মানসিক রোগ ও একটি অসুখ

মানসিক রোগীকে পাগল বলা সামাজিক অপরাধ। শরীরের অন্যান্য অসুখের মতোই মানসিক রোগও একটি অসুখ। মানুষের হাত-পা, হৃৎপি-, কিডনি যেমন অসুস্থ হতে পারে তেমনি মনেরও অসুখ হতে পারে। সামাজিকভাবে মানসিক রোগ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাবের কারণে মানসিক রোগীরা সমাজ সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।


কোন পরিবারের সদস্য মানসিক অসুস্থ হয়ে পড়লে সে পরিবারেও নেমে আসছে সামাজিক বিপর্যয়। তাই এসব রোগীদের মানসিক হাসপাতালে ভর্তির পর অনেক অভিভাবকরাই তাদের খোঁজ নেন না। এসব রোগী সুস্থ হয়ে বছরের পর বছর বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকলেও অভিভাবকরা তাদের ফিরিয়ে নেন না। বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে এরা আবারও মানসিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। এদের আমৃত্যু মানসিক হাসপাতালেই কাটাতে হচ্ছে। এখানে মৃত্যু হলে কেউ মরদেহও নিতে আসে না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই দাফন-কাফন করতে হচ্ছে।
শফিকুল ইসলাম দীর্ঘ ১৮ বছর পাবনা মানসিক হাসপাতালে পড়ে আছেন। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ২৬৩নং ফ্রি স্কুল স্ট্রীট নিউমার্কেট ঢাকার ঠিকানায় বারবার যোগাযোগ করলেও তাকে কেউ নিতে আসেননি। বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তিনি আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার বাড়িতে অনুসন্ধান চালিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানতে পারেন ৩ ভাই ১ বোনের সংসারে শফিকুলের অনুপস্থিতিতে পৈত্রিক বাড়িটি বিক্রি করে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়া হয়েছে। এখন আর কেউ তার খোঁজ নেয় না। এভাবেই হাসপাতালে চলছে তার ১৮ বছর।
৫২নং শাঁখারীবাজার ঢাকার বাসিন্দা শিপ্রা রানী দে প্রায় ১২ বছর ধরে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হবার পর হাসপাতাল থেকে তার বাড়িতে বার বার যোগাযোগ করা হলেও তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নেয়া হয়নি। চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার ওইহারী গ্রামের সিরাজুল ইসলামের মেয়ে কাজী খোদেজা ৭ বছর ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার বুড়িরচর গ্রামের আব্দুল গফুরের মেয়ে আরজু বেগম প্রায় ১০ বছর হাসপাতালে রয়েছেন। ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের হাজারীবাগের নাজমা চৌধুরী ৩ বছর, ১১৩/০২ কাটাসুর, মোহাম্মদপুর ঢাকার হাফেজ মিয়ার মেয়ে গোলজার বিবি প্রায় ১২ বছর, ১১৬ সবুজবাগ ঢাকার দেলোয়ার হোসেনের মেয়ে বুলবুলি ৭ বছর, চাঁদপুর জেলার মতলব থানার মাগুরিয়ার ফজলুল ইসলামের ছেলে মোঃ মোশাররফ হোসেন ২ বছর, বিসিসি রোড নং-৮৪৩, ইব্রাহিমপুর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, কাফরুলের আশরাফ উদ্দিন ৯ বছর ধরে মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। ৩৮নং নয়াপল্টন ঢাকার আশরাফ উদ্দিন ৭ বছর ধরে মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এভাবেই ষাট জন রোগী মানসিক সুস্থ হলেও অভিভাবকরা বাড়িতে ফিরিয়ে নিচ্ছেন না। বছরের পর বছর বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় এসব সুস্থ রোগীরা আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অভিভাবকহীন এসব রোগী মৃত্যুবরণ করলেও তাদের মরদেহ বাড়ি থেকে কেউ নিতে আসেন না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই দাফন করতে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল এ্যাসিসটেন্ট ডা. নিখিল কুমার সাহা জানিয়েছেন, মানসিক সুস্থতার পর রোগীদের ফিরিয়ে না নেয়ায় তারা পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ওয়ার্ড ভিজিটে প্রতিদিনই এ রোগীদের মিথ্যা আশ্বাস দিতে আমরা বাধ্য হচ্ছি। সব রোগীর একই কথাÑ কবে তাদের বাড়িতে পাঠানো হবে। আমরা প্রতিদিনই রোগীদের মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছি দু’একদিনের মধ্যে তোমাদের বাড়িতে পাঠানো হবে। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। পাবনা মানসিক হাসপাতালের ডা. দীপক কুমার সাহা জানিয়েছেন, পেয়িং বেডের ২৫ রোগীর বকেয়া পাওনা সাড়ে ৩ লাখ টাকা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে মওকুফ করা হলেও অভিভাবকরা আজ পর্যন্ত তাদের নিতে আসেননি। এরপর এসব রোগীকে ননপেয়িং বেডে রাখা হয়েছে।
পাবনা মানসিক হাসপাতালে সাধারণ বেডে রোগী ভর্তিতে দালাল উচ্ছেদ হলেও প্রতিদিন নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। সিট অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫শ’ বেডের পাবনা মানসিক হাসপাতালে ১শ’ ২০টি বেড হচ্ছে পেয়িং, ৩শ’ ৮০টি হচ্ছে ননপেয়িং। ননপেয়িং বেডের মধ্যে ১৫% বেড ক্রনিক রোগীরা দীর্ঘদিন দখল করে রাখায় ননপেয়িং সিটের সংখ্যা ৩২৩টি। দেশের একমাত্র মানসিক হাসপাতালে ননপেয়িং সিটের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। অন্যদিকে মানসিক চিকিৎসা দীর্ঘ সময়ের কারণে অধিকাংশ অভিভাবকই পেয়িং বেডে চিকিৎসা খরচ বহন করতে নিরুৎসাহ বোধ করেন। তাই পেয়িং বেডের ১শ’ ২০ সিটের মধ্যে গড়ে ৮০ সিটের বেশি রোগী ভর্তি হয় না। ৪০টি পেয়িং সিট সবসময়ই খালি থাকে। তাই ননপেয়িং বেডে রোগী ভর্তিতে প্রতিদিনই দীর্ঘ লাইনে থাকতে হচ্ছে। সারাদেশ থেকে আসা রোগীরা ননপেয়িং বেডে ভর্তি হতে ৪/৫ দিন শহরের হোটেলে থেকে প্রতিদিন হাসপাতালে হাজিরা দিতে হচ্ছে। মানসিক অসুস্থ রোগী নিয়ে শহরের হোটেলে ৪/৫ দিন অপেক্ষায় থাকার যন্ত্রণা শুধু ভুক্তভোগী অভিভাবকরাই বোঝেন। এসব রোগী আবার অনেক সময় দালালের খপ্পরে পড়ে মানসিক হাসপাতাল এলাকায় গঁজিয়ে ওঠা বেসরকারি ক্লিনিকে গিয়ে প্রতারিত হন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক দীপক কুমার ঘোষ জানিয়েছেন, পেয়িং বেডের ৪০টিতে যদি ননপেয়িং করা হতো তাহলে রোগীদের ভর্তি বিড়ম্বনা অনেকাংশেই লাঘব হতো। ৪০ বেডকে ননপেয়িং করার পাশাপাশি এ বেডের খাবারসহ এস্টাবলিস্ট খরচ দেয়া হলে রোগীরা উপকৃত হতো বলেও তিনি জানান।
দেশের ব্যতিক্রমী এ হাসপাতালটির রোগীপ্রতি খাবার বরাদ্দও অপ্রতুল। সরকারী অন্যান্য হাসপাতালের ন্যায় হাসপাতালটিতে প্রতিদিনের ৩ বেলা রোগিপ্রতি বরাদ্দ হচ্ছে ৭৫ টাকা। অন্যান্য হাসপাতালের রোগীরা বাড়ি বা আত্মীয়স্বজনদের আনা খাবার খেলেও পাবনা মানসিক হাসপাতালে সে সুযোগ নেই। সকালে নাস্তা ও দুপুরের ভাত ও রাতের খাবার সূর্যাস্তের আগেই দিতে হয়। রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে আবার একটা নাস্তা দিতে হয়। ৪ বেলা খাবার বাবদ ৭৫ টাকা ব্যয় বরাদ্দ অত্যন্ত অপ্রতুল। খাবার টাকারও বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।
পাবনা মানসিক হাসপাতালটি একটি বিশেষ ধরনের হাসপাতাল। এখানে রোগীদের দৈহিক ও মানসিক উভয় দিকের চিকিৎসা হবার কথা। তাই এখানের চিকিৎসা একটি দলগত কার্যক্রমের আওতায় পড়ে। এখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার, নার্সের প্রয়োজন অপরিহার্য। মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের সাইকোথেরাপি, রেডিও থেরাপি, আকুপেশনাল ও রিক্রিয়েশনাল থেরাপি অপরিহার্য।
মানসিক রোগীদের চিত্তবিনোদন চিকিৎসারই একটি অংশ হলেও এখানে নানা সীমাবদ্ধতায় তা পিছিয়ে পড়েছে। ইনডোরে রোগীদের ক্যারাম, তাস, দাবা খেলার সুযোগ থাকলেও আউটডোরে তাদের চিত্তবিনোদনের কোন সুযোগ নেই। প্রতি সপ্তাহে অসুস্থ রোগীদের হাসপাতালের বাইরে নিয়ে গিয়ে বিনোদনমূলক ভ্রমণের জন্য ১৯৮৭ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থা ৮২ সিটের একটি বাস দিলেও সে বাসটি আজও হাসপাতালে আসেনি। মেন্টাল হেল্থ ইনস্টিটিউট ঢাকার কর্মচারীরা দীর্ঘকাল ধরে এ বাসটি ব্যবহার করলেও যেন কারও মাথাব্যথা নেই। এছাড়াও মানসিক রোগীদের চিত্তবিনোদনের জন্য সরকারী ব্যয় বরাদ্দও নেই।
ডাক্তার ও স্টাফদের স্বল্পতায় পাবনা মানসিক হাসপাতালে দলগত চিকিৎসা কার্যক্রম থেকে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। এখানে মঞ্জুরিকৃত ৩৭টি পদের মধ্যে ২০টি পদই শূন্য রয়েছে। হাসপাতালটিতে ২ জন সিনিয়র কনসালটেন্টের পদে ১ জনও নেই। ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিস্টের ১টি পদ থাকলেও তা শূন্য। আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারের ১টি পদ থাকলেও তা পূরণ হয়নি। ক্লিনিক্যাল এ্যাসিসটেন্টের ৯টি পদের ৪টি শূন্য, মেডিক্যাল অফিসারের ২টি পদ শূন্য। ৩টি সহকারী রেজিস্ট্র্রারের পদ, এমএলপিপি’র ১টি, ডেন্টাল সার্জনের ১টি, আবাসিক সাইকিয়াট্রিস্ট ১টি, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজির ১টি, সাইকিয়াট্রিক সোস্যাল ওয়ার্কার ৩টি, বায়োকেমিস্ট্রি ১টি, সেবা তত্ত্বাবধায়ক ১টি, স্টাফ নার্স ২০টি, ১০টি সহকারী নার্সের পদ শূন্য রয়েছে।
দীর্ঘকাল ধরে পদ শূন্য থাকলেও ৮ জন স্টাফ প্রেষণে অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করায় চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহিনুর নাহার ময়মনসিংহ থেকে ২০০২ সালে পাবনা মানসিক হাসপতালে যোগদানের পর থেকেই প্রেষণে নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে চাকরি করছেন। নার্সিং সুপারভাইজার গীতা রানী রায়, সিনিয়র স্টাফ নার্স মিনতি রানী নাথ, দিলারা পারভীন, হ্যাপী বাড়ৈ, দিপালী বৈরাগী, আল্পনা বিশ্বাস, নার্গিস সুলতানা দীর্ঘকাল ধরে প্রেষণে অন্যত্র চাকরি করছেন। প্রেষণ বাতিলে বার বার উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠানো হলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
পাবনা মানসিক হাসপাতালটি ১৯৫৭ সালে ভাড়া বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ হোসেনের উদ্যোগে হাসপাতালটি এরপর শীতলাই জমিদার বাড়িতে (এডরুক লিঃ) সম্প্রসারণ করা হয়। ১৯৫৯ সালে দেশের একমাত্র মনোরোগ হাসপাতালটি ২শ’ শয্যায় এবং ১৯৬৬ সালে ৪শ’ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এ সময় ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের জায়গা অধিগ্রহণ করে বিশাল ইমারত নির্মাণ করা হয়। দেশের একমাত্র হাসপাতালটিতে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি বা উন্নয়নে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত কোন সরকারই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৫শ’ করে লোকবল নিয়োগ দেয়। পাবনা মানসিক হাসপাতালটি ১শ’ ১১ দশমিক ২৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে ১৩টি ভবন থাকলেও দীর্ঘকালেও তা সংস্কার হয়নি। মানসিক হাসপাতালের পরিচালকের পদটি যুগ্ম সচিব হলেও তার ব্যবহারের জন্য ভাল গাড়িও নেই।
কৃষ্ণ ভৌমিক, পাবনা

No comments

Powered by Blogger.