ফ্ল্যাটে উঠেই তাঁরা হতবাক-সোয়া ৩ কোটি টাকা খরচ করে ঝুঁকিপূর্ণ কোয়ার্টার নির্মাণ করেছে ঢাকা ওয়াসা by অমিতোষ পাল

কর্মকর্তাদের আবাসন সুবিধা দেওয়ার জন্য ঢাকায় ধানমণ্ডির ১৩/১ নম্বর রোডে 'ওয়াসাকুঞ্জ' আবাসিক এলাকায় একটি আধুনিক কোয়ার্টার নির্মাণ করেছে ঢাকা ওয়াসা। ছয় তলা ভবনের নিচতলায় গ্যারেজ আর বাকি পাঁচ তলায় পাঁচটি ফ্ল্যাট রয়েছে। গত মার্চ মাসে পুরো কাজ সম্পন্ন করেছেন জসিম উদ্দিন নামের একজন ঠিকাদার।


নির্মাণকাজ তদারকির দায়িত্বে ছিলেন ওয়াসারই তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী) মো. আক্তারুজ্জামান। পরের মাসে ওয়াসা তাঁকেসহ মোট পাঁচজন কর্মকর্তাকে পাঁচটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়। কিন্তু বাসায় উঠতে গিয়েই চারজন কর্মকর্তা হতবাক হয়ে যান। তাঁরা দেখতে পান, দরজায় কাঠের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে হালকা প্লাস্টিকের পাত, যা আঙুল দিয়েই ভেঙে ফেলা যায়। বারান্দায় নেই কোনো গ্রিল। টয়লেটের ফ্লাশ নষ্ট। পানির কল বিকল। লিফটও অচল।
অথচ লিফট বাবদই খরচ ধরা হয়েছে ২২ লাখ ২৩ হাজার ৮৯১ টাকা। আর পুরো ভবন নির্মাণে খরচ দেখানো হয়েছে সোয়া তিন কোটি টাকারও বেশি। বরাদ্দপ্রাপ্তদের অভিযোগ, ভবনের কোনো নির্মাণসামগ্রীই দরপত্র শিডিউল অনুযায়ী সংযোজন করা হয়নি। দৃশ্যমান জিনিসের মানই যদি এত নিম্নমানের হয়, তাহলে অদৃশ্যমান জিনিসপত্র যেমন- রড, সিমেন্ট ইত্যাদির ক্ষেত্রে নিশ্চয় আরো জালিয়াতি করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে কর্মকর্তারা পুরো ভবনটিকেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে মনে করছেন বলে জানিয়েছেন।
বরাদ্দপ্রাপ্ত পাঁচজনের মধ্যে চারজনই লিখিত অভিযোগ জানালেও একজন কোনো অভিযোগ করেননি। তিনি হলেন ওই ভবনের তদারককারী মো. আক্তারুজ্জামান। তিনি বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের স্টাফ অফিসার পদে কর্মরত। তিনি নিজের টাকায় তাঁর ফ্ল্যাটের সব কিছু পরিবর্তন করে আধুনিকায়ন করে নিয়েছেন। এ জন্য অন্তত তাঁর ১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ঘটনায় ঢাকা ওয়াসাজুড়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। সবারই ধারণা, ব্যবহার-অযোগ্য নিম্নমানের মালামাল দিয়ে ভবন নির্মাণ করে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করার কারণেই এমন অবস্থা হয়েছে।
জানা গেছে, কোনো ভবন নির্মাণের পর প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে সংস্কারের জন্য নতুন কোনো বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু ওয়াসার এ ভবনের ক্ষেত্রে নির্মাণকাজ শেষের এক মাসের মধ্যেই গত এপ্রিলে আরো দেড় লাখ টাকা খরচ করে লিফট মেরামত করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ওয়াসাকুঞ্জের ছয় তলাবিশিষ্ট এই ৪ নম্বর ভবনের নিচতলায় রয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। অন্য প্রতিটি তলায় রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বর্গফুটের একেকটি অ্যাপার্টমেন্ট। তৃতীয় তলায় বরাদ্দ পেয়েছেন মো. আক্তারুজ্জামান। অন্য বরাদ্দপ্রাপ্তরাও নিজস্ব টাকায় বিভিন্ন জিনিস মেরামত করে নিয়েছেন। নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, পুরো ভবনের পেছনে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন কোটি ১৭ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। শুরুতে তিন কোটি সাত লাখ ২৭ হাজার টাকা ধরা হলেও পরে ব্যয় আরো বাড়ানো হয়। অথচ এ ধরনের একটি ভবন নির্মাণ করতে দুই কোটি টাকাই যথেষ্ট বলে মনে করেন খোদ ওয়াসারই একজন প্রকৌশলী।
ষষ্ঠ তলায় বরাদ্দ পাওয়া তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কামরুল হাসানের অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, তাঁর ফ্ল্যাটের বারান্দায় গ্রিল নেই। আটটি দরজা ব্যবহারের অযোগ্য। চতুর্থ তলার বরাদ্দপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোসফিকুর রহমানের অভিযোগ, দরজার পাল্লাগুলোতে একটি কাঠের ফ্রেমের ওপর দুটি লেয়ারের প্লাস্টিক জাতীয় জিনিস দেওয়া হয়েছে, যা সহজেই ছিদ্র করা যায়। দ্বিতীয় তলার বরাদ্দপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বাহারুল ইসলামের অভিযোগও একই। পঞ্চম তলার বরাদ্দ পাওয়া প্রকৌশলী মতিউর রহমানের অভিযোগ, তাঁর ইউনিটের ৯টি দরজাই প্লাস্টিক বোর্ড দিয়ে তৈরি। বারান্দায় গ্রিল নেই। ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। মাস্টার বেড-সংলগ্ন টয়লেটের ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। পানির কল ও কমোডের ফ্লাশ নষ্ট। অথচ এরই মধ্যে ঠিকাদারকে বিলও পরিশোধ করা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালের প্রথম দিকে এ ভবন নির্মাণ করার জন্য ওয়াসা দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ঠিকাদার মনোনীত হয় ১০, দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার জীবন বীমা ভবনের ষষ্ঠ তলায় অবস্থিত মেসার্স আনাম ট্রেডার্স। এর স্বত্বাধিকারী মনিরুল ইসলাম মানিক। কিন্তু তিনি কাজটি বিক্রি করে দেন আরেক ঠিকাদার জসিম উদ্দিনের কাছে। পরে জসিম উদ্দিনই ভবনটি নির্মাণ করেন।
বরাদ্দপ্রাপ্তদের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে জসিম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বুদ্ধির ভুলে কিছু কিছু কাজের মান খারাপ হয়েছে। যেটা বেশি খারাপ হয়েছে, সেটা বদলে দেওয়া হয়েছে। আর নতুন লিফটই লাগানো হয়েছে। কিন্তু একটা ভোল্ট স্ট্যাবিলাইজার লাগানোর প্রয়োজন ছিল। দরপত্র শিডিউলে সেটা ধরা হয়নি, যে কারণে লিফটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।' কিন্তু কাজের মান ভালো হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
ভবনটির তদারক কর্মকর্তা মো. আকতারুজ্জামান তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন দাবি করে বলেন, ষড়যন্ত্রমূলভাবে সহকর্মীরা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। এর বেশি কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন তিনি।
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. তাকসিম এ খান বলেন, এ বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একটা পরিদর্শন কমিটিও করা হয়েছে। তারা বিষয়টি দেখছে।

No comments

Powered by Blogger.