প্রবাসে বাংলা ভাষার বিকাশ ও প্রতিবন্ধকতা by ফারুক যোশী

একুশের চেতনা ছড়িয়ে গেছে দেশ থেকে দেশান্তরে। এই চেতনা ছায়া ফেলে। একুশে মানেই বাংলা ভাষা। একটি জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের সন্ধানে প্রথম বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণে একটি জাতি অঙ্কুরিত হয়। এ অঙ্কুর থেকেই জাতি ক্রমে বিস্তৃত হতে থাকে। একটি বৃক্ষ পত্র-পল্লবে পুষ্পিত হতে থাকে। আর যা চূড়ান্ত গতি পায় একাত্তরে।


খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলা ভাষা নিয়ে আছে অহংকার। এই অহংকার অর্ধশতাব্দীরও আগের সেই বিস্ফোরণ এখনো বাঙালিদের তারুণ্যে ঝড় তোলে। শোষণ-নির্যাতনে এরা একুশের ত্যাগে উজ্জীবিত হয়। প্রবাসে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলোও ফিরে তাকায় প্রতিনিয়ত। ফিরে তাকাতে গিয়েই একুশে কিংবা ভাষা আন্দোলন নিয়ে এই প্রবাসীরাই সৃষ্টি করছে নতুন নতুন ইতিহাস। কানাডাপ্রবাসী দুজনের উদ্যোগে যেমন জাতিসংঘ একুশে ফেব্রুয়ারিকে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা, অন্যদিকে ওই ব্রিটেন থেকেই আওয়াজ উঠেছে বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার। ব্রিটেনপ্রবাসীদের একটি সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ সদস্য মাঈনউদ্দিন খান বাদলের মাধ্যমে এ দাবিটি উত্থাপিত হয় ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের সংসদে এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে এ প্রস্তাবটি ওই বছরই বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের ৬৪তম অধিবেশনে তাঁর বক্তৃতায় তুলে ধরেন। এরই সূত্র ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায়ও ২০০৯ সালের ১৭ নভেম্বর এ নিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয় এবং তারাও বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বলতে গেলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবেরই প্রতিধ্বনি করে। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালেই এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব বার্মিংহামের রোজার গোডশিপ (ওয়েস্টমিনিস্টার এমপি) ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উত্থাপন করেন এবং এতে ৪৭ এমপি সমর্থনও দেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ওই সংগঠনটির সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই সংসদ সদস্য মাঈনুদ্দিন খান বাদল এমনকি এ সংক্রান্ত আলাপে রোজার গডশিপের সঙ্গে মতবিনিময় করে বাংলা আর বাঙালির সংগ্রাম-ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘের ভাষণ, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ৪৭ এমপির সমর্থন, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এ নিয়ে প্রস্তাব পাস প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি জোরালো হয়েছে এবং এটা এখন আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় এসেছে। তার ফল সুদূরপ্রসারী হলেও আমাদের প্রত্যাশা আছে।
২. ভাষা আর বিজয়ের গর্ব নিয়ে এই প্রবাসের মানুষগুলো করে যাচ্ছে সংস্কৃতির কর্ষণ। সাংস্কৃতিক উৎকর্ষে বিশেষত দেশ থেকে আসা মানুষগুলো ভিনদেশেও চালিয়ে যায় নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা। বাঙালি কমিউনিটির দৃঢ়ভিত্তির কারণেই এখানকার স্থানে স্থানে বাঙালি স্থাপনা। ব্রিটেনই প্রথম দেশ যেখানে নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের বাইরে একুশের প্রথম শহীদ মিনার। বাঙালি অধ্যুষিত শহর ওল্ডহামে প্রথম নির্মাণের পর লন্ডনের আরেকটি শহীদ মিনার নিয়ে ব্রিটেনে আছে দুটো একুশের মিনার। তারই পাশাপাশি বাংলা ভাষা নিয়ে চলছে ভিন্ন আলোকপাত। এখানকার বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোর লাইব্রেরিতে থরে থরে সাজানো বাংলা বই। লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেট্সের বিশাল লাইব্রেরি ও লার্নিং সেন্টার 'আইডিয়া স্টোর'। এখানকার লাইব্রেরিগুলো শুধুই তো বইয়ের সমাহার নয়; তথ্য কিংবা ইনফরমেশনের জন্য এ লাইব্রেরিগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে পাঠক-পাঠিকা কিংবা তথ্য জানতে ইচ্ছুক মানুষগুলো প্রতিদিন লাইব্রেরি ব্যবহার করছে। শুধু স্কুল-কলেজের লাইব্রেরিতেই ছাত্রছাত্রীরা যাতে নিজেদের কেন্দ্রীভূত না রাখে, সে জন্য এই লাইব্রেরিগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে এমনকি ছাত্রছাত্রীদের হোমওয়ার্কের একটা নিরিবিলি জায়গা হিসেবে। আইডিয়া স্টোরের মতোই ব্রিটেনের বাঙালি অধ্যুষিত বিভিন্ন শহরেও দেখা যায় বাংলা বইয়ের র‌্যাক। ভালোই লাগে গল্প-উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধের বইগুলো দেখে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ বইগুলো দেখে কে? আমি কিংবা আমাদের মতো দেশছাড়া মানুষগুলোও এখন আর খুব একটা এসব বইয়ের দিকে ঝোঁকে না। কারণ এগুলো আমাদের কোনো তথ্য (ইনফরমেশন) দেয় না। ইন্টারনেট আর অনলাইন পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের সর্বশেষ খবর দেয়। মানুষ অনেকটাই তৃপ্ত হয়। যে কারণে মানুষ লাইব্রেরিতে যাবে, সেই তথ্যভাণ্ডার কিন্তু এখানে নেই। বাংলাদেশ কিংবা বাংলা কিংবা বাঙালি নিয়ে তথ্য জানার কোনো ভালো মাধ্যম বলতে গেলে এখানে অনুপস্থিত। বিজয় দিবস, একুশে কিংবা স্বাধীনতা দিবসের দিনগুলো ঘটা করে পালিত হয় হয়তো এই ব্রিটেনে। জেনেছি এগুলো পালিত হয় আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ইউরোপ কিংবা অন্যান্য দেশেও। যেখানেই বাঙালি, সেখানে সে এক আশ্চর্য শেকড়ের টান। কিন্তু বিশেষত ব্রিটেনের কথাই বলতে চাই। ব্রিটেনে একটি কথা সভা-সমাবেশে বহু উচ্চারিত, আর তা হলো, পরবর্তী প্রজন্মকে শেকড়মুখী করা। কিন্তু এ জেনারেশনকে শেকড়মুখী করবে কে? বাংলা শেখার কিছু কিছু স্কুল সারা ব্রিটেনের বিভিন্ন বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় আছে, এটা আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু হাতে-কলমে শুধু অক্ষরগুলো শিখে কিংবা বাংলায় দু-একটি বাক্য লিখে কিংবা পড়েই এই দায়িত্ব শেষ হচ্ছে আজকাল। আজ থেকে পাঁচ-দশ বছর আগেও একটা ট্রেন্ড ছিল, স্কুলে বাংলায় জিসিএসই অনেকেই করত বিদেশি ভাষা হিসেবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলা নিয়ে অনেকেই ভালো রেজাল্টও নিয়ে আসত। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে; সব কিছু বদলে যাচ্ছে। অনেক স্থানীয় কাউন্সিলের শিক্ষা বিভাগগুলো বাংলা ভাষাকে এখন আর তাদের কারিকুলামে অন্তর্ভুক্তই করছে না খুব স্বাভাবিক কারণেই। এমনকি বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের সেই উৎসাহ নেই বাংলার প্রতি। আর তার প্রধান কারণই হলো, বাংলা কিংবা বাঙালি নিয়ে নেই কোনো ভালো ইতিহাস-আশ্রয়ী বই। বাংলা বিষয়ক ইংরেজি বইগুলোর অভাব। যে বইগুলো পড়ে কিংবা বইকে কেন্দ্র করে বাংলা-বাঙালি নিয়ে অন্তত বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা আগ্রহ সৃষ্টি হবে, তার কোনো রিসোর্স নেই। বাংলা ভাষা কিংবা বাঙালি নিয়ে কোনো সমৃদ্ধ অনুবাদ নেই, নেই কোনো ভালো গল্প-কবিতা কিংবা উপন্যাসের অনুবাদ। যেহেতু এখানে এসব অনুবাদ কিংবা রিসোর্স অপ্রতুল, সেহেতু স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তাদের এমনকি বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের খুব একটা এতে আগ্রহী করে তোলেন না কিংবা অন্য অর্থে আগ্রহী করতে পারেন না। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই কোনো ছাত্রছাত্রী যখন বিদেশি ভাষা হিসেবে ফ্রেঞ্চ কিংবা স্প্যানিশকেই প্রাধান্য দেয়, তখন অভিভাবকরাও আর তাদের ছেলেমেয়েদের চাপাচাপি করেন না। কারণ এ এমন এক দেশ যেখানে তথ্য নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রছাত্রীদের আবেগ বাস্তবতার কাছে পরাভূত হয়। বাংলা ভাষার টিভি চ্যানেলগুলো কমিউনিটির কথা বলে কিংবা বাংলা ভাষায় কথা বলে, কৃষ্টি আর কালচারের কথা কি বলছে, সে প্রশ্নটিও আছে এবং সে কারণেই এ চ্যানেলগুলো থেকে পরবর্তী জেনারেশনের কোনো কিছু শেখার কিংবা প্রাণিত হওয়ার কোনো সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে না।
স্থানীয় কাউন্সিলগুলোতে বাঙালি কাউন্সিলার আছেন। এতে শিক্ষাবিষয়ক সরকারি বিভাগগুলোতে বাঙালি প্রতিনিধিদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপস্থিতিও লক্ষণীয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। কোনো কাউন্সিলই এমনকি বাঙালি অধ্যুষিত কাউন্সিলগুলো এ ব্যাপারে ঔদাসীন্য দেখায়। বাংলাদেশ লিংকের কথা বলে বিভিন্ন বাঙালি অধ্যুষিত কাউন্সিল থেকে লাখ লাখ পাউন্ড পর্যন্ত ফান্ডিং যায় দেশে, সিলেটে। বড় বড় কর্তা ভিজিট করেন। এতে সিলেট লিংক হয়, সংস্কৃতির লিংক হয় না। ভেবে দেখতে হবে ভাষা কিংবা সংস্কৃতিকে এই ব্রিটেনের কিংবা অভিবাসী সমাজে পোক্ত করতে হলে আগামী প্রজন্মকে এর বার্তা পেঁৗছাতে হবে। বার্তা পেঁৗছাতে বাংলা আর বাঙালি নিয়ে ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটির প্রয়োজন আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, কিছু কিছু ফান্ডিং মূলত আসেই আগাছায় পানি দিতে। অথচ গোড়া সমৃদ্ধ করার জন্য অর্থ প্রাপ্তির কথা ভাবতে হবে। আর সে জন্য স্থানীয় বাঙালি জনপ্রতিনিধিসহ কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্টদের উদ্যোগী হতে হবে।
৩. আজকের পৃথিবীতে চতুর্থ ভাষা হিসেবে চর্চিত কিংবা উচ্চারিত হয়ে এক উঁচু আসনে আছে আমাদের মাতৃভাষা। বীরত্ব আর সাহসের প্রতীক এই ভাষা আজ উচ্চারিত পৃথিবীর দেশে দেশে অর্ধকোটি বাঙালির মুখে মুখে। ব্রিটেনের অর্ধমিলিয়ন বাঙালিসহ ইউরোপ-আমেরিকায় অভিবাসিত বাঙালিদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এ ভাষা আদৌ উচ্চারিত হবে কি হবে না_এ প্রশ্ন এখন আমাদের ভাবায়। যতই সময় গড়াচ্ছে, ততই যেন শেকড়মুখী হওয়ার প্রবণতা কমছে বৈ বাড়ছে না। আর তাই শেকড়ের সন্ধানে থাকা এই সময়ের মানুষদের অর্থাৎ আমাদেরই ভাবতে হবে। সংগ্রামের ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে সময়োপযোগী করেই রাখতে হবে, তথ্য সাম্রাজ্যে নিজেকে বিস্তৃৃত করতে হবে। তবেই না গর্বের ইতিহাস উচ্চারিত হবে যুগ থেকে যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক
faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.