন্দরভাবে দেখিছেন যে, ২২ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকার মধ্যে চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরে খরচ হবে ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৭ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।
এ বছর আমাদের জাতীয় বাজেট ১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা, তার মধ্যে উন্নয়ন বাজেট হলো ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এ থেকে যেমন ২৪ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা যাবে, তেমনি বন্ড, সারচার্জ থেকেও অর্থ সংগ্রহ করা যাবে। সরকারী- বেসরকারী অংশীদারি কর্মসূচী চচচতে তিন হাজার কোটি টাকা আছে, তা-ও ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া প্রতি বছর যেভাবে সরকারের ‘কাবিখা’ বা ‘টিআরে’র চাল-গমের ‘হরিলুট’ হয় তা থেকেও অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে। কেননা যে লক্ষ্যে এই ‘কাবিখা’ এবং ‘টিআর’ দেয়া হয় তার ১০ শতাংশও কাজে লাগে না। যেমন থানায় থানায় পিআইও অফিস ঘিরে যে যখন ক্ষমতায় থাকে তাদের লোক এবং মুখ বন্ধ রাখার জন্য বিরোধী দলের লোকের সমন্বয়ে (লুটপাটে সব ভাই ভাইÑ দলে দলে বিরোধ নাই) গঠিত সিন্ডিকেট তা নিয়ন্ত্রণ করে। তারা কোনভাবেই রবাদ্দের চাল-গম প্রকল্প এলাকায় নিতে দেয় না। প্রতিটন গম ৫০০০ টাকা ও প্রতিটন চাল ৮০০০ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে। বাজারদর গম প্রতিটন কমপক্ষে ১৪/১৫ হাজার টাকা, চাল ২০/২২ হাজার টাকা টন। কাজেই যেখানে ১০ শতাংশের বেশি কাজ হয় না, সেখানে এই ব্যবস্থা চালু রাখার দরকার কি? সবচেয়ে বড় কথা হলো, সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মচারীরা শতকরা ৯৯ ভাগই এই লুটপাটে যুক্ত এবং তারা দলীয় সিন্ডিকেটকে ব্যবহার করে তাদের উচ্ছিষ্ট দিয়ে নিজেরা মাখনটা তুলে খায়। এদের ব্যাপারে কখনও ব্যবস্থা নেয়া হলে বা অন্যত্র বদলি করা হলে উচ্ছিষ্ট খাওয়া নেতাকর্মীরা তদ্বিরে নেমে পড়ে এবং আবার জাগামতো ফিরিয়ে আনে। এমনকি সম্মানিত সংসদ সদস্যদের বছরে যে তিন কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেয়া হয় তার চিহ্ন গ্রামীণ জনপদে দেখা যায় না। বরং যে জিনিসটি দেখা যায় তাহলো ভাঙ্গাচোরা গ্রামীণ জনপদ দিয়ে দুই থেকে পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের বিশাল বিশাল পাজেরো লেক্সাস, ল্যান্ড ক্রোজার জীপ চলাচলের দৃশ্য।
নিবন্ধের প্রথমে আমি উল্লেখ করেছিলাম অমরা তথাকথিত সিভিলরা (একাংশ অবশ্যই) যতখানি ঘাবড়ে গেছি শেখ হাসিনার মধ্যে তাঁর জিরো পার্সেন্ট ছাপও নেই। তার প্রমাণও তিনি পেয়েছেন, টেলিফোন নং দেয়ায় যে সাড়া পেয়েছেন তাতে তিনি আরও প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছেন। তাঁর ভাষায়, “প্রবাসীরা কাজ শুরু করতে বলেছেন, তারা আরও বেশি টাকা পাঠাবেন। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা টিফিনের পয়সা, গরিব কৃষকরাও টাকা দিতে চেয়েছেন। দেশের মানুষের মধ্যে যে চেতনা দেখেছি তাতে আমি আশাবাদী। যুদ্ধ করে যে জাতি দেশ স্বাধীন করেছে তারা মাথা নত করতে জানে না।”
মাননীয় বঙ্গবন্ধুর কন্যা, আপনার সাথে আমরাও আশাবাদী। সব সময়ই।
ঢাকা, ১৩ জুলাই, ২০১২
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
গত শনিবারের কলামে আমি বলেছিলাম বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করায় আমরা যতটা ঘাবড়ে গেছি বাংলার নেত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ঘাবড়াবার সামান্য চিহ্নও আমি দেখিনি। বরং তাঁর মধ্যে জাতির জনকের মতোই এক সাহসী আত্মপ্রত্যয়ী রাষ্ট্রনায়কের প্রতিচ্ছবি দেখেছি। এতে করে জাতি হিসেবে আমরাও আত্মপ্রত্যয়ী হয়েছি। তাই তো শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানানোর আগেই বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ, ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের।
