ডিজিটাল বাংলাদেশ কতদূর? by ড. এমএ দিকপাল
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত মহাজোট সরকারের অন্যতম লক্ষ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। সমাজের সকল স্তরে ডিজিটাল লিটারেসি সম্প্রসারণের মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রয়োগ এবং জ্ঞানভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে জনগণের সেবা
নিশ্চিত করা সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া এবং সেজন্য ধাপে ধাপে প্রতিবছর বিভিন্ন কর্মসূচী এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।
২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা-২০০৯’ পাসের মধ্য দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অগ্রযাত্রা শুরু হয়। এক্ষেত্রে ১০টি উদ্দেশ্য সামনে রেখে নীতিমালায় আশু, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী ৩০৬টি কর্মপরিকল্পনা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার জন্য সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। সরকারের কর্মপ্রক্রিয়াতে সর্বক্ষেত্রেই এ বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজকে প্রশাসনিকভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য পৃথক ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতর’ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
২০১১ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ৪৫০১টি ইউনিয়নে একযোগে ইউনিয়ন তথ্য সেবাকেন্দ্র সংক্ষেপে ই-তথ্য কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। ই-তথ্য কেন্দ্রগুলো মানুষকে তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি আগ্রহশীল করে তুলছে। পরীক্ষার ফলাফল, পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন, মেইল করা, প্রিন্ট ও ফটোকপি, দেশ-বিদেশে যোগাযোগ, প্রজেক্টরের মাধ্যমে বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখা ইত্যাদি কাজ ই-তথ্য কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ২০১২ সালের জুন মাসের মধ্যে দেশের সব জেলা ও উপজেলায় ওয়েব পোর্টাল তৈরির কাজ সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
২০১১ সালের ৩১ মার্চ ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় মোবাইল ব্যাংকিং। প্রথমে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক দেশে মোবাইল ব্যাংকিং শুরু করে। তবে পূর্ণাঙ্গ মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করার জন্য এ পর্যন্ত ১০টি বাণিজ্যিক ব্যাংককে অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১১ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ই-টেন্ডার পদ্ধতির উদ্বোধন করেন। ই-টেন্ডার চালু হওয়ার ফলে ঠিকাদাররা দরপত্র দাখিল, দরপত্র উন্মুক্তকরণ, অনুমোদন ও নিবন্ধন ইত্যাদি করতে পারবেন এবং চুক্তির তথ্য, ক্রয় পরিকল্পনা, দরদাতাদের তালিকা ইত্যাদি জানতে পারবেন। ই-টেন্ডার পদ্ধতি পুরোপুরি চালু হলে দেশে টেন্ডারবাজি পুরোপুরি বন্ধ হবে আশা করা হচ্ছে।
বর্তমানে শিক্ষাসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। সব পরীক্ষার ফলাফল, ভর্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রাসঙ্গিক অন্য তথ্যাদি পাওয়া যায়। তাছাড়া সরকার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাগুলোতে প্রযুক্তিগত শিক্ষাদানের উদ্যোগ নিয়েছেন। শিক্ষা শেষে চাকরির আবেদন ও ফলাফল অনলাইনে চালু করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন। এ ব্যবস্থা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারিত হচ্ছে। তাছাড়া পাঠ্যবই ওয়েবসাইটে দেয়া হচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ইলেক্ট্রনিক পেমেন্ট (ই-পেমেন্ট) পদ্ধতিতে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা চালু করেছে। ই-পেমেন্ট পদ্ধতিতে টিন নম্বর গ্রহণ ও বার্ষিক আয়কর পরিশোধ করা যাবে। মূল্য সংযোজন করদানেও এ পদ্ধতি কার্যকর করা হবে বলে জানা গেছে।
২০১০ সালের ২৬ মার্চ থেকে ডাক-বিভাগে ইলেক্ট্রনিক মানি ট্রান্সফার সার্ভিস (ইএমটিএস) সেবাদান পদ্ধতি চালু করা হয়। এ পদ্ধেিত দ্রুত টাকা পাঠানো যায়। এছাড়া কম্পিউটারে মোটরযানের কর প্রদান, স্বয়ংক্রিয় কাউন্টার, ওয়েস্টার্ন মানি অর্ডার, মোবাইল কল সেন্টার, পোস্টাল ক্যাশ কার্ড, গ্রামীণ পোস্ট অফিসে ই-সেন্টার ইত্যাদি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সরকার সারাদেশে ৮ হাজার ডাকঘরকে ডাকঘর ই-কেন্দ্রে রূপান্তরিত করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের মেয়াদকাল হচ্ছে ২০১১-২০১৫ সাল পর্যন্ত। এ প্রক্রিয়ায় ওয়েব ক্যামেরার মাধ্যমে বিদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যাবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে চিঠিপত্র ও ডকুমেন্ট গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া যাবে। বিদেশ থেকে পাঠানো টাকাও দ্রুত গ্রাহকের হাতে পৌঁছে যাবে।
২০১০ সাল থেকে জাতীয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে পেশ করা হচ্ছে। বর্তমানে জাতীয় বাজেট সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাবলী ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। একই বছর থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাংলাদেশের যে কোন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার সুবিধা চালু হয়েছে। এছাড়া ২০১০ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত মহাজোট সরকার ‘মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট’ (এমআরপি) কার্যক্রম শুরু করে। পাসপোর্ট সংক্রান্ত জালিয়াতি ও হয়রানি রোধে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
২০১০ সালের শেষের দিকে ‘বাংলাদেশ জাতীয় ওয়েব পোর্টাল’ চালু করা হয়। এতে ইংরেজী ও বাংলা দুটো ভার্শন যুক্ত হয়। এতে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি যেমন- রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, জাতীয় সংসদ, বিচারব্যবস্থা, মন্ত্রণালয়, বিভাগ, নাগরিক সেবা, ব্যবসায়িক সেবা, সার্কুলার প্রভৃতি বিষয় দ্বারা সমৃদ্ধ করা হয়েছে। পোর্টালগুলোতে সরকারী দিনপঞ্জিকা, সার্কুলার, গেজেটসমূহও পাওয়া যায়। তাছাড়াও রয়েছে সরকারী বিজ্ঞাপন, প্রতিদিনের মুদ্রার হার, পোস্টাল কোড, পাসপোর্ট ও ভিসাসংক্রান্ত তথ্যাদি, আয়কর, শিক্ষাব্যবস্থা, ড্রাইভিং লাইসেন্স, কৃষি তথ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালু করার প্রচেষ্টাও শেখ হাসিনার সরকারের একটি অন্যতম লক্ষ্য। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে একটি ওয়ার্ডের (চট্টগ্রাম নগরীর ২১ নম্বর জামালখান ওয়ার্ডে) ১৪টি ভোটকেন্দ্রে সর্বপ্রথম পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম পদ্ধতি চালু করা হয়। অতঃপর নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ইভিএম পদ্ধতিতে অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হয়। বিরোধী দল এ পদ্ধতির বিরোধিতা করলেও জনগণের মধ্যে ইভিএম পদ্ধতির প্রতি ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়।
২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করা হয়। এ ক্ষেত্রে দুটি প্রক্রিয়া রয়েছে। একটি কন্টেনার ব্যবস্থাপনায় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি (সিটিএমএস) এবং অন্যটি পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ পদ্ধতি (আরভিএস)। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালুর ফলে বন্দরের আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী কন্টেনার ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের যাবতীয় দালিলিক কার্যক্রম অনলাইনে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে কন্টেনারের অবস্থান, কন্টেনার কোন্ জাহাজে করে আসছে বা রফতানি হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব অনলাইনে পাওয়া যায়। স্বাস্থ্যসেবাকে ডিজিটালাইজেশন করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ই-হেলথ কর্মসূচী চালুর উদ্যোগ নেয়। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ৪৮২টি হাসপাতালে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। তাছাড়া বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় টেলিমেডিসিন বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেশে বসে বিদেশী বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শ ও প্রেসক্রিপশন অনলাইনে সম্পন্ন করা যাচ্ছে। বর্তমানে কেনাকাটার ক্ষেত্রেও ই-বাজার চালু হচ্ছে। ভিসা, মেট্রো বা অন্যান্য ক্রেডিটকার্ড, ডেবিটকার্ড ও এটিএম কার্ডের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ এবং বিভিন্ন বিল দেয়ার পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মানুষ ক্যাশ টাকা বহনের ঝুঁকিতে না দিয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ সারতে পারছেন। অধিকাংশ ব্যাংকে অনলাইন পদ্ধতি চালু হয়েছে। ঘরে বসেই ব্যাংকিং লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও অর্ডার প্রদান করা যাচ্ছে। রেলওয়ের টিকেট মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কেনা যাচ্ছে। দূরপাল্লার বাসগুলোতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে টিকেট প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রেও অনলাইনে নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশের যে কোন স্থান থেকে বিদেশে কর্মসংস্থানে আগ্রহীরা মোবাইল অথবা ইন্টারনেটের সাহায্যে বিএমইটির ওয়েবসাইটে নাম নিবন্ধন করতে পারেন। বিদেশ গমনেচ্ছুদের ঝক্কি-ঝামেলা থেকে রক্ষার্থে শেখ হাসিনার সরকার অনলাইনে নিবন্ধন পদ্ধতি চালু করেছে।
তথ্য ও প্রযুক্তি বিকাশে অনেক বাধা রয়েছে। তারপরও ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। শেখ হাসিনার নির্বাচনের প্রাক্কালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এবং দায়িত্ব লাভের পর সেই ইচ্ছার বাস্তবায়ন শুরু করেছেন। যদিও টার্গেট ২০২১ সাল, তারপরও চলার পথে অর্জন একেবারে কম নয়। কাজটি যখন তিনি শুরু করেছেন এবং ধাপে ধাপে এগিয়ে নিচ্ছেন, তাতে আশা করা যায়, একদিন এই বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। আমরা অবশ্যই আশাবাদী।
লেখক : শিক্ষাবিদ
২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা-২০০৯’ পাসের মধ্য দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অগ্রযাত্রা শুরু হয়। এক্ষেত্রে ১০টি উদ্দেশ্য সামনে রেখে নীতিমালায় আশু, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী ৩০৬টি কর্মপরিকল্পনা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার জন্য সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। সরকারের কর্মপ্রক্রিয়াতে সর্বক্ষেত্রেই এ বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজকে প্রশাসনিকভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য পৃথক ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতর’ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
২০১১ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ৪৫০১টি ইউনিয়নে একযোগে ইউনিয়ন তথ্য সেবাকেন্দ্র সংক্ষেপে ই-তথ্য কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। ই-তথ্য কেন্দ্রগুলো মানুষকে তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি আগ্রহশীল করে তুলছে। পরীক্ষার ফলাফল, পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন, মেইল করা, প্রিন্ট ও ফটোকপি, দেশ-বিদেশে যোগাযোগ, প্রজেক্টরের মাধ্যমে বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখা ইত্যাদি কাজ ই-তথ্য কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ২০১২ সালের জুন মাসের মধ্যে দেশের সব জেলা ও উপজেলায় ওয়েব পোর্টাল তৈরির কাজ সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
২০১১ সালের ৩১ মার্চ ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় মোবাইল ব্যাংকিং। প্রথমে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক দেশে মোবাইল ব্যাংকিং শুরু করে। তবে পূর্ণাঙ্গ মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করার জন্য এ পর্যন্ত ১০টি বাণিজ্যিক ব্যাংককে অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১১ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ই-টেন্ডার পদ্ধতির উদ্বোধন করেন। ই-টেন্ডার চালু হওয়ার ফলে ঠিকাদাররা দরপত্র দাখিল, দরপত্র উন্মুক্তকরণ, অনুমোদন ও নিবন্ধন ইত্যাদি করতে পারবেন এবং চুক্তির তথ্য, ক্রয় পরিকল্পনা, দরদাতাদের তালিকা ইত্যাদি জানতে পারবেন। ই-টেন্ডার পদ্ধতি পুরোপুরি চালু হলে দেশে টেন্ডারবাজি পুরোপুরি বন্ধ হবে আশা করা হচ্ছে।
বর্তমানে শিক্ষাসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। সব পরীক্ষার ফলাফল, ভর্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রাসঙ্গিক অন্য তথ্যাদি পাওয়া যায়। তাছাড়া সরকার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাগুলোতে প্রযুক্তিগত শিক্ষাদানের উদ্যোগ নিয়েছেন। শিক্ষা শেষে চাকরির আবেদন ও ফলাফল অনলাইনে চালু করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন। এ ব্যবস্থা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারিত হচ্ছে। তাছাড়া পাঠ্যবই ওয়েবসাইটে দেয়া হচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ইলেক্ট্রনিক পেমেন্ট (ই-পেমেন্ট) পদ্ধতিতে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা চালু করেছে। ই-পেমেন্ট পদ্ধতিতে টিন নম্বর গ্রহণ ও বার্ষিক আয়কর পরিশোধ করা যাবে। মূল্য সংযোজন করদানেও এ পদ্ধতি কার্যকর করা হবে বলে জানা গেছে।
২০১০ সালের ২৬ মার্চ থেকে ডাক-বিভাগে ইলেক্ট্রনিক মানি ট্রান্সফার সার্ভিস (ইএমটিএস) সেবাদান পদ্ধতি চালু করা হয়। এ পদ্ধেিত দ্রুত টাকা পাঠানো যায়। এছাড়া কম্পিউটারে মোটরযানের কর প্রদান, স্বয়ংক্রিয় কাউন্টার, ওয়েস্টার্ন মানি অর্ডার, মোবাইল কল সেন্টার, পোস্টাল ক্যাশ কার্ড, গ্রামীণ পোস্ট অফিসে ই-সেন্টার ইত্যাদি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সরকার সারাদেশে ৮ হাজার ডাকঘরকে ডাকঘর ই-কেন্দ্রে রূপান্তরিত করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের মেয়াদকাল হচ্ছে ২০১১-২০১৫ সাল পর্যন্ত। এ প্রক্রিয়ায় ওয়েব ক্যামেরার মাধ্যমে বিদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যাবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে চিঠিপত্র ও ডকুমেন্ট গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া যাবে। বিদেশ থেকে পাঠানো টাকাও দ্রুত গ্রাহকের হাতে পৌঁছে যাবে।
২০১০ সাল থেকে জাতীয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে পেশ করা হচ্ছে। বর্তমানে জাতীয় বাজেট সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাবলী ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। একই বছর থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাংলাদেশের যে কোন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার সুবিধা চালু হয়েছে। এছাড়া ২০১০ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত মহাজোট সরকার ‘মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট’ (এমআরপি) কার্যক্রম শুরু করে। পাসপোর্ট সংক্রান্ত জালিয়াতি ও হয়রানি রোধে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
২০১০ সালের শেষের দিকে ‘বাংলাদেশ জাতীয় ওয়েব পোর্টাল’ চালু করা হয়। এতে ইংরেজী ও বাংলা দুটো ভার্শন যুক্ত হয়। এতে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি যেমন- রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, জাতীয় সংসদ, বিচারব্যবস্থা, মন্ত্রণালয়, বিভাগ, নাগরিক সেবা, ব্যবসায়িক সেবা, সার্কুলার প্রভৃতি বিষয় দ্বারা সমৃদ্ধ করা হয়েছে। পোর্টালগুলোতে সরকারী দিনপঞ্জিকা, সার্কুলার, গেজেটসমূহও পাওয়া যায়। তাছাড়াও রয়েছে সরকারী বিজ্ঞাপন, প্রতিদিনের মুদ্রার হার, পোস্টাল কোড, পাসপোর্ট ও ভিসাসংক্রান্ত তথ্যাদি, আয়কর, শিক্ষাব্যবস্থা, ড্রাইভিং লাইসেন্স, কৃষি তথ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালু করার প্রচেষ্টাও শেখ হাসিনার সরকারের একটি অন্যতম লক্ষ্য। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে একটি ওয়ার্ডের (চট্টগ্রাম নগরীর ২১ নম্বর জামালখান ওয়ার্ডে) ১৪টি ভোটকেন্দ্রে সর্বপ্রথম পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম পদ্ধতি চালু করা হয়। অতঃপর নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ইভিএম পদ্ধতিতে অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হয়। বিরোধী দল এ পদ্ধতির বিরোধিতা করলেও জনগণের মধ্যে ইভিএম পদ্ধতির প্রতি ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়।
২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করা হয়। এ ক্ষেত্রে দুটি প্রক্রিয়া রয়েছে। একটি কন্টেনার ব্যবস্থাপনায় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি (সিটিএমএস) এবং অন্যটি পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ পদ্ধতি (আরভিএস)। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালুর ফলে বন্দরের আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী কন্টেনার ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের যাবতীয় দালিলিক কার্যক্রম অনলাইনে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে কন্টেনারের অবস্থান, কন্টেনার কোন্ জাহাজে করে আসছে বা রফতানি হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব অনলাইনে পাওয়া যায়। স্বাস্থ্যসেবাকে ডিজিটালাইজেশন করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ই-হেলথ কর্মসূচী চালুর উদ্যোগ নেয়। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ৪৮২টি হাসপাতালে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। তাছাড়া বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় টেলিমেডিসিন বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেশে বসে বিদেশী বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শ ও প্রেসক্রিপশন অনলাইনে সম্পন্ন করা যাচ্ছে। বর্তমানে কেনাকাটার ক্ষেত্রেও ই-বাজার চালু হচ্ছে। ভিসা, মেট্রো বা অন্যান্য ক্রেডিটকার্ড, ডেবিটকার্ড ও এটিএম কার্ডের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ এবং বিভিন্ন বিল দেয়ার পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মানুষ ক্যাশ টাকা বহনের ঝুঁকিতে না দিয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ সারতে পারছেন। অধিকাংশ ব্যাংকে অনলাইন পদ্ধতি চালু হয়েছে। ঘরে বসেই ব্যাংকিং লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও অর্ডার প্রদান করা যাচ্ছে। রেলওয়ের টিকেট মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কেনা যাচ্ছে। দূরপাল্লার বাসগুলোতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে টিকেট প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রেও অনলাইনে নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশের যে কোন স্থান থেকে বিদেশে কর্মসংস্থানে আগ্রহীরা মোবাইল অথবা ইন্টারনেটের সাহায্যে বিএমইটির ওয়েবসাইটে নাম নিবন্ধন করতে পারেন। বিদেশ গমনেচ্ছুদের ঝক্কি-ঝামেলা থেকে রক্ষার্থে শেখ হাসিনার সরকার অনলাইনে নিবন্ধন পদ্ধতি চালু করেছে।
তথ্য ও প্রযুক্তি বিকাশে অনেক বাধা রয়েছে। তারপরও ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। শেখ হাসিনার নির্বাচনের প্রাক্কালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এবং দায়িত্ব লাভের পর সেই ইচ্ছার বাস্তবায়ন শুরু করেছেন। যদিও টার্গেট ২০২১ সাল, তারপরও চলার পথে অর্জন একেবারে কম নয়। কাজটি যখন তিনি শুরু করেছেন এবং ধাপে ধাপে এগিয়ে নিচ্ছেন, তাতে আশা করা যায়, একদিন এই বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। আমরা অবশ্যই আশাবাদী।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments