দেশীয় অর্থে পদ্মা সেতুর দায় নিয়ে ভাবনা কম by শওকত হোসেন

পদ্মা সেতু তৈরি করতে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে। তবে এর প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই ব্যয় হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। ফলে পুরোপুরি দেশের অর্থে পদ্মা সেতু করলে অর্থনীতির ওপর দায় বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।


আবার দেশে সাধারণ মানুষের একটি অংশের মধ্যে সাহায্যনির্ভর না থেকে নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করার পক্ষে সমর্থন বাড়ছে। সরকারও এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অনেকেই সহায়তা দেওয়ার কথা বলছেন। আবার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো পদ্মা সেতু নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে দুর্নীতির বিষয়টিও হারিয়ে যাচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ছাড়া সরকারপক্ষের সবাই এখন নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু তৈরির কথা বলছেন। অর্থ মন্ত্রণালয় চেষ্টা করছে বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে থেকে সংগ্রহের। বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা চালাচ্ছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। কেননা, বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়া বড় অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণ স্বল্পোন্নত কোনো দেশের পক্ষেই সম্ভব হয়নি।
সার্বিকভাবে, দেশীয় অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ধারণা জনপ্রিয়তা পেলেও অর্থনীতির ওপর এর সম্ভাব্য দায় নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। সরকারের ভেতর থেকে এ নিয়ে কেউ কোনো কথাও বলছেন না।
ফাইন্যান্সিং লার্জ প্রজেক্টস নামের একটি বই যৌথভাবে লিখে বিখ্যাত হয়েছেন সাবেক সচিব ফয়জুল কবির খান। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বইটির লেখক গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে সম্পদ সীমিত। সুতরাং দেশীয় অর্থ থেকে পদ্মা সেতু করলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ কমবে। আবার প্রবাসী-আয় এই খাতে ব্যয় করলে অন্যান্য খাত বঞ্চিত হবে। কেননা, এসব প্রবাসী-আয় অন্য কাজে ইতিমধ্যেই ব্যবহূত হচ্ছে। সুতরাং দেশীয় সম্পদ ব্যবহার করলে এর প্রভাব কী পড়বে, তার একটি পর্যালোচনা প্রয়োজন।
সার্বভৌম বন্ড: দেশীয় অর্থে একটি কেন, একাধিক পদ্মা সেতু করা সম্ভব। তবে তা উচিত কি না, সেই প্রশ্নটিই এখন তোলা হচ্ছে। সরকারও পদ্মা সেতুর অর্থায়নের জন্য একাধিক বিকল্পের কথা ভাবছে। এর মধ্যে রয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ থেকে অর্থ নেওয়া, সার্বভৌম বা সভরিন বন্ড এবং প্রবাসীদের জন্য বন্ড ছাড়া। এর মধ্যে সার্বভৌম বন্ডই বেশি সমর্থন পাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ এর আগে কখনো সার্বভৌম বন্ড ছাড়েনি।
প্রায় একই ধরনের অর্থনীতির মধ্যে শ্রীলঙ্কা প্রথম সভরিন বন্ড ছাড়ে ২০০৭ সালে। পাঁচ বছর মেয়াদি ওই বন্ডের মাধ্যমে দেশটি সংগ্রহ করেছিল ৫০ কোটি ডলার। এর জন্য সুদ দিতে হয়েছে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। যখন বন্ড ছাড়ে তখন শ্রীলঙ্কার ঋণমান (ক্রেডিট রেটিং) ছিল ‘বি প্লাস পজেটিভ আউটলুক’। তবে স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস (এস অ্যান্ড পি) সম্প্রতি ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে ‘বি প্লাস স্টাবল আউটলুক’ করেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ঋণমান ‘বিবি মাইনাস, স্টাবল আউটলুক’। অর্থাৎ ঋণমানে বাংলাদেশের অবস্থান শ্রীলঙ্কার তুলনায় খারাপ। এ অবস