১৯৭১ সালে যেভাবে বাংলার অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মুষ্টিমেয় রাজাকার-আলবদর-শান্তি কমিটির কুসন্তান বাদ দিয়ে গোটা বাঙালী জাতি অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এবারও দেশরতœ শেখ হাসিনার ডাকে তেমনি এক জাতীয় ঐক্যের আবহ তৈরি হয়েছে। এখন কেবল আহ্বানটি বাকি।
তবে হ্যাঁ, একাত্তরের মতো এবারও শেখ হাসিনার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা একশ্রেণীর মানুষের পছন্দ হয়নি। কেন শেখ হাসিনা আমেরিকাকে ক্ষ্যাপাতে চাচ্ছেন? এতে করে শেখ হাসিনা জাতিকে এক মহাসঙ্কটে নিপতিত করছেন। পদ্মা সেতু ছাড়াও আরও অনেক প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন চলছে, সেগুলোর কী হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ মানুষগুলোর পোশাকে অবশ্য বাম গন্ধ আছে। সুগন্ধ অবশ্যই নয়।
গত কয়েক রাতে আমি কয়েকটি মধ্যরাতের গলাবাজি টকশো দেখেছি। সাধারণত রাতের ঘুম নষ্ট করে টকশো দেখি না। কারণ এসব হাবিজাবি দেখার চেয়ে বিদেশী চ্যানেলের হিন্দী ছবি- সিরিয়াল দেখাও বেশি উপভোগ্য। কিন্তু যেহেতু পদ্মা সেতু এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু তাই স্যাটেলাইট চ্যালেন ইটিভি এবং বাংলা ভিশনের একাধিক টকশো দেখেছি। এসব চ্যানেলে খুঁজে খুঁজে এমন সব গলাজীবীকে আনা হয় যাদের কাছে আওয়ামী লীগ একটি ‘অগণতান্ত্রিক’ ‘স্বৈরাচারী’ রাজনৈতিক দল এবং এই দল তথা মহাজোট সরকার অশিক্ষিত, অযোগ্য, অদেশপ্রেমিক। এদের আমি মধ্যরাতের গলাজীবী নাম দিয়েছি। এরা সরাসরি না বললেও আকারে-ইঙ্গিতে বর্তমান সময়ের সফল রাষ্ট্রনয়ক সবচেয়ে যোগ্য সাহসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিরাকে পর্যন্ত আজেবাজে শব্দ মিশিয়ে সমালোচনা করেন। সমালোচনা করা অন্যায় নয়, কিন্তু সে সমালোচনা যদি গোষ্ঠীস্বার্থে হয় এবং রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী হয় তখন তা কোনভাবেই গ্রহণীয় হতে পারে না। যেমন আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, গণতন্ত্র, জাতির জনক, রাষ্ট্রের পরিধি এসব ব্যাপারে কোনভাবেই নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ নেই। অবশ্যই নেই।
পৃথিবীতে এ সময়ে বাংলাদেশ বোধহয় একমাত্র দেশ যেখানে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ দেশ ও জাতির স্বার্থের পক্ষে না দাঁড়িয়ে প্রকারান্তরে বিপক্ষেই দাঁড়ায়। এদের আবার নাম দেয়া হয়েছে সিভিল সোসাইটি। এদেরই একজন এককালে সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিল। তখনকার দিনে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং তাতে সে লেখালেখি করত। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও লেখালেখি ছাড়েনি। ওই সাপ্তাহিক পত্রিকাটির নাম ‘বিচিত্রা’। এটি চীনপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত হতো এবং এটা কে না জানে চীনপন্থীরা প্রয়োজনে রাজাকার-আলবদরদের সাথে হাত মেলাতেও দ্বিধা করে না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তা-ই দেখা গেছে। আরেকজন একটি পত্রিকা চালান, যে পত্রিকা ৫ কপি বিক্রি হয় কি-না সন্দেহ। আরেকজন একটি বেসকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এদের কথাবার্তা সব সময়ই চ্যানেলগুলোতে শোনা যায়। এদের যারা নিয়ে আসেন গলাবাজি করার জন্য তাদের অবস্থাও এমন যে পারলে এখনই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং অশিক্ষিত অযোগ্য চরম দুর্নীতিবাজ কাউকে এনে সিংহাসনে বসান। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মিলিটারি হলেও আপত্তি নেই বা লুটেরা হলেও দোষের কিছু নয়।
শেখ হাসিনা যখন বলেন, এই পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে জমি অধিগ্রহণে দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে, কোথাও কোন দুর্নীতি হয়নি। তথাকথিত সিভিল সোসাইটি বা গলাজীবীরাও কোন একটি উদাহরণও দেখাতে পারবে না। অথচ যেখানে এখনও বিশ্বব্যাংক একটি পয়সাও খরচ করেনি তাতেই তারা দুর্নীতি আবিষ্কার করলেন! এমনকি বিশ্বব্যাংকের গডফাদার আমেরিকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজেনাও যখন বলেন, “বাংলাদেশের জন্য এই সেতু (পদ্মা সেতু) অত্যন্ত জরুরী। বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়ায় আমি অত্যন্ত হতাশ হয়েছি। .... এ ব্যাপারে (দুর্নীতির) কোন প্রমাণ আমি দেখতে পাইনি। এ নিয়ে কানাডায় তদন্ত চলছে। আর তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করার কোন সুযোগ নেই।” (প্রথম আলো, ১১ জুলাই ২০১২)।
বাস্তব অবস্থা বলছে, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে এটি এখনও প্রমাণিত হয়নি। তার আগেই বলা হচ্ছে দুর্নীতি হয়েছে এবং অমুক অমুক জড়িত! বিশ্বব্যাংকের এই আগাম উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণায় বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের সহগামী বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত খুশি হতে পারে। কারণ তাদের এজেন্ডা আছেÑ বিএনপির এজেন্ডা হলো ক্ষমতায় যাওয়াÑসে যত রকম অপকৌশলই হোক না কেন? আর জামায়াতের এজেন্ডা হলো তাদের নেতাদের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়া থেকে মুক্ত করে আনা। সে যত অর্থ ব্যয় করে হোক না কেন? এই জামায়াতের অর্থের কোন অভাব নেই। বরং এত অর্থ তাদের হাতে আছে, যা দিয়ে দু’একটা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকও কিনতে পারে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, ওই মধ্যরাতের গলাজীবীদের এজেন্ডা কি? তাদের এজেন্ডা কি তবে জামায়াত-বিএনপির এজেন্ডার সাথে চলা? হয়ত তা-ই। যদি ভবিষ্যতে কপালে চাঁদ ওঠে?
এবার শুরুর বক্তব্যে ফিরে আসি। কেননা, এই তথাকথিত সিভিল সোসাইটির (একাংশ) কথা বলে অযথা সময় নষ্ট করা হবে, এই নিবন্ধের প্রতি সুবিচার করা হবে না। অযথা কালক্ষেপণ হবে। কেননা, পৃথিবীতে এমন কোন দেশ কি আছে সে দেশে একটি জাতীয় ইস্যুতে দেশের কোন নাগরিক অংশ নেয় না বা দূরে থাকে বা বিরোধিতা করে? আছে। সে দেশটি হলো বাংলাদেশ এবং এখানে একটি শ্রেণীর কাজই জাতীয় স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া, যেমন তারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তান-চীন ও আমেরিকার পক্ষে ছিল। আজও তেমনি বিশ্বব্যাংকের অন্যায় আচরণের পক্ষে তারা।
আমাদের মনে হয় শেখ হাসিনা বা তাঁর সরকার যদি বিশ্বব্যাংকের কথা শুনতেন, অন্যায় হলেও শুনতেন কিংবা বিশ্বব্যাংকের বাচ্চা গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে ড. মুহম্মদ ইউনূসকে রেখে দিতেন, কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু না করতেন, তা হলে হয়ত পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ হতো না। শোনা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাংক নাকি চীনের একটি অখ্যাত প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রস্তাবটি গেলানোর চেষ্টাও করেছিল কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা নাকচ করে দিয়েছিলেন বলেই তারা মনোক্ষুণœ হয়ে ঋণচুক্তি বাতিল করে দিল। নিকটঅতীতে দেখা গেছে, নির্বাচনের আগে বিশ্বব্যাংকের গডফাদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাব দিয়েছিল গ্যাস রফতানির। জবাবে শেখ হাসিনা সেদিনের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের পাশে দাঁড়িয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “আগে দেখতে হবে আমাদের কত গ্যাস আছে। সে অনুপাতে ৫০ বছরের মজুদ রেখে তবেই রফতানির প্রশ্ন আসতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশ কেন গ্যাস রফতানি করবে বরং গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন, সার কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে দেশেই আদর্শ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।” পক্ষান্তরে সেদিন খালেদা জিয়া রাজি হয়েছিলেন বলে নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে পরাজয়বরণ করতে হয়েছিল। একজন সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে মানে করি শেখ হাসিনা সেদিন হেরে গিয়েও এক বড় ধরনের বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি, অল্প দিনেই ক্ষমতায় ফিরে এসে (বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে) মাত্র তিন বছরের মাথায় দেশকে আবারও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা বছরে ৩ কোটি টনের ওপরে খাদ্যশস্য উৎপাদন, মাত্র সাড়ে ৩ বছরে ৩১০০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুত উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন করে দেশব্যাপী সরবরাহ করেন। অর্থাৎ খালেদা-নিজামীদের রেখে যাওয়া খাদ্য ঘাটতি ও বিদ্যুত ঘাটতির বাংলাদেশকে ১৯৯৬-২০০১ সময়ের মতো আবারও খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং বিদ্যুত খাতে সহনীয় অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, সেদিন যেমন বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার করেছিলেন ঠিক তেমনি আইন করে এবার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জাতির দীর্ঘদিনের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। একই সঙ্গে জাতির জন্য দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীাতর জন্য অবমাননাকর কেয়ারটেকার আইন বাতিল করে সম্মান রক্ষা করেন।
আজ বিশ্বব্যাংকের অন্যায় পদক্ষপের প্রতিবাদ করে শেখ হাসিনা জাতির মর্যাদা রক্ষা করলেন। পদ্মা সেতু এতদিন ছিল ‘স্বপ্নের সেতু’। এখন তা হয়েছে ‘মর্যাদার সেতু’। আর এ মর্যাদার পক্ষে অবস্থান নিয়ে শেখ হাসিনা তাই তো উচ্চারণ করলেন, “পদ্মা সেতু আমরা আমাদের অর্থ দিয়েই বানাব।” একশ্রেণীর তথাকথিত সিভিল সোসাইটি এতে সাড়া দিক বা না দিক ইতোমধ্যে দেশে- বিদেশে বাঙালীদের মধ্যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। নিউইয়র্কে প্রবাসী বাঙালীরা জাতিসংঘ কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভ-প্রতিবাদ করেই থেমে থাকেনি। এরই মধ্যে বিদেশে অবস্থানরত বাঙালী, দেশে অবস্থানরত সচেতন নাগরিকরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়ে ইউজিসি সংসদ সদস্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোমলমতি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা পদ্মা সেতু অর্থায়নের ঘোষণা দিয়েছে। সরকারী কর্মচারীরাও তাদের একদিনের বেতন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছ।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, এক কুঁড়েঘরবাসিনী অসহায় বৃদ্ধা বঙ্গবন্ধুকে ঘরে ডেকে নিয়ে এক গ্লাস গরম দুধ খেতে দিলেন এবং শেষে ৪ আনা পয়সা দিয়ে বলেছিলেন,“বাবা আমার তো এর চেয়ে বেশি দেবার ক্ষমতা নেই।” বঙ্গবন্ধু ৪ আনা পয়সার সাথে কিছু টাকা যোগ করে ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, আপনার দোয়াই হবে অনেক বড় পাওনা। এই বৃদ্ধারা এখনও বাংলার ঘরে ঘরে আছেন এবং আমি বিশ্বাস করি তারা বঙ্গবন্ধুর কন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করেন এবং তাঁর ওপর আস্থা রাখেন। মনে রাখতে হবে রাজাকার-আলবদর কুসন্তান সাম্রাজ্যবাদের দালালের চেয়ে জাতির জনকের আদর্শের অনুসারী দেশপ্রেমিক নাগরিকের সংখ্যা হাজারগুণ বেশি।
প্রধানমন্ত্রী কেবল কথাটা বলেছেন। তাতেই এত সাড়া পড়েছে। আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানালে বা ‘পদ্মা সেতু’ নামে ব্যাংক হিসেব খুললে অথবা একটি সংস্থার প্রস্তাব অনুযায়ী পদ্মা সেতুকে ‘পাবলিক লিং কোম্পানি’ করে বাজারে শেয়ার ছাড়া হলে আমাদের বিদেশের দিকে তাকাতে হবে না। পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ২২ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকার বেশি অর্থ এবং তা তো প্রথম বছরেই সব লাগবে না। মাননীয় শেখ হাসিনা গত ৮ জুলাই তাঁর চলতি অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনের সমাপ্তি ভাষণে সুন্দরভাবে দেখিছেন যে, ২২ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকার মধ্যে চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরে খরচ হবে ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৭ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।
এ বছর আমাদের জাতীয় বাজেট ১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা, তার মধ্যে উন্নয়ন বাজেট হলো ৫৫ হাজার কোটি টাকা। এ থেকে যেমন ২৪ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা যাবে, তেমনি বন্ড, সারচার্জ থেকেও অর্থ সংগ্রহ করা যাবে। সরকারী- বেসরকারী অংশীদারি কর্মসূচী চচচতে তিন হাজার কোটি টাকা আছে, তা-ও ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া প্রতি বছর যেভাবে সরকারের ‘কাবিখা’ বা ‘টিআরে’র চাল-গমের ‘হরিলুট’ হয় তা থেকেও অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে। কেননা যে লক্ষ্যে এই ‘কাবিখা’ এবং ‘টিআর’ দেয়া হয় তার ১০ শতাংশও কাজে লাগে না। যেমন থানায় থানায় পিআইও অফিস ঘিরে যে যখন ক্ষমতায় থাকে তাদের লোক এবং মুখ বন্ধ রাখার জন্য বিরোধী দলের লোকের সমন্বয়ে (লুটপাটে সব ভাই ভাইÑ দলে দলে বিরোধ নাই) গঠিত সিন্ডিকেট তা নিয়ন্ত্রণ করে। তারা কোনভাবেই রবাদ্দের চাল-গম প্রকল্প এলাকায় নিতে দেয় না। প্রতিটন গম ৫০০০ টাকা ও প্রতিটন চাল ৮০০০ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে। বাজারদর গম প্রতিটন কমপক্ষে ১৪/১৫ হাজার টাকা, চাল ২০/২২ হাজার টাকা টন। কাজেই যেখানে ১০ শতাংশের বেশি কাজ হয় না, সেখানে এই ব্যবস্থা চালু রাখার দরকার কি? সবচেয়ে বড় কথা হলো, সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মচারীরা শতকরা ৯৯ ভাগই এই লুটপাটে যুক্ত এবং তারা দলীয় সিন্ডিকেটকে ব্যবহার করে তাদের উচ্ছিষ্ট দিয়ে নিজেরা মাখনটা তুলে খায়। এদের ব্যাপারে কখনও ব্যবস্থা নেয়া হলে বা অন্যত্র বদলি করা হলে উচ্ছিষ্ট খাওয়া নেতাকর্মীরা তদ্বিরে নেমে পড়ে এবং আবার জাগামতো ফিরিয়ে আনে। এমনকি সম্মানিত সংসদ সদস্যদের বছরে যে তিন কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেয়া হয় তার চিহ্ন গ্রামীণ জনপদে দেখা যায় না। বরং যে জিনিসটি দেখা যায় তাহলো ভাঙ্গাচোরা গ্রামীণ জনপদ দিয়ে দুই থেকে পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের বিশাল বিশাল পাজেরো লেক্সাস, ল্যান্ড ক্রোজার জীপ চলাচলের দৃশ্য।
নিবন্ধের প্রথমে আমি উল্লেখ করেছিলাম অমরা তথাকথিত সিভিলরা (একাংশ অবশ্যই) যতখানি ঘাবড়ে গেছি শেখ হাসিনার মধ্যে তাঁর জিরো পার্সেন্ট ছাপও নেই। তার প্রমাণও তিনি পেয়েছেন, টেলিফোন নং দেয়ায় যে সাড়া পেয়েছেন তাতে তিনি আরও প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছেন। তাঁর ভাষায়, “প্রবাসীরা কাজ শুরু করতে বলেছেন, তারা আরও বেশি টাকা পাঠাবেন। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা টিফিনের পয়সা, গরিব কৃষকরাও টাকা দিতে চেয়েছেন। দেশের মানুষের মধ্যে যে চেতনা দেখেছি তাতে আমি আশাবাদী। যুদ্ধ করে যে জাতি দেশ স্বাধীন করেছে তারা মাথা নত করতে জানে না।”
মাননীয় বঙ্গবন্ধুর কন্যা, আপনার সাথে আমরাও আশাবাদী। সব সময়ই।
ঢাকা, ১৩ জুলাই, ২০১২
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
No comments