কালের পুরাণ-বিএনপির ক্ষমতার খোয়াব ও গলার কাঁটা by সোহরাব হাসান
২০০৬ সালের অক্টোবরের পর প্রায় ছয় বছর বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকলেও ক্ষমতার ক্লেদ ও ক্লান্তি তাদের পিছু ছাড়ছে না। বিভিন্ন মত ও পথের অনুসারীদের নিয়ে গড়ে ওঠা এই দলটি আদর্শিক ও সাংগঠনিকভাবে বরাবরই দুর্বল ছিল। প্রতিটি বিপর্যয়ের পর বিএনপি ঘুরে দাঁড়িয়েছে নেতা নয়, কর্মীদের শক্তিতে।
কিন্তু এবার বিএনপি যে নতুন প্রজন্মের কর্মীদের দলে টানতে পারেনি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রদলের নাজুক অবস্থাই তার প্রমাণ। বিএনপিতে এখন কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি এবং সেই নেতাদের অধিকাংশ দৃশ্যমান নেতৃত্বের চেয়ে অদৃশ্যমান নেতৃত্বের প্রতি ভক্তি ও আনুগত্যের প্রতিযোগিতা প্রদর্শন করে চলেছেন। দলের যেকোনো জনসভায় এখন জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার চেয়ে তারেক রহমানের পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানার বেশি দেখা যায়। এটি দলের মর্যাদাপূর্ণ নেতাদের কাছে উৎকট ও অসুন্দর মনে হলেও পদ হারানোর ভয়ে তাঁরা কিছু বলতে পারছেন না।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২০০৯ সালে বিএনপির কাউন্সিল হলেও একজন যোগ্য মহাসচিব নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ‘ভারপ্রাপ্তের’ বোঝা বইতে হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে আবদুল মান্নান ভুঁইয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করার পর স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মহাসচিবের দায়িত্ব নেন। বিগত কাউন্সিলেও তিনি মহাসচিব হিসেবে বহাল থাকেন। কাউন্সিল সামনে রেখে খালেদা জিয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টির মতো নিজে দলের চেয়ারপারসন এবং তারেক রহমানকে কার্যকরী চেয়ারম্যান করার সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছিলেন। কিন্তু দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার আপত্তিতে সেটি সম্ভব হয়নি। তাঁরা খালেদা জিয়াকে এ-ও বলেছিলেন, এখানে পাকিস্তানি কৌশল কাজে লাগবে না। তাঁকে কার্যকরী চেয়ারম্যান করা হলে সারা দেশের নেতা-কর্মীদের কাছে এই বার্তা যাবে যে খালেদা জিয়া আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকছেন না। এরপর তারেক রহমানকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো, বিরোধী দলে থাকতে সংগঠন গোছানো হয়; সরকারি দলে গেলে সরকারের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করা যায়নি দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, সংশয় ও সন্দেহের কারণে। প্রত্যেকেই নিজের কোটারি স্বার্থ বজায় রাখতে সচেষ্ট। তাঁরা একে অপরকে বিশ্বাস করেন না, সন্দেহের চোখে দেখেন। এই সন্দেহের মাত্রাটি বেড়ে যায় সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায়। দলীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর ‘লন্ডন প্রত্যাদেশে’ বিএনপি কঠোর কর্মসূচি শুরু করেও যে তা ধরে রাখতে পারেনি, এর জন্য সরকারের দমন-পীড়ন যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী বিএনপির নেতাদের সুবিধাবাদ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে বাস পোড়ানো এবং সচিবালয়ে বোমা নিক্ষেপের দায়ে ৩৩ নেতাকে আসামি করা হয়। মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, মঈন খান, আবদুল্লাহ আল নোমানসহ বেশ কিছু নেতা বাইরে থাকেন। যাঁরা আসামি হয়েছেন, তাঁরা অন্যদের সন্দেহ করতে থাকেন। আবার যাঁরা আসামি হওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান, তাঁদের ওপর দলের নেতা-কর্মীরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। গত ১২ জুনের পর বিএনপি যে সরকারবিরোধী কঠোর কর্মসূচি থেকে বিরত থাকে, তা সরকারের প্রতি উদারতা থেকে নয়, নেতৃত্বের মধ্যকার সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কারণে। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের নাটকীয় উত্থান ও জনপ্রিয়তা অনেক নেতা ভালো চোখে দেখছেন না। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের বিরুদ্ধে কেউ কেউ লন্ডনে তারেক রহমানের কান ভারী করতেও দ্বিধা করেননি।
ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ দলের এতজন নেতা জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরও বড় ধরনের কর্মসূচি না নেওয়ায় কর্মীদের মধ্যে একধরনের হতাশা দেখা দিয়েছে। এমনকি পদ্মা সেতুর মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনায়ও বিএনপির নেতৃত্ব উপযুক্ত কর্মসূচি নিতে পারেনি বলেই মনে করেন তাঁরা। সাম্প্রতিক ঘটনায় সরকার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে সত্য, কিন্তু বিএনপি তার শূন্যস্থানটি পূরণ করতে পারেনি বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা। ১২ জুনের জনসভায় ছাত্রদলের সঙ্গে শিবিরকর্মীদের মারামারির ঘটনা প্রমাণ করে যে বিএনপির ঘাড়ে বন্দুক রেখে জামায়াতে ইসলামী যেমন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়, তেমনি প্রয়োজনে বিএনপিকে দেখে নিতেও দ্বিধা করবে না। নেতৃত্ব যা-ই ভাবুক না কেন, বিএনপির সাধারণ কর্মীরা জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলনকে আত্মঘাতী বলে মনে করেন। জামায়াতের মূল লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো। সেই আন্দোলনে কেন তাঁরা মাঠে থাকবেন?
বর্তমানে বিএনপির আন্দোলন মূলত ঢাকায় গোলটেবিল বৈঠক এবং নয়াপল্টন ও প্রেসক্লাবের সামনে শ দেড়েক লোকের মানববন্ধনের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ছে। ঢাকার বাইরে খুব কম জেলায় কমিটি তৎপর। অধিকাংশ জেলায় কমিটির নেতৃত্ব দ্বিধা-ত্রিধাবিভক্ত। কোনো কোনো জেলায় কমিটি করাও সম্ভব হয়নি দলীয় কোন্দলের কারণে।
ক্ষমতাসীন দলে পদ-পদবি ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধের ঘটনা সব সময়ই লক্ষ করা যায়। কিন্তু বিরোধী দলে থেকেও বিএনপি এই দ্বন্দ্ব-বিরোধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ভারতবিরোধিতা এবং আওয়ামী লীগের ব্যর্থতাই বিএনপির রাজনীতির বড় পুঁজি। কিন্তু জনজীবনের সমস্যা-সংকট নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। গত সাড়ে তিন বছরে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি সংসদের ভেতরে ও বাইরে ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির সংসদ সদস্যরা সংসদে গরহাজির থাকলেও বেতন-ভাতা ও শুল্কমুক্ত গাড়ি ঠিকই নিয়েছেন।
ঢাকা মহানগরে শুরু থেকে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত শক্ত ছিল। সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ছিলেন বিএনপির মহানগর সভাপতি। এক-এগারোর বিপর্যয় তাঁর ওপরও আঘাত হেনেছে। তিনি যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘মেয়রগিরি’ করেছেন এবং গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হয়েছেন, সে কারণে আরেক সাবেক মেয়র তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। জনসমাবেশে দুই সাবেক মেয়রের সমর্থকদের মধ্যে একাধিকবার মারামারি হয়েছে। শেষে আপসরফা হিসেবে খালেদা জিয়া খোকাকে মহানগরের আহ্বায়ক এবং মির্জা আব্বাসকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করে নগর রাজনীতি চাঙা করতে চাইলেও তা সফল হয়নি। দলের নেতৃত্বে এ ধরনের টানাপোড়েন আছে প্রায় সব জেলা ও নগরেই। সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা আছে বিএনপির অন্তত ৩৫টি জেলায়। ৮-১০টি জেলায় এখনো কমিটি গঠন সম্ভব হয়নি। তাই তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা হতাশ ও নিষ্ক্রিয়। সম্প্রতি কুমিল্লার মেয়র ও তাঁর বিরোধী গ্রুপের হাতাহাতির ঘটনা, চট্টগ্রামে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আবদুল্লাহ আল নোমানের সমর্থকদের মারামারির ঘটনা কেবল নেতৃত্বের কোন্দল নয়, দলের অনৈক্যের কথাও মনে করিয়ে দেয়। কয়েক দিন আগে সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলুকে সাংগঠনিক সম্পাদক করায় রংপুরে তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে।
বিএনপির নেতৃত্ব এখন স্পষ্টত দুই ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষ খালেদা জিয়াকেই দলের প্রধান শক্তি মনে করে। অন্য পক্ষের ধারণা, ঢাকা নয়, লন্ডন থেকেই দল পরিচালিত হবে। তারেক রহমানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, যা দলের অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ নেতার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। এ কারণে অনেকে নিষ্ক্রিয়ও রয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, ক্ষমতায় থাকতে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে এই সুবিধাভোগীরাই দলকে ডুবিয়েছেন। এখন খালেদা জিয়াকে ডোবাচ্ছেন। এই নেতারা হাওয়া ভবন কিংবা জঙ্গিবাদের সঙ্গে গাটছড়া বাঁধার অপবাদ মাথায় নিতে রাজি নন। নাজমুল হুদার দলত্যাগের পর অনেকেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। সুযোগ বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন।
দলের একাংশ এই মুহূর্তে তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার পক্ষপাতী হলেও অন্য পক্ষ মনে করে, দেশে ফিরে তিনি বিচারের মুখোমুখি হলে তা দলের ভাবমূর্তির জন্য ভালো হবে না। কেননা, তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত একটি মামলার প্রামাণিক দলিল আছে। এই গ্রুপটি আন্দোলনের মাধ্যমে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পরই তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী। বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলনের এটিও বড় কারণ। আওয়ামী লীগের পরিকল্পনামাফিক ‘অন্তর্বর্তী’ সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করা হলেও বিএনপি তা মানতে চাইবে না। কেননা, তাতে নির্বাচনের আগে তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে না।
ক্ষমতাসীন মহাজোটের বর্তমানে যে হাল, তাতে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখা অসম্ভব নয়। অতীতেও দলটি জনগণের ভোটেই ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু এক-এগারোর পর নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য পুরোনো ধর্ম ও ভারতবিরোধী কার্ড কতটা কার্যকর হবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সময় বদলেছে, কিন্তু বিএনপি বদলায়নি।
বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দলই যে এককভাবে ক্ষমতায় আসতে পারবে না, সে কথা বিএনপির নেতারা ভালো করেই জানেন। এ কারণেই তাঁরা জোটের আয়তন বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটিকে নিয়ে বিএনপি জোটসংখ্যায় বাড়লেও শক্তিতে বাড়বে না। বিএনপি মহা ঢাকঢোল পিটিয়ে যে ১৮ দলীয় জোট গঠন করল, তার ভবিষ্যৎ একেবারে ফরসা। এই জোট কোনো পর্যায়েই কোনো কমিটি গঠন করতে পারেনি। খালেদা জিয়া জোটের পরিধি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেও তা সম্ভব হচ্ছে না জামায়াতের কারণেই। দলটি এখন তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জামায়াতকে না ছাড়লে কোনো আধা গণতান্ত্রিক দলও বিএনপির জোটে আসবে না।
এই রাজনৈতিক বাস্তবতা বিএনপির নেতারা কত দিন অগ্রাহ্য করবেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২০০৯ সালে বিএনপির কাউন্সিল হলেও একজন যোগ্য মহাসচিব নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ‘ভারপ্রাপ্তের’ বোঝা বইতে হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে আবদুল মান্নান ভুঁইয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করার পর স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মহাসচিবের দায়িত্ব নেন। বিগত কাউন্সিলেও তিনি মহাসচিব হিসেবে বহাল থাকেন। কাউন্সিল সামনে রেখে খালেদা জিয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টির মতো নিজে দলের চেয়ারপারসন এবং তারেক রহমানকে কার্যকরী চেয়ারম্যান করার সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছিলেন। কিন্তু দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার আপত্তিতে সেটি সম্ভব হয়নি। তাঁরা খালেদা জিয়াকে এ-ও বলেছিলেন, এখানে পাকিস্তানি কৌশল কাজে লাগবে না। তাঁকে কার্যকরী চেয়ারম্যান করা হলে সারা দেশের নেতা-কর্মীদের কাছে এই বার্তা যাবে যে খালেদা জিয়া আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকছেন না। এরপর তারেক রহমানকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো, বিরোধী দলে থাকতে সংগঠন গোছানো হয়; সরকারি দলে গেলে সরকারের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করা যায়নি দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, সংশয় ও সন্দেহের কারণে। প্রত্যেকেই নিজের কোটারি স্বার্থ বজায় রাখতে সচেষ্ট। তাঁরা একে অপরকে বিশ্বাস করেন না, সন্দেহের চোখে দেখেন। এই সন্দেহের মাত্রাটি বেড়ে যায় সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায়। দলীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর ‘লন্ডন প্রত্যাদেশে’ বিএনপি কঠোর কর্মসূচি শুরু করেও যে তা ধরে রাখতে পারেনি, এর জন্য সরকারের দমন-পীড়ন যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী বিএনপির নেতাদের সুবিধাবাদ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে বাস পোড়ানো এবং সচিবালয়ে বোমা নিক্ষেপের দায়ে ৩৩ নেতাকে আসামি করা হয়। মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, মঈন খান, আবদুল্লাহ আল নোমানসহ বেশ কিছু নেতা বাইরে থাকেন। যাঁরা আসামি হয়েছেন, তাঁরা অন্যদের সন্দেহ করতে থাকেন। আবার যাঁরা আসামি হওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান, তাঁদের ওপর দলের নেতা-কর্মীরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। গত ১২ জুনের পর বিএনপি যে সরকারবিরোধী কঠোর কর্মসূচি থেকে বিরত থাকে, তা সরকারের প্রতি উদারতা থেকে নয়, নেতৃত্বের মধ্যকার সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কারণে। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের নাটকীয় উত্থান ও জনপ্রিয়তা অনেক নেতা ভালো চোখে দেখছেন না। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের বিরুদ্ধে কেউ কেউ লন্ডনে তারেক রহমানের কান ভারী করতেও দ্বিধা করেননি।
ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ দলের এতজন নেতা জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরও বড় ধরনের কর্মসূচি না নেওয়ায় কর্মীদের মধ্যে একধরনের হতাশা দেখা দিয়েছে। এমনকি পদ্মা সেতুর মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনায়ও বিএনপির নেতৃত্ব উপযুক্ত কর্মসূচি নিতে পারেনি বলেই মনে করেন তাঁরা। সাম্প্রতিক ঘটনায় সরকার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে সত্য, কিন্তু বিএনপি তার শূন্যস্থানটি পূরণ করতে পারেনি বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা। ১২ জুনের জনসভায় ছাত্রদলের সঙ্গে শিবিরকর্মীদের মারামারির ঘটনা প্রমাণ করে যে বিএনপির ঘাড়ে বন্দুক রেখে জামায়াতে ইসলামী যেমন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়, তেমনি প্রয়োজনে বিএনপিকে দেখে নিতেও দ্বিধা করবে না। নেতৃত্ব যা-ই ভাবুক না কেন, বিএনপির সাধারণ কর্মীরা জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলনকে আত্মঘাতী বলে মনে করেন। জামায়াতের মূল লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো। সেই আন্দোলনে কেন তাঁরা মাঠে থাকবেন?
বর্তমানে বিএনপির আন্দোলন মূলত ঢাকায় গোলটেবিল বৈঠক এবং নয়াপল্টন ও প্রেসক্লাবের সামনে শ দেড়েক লোকের মানববন্ধনের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ছে। ঢাকার বাইরে খুব কম জেলায় কমিটি তৎপর। অধিকাংশ জেলায় কমিটির নেতৃত্ব দ্বিধা-ত্রিধাবিভক্ত। কোনো কোনো জেলায় কমিটি করাও সম্ভব হয়নি দলীয় কোন্দলের কারণে।
ক্ষমতাসীন দলে পদ-পদবি ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধের ঘটনা সব সময়ই লক্ষ করা যায়। কিন্তু বিরোধী দলে থেকেও বিএনপি এই দ্বন্দ্ব-বিরোধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ভারতবিরোধিতা এবং আওয়ামী লীগের ব্যর্থতাই বিএনপির রাজনীতির বড় পুঁজি। কিন্তু জনজীবনের সমস্যা-সংকট নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। গত সাড়ে তিন বছরে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি সংসদের ভেতরে ও বাইরে ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির সংসদ সদস্যরা সংসদে গরহাজির থাকলেও বেতন-ভাতা ও শুল্কমুক্ত গাড়ি ঠিকই নিয়েছেন।
ঢাকা মহানগরে শুরু থেকে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত শক্ত ছিল। সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ছিলেন বিএনপির মহানগর সভাপতি। এক-এগারোর বিপর্যয় তাঁর ওপরও আঘাত হেনেছে। তিনি যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘মেয়রগিরি’ করেছেন এবং গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হয়েছেন, সে কারণে আরেক সাবেক মেয়র তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। জনসমাবেশে দুই সাবেক মেয়রের সমর্থকদের মধ্যে একাধিকবার মারামারি হয়েছে। শেষে আপসরফা হিসেবে খালেদা জিয়া খোকাকে মহানগরের আহ্বায়ক এবং মির্জা আব্বাসকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করে নগর রাজনীতি চাঙা করতে চাইলেও তা সফল হয়নি। দলের নেতৃত্বে এ ধরনের টানাপোড়েন আছে প্রায় সব জেলা ও নগরেই। সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা আছে বিএনপির অন্তত ৩৫টি জেলায়। ৮-১০টি জেলায় এখনো কমিটি গঠন সম্ভব হয়নি। তাই তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা হতাশ ও নিষ্ক্রিয়। সম্প্রতি কুমিল্লার মেয়র ও তাঁর বিরোধী গ্রুপের হাতাহাতির ঘটনা, চট্টগ্রামে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আবদুল্লাহ আল নোমানের সমর্থকদের মারামারির ঘটনা কেবল নেতৃত্বের কোন্দল নয়, দলের অনৈক্যের কথাও মনে করিয়ে দেয়। কয়েক দিন আগে সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলুকে সাংগঠনিক সম্পাদক করায় রংপুরে তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে।
বিএনপির নেতৃত্ব এখন স্পষ্টত দুই ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষ খালেদা জিয়াকেই দলের প্রধান শক্তি মনে করে। অন্য পক্ষের ধারণা, ঢাকা নয়, লন্ডন থেকেই দল পরিচালিত হবে। তারেক রহমানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, যা দলের অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ নেতার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। এ কারণে অনেকে নিষ্ক্রিয়ও রয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, ক্ষমতায় থাকতে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে এই সুবিধাভোগীরাই দলকে ডুবিয়েছেন। এখন খালেদা জিয়াকে ডোবাচ্ছেন। এই নেতারা হাওয়া ভবন কিংবা জঙ্গিবাদের সঙ্গে গাটছড়া বাঁধার অপবাদ মাথায় নিতে রাজি নন। নাজমুল হুদার দলত্যাগের পর অনেকেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। সুযোগ বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন।
দলের একাংশ এই মুহূর্তে তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার পক্ষপাতী হলেও অন্য পক্ষ মনে করে, দেশে ফিরে তিনি বিচারের মুখোমুখি হলে তা দলের ভাবমূর্তির জন্য ভালো হবে না। কেননা, তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত একটি মামলার প্রামাণিক দলিল আছে। এই গ্রুপটি আন্দোলনের মাধ্যমে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পরই তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী। বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলনের এটিও বড় কারণ। আওয়ামী লীগের পরিকল্পনামাফিক ‘অন্তর্বর্তী’ সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করা হলেও বিএনপি তা মানতে চাইবে না। কেননা, তাতে নির্বাচনের আগে তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে না।
ক্ষমতাসীন মহাজোটের বর্তমানে যে হাল, তাতে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখা অসম্ভব নয়। অতীতেও দলটি জনগণের ভোটেই ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু এক-এগারোর পর নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য পুরোনো ধর্ম ও ভারতবিরোধী কার্ড কতটা কার্যকর হবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সময় বদলেছে, কিন্তু বিএনপি বদলায়নি।
বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দলই যে এককভাবে ক্ষমতায় আসতে পারবে না, সে কথা বিএনপির নেতারা ভালো করেই জানেন। এ কারণেই তাঁরা জোটের আয়তন বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটিকে নিয়ে বিএনপি জোটসংখ্যায় বাড়লেও শক্তিতে বাড়বে না। বিএনপি মহা ঢাকঢোল পিটিয়ে যে ১৮ দলীয় জোট গঠন করল, তার ভবিষ্যৎ একেবারে ফরসা। এই জোট কোনো পর্যায়েই কোনো কমিটি গঠন করতে পারেনি। খালেদা জিয়া জোটের পরিধি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেও তা সম্ভব হচ্ছে না জামায়াতের কারণেই। দলটি এখন তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জামায়াতকে না ছাড়লে কোনো আধা গণতান্ত্রিক দলও বিএনপির জোটে আসবে না।
এই রাজনৈতিক বাস্তবতা বিএনপির নেতারা কত দিন অগ্রাহ্য করবেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments