বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে ঢাকা-জলবায়ু উদ্বাস্তুরা নগরমুখী by আহমেদ রিয়াদ
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সময়-অসময়ে উপকূলীয় এলাকায় ক্রমাগত ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙ্গন, খরা, বন্যার ফলে কৃষি উৎপাদন কমে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। এই কর্মহীন লোকজন কাজের সন্ধানে ছুটে আসছে ঢাকায়। এর ফলে জনসংখ্যার ভারে ঢাকা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে।
নগরীতে নাগরিক সুবিধা ক্রমে সঙ্কুচিত হয়ে পড়লেও তা ঠেকাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিশেষ কোন পরিকল্পনা নেই। সপ্তাহ আগে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নিয়ে কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ঢাকামুখী জনস্রোত রোধ করার জন্য পৃথক কোন পরিকল্পনা নেয়নি কোন সরকার। বর্তমানে সরকারের গৃহীত ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নগরায়ন সমস্যাকে প্রাধান্যপ্রাপ্ত ১০ খাতের একটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে তিনি জানান। প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি বলেন, জনসংখ্যার বাড়তি চাপের কারণে বিভিন্ন নাগরিক সমস্যা ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত হচ্ছে।
এদিকে ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে এক বেসরকারী সংস্থার বলছে, ২০১৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৩ ভাগ বাস করবে ঢাকায়, যা বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বেশি। কর্মসংস্থানের জন্য সবাই ঢাকায় ছুটে এলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বিমোচন হয় না এবং শহরে দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে তেমন সহায়ক হয় না। বর্তমানে রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি বলে দেখানো হয়, যা বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠা মেগাসিটিগুলোর অন্যতম। নগর বিশেষজ্ঞরা ঢাকার এমন পরিস্থিতি নিয়ে বেশ শঙ্কিত। তারা বলছেন, দেশের অপরিকল্পিত নগরায়নে দিনে দিনে মাঠপর্যায়ে প্রান্তিক মানুষের কাজের সুযোগ কমছে। এ অবস্থায় সহায়-সম্বলহীন মানুষ গ্রাম থেকে প্রথমে স্থানীয় শহর পরে রাজধানী অভিমুখী হচ্ছে। এভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাবে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে গ্রামের মানুষ শহরমুখী হওয়ার যাত্রা বাড়তে থাকলে আগামী দুই দশকে গ্রাম থেকে শহর অভিমুখী মানুষের এ সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়বে বলে ধারণা করছেন তারা। কিন্তু সেই অনুপাতে নগরের আয়তনের বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে ঢাকা। গ্রামের মানুষ জীবিকার তাগিদে শহরমুখী হচ্ছে বেশি। ধারণা করা হচ্ছে দেশের মোট নগর জনসংখ্যার ৪০ ভাগই ঢাকায়। দেশের উৎপাদন ও শ্রমসংস্থানগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় এমনটি হচ্ছে বলে মত দিয়েছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, সরকারের উচিত উৎপাদন ও শ্রমসংস্থান ক্ষেত্রগুলোকে রাজধানী ঢাকা থেকে পরিকল্পিতভাবে স্থানান্তরিত করা। বিশেষজ্ঞরা এও বলছেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৩ ভাগের এক ভাগ নগরবাসী। অর্থাৎ শতকরা ২৮ ভাগ মানুষ নগরে বাস করে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি নগরায়ন হয়েছে পাকিস্তানে। পাকিস্তানে প্রায় ৩৮ ভাগ মানুষ নগরে বাস করে। উন্নত বিশ্বে এই হার ৫০ শতাংশের ওপরে। জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বাংলাদেশেও নগরায়ন ৫০ ভাগের ওপরে নিতে হবে। যে শহরের জনসংখ্যা ১ কোটি তাকে মেগাসিটি হিসেবে ধরা হয়। ২০০১ সাল থেকে সরকারীভাবে ঢাকাকে মেগাসিটি হিসেবে গণ্য করা হয়। যদিও জাতিসংঘ ১৯৮৬ সালে বিশেষ পরিসংখ্যানের মাধ্যমে ঢাকাকে মেগাসিটি ঘোষণা করে। বর্তমানে ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশে নগরায়ন খুবই ধীরগতির। নগরের সুবিধা নিয়ে বাস করে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক কম। যেখানে সারা পৃথিবী নগরায়নে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে দক্ষিণ এশিয়া পেছনে পড়ে গেছে। বাংলাদেশের অবস্থান আরও পেছনে। সব উপজেলা শহরকে নগর ধরে হিসাব করেও অবস্থা এরকম। ঢাকা ও চট্টগামের পর বিভাগীয় শহর ও পুরনো জেলাগুলো বড় শহর। মাঝারি শহর হলো সাধারণ জেলা শহরগুলো। এর মধ্যে পুরনো জেলাগুলো একটু বড়। উপজেলা শহরগুলো ছোট শহর। ৮০ হাজার গ্রামের মানুষ কোথা থেকে নাগরিক সেবা নেয় তা গবেষণা করা দরকার। নগরায়নের উদ্দেশ্য উন্নততর সেবা দেয়া। এটি দিতে হবে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সব ক্ষেত্রেই। এখন নগর ও গ্রামের সংস্কৃতি প্রায় একই রকম ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ঢাকা শহর এমন শহরে পরিণত হয়েছে, যেখানে সিস্টেম অনুসারে ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা হচ্ছে। ঢাকা আজ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। নদীকে কেন্দ্র করে নগর গড়ে উঠলেও আজ সেই নদীকে অবহেলা করা হচ্ছে। বুড়িগঙ্গাকে পরিকল্পনার আওতায় আনা হচ্ছে না।
দেশে নগর জনসংখ্যার চিত্র ॥ দেশের মোট ‘নগর জনসংখ্যা’র ৪০ ভাগই বাস করে ঢাকায়। আর রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে মোট নগর জনসংখ্যার ৬৫ ভাগ মানুষ বাস করে। নানান নাগরিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ধরনের সমস্যারও কমতি নেই। অপরদিকে নগরায়ন বা নগরায়নের সুবিধা না বাড়লেও নগরে জনসংখ্যা বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে চার কোটিরও বেশি মানুষ নগরবাসী। বলা যায়, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশিসংখ্যক মানুষ বাংলাদেশে নগরবাসী। আগামী ৪০ বছরে ঢাকায় জনসংখ্যা হবে ৩ কোটিরও বেশি। অথচ সেই অনুপাতে সুবিধা বা অবকাঠামো নেই। নগরায়নের উদ্দেশ্য উন্নততর সেবা দেয়া। আর এমন সেবা দিতে হবে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সব ক্ষেত্রেই। কিন্তু বাস্তবে এ সেবার অভাবে এখন নগর ও গ্রামের সংস্কৃতির প্রায় একই রকম চিত্র। নগর উন্নয়নের সেবা উন্নয়নে করা হলো উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। দুই সিটি কর্পোরেশন মিলে একটি ঢাকা।
বেসরকারী এক নগর গবেষণা সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের প্রায় ৫ হাজারের ওপরে বস্তিতে মোট নগর জনসংখ্যার ১৭.৬ শতাংশ লোক বসবাস করে। অর্থাৎ নগর জনসংখ্যা প্রায় ৩.৪ মিলিয়ন লোক বস্তিতে বসবাস করে। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ১৯৭১ সাল থেকে ঢাকা শহরে বস্তির সংখ্যা উদ্বেগজনকহারে বাড়তে থাকে। নগর গবেষণা কেন্দ্রের ১৯৭৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, তখন নগর জনসংখ্যার ২,৭৫০০০ লাখ মানুষ বস্তিতে বসবাস করত। ১৯৯১ সালে নগর জনসংখ্যার ৭,১৮,১৪৩ জন বস্তিতে বসবাস করত। ১৯৯৬ সালে ১.৫ মিলিয়ন এবং ২০০৫ সালে ৩.৪ মিলিয়ন বসস্তিতে বসবাস করত। ২০১০ সালে ১৭.৬ মিলিয়ন যার ৬০% বস্তিতে। ২০২০ সালের মধ্যে নগর জনসংখ্যার বর্তমান বস্তিবাসীর তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়ে বস্তিবাসীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৯ মিলিয়নে।
ইউএনএফপিএর সাম্প্রতিক তথ্যে জানা যায়, ২০৫০ সালে এদেশের জনসংখ্যা হবে প্রায় ৩৬ কোটি। তখন নগর জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে কত কোটিতে এটিই এখন প্রশ্নের বিষয়। আর তাই বিশেষজ্ঞরা দ্রুতই ঢাকাকে বাঁচাতে সেটি হোক সরকারীভাবে কিংবা পিপিপির মাধ্যমে ঢাকাকে আধুনিক স্যাটেলাইট শহর হিসেবে গড়ে তুলতে শীঘ্রই ঢাকার বাইরে স্যাটেলাইট শহর তৈরি করা। যাতে সেখানে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীকে সেখানে পুনর্বাসিত করা যায়। আর এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষকে।
নগরকেন্দ্রিক প্রকল্প বাস্তবায়নই হবে বড় চ্যালেঞ্জ ॥ পিকেএসএফ চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেছেন, আগামীতে নগর উন্নয়নের জন্য সরকারী প্রকল্পের টাকা পাওয়া নয়, বরং বাস্তবায়নই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, টাকা থাকলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় না। তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরের জন্য আর্থিক সামর্থ্য বড় ব্যাপার নয়, বরং সঠিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নই প্রধান সমস্যা।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া দেশের সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলের মানুষের অধিকার রয়েছে উন্নয়ন কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হওয়ার।’ আর এক্ষেত্রে ঢাকা শহরকে বসবাসের উপযোগী করতে নগর বিষয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
যে কারণে ঢাকা অপরিকল্পিত ॥ ঢাকায় এখন নানা সমস্যা। মূল কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ন। উত্তরা থেকে প্রেসক্লাব ৩৫ মিনিটের পথ আসতে লাগে তিনঘণ্টা। রাস্তায় নিয়ম নীতি ভঙ্গ করে পার্কিং ও যান চালানোয় এমন ঘটছে। কারণ প্রতিদিনই মানুষ ঢাকা আসছে। কিন্ত সুবিধা বাড়ছে না। এ ধরনের সমস্যা দিন দিন বাড়তে থাকবে। কিন্তু এই সমস্যা মোকাবেলার প্রথম অন্তরায় ঢাকামুখী জনস্রোত ঠেকানো, যা নিয়ে খোদ সরকার এখনও উদাসীন। বর্তমান চিত্রে দেখা যায়, সরকার সব প্রকল্প ও উন্নয়ন প্রজেক্ট ঢাকাকেন্দ্রিক। ফলে এখন সবকিছু ঢাকামুখী। এমন অবস্থা থেকে মুক্তির এক মাত্র উপায় যদি শিল্প কারখানা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ হয়। যা কিনা খুবই জরুরী ভিত্তিতে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘রাজনীতিকদের কারণে অপরিকল্পিতভাবে ঢাকা নগরী গড়ে উঠেছে। বলা যায় রাজনীতির কারণেই ঢাকা কেন্দ্রীভূত বা অতি কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশের রাজনীতি ঢাকামুখী। আগামীতে কী হবে তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে। এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশের উৎপাদন ও শ্রমসংস্থানগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় প্রতিদিন ২৪১ রুটে প্রায় ছয় লাখ লোক কাজের জন্য ঢাকায় প্রবেশ করে। কিন্তু সামান্য ফিরছে। কাজের আশায় অনেক মানুষের বেশিরভাগ থেকে যাচ্ছে। নগরীর বাইরে পরিকল্পিতভাবে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করলে এমন অবস্থা কমে আসত। পল্লী উন্নয়ন ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে ঢাকাকে রক্ষা করা যেতে পারে। দেশের ৭০ ভাগের বেশি মানুষ গ্রামে বাস করে। বাজেটে গ্রামকে কম গুরুত্ব দিয়ে মারাত্মক অপরাধ হয়েছে। কিন্ত নাগরিক সুবিধার দিক থেকে ঢাকার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। তাই বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। জেলা, থানা ও ইউনিয়নকে গুরুত্ব দিয়ে বাজেট করতে হবে। এদিকে বিশেষ প্রকল্পে নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম উন্নত হলেও জেলা শহরগুলো বঞ্চিত রয়ে গেছে। এই দুই শহরের বাইরে জেলা শহরগুলো যোগাযোগ, শিক্ষা বা স্থানীয় কোন সম্পদের কারণে বা অন্য কারণে নগর হিসেবে গড়ে উঠেছে, কিন্ত শিল্পায়ন হয়নি। ড. জিল্লুর বলেন, ‘আশার কথা ঢাকা ও চট্টগ্রামের পর গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী ও বগুড়ায় শিল্পায়ন হচ্ছে। আগামীতে ময়মনসিংহ ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী সব জেলাতেই শিল্পায়ন হবে। এ ধারায় সব বিভাগকেই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘জমি ব্যবহারে এখনও সরকার অপরিকল্পিতভাবে কাজ করছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বা প্রকৌশল শিক্ষা ব্যবস্থায় জমির ব্যবহার নিয়ে কোন শিক্ষা দেয়া হয় না। আমরা এখনও গ্রাম্য ধারণা নিয়ে চলছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে সহজ সড়ক যোগাযোগের কারণে অর্থনেতিক অবস্থা পরিবর্তিত হবে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজ অঞ্চলেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সবাইকে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কথা ভাবতে হবে।’
এদিকে ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে এক বেসরকারী সংস্থার বলছে, ২০১৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৩ ভাগ বাস করবে ঢাকায়, যা বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বেশি। কর্মসংস্থানের জন্য সবাই ঢাকায় ছুটে এলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বিমোচন হয় না এবং শহরে দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে তেমন সহায়ক হয় না। বর্তমানে রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি বলে দেখানো হয়, যা বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠা মেগাসিটিগুলোর অন্যতম। নগর বিশেষজ্ঞরা ঢাকার এমন পরিস্থিতি নিয়ে বেশ শঙ্কিত। তারা বলছেন, দেশের অপরিকল্পিত নগরায়নে দিনে দিনে মাঠপর্যায়ে প্রান্তিক মানুষের কাজের সুযোগ কমছে। এ অবস্থায় সহায়-সম্বলহীন মানুষ গ্রাম থেকে প্রথমে স্থানীয় শহর পরে রাজধানী অভিমুখী হচ্ছে। এভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাবে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে গ্রামের মানুষ শহরমুখী হওয়ার যাত্রা বাড়তে থাকলে আগামী দুই দশকে গ্রাম থেকে শহর অভিমুখী মানুষের এ সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়বে বলে ধারণা করছেন তারা। কিন্তু সেই অনুপাতে নগরের আয়তনের বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে ঢাকা। গ্রামের মানুষ জীবিকার তাগিদে শহরমুখী হচ্ছে বেশি। ধারণা করা হচ্ছে দেশের মোট নগর জনসংখ্যার ৪০ ভাগই ঢাকায়। দেশের উৎপাদন ও শ্রমসংস্থানগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় এমনটি হচ্ছে বলে মত দিয়েছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, সরকারের উচিত উৎপাদন ও শ্রমসংস্থান ক্ষেত্রগুলোকে রাজধানী ঢাকা থেকে পরিকল্পিতভাবে স্থানান্তরিত করা। বিশেষজ্ঞরা এও বলছেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৩ ভাগের এক ভাগ নগরবাসী। অর্থাৎ শতকরা ২৮ ভাগ মানুষ নগরে বাস করে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি নগরায়ন হয়েছে পাকিস্তানে। পাকিস্তানে প্রায় ৩৮ ভাগ মানুষ নগরে বাস করে। উন্নত বিশ্বে এই হার ৫০ শতাংশের ওপরে। জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বাংলাদেশেও নগরায়ন ৫০ ভাগের ওপরে নিতে হবে। যে শহরের জনসংখ্যা ১ কোটি তাকে মেগাসিটি হিসেবে ধরা হয়। ২০০১ সাল থেকে সরকারীভাবে ঢাকাকে মেগাসিটি হিসেবে গণ্য করা হয়। যদিও জাতিসংঘ ১৯৮৬ সালে বিশেষ পরিসংখ্যানের মাধ্যমে ঢাকাকে মেগাসিটি ঘোষণা করে। বর্তমানে ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশে নগরায়ন খুবই ধীরগতির। নগরের সুবিধা নিয়ে বাস করে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক কম। যেখানে সারা পৃথিবী নগরায়নে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে দক্ষিণ এশিয়া পেছনে পড়ে গেছে। বাংলাদেশের অবস্থান আরও পেছনে। সব উপজেলা শহরকে নগর ধরে হিসাব করেও অবস্থা এরকম। ঢাকা ও চট্টগামের পর বিভাগীয় শহর ও পুরনো জেলাগুলো বড় শহর। মাঝারি শহর হলো সাধারণ জেলা শহরগুলো। এর মধ্যে পুরনো জেলাগুলো একটু বড়। উপজেলা শহরগুলো ছোট শহর। ৮০ হাজার গ্রামের মানুষ কোথা থেকে নাগরিক সেবা নেয় তা গবেষণা করা দরকার। নগরায়নের উদ্দেশ্য উন্নততর সেবা দেয়া। এটি দিতে হবে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সব ক্ষেত্রেই। এখন নগর ও গ্রামের সংস্কৃতি প্রায় একই রকম ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ঢাকা শহর এমন শহরে পরিণত হয়েছে, যেখানে সিস্টেম অনুসারে ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা হচ্ছে। ঢাকা আজ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। নদীকে কেন্দ্র করে নগর গড়ে উঠলেও আজ সেই নদীকে অবহেলা করা হচ্ছে। বুড়িগঙ্গাকে পরিকল্পনার আওতায় আনা হচ্ছে না।
দেশে নগর জনসংখ্যার চিত্র ॥ দেশের মোট ‘নগর জনসংখ্যা’র ৪০ ভাগই বাস করে ঢাকায়। আর রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে মোট নগর জনসংখ্যার ৬৫ ভাগ মানুষ বাস করে। নানান নাগরিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ধরনের সমস্যারও কমতি নেই। অপরদিকে নগরায়ন বা নগরায়নের সুবিধা না বাড়লেও নগরে জনসংখ্যা বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে চার কোটিরও বেশি মানুষ নগরবাসী। বলা যায়, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশিসংখ্যক মানুষ বাংলাদেশে নগরবাসী। আগামী ৪০ বছরে ঢাকায় জনসংখ্যা হবে ৩ কোটিরও বেশি। অথচ সেই অনুপাতে সুবিধা বা অবকাঠামো নেই। নগরায়নের উদ্দেশ্য উন্নততর সেবা দেয়া। আর এমন সেবা দিতে হবে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সব ক্ষেত্রেই। কিন্তু বাস্তবে এ সেবার অভাবে এখন নগর ও গ্রামের সংস্কৃতির প্রায় একই রকম চিত্র। নগর উন্নয়নের সেবা উন্নয়নে করা হলো উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। দুই সিটি কর্পোরেশন মিলে একটি ঢাকা।
বেসরকারী এক নগর গবেষণা সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের প্রায় ৫ হাজারের ওপরে বস্তিতে মোট নগর জনসংখ্যার ১৭.৬ শতাংশ লোক বসবাস করে। অর্থাৎ নগর জনসংখ্যা প্রায় ৩.৪ মিলিয়ন লোক বস্তিতে বসবাস করে। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ১৯৭১ সাল থেকে ঢাকা শহরে বস্তির সংখ্যা উদ্বেগজনকহারে বাড়তে থাকে। নগর গবেষণা কেন্দ্রের ১৯৭৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, তখন নগর জনসংখ্যার ২,৭৫০০০ লাখ মানুষ বস্তিতে বসবাস করত। ১৯৯১ সালে নগর জনসংখ্যার ৭,১৮,১৪৩ জন বস্তিতে বসবাস করত। ১৯৯৬ সালে ১.৫ মিলিয়ন এবং ২০০৫ সালে ৩.৪ মিলিয়ন বসস্তিতে বসবাস করত। ২০১০ সালে ১৭.৬ মিলিয়ন যার ৬০% বস্তিতে। ২০২০ সালের মধ্যে নগর জনসংখ্যার বর্তমান বস্তিবাসীর তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়ে বস্তিবাসীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৯ মিলিয়নে।
ইউএনএফপিএর সাম্প্রতিক তথ্যে জানা যায়, ২০৫০ সালে এদেশের জনসংখ্যা হবে প্রায় ৩৬ কোটি। তখন নগর জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে কত কোটিতে এটিই এখন প্রশ্নের বিষয়। আর তাই বিশেষজ্ঞরা দ্রুতই ঢাকাকে বাঁচাতে সেটি হোক সরকারীভাবে কিংবা পিপিপির মাধ্যমে ঢাকাকে আধুনিক স্যাটেলাইট শহর হিসেবে গড়ে তুলতে শীঘ্রই ঢাকার বাইরে স্যাটেলাইট শহর তৈরি করা। যাতে সেখানে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীকে সেখানে পুনর্বাসিত করা যায়। আর এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষকে।
নগরকেন্দ্রিক প্রকল্প বাস্তবায়নই হবে বড় চ্যালেঞ্জ ॥ পিকেএসএফ চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেছেন, আগামীতে নগর উন্নয়নের জন্য সরকারী প্রকল্পের টাকা পাওয়া নয়, বরং বাস্তবায়নই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, টাকা থাকলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় না। তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরের জন্য আর্থিক সামর্থ্য বড় ব্যাপার নয়, বরং সঠিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নই প্রধান সমস্যা।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া দেশের সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলের মানুষের অধিকার রয়েছে উন্নয়ন কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হওয়ার।’ আর এক্ষেত্রে ঢাকা শহরকে বসবাসের উপযোগী করতে নগর বিষয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
যে কারণে ঢাকা অপরিকল্পিত ॥ ঢাকায় এখন নানা সমস্যা। মূল কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ন। উত্তরা থেকে প্রেসক্লাব ৩৫ মিনিটের পথ আসতে লাগে তিনঘণ্টা। রাস্তায় নিয়ম নীতি ভঙ্গ করে পার্কিং ও যান চালানোয় এমন ঘটছে। কারণ প্রতিদিনই মানুষ ঢাকা আসছে। কিন্ত সুবিধা বাড়ছে না। এ ধরনের সমস্যা দিন দিন বাড়তে থাকবে। কিন্তু এই সমস্যা মোকাবেলার প্রথম অন্তরায় ঢাকামুখী জনস্রোত ঠেকানো, যা নিয়ে খোদ সরকার এখনও উদাসীন। বর্তমান চিত্রে দেখা যায়, সরকার সব প্রকল্প ও উন্নয়ন প্রজেক্ট ঢাকাকেন্দ্রিক। ফলে এখন সবকিছু ঢাকামুখী। এমন অবস্থা থেকে মুক্তির এক মাত্র উপায় যদি শিল্প কারখানা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ হয়। যা কিনা খুবই জরুরী ভিত্তিতে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘রাজনীতিকদের কারণে অপরিকল্পিতভাবে ঢাকা নগরী গড়ে উঠেছে। বলা যায় রাজনীতির কারণেই ঢাকা কেন্দ্রীভূত বা অতি কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশের রাজনীতি ঢাকামুখী। আগামীতে কী হবে তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে। এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশের উৎপাদন ও শ্রমসংস্থানগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় প্রতিদিন ২৪১ রুটে প্রায় ছয় লাখ লোক কাজের জন্য ঢাকায় প্রবেশ করে। কিন্তু সামান্য ফিরছে। কাজের আশায় অনেক মানুষের বেশিরভাগ থেকে যাচ্ছে। নগরীর বাইরে পরিকল্পিতভাবে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করলে এমন অবস্থা কমে আসত। পল্লী উন্নয়ন ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে ঢাকাকে রক্ষা করা যেতে পারে। দেশের ৭০ ভাগের বেশি মানুষ গ্রামে বাস করে। বাজেটে গ্রামকে কম গুরুত্ব দিয়ে মারাত্মক অপরাধ হয়েছে। কিন্ত নাগরিক সুবিধার দিক থেকে ঢাকার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। তাই বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। জেলা, থানা ও ইউনিয়নকে গুরুত্ব দিয়ে বাজেট করতে হবে। এদিকে বিশেষ প্রকল্পে নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম উন্নত হলেও জেলা শহরগুলো বঞ্চিত রয়ে গেছে। এই দুই শহরের বাইরে জেলা শহরগুলো যোগাযোগ, শিক্ষা বা স্থানীয় কোন সম্পদের কারণে বা অন্য কারণে নগর হিসেবে গড়ে উঠেছে, কিন্ত শিল্পায়ন হয়নি। ড. জিল্লুর বলেন, ‘আশার কথা ঢাকা ও চট্টগ্রামের পর গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী ও বগুড়ায় শিল্পায়ন হচ্ছে। আগামীতে ময়মনসিংহ ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী সব জেলাতেই শিল্পায়ন হবে। এ ধারায় সব বিভাগকেই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘জমি ব্যবহারে এখনও সরকার অপরিকল্পিতভাবে কাজ করছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বা প্রকৌশল শিক্ষা ব্যবস্থায় জমির ব্যবহার নিয়ে কোন শিক্ষা দেয়া হয় না। আমরা এখনও গ্রাম্য ধারণা নিয়ে চলছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে সহজ সড়ক যোগাযোগের কারণে অর্থনেতিক অবস্থা পরিবর্তিত হবে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজ অঞ্চলেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সবাইকে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কথা ভাবতে হবে।’
No comments