আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গ by সৈয়দ ইমতিয়াজ ইসলাম
বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসনসংক্রান্ত অমীমাংসিত ইস্যুটি বাংলাদেশ-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি) পরিচালিত এক সমীক্ষার রিপোর্টে বলা হয়েছে : আটকে পড়া পাকিস্তানিরা হচ্ছে সেসব অস্থানীয় ও অবাঙালি পাকিস্তানি, যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে বহাল থাকার এবং সে দেশে চলে যাওয়ার অপশন দিয়েছিল।
পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভেঙে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর যেসব অস্থানীয় এবং অবাঙালি জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের পক্ষে অপশন দিয়েছিল, তারা সেই থেকে এ দেশের মূল জনস্রোতে মিশে গেছে। রেডক্রসের জরিপ অনুসারে পাঁচ লাখ ৩৯ হাজার ৬৬৯ জন অবাঙালি পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিল। এই আটকে পড়া পাকিস্তানিদের রাখা হয় ১৩টি জেলার ৭০টি ক্যাম্পে (বর্তমান সংখ্যা ৬৬) এবং তাদের বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের শরণার্থীসংক্রান্ত হাইকমিশন খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ও স্যানিটেশন সুবিধা দিয়ে থাকে।
১৯৭৩ সালের নয়াদিল্লি চুক্তি এবং ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির (বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান) অধীনে বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসনের রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল। নয়াদিল্লি চুক্তিতে একই সঙ্গে বন্দি ও আটকে পড়া ব্যক্তিদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়। চুক্তিতে পাকিস্তানে প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক অবাঙালিদের সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলা হয়, 'মানবতার বিবেচনা দ্বারা পরিচালিত হয়ে পাকিস্তান সরকার প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অবাঙালিকে গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে। পাকিস্তান আরো সম্মত হয়েছে যে অতঃপর পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় অথবা তাঁদের মনোনীত প্রতিনিধিরা বৈঠকে মিলিত হয়ে স্থির করবেন, কতজন অবাঙালি পাকিস্তানে যেতে চায় এবং তাদের কতজনকে পাকিস্তানে প্রত্যাবাসনের অনুমতি দেওয়া হবে।
পাকিস্তান শুরুতে এক লাখ ৪৭ হাজার ৬৩৭ জনকে সে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়; কিন্তু গ্রহণ করে এক লাখ ২৬ হাজার ৯৪১ জনকে। এরপর অনুমতিপ্রাপ্ত ২০ হাজার ৬৯৬ জনকে ফেরত নেওয়ারও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, বাকিদের বিষয় তো দূরের কথা। সেই থেকে পাকিস্তান অজুহাত দেখাচ্ছে, ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে যাদের ফেরত নেওয়ার কথা, পাকিস্তান তার চেয়ে বেশিসংখ্যক লোককে ফেরত নিয়েছে।
পাকিস্তানি সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৭৮ সালে একটি অধ্যাদেশবলে বাংলাদেশে আটক সব পাকিস্তানির নাগরিকত্ব ১৯৭১ সাল থেকে বাতিল করে দেন। ফলে প্রায় চার লাখ আটকে পড়া পাকিস্তানির প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। জেনারেল জিয়াউল হক অবশ্য পরে ১৯৮২ সালে তাঁর অবস্থান নরম করেন। জাতিসংঘ শরণার্থীসংক্রান্ত হাইকমিশনের সহযোগিতায় সৌদি আরব, কুয়েত এবং অন্যান্য উপসাগরীয় দেশের ১.৫ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তায় চার হাজার ৬০০ আটকে পড়া পাকিস্তানির প্রত্যাবাসন সম্পন্ন হয়। এর চেয়েও বড় অগ্রগতি অর্জিত হয় ১৯৮৩ সালে, যখন জেনারেল জিয়াউল হক করাচিতে জনসমক্ষে ঘোষণা করেন, দাতারা প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দিলে বাংলাদেশ থেকে অবশিষ্ট আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত আনতে পাকিস্তান আপত্তি করবে না।
সৌদি আরবভিত্তিক এনজিও রাবিতায়ে আলম আলম আল ইসলামী আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহের একটি উদ্যোগ নেয়। রাবিতার পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ৬৬টি ক্যাম্পে দুই লাখ ৮৩ হাজার ৯৩ জন আটকে পড়া পাকিস্তানি রয়েছে। আনুমানিক আড়াই লাখ আটকে পড়া পাকিস্তানিকে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে তহবিল সংগ্রহের জন্য ১৯৮৬ সালের ৯ জুলাই রাবিতায়ে আলম আল ইসলামী এবং পাকিস্তান সরকার একটি ট্রাস্ট গঠনের চুক্তি সই করে। পাকিস্তানের ২৫০ মিলিয়ন টাকা এবং রাবিতার ৫০ মিলিয়ন টাকার অনুদান দিয়ে ট্রাস্টের প্রাথমিক তহবিল গঠিত হয়। কিন্তু জেনারেল জিয়াউল হকের আকস্মিক মৃত্যুর ফলে এ চুক্তি অকার্যকর হয়ে পড়ে।
এরপর প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা আবার উজ্জ্বল হয় প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত আনার নির্বাচনী ওয়াদা করে ১৯৯০ সালে ক্ষমতায় আসার ফলে। নওয়াজ শরিফ রাবিতা ট্রাস্টের কার্যক্রম ফের চালু করেন। ১৯৯১ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেওয়ার পরিকল্পনা, তদারকি ও ব্যবস্থাপনার জন্য তিনটি কমিটি গঠন করা হবে। আরো সিদ্ধান্ত হয়, প্রত্যাবাসনের জন্য বিদেশ থেকে পাওয়া সাহায্যের সমপরিমাণ অর্থ পাকিস্তান দেবে এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ৩২টি জেলায় প্রত্যাগতদের পুনর্বাসনের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হবে। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান যৌথভাবে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের একটি আদমশুমারি করে। এতে রাবিতা এবং আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। আটকে পড়াদের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ ৩৮ হাজার। এর ভিত্তিতে পাকিস্তান হাইকমিশন আটকে পড়া পাকিস্তানিদের পরিচয়পত্র দেবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
১৯৯২ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের প্রথম বাংলাদেশ সফরের সময় পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে, প্রথম দফায় তিন হাজার আটকে পড়া পাকিস্তানি পরিবারের প্রত্যাবাসন ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে ৫০ পরিবারের প্রথম ব্যাচের প্রতীকী প্রত্যাবাসনের পর পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশ থেকে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়। এরপর ১৯৯৫ সালে বেনজির ভুট্টোর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবর ঘোষণা করেন, পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে 'বিহারিদের' পাকিস্তানে গ্রহণ করবে না।
সেই থেকে বাংলাদেশের সরকারগুলো বিভিন্ন সরকারি পর্যায়ে পাকিস্তানের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেছে; কিন্তু ফল হয়নি। ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান সফরকালে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যারা পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য অপশন দিয়েছে, তাদের প্রতি নৈতিক দায়িত্ববোধ ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দুই লাখ ৪০ হাজার আটকে পড়া পাকিস্তানিকে ফেরত নেওয়ার জন্য পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু জবাবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশেই ঠাঁই করে দেওয়ার পরামর্শ দেন। পরে ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শারতাজ আজিজ বলেন, বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিরা পাকিস্তানি নয়, তাই তাদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
নওয়াজ শরিফ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দ্বিতীয়বার ঢাকা সফরকালে নিজস্ব অর্থায়নের ভিত্তিতে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসনের বিষয় পরীক্ষা করে দেখার আশ্বাস দেন। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাকিস্তান সফর এবং সচিবদের বার্ষিক বৈঠককালে পাকিস্তানের কাছে বিষয়টি আবার উত্থাপন করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান বাংলাদেশের উদ্বেগ নজরে নিলেও কোনো অঙ্গীকার করা থেকে বিরত থাকে।
পাকিস্তান প্রাথমিকভাবে এ অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করে যে ১৯৭৩ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে যে সংখ্যা ধরা হয়েছে, পাকিস্তান তার চেয়েও বেশি লোক ফেরত নিয়েছে। পাকিস্তান এই বক্তব্যও প্রদান করে যে এক লাখ ২৬ হাজার ৯৪১ জনকে ফেরত নেওয়া হয়েছে এবং এর চেয়ে বেশি লোক নেওয়ার কোনো নৈতিক দায় পাকিস্তানের নেই। পাকিস্তান আটকে পড়া পাকিস্তানিদের বিহারি আখ্যা দিয়ে প্রত্যাবাসন ইস্যুটিকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করে আসছে। এর পেছনে একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেওয়ার দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
১৯৭৩ সালের নয়াদিল্লি চুক্তি এবং ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির (বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান) অধীনে বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসনের রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল। নয়াদিল্লি চুক্তিতে একই সঙ্গে বন্দি ও আটকে পড়া ব্যক্তিদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়। চুক্তিতে পাকিস্তানে প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক অবাঙালিদের সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলা হয়, 'মানবতার বিবেচনা দ্বারা পরিচালিত হয়ে পাকিস্তান সরকার প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অবাঙালিকে গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে। পাকিস্তান আরো সম্মত হয়েছে যে অতঃপর পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় অথবা তাঁদের মনোনীত প্রতিনিধিরা বৈঠকে মিলিত হয়ে স্থির করবেন, কতজন অবাঙালি পাকিস্তানে যেতে চায় এবং তাদের কতজনকে পাকিস্তানে প্রত্যাবাসনের অনুমতি দেওয়া হবে।
পাকিস্তান শুরুতে এক লাখ ৪৭ হাজার ৬৩৭ জনকে সে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়; কিন্তু গ্রহণ করে এক লাখ ২৬ হাজার ৯৪১ জনকে। এরপর অনুমতিপ্রাপ্ত ২০ হাজার ৬৯৬ জনকে ফেরত নেওয়ারও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, বাকিদের বিষয় তো দূরের কথা। সেই থেকে পাকিস্তান অজুহাত দেখাচ্ছে, ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে যাদের ফেরত নেওয়ার কথা, পাকিস্তান তার চেয়ে বেশিসংখ্যক লোককে ফেরত নিয়েছে।
পাকিস্তানি সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৭৮ সালে একটি অধ্যাদেশবলে বাংলাদেশে আটক সব পাকিস্তানির নাগরিকত্ব ১৯৭১ সাল থেকে বাতিল করে দেন। ফলে প্রায় চার লাখ আটকে পড়া পাকিস্তানির প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। জেনারেল জিয়াউল হক অবশ্য পরে ১৯৮২ সালে তাঁর অবস্থান নরম করেন। জাতিসংঘ শরণার্থীসংক্রান্ত হাইকমিশনের সহযোগিতায় সৌদি আরব, কুয়েত এবং অন্যান্য উপসাগরীয় দেশের ১.৫ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তায় চার হাজার ৬০০ আটকে পড়া পাকিস্তানির প্রত্যাবাসন সম্পন্ন হয়। এর চেয়েও বড় অগ্রগতি অর্জিত হয় ১৯৮৩ সালে, যখন জেনারেল জিয়াউল হক করাচিতে জনসমক্ষে ঘোষণা করেন, দাতারা প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দিলে বাংলাদেশ থেকে অবশিষ্ট আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত আনতে পাকিস্তান আপত্তি করবে না।
সৌদি আরবভিত্তিক এনজিও রাবিতায়ে আলম আলম আল ইসলামী আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহের একটি উদ্যোগ নেয়। রাবিতার পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ৬৬টি ক্যাম্পে দুই লাখ ৮৩ হাজার ৯৩ জন আটকে পড়া পাকিস্তানি রয়েছে। আনুমানিক আড়াই লাখ আটকে পড়া পাকিস্তানিকে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে তহবিল সংগ্রহের জন্য ১৯৮৬ সালের ৯ জুলাই রাবিতায়ে আলম আল ইসলামী এবং পাকিস্তান সরকার একটি ট্রাস্ট গঠনের চুক্তি সই করে। পাকিস্তানের ২৫০ মিলিয়ন টাকা এবং রাবিতার ৫০ মিলিয়ন টাকার অনুদান দিয়ে ট্রাস্টের প্রাথমিক তহবিল গঠিত হয়। কিন্তু জেনারেল জিয়াউল হকের আকস্মিক মৃত্যুর ফলে এ চুক্তি অকার্যকর হয়ে পড়ে।
এরপর প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা আবার উজ্জ্বল হয় প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত আনার নির্বাচনী ওয়াদা করে ১৯৯০ সালে ক্ষমতায় আসার ফলে। নওয়াজ শরিফ রাবিতা ট্রাস্টের কার্যক্রম ফের চালু করেন। ১৯৯১ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেওয়ার পরিকল্পনা, তদারকি ও ব্যবস্থাপনার জন্য তিনটি কমিটি গঠন করা হবে। আরো সিদ্ধান্ত হয়, প্রত্যাবাসনের জন্য বিদেশ থেকে পাওয়া সাহায্যের সমপরিমাণ অর্থ পাকিস্তান দেবে এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ৩২টি জেলায় প্রত্যাগতদের পুনর্বাসনের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হবে। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান যৌথভাবে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের একটি আদমশুমারি করে। এতে রাবিতা এবং আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। আটকে পড়াদের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ ৩৮ হাজার। এর ভিত্তিতে পাকিস্তান হাইকমিশন আটকে পড়া পাকিস্তানিদের পরিচয়পত্র দেবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
১৯৯২ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের প্রথম বাংলাদেশ সফরের সময় পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে, প্রথম দফায় তিন হাজার আটকে পড়া পাকিস্তানি পরিবারের প্রত্যাবাসন ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে ৫০ পরিবারের প্রথম ব্যাচের প্রতীকী প্রত্যাবাসনের পর পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশ থেকে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়। এরপর ১৯৯৫ সালে বেনজির ভুট্টোর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবর ঘোষণা করেন, পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে 'বিহারিদের' পাকিস্তানে গ্রহণ করবে না।
সেই থেকে বাংলাদেশের সরকারগুলো বিভিন্ন সরকারি পর্যায়ে পাকিস্তানের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেছে; কিন্তু ফল হয়নি। ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান সফরকালে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যারা পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য অপশন দিয়েছে, তাদের প্রতি নৈতিক দায়িত্ববোধ ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দুই লাখ ৪০ হাজার আটকে পড়া পাকিস্তানিকে ফেরত নেওয়ার জন্য পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু জবাবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশেই ঠাঁই করে দেওয়ার পরামর্শ দেন। পরে ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী শারতাজ আজিজ বলেন, বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিরা পাকিস্তানি নয়, তাই তাদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
নওয়াজ শরিফ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দ্বিতীয়বার ঢাকা সফরকালে নিজস্ব অর্থায়নের ভিত্তিতে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসনের বিষয় পরীক্ষা করে দেখার আশ্বাস দেন। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাকিস্তান সফর এবং সচিবদের বার্ষিক বৈঠককালে পাকিস্তানের কাছে বিষয়টি আবার উত্থাপন করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান বাংলাদেশের উদ্বেগ নজরে নিলেও কোনো অঙ্গীকার করা থেকে বিরত থাকে।
পাকিস্তান প্রাথমিকভাবে এ অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করে যে ১৯৭৩ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে যে সংখ্যা ধরা হয়েছে, পাকিস্তান তার চেয়েও বেশি লোক ফেরত নিয়েছে। পাকিস্তান এই বক্তব্যও প্রদান করে যে এক লাখ ২৬ হাজার ৯৪১ জনকে ফেরত নেওয়া হয়েছে এবং এর চেয়ে বেশি লোক নেওয়ার কোনো নৈতিক দায় পাকিস্তানের নেই। পাকিস্তান আটকে পড়া পাকিস্তানিদের বিহারি আখ্যা দিয়ে প্রত্যাবাসন ইস্যুটিকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করে আসছে। এর পেছনে একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেওয়ার দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
No comments