চরাচর-আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বার্তা by সুব্রত কুমার দাস
আমরা সবাই জানি, ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ঘোষণা দিয়েছিল যে বৈশ্বিক সংস্থাটি, তার নাম ইউনেসকো। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে, সে ঘোষণার ভেতরে একটি নতুনতর মাত্রা যুক্ত হয়েছিল ভাষা দিবসের ভাবনার সঙ্গে।
আর তা হলো, প্রতিটি ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং পৃথিবী থেকে আর কোনো ভাষা যাতে বিলুপ্ত না হয়, সে ব্যাপারে অঙ্গীকার করা। প্রসঙ্গটি এ কারণে টানছি যে আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অনেক বক্তাই শুধু শহীদ দিবসের ইতিহাস সামনে এনে গর্বের কথা উচ্চারণ করতে পছন্দ করেন, এর বৈশ্বিক মাত্রাকে আত্মস্থ করতে আগ্রহী থাকেন না। ইউনেসকোর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ২০০২ সাল থেকে। ২০০৫ সালে সেটি সুদৃঢ় হলো ওদের পরিচালিত আন্তসাংস্কৃতিক সংলাপ প্রতিযোগিতা 'মনডিয়ালোগো'তে, যখন আমার তৎকালীন কর্মস্থল ঢাকার পিলখানাস্থ বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ রাইফেলস্ কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে অংশগ্রহণ করলাম এবং সে দল 'উই লাভ বাংলাদেশ' ২০০৬ সালে সারা পৃথিবীর ২৬৪০টি দলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ৫০-এ অন্তর্ভুক্ত হলো। রোম সিম্পোজিয়াম সেরে ফেরার পর ওই ৫০টি দলের কার্যক্রমের ভিত্তিতে ২০০৭ সালে শ্রেষ্ঠ যে তিনটি দলকে ইউনেসকো মুম্বাই সিম্পোজিয়ামে আহ্বান করেছিল, তার ভেতর আমাদের দলটির স্থান ছিল প্রথম। এসব সিম্পোজিয়ামের ভেতর দিয়ে যোগাযোগ ঘটেছিল জাপানের কোবে শহরের ফুকিয়াই মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুলের শিক্ষিকা রোজ সাবানালের সঙ্গে। ফিলিপিনো রোজ রোম সিম্পোজিয়াম থেকে ফিরেই আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করতে। জাতিসংঘ কিন্তু ২০০৮ সালকে 'ভাষাবর্ষ' ঘোষণা দিয়েছিল। জাতিসংঘের স্লোগান ছিল 'খধহমঁধমবং গধঃঃবৎ'। যদিও বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আন্তর্জাতিক এমন একটি ঘোষণাকে প্রসার-প্রচারে বিশেষ কারো ভূমিকা চোখে পড়েনি। সিদ্ধান্ত হলো, ২০ জানুয়ারি প্রকাশনা অনুষ্ঠান হবে। এ ব্যাপারে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়ালেন র্যানকন মোটর্স্ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রোমো রউফ চৌধুরী। দূর থেকে আশীর্বাণী পেলাম বাংলাদেশে ইউনেসকোর কান্ট্রি প্রতিনিধি মালামা মালিসা ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেসকোর সচিব ড. মাহমুদুল হাসানের। ইতিমধ্যে ইউনেসকো ফ্রান্সের প্রতিনিধিরা জাপান থেকে জানতে পেরেছিলেন আমাদের কাজের কথা। ৭ ফেব্রুয়ারি মনডিয়ালোগো ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হলো প্রজেক্ট নিয়ে সংবাদ-দুই দেশের দুই দলের গ্রুপ ছবিসহ। কী আনন্দ, কী আনন্দ! এখানে ছাপানো হলো অনিন্দ্যসুন্দর এক ডেস্ক ক্যালেন্ডার, ইউনেসকো কার্যক্রমে আমাদের ছেলেমেয়েদের গত তিন-চার বছরের কর্মতৎপরতার ছবি নিয়ে। ইউনেসকো, ভাষাবর্ষ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রভৃতির বাণী-সজ্জিত বর্ণিল কলেজ প্রাঙ্গণে জাপানি রাষ্ট্রদূত এসে পৌঁছালেন। ঘড়ির কাঁটার পূর্বনির্ধারণে শুরু হলো অনুষ্ঠান। রাষ্ট্রদূত ইনোওয়ের সেদিনের ভাষণের একটি বাক্য এখনো কানে বাজে-'This is a small book, but this is a big book...' রোজ জানিয়েছিলেন, ওঁরা ওঁদের স্কুলে সপ্তাহব্যাপী মাতৃভাষা দিবস প্রদর্শনী করেছেন। প্রজেক্টের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানের অন্যদের কাছে তুলে ধরেছে এ দিবসের ইতিহাস এবং দিবসটির মর্মার্থ। রোজকে অনুরোধ করেছিলাম ভাষা নিয়ে অভিনব এ কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে। মার্চের ২ তারিখে ঢাকার ইংরেজি দৈনিকে ছাপা হয়েছিল রোজের লেখা 'গু খধহমঁধমব ড়ভ ঞযড়ঁমযঃ'। অনেকের দৃষ্টিতেই কাজটি তত বেশি গুরুত্বের নয়। হয়তো কিশোরদের করা বলে। কিন্তু অপার বিস্ময় লেগেছিল কাজটি নিয়ে যখন উন্নত বিশ্বের প্রথম সারির দেশ জাপানের রাষ্ট্রদূত ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন। ভালো লেগেছিল প্রজেক্টের শিক্ষার্থীদের গাওয়া 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...' গানের সঙ্গে যখন তিনি কণ্ঠ মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন বিনম্র দাঁড়িয়ে। বারবার মনে হয়েছিল, এমন অনেক প্রচেষ্টা সংহত হলে কি আমার শহীদ দিবস সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বার্তা নিয়ে পূর্বদেশীয় দ্বীপ ফিজি থেকে সুদূর পশ্চিমের পেরু পর্যন্ত পেঁৗছাতে পারত!
সুব্রত কুমার দাস
সুব্রত কুমার দাস
No comments