সদরে অন্দরে-কে নেভাবে বুয়েটের আগুন by মোস্তফা হোসেইন

বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়- সবখানেই অস্থিরতা। কোথাও পেশাগত দাবি, কোথাও রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় দলাদলি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের রাজপথে নেমে আসা কিংবা নিজ ক্যাম্পাসে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার চিত্র এখন নিত্যদিনের সংবাদের বিষয়।


দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি লক্ষ করা গেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাময়িক স্বস্তি দেখা গেল ড. আনোয়ার হোসেনকে সেখানে উপাচার্য নিয়োগের পর। কিন্তু শান্ত হয়নি ক্যাম্পাস। উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন নিয়ে বিভক্ত এখন সেখানকার শিক্ষকরা। লাগাতার আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু সিলেট এম সি কলেজের আগুন সবার চোখ ফিরিয়ে নেয় ওই দিকে। এটাও কি সম্ভব? ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেউ এভাবে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে? নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদলেন শিক্ষামন্ত্রী। তাঁর চোখের পানি কি পারবে এই অবক্ষয় রোধ করতে? দেশের ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয়, ৩৭টি কলেজ ও আটটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এখন আন্দোলনের ঘেরে আবদ্ধ। কোন দিকে তাকাব আমরা? কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) যে আন্দোলন চলে আসছে, তারও কি সুষ্ঠু সমাধান হয়েছে? অথচ ক্ষোভগুলো দানা বাঁধতে শুরু করে ২০০৯ সাল থেকে, যা উপাচার্যের কৃতকর্মের সূত্র ধরে বিস্ফোরিত হয়েছে প্রচণ্ড আকারে। সেখানকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রায় সবাই দপ্তর ও ক্লাসরুম ছেড়ে অবস্থান ধর্মঘটে শামিল হয়েছেন। বৃহস্পতি ও শুক্রবার ছুটির দিনেও তাঁরা অবস্থান ত্যাগ করেননি। বিতর্কিত নির্দেশের মাধ্যমে ভিসির ৪৪ দিন ছুটি ঘোষণাটি আগুনে কেরোসিন ঢেলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। অভিযোগ উঠেছে, একাডেমিক কাউন্সিলের কোনো পরামর্শ নেননি তিনি। একাডেমিক রুটিনে না থাকার পরও তিনি কিভাবে গ্রীষ্মকালীন ছুটি ঘোষণা করলেন, তাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনা করে উপাচার্যের ক্ষমতার কথা যদি বলা হয় তার পরও কথা আসে, এ কাজে তিনি একক ক্ষমতা প্রয়োগ করলেন কেন? শিক্ষক, ডিন, ইনস্টিটিউট প্রধান ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন এমনকি শিক্ষার্থীরাও যখন আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন, তখন বলতেই হবে উপাচার্য এখন নিঃসঙ্গ। এই নিঃসঙ্গতা কি নিকট-অতীতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালনকালীন পরিস্থিতির কথাই মনে করিয়ে দেবে না? দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বুয়েট। পরীক্ষিত মেধাবীদের সমাবেশ সেখানে। শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক- সবাই দেশের সেরা মাপের মানুষ। সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে এখন কী চলছে? একজন অভিভাবক অনেক আশা করে তাঁর সন্তানকে পাঠান সেখানে। একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার আশায় সেখানে শিক্ষার্থীদের ভিড় জমে। আজকের পরিস্থিতি কি সেই আশা পূরণে সহায়ক হতে পারে?
ওখানকার মূল ঘটনা কি শুধুই উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে কেন্দ্র করে, নাকি রাজনীতিও আছে নেপথ্যে। শিক্ষক সমিতি উপাচার্যের বিরুদ্ধে দলীয়করণের অভিযোগ এনেছে। এ অভিযোগ রাজনৈতিক। আবার ছাত্রলীগ অত্যন্ত আপত্তিজনক কিছু লিফলেট বিতরণ করেছে আন্দোলনের বিপক্ষে। তাতে দোষারোপ করা হয়েছে, হিজবুত তাহ্‌রীর ও শিবিরকে। এটাও রাজনৈতিক। তার মানে, উভয় পক্ষই স্বীকার করে নিয়েছে, এই গোলযোগের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক কারণ।
শিক্ষক সমিতি বলছে, নিয়ম ও রীতিবহির্ভূত উপ-উপাচার্য নিয়োগের মাধ্যমেই জন্ম দেওয়া হয়েছে ক্ষোভের। সিনিয়রিটি মানা হয়নি এ ক্ষেত্রে। অর্ধশতাধিক সিনিয়র শিক্ষককে ডিঙিয়ে একজনকে উপ-উপাচার্য করা হয়েছে। যিনি রাজনৈতিক পরিচয়ে ক্ষমতাসীন দলের একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের রাজনীতিসংশ্লিষ্টতা নিয়ে অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে আসছে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারগুলো তাদের দলীয় স্বার্থে এ দিকে নজর দেয় না। আজকে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড রীতিমতো আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যে দলই ক্ষমতায় আসে, তারাই সেখানে আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়। উপ-উপাচার্যের পদ না থাকার পরও বুয়েটে উপ-উপাচার্য নিয়োগ হয়েছে একান্তই রাজনৈতিক কারণে। অথচ বুয়েটে এমন পরিস্থিতি হওয়াটা ঠিক হয়নি। কারণ বুয়েট ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয় না। সেখানে শিক্ষকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তিই উপাচার্য হওয়ার সুযোগ পাওয়ার কথা। যদিও উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সিনিয়রিটি না মানার উদাহরণ আগেও আছে। আসলে সর্বক্ষেত্রেই রাজনীতির বিষবাষ্পের ছোঁয়া লেগেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতির দানবকে কি আমরা পুষতে থাকব? নাকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনব?
আন্দোলনকারীদের দাবিগুলো নিয়ে নিশ্চয়ই আলোচনা হতে পারে। আলোচনায় আসতে পারে সরকার ও কর্তৃপক্ষের গ্রহণ করা পদক্ষেপগুলোও। সরকার বলছে, শিক্ষক সমিতি উত্থাপিত ১৬ দফা দাবির প্রায় সব কয়টিই মেনে নেওয়া হয়েছে। সরকারি দল বলছে, সেখানে হিজবুত তাহ্‌রীর ও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের শিক্ষকরা একজোট হয়েছেন। প্রশ্ন আসে, নিষিদ্ধ ঘোষিত হিজবুত তাহ্‌রীর যদি সেখানে আন্দোলনে ইন্ধন জুগিয়ে থাকে, তাহলে সরকার বসে বসে কী করছে? বুয়েটের এ অচলাবস্থা এক দিনে তৈরি হয়নি। গত ফেব্রুয়ারি থেকে ধাপে ধাপে আন্দোলনকারীরা এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা পর্যাপ্ত সময়ও দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের আশ্বাস দিয়েছেন। সেই আশ্বাসে শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরে গেছেন। কিন্তু সরকারের পদক্ষেপগুলো শিক্ষকদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। গঠিত তদন্ত কমিটির ব্যাপারে আন্দোলনকারীদের আপত্তি শুরু থেকেই ছিল। দাবি ছিল, অন্তত তিনজন ডিনকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক সেই কমিটিতে। সরকার করেছে একজনকে। কী সমস্যা হতো আরো দুজনকে অন্তর্ভুক্ত করলে? তদন্ত কমিটি মাত্র দুটি বৈঠক করেই তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে। যাকে শিক্ষক সমিতি পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিহিত করেছে, যে তদন্ত কমিটিকে শিক্ষক সমিতি কোনো সহযোগিতাও করেনি। উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তিনি প্রশাসনকে দলীয়করণ করেছেন। অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে একাডেমিক বিষয়ে অবৈধ দলীয়করণের। আজকে বুয়েটসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, সেগুলো রাজনৈতিকীকরণেরই ফল। সুতরাং দলীয়করণের বিরুদ্ধে যাওয়ার আগে রাজনৈতিকীকরণের বিরুদ্ধে যেতে হবে। স্বায়ত্তশাসিত বুয়েটকে স্বায়ত্তশাসিতই রাখতে হবে। রাজনীতির নামে দলাদলি কিংবা ধর্মের নামে উগ্রতা প্রবেশ করলে শিক্ষা সেখান থেকে প্রস্থান করবে- এটাই স্বাভাবিক। সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের চাওয়া হতে পারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাচর্চা হবে, রাজনীতিচর্চা হবে এর জন্য নির্ধারিত বিশাল ক্ষেত্রে। শিক্ষাকে যদি রাজনীতি গ্রাস করতে চায়, তাহলে দেশ ও রাজনীতি উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পরিণতি হবে ভয়াবহ।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.