সুরঞ্জিতের সময়ে পূর্ব রেলে নিয়োগ বাণিজ্যে ভয়াবহ দুর্নীতি!-ফারুক, মৃধা, এনামুল হকসহ কয়েকজনের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুদক by মহিউদ্দিন আহমদ

সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সময়ে পূর্বাঞ্চলীয় রেলের নিয়োগে ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে। ছয়টি ক্যাটাগরির ১০৬৯টির বেশিরভাগ পদেই মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেয়া হয়। মন্ত্রীর সে সময়ের এপিএস ফারুক (বরখাস্ত), পূর্বাঞ্চলীয় রেলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা (বরখাস্ত),


নিরাপত্তা কর্মকর্তা এনামুল হকসহ বেশ ক’জন নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। তবে পিলখানায় বিজিবির হাতে আটক ৭০ লাখ টাকাও পূর্বাঞ্চল রেলের নিয়োগ বাণিজ্যের টাকা ছিল কি না এখন সে বিষয়টি খতিয়ে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশনের এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
গত ৯ এপ্রিল রাতে বিদায়ী রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বরখাস্তকৃত এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা পাওয়া যায়। এ সময় ফারুকের সঙ্গে ছিলেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের সাবেক জিএম ইউসুফ আলী মৃধা, রেল পুলিশের কমান্ড্যান্ট (ঢাকা) এনামুল হক। অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশন ঘটনা তদন্তে উপ-পরিচালক মোঃ আবু সাঈদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক রাশেদুর রেজা ও মজিবুর রহমান। দায়িত্ব পাওয়ার পর তারা এ ঘটনায় ফারুক, মৃধা দম্পতি, এনামুল দম্পতির সম্পদের হিসাব চেয়ে পাঠায় কমিটি। ইতোমধ্যে তারা দুদকে সম্পদের হিসেব দিয়েছেন। দেড় মাস আগে তদন্ত কমিটি নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে যান রেলের পূর্বাঞ্চল অফিসে। সেখান থেকে জব্দকৃত নথিপত্রে দেখা যায়, ট্রেড এ্যাপ্রেন্টিস পদে ১২১৬ কোড নম্বরধারী লিখিত পরীক্ষায় পেয়েছেন মাত্র ২ নম্বর। কিন্তু তা পরিবর্তন করে ২৫ নম্বর দেখিয়ে এ কোড নম্বরধারীকে উত্তীর্ণ দেখানো হয়েছে। ৩৫টির বেশি কোড নম্বরের খাতায় কাটাছেঁড়া করে নম্বর দেয়া হয়েছে। টেবুলেশন শীটে ভয়াবহ জালিয়াতির মাধ্যমে এ রকম অসংখ্য অকৃতকার্যকে দেখানো হয়েছে কৃতকার্য। সুইপার থেকে রেলের লোকো মাস্টার পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। ওই টাকা পার্সেন্টেজের ভিত্তিতে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা। সবচেয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে ১১২ চৌকিদার, ৩৬৯ ট্রেড এ্যাপ্রেন্টিস, ২৪৮ সুইপার, ১৪৩ ট্রলি ম্যান, ১৫ সহকারী সাব ইন্সপেক্টর ও ১৮২ লোকো মাস্টার পদে নিয়োগে। সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর পদে লিখিত পরীক্ষায় ৯৫ জনের মধ্যে মাত্র ৭ জন মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। নিয়োগ দেয়া হয়েছে ১১ জনকে। এর মধ্যে ৬ জনই মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১০, ময়মনসিংহ-১, কিশোরগঞ্জ-২৫, পটুয়াখালীর-১৮, রংপুর-৩৩, মাদারীপুরের-২৬ রোল নম্বরধারী প্রার্র্থীরা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়েও নিয়োগ পেয়েছেন। অথচ নিয়োগের জন্য উপযুক্ত থাকার পরও টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় অন্যায়ভাবে বাদ পড়েছেন চট্টগ্রাম-৬০ ও কুমিল্লার-৫০ রোল নম্বরধারী। একই রকম পরিস্থিতির শিকার আরও হয়েছেন অনেক প্রার্থী। এ ছাড়া রেলওয়ের কর্মচারীদের জন্য সংরক্ষিত, মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানসন্ততি, মহিলা, অনগ্রসর জেলা, আনসার-ভিডিপি, উপজাতীয়, এতিম প্রতিবন্ধীসহ বিভিন্ন ধরনের কোটার ক্ষেত্রে কোন ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করার প্রমাণ পেয়েছে দুদক তদন্ত কর্মকর্তারা।
রেলে নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে রেলের কর্মকর্তারা ছাড়াও পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত সবাইয়ের সংশ্লিষ্ট থাকার প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলের কয়েক শিক্ষক খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ভয়াবহ দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার তথ্য মিলেছে। এ বিষয়ে গত সপ্তাহের সোম, মঙ্গল ও বুধবার পূর্ব রেলের নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক পূর্ব রেলওয়ের অতিরিক্ত যান্ত্রিক প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান চৌধুরী এবং সদস্য সচিব সিনিয়র ওয়েলফেয়ার অফিসার গোলাম কিবরিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় রেল বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এসএম লিয়াকত আলী, মেইনটেনেন্স ইঞ্জিনিয়ার (চট্টগ্রাম সদর পূর্ব) এফএম মহিউদ্দিন ও আইন কর্মকর্তা (চট্টগ্রাম পƒর্ব) আমান উল্লাহ, বরখাস্তকৃত জিএম ইউসুফ আলী মৃধা, বরখাস্তকৃত নিরাপত্তা কর্মকর্তা এনামুল হক ও বরখাস্তকৃত এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারকে। একই ঘটনায় চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলের ৯, চট্টগ্রাম কলেজের সাত শিক্ষকসহ ৪৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় অনেকে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর এবং দুর্নীতিতে জড়িত না থাকার প্রমাণ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হন। তবে শিক্ষকদের ক’জন বলেছেন, রেলের প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট চাপ দিয়ে অনুত্তীর্ণদের খাতায় বেশি নম্বর দিতে তাদের বাধ্য করে।
রেলে নিয়োগ বাণিজ্য তদন্তের বিষয়ে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা তদন্তাধীন বিষয় উল্লেখ করে কথা বলতে রাজি হননি। তবে এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেছেন, যেসব অভিযোগ এসেছে তার মধ্যে অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে গিয়ে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় নথি ও কাগজপত্র সংগ্রহ করার বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি। এ ছাড়া যে ৩৯ জনকে জিজ্ঞাসবাদ করা হয়েছে তাদের বক্তব্যে গরমিল পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। তদন্ত কাজ দ্রুত শেষ হবে বলেও ইঙ্গিত দেন ওই কর্মকর্তা।

No comments

Powered by Blogger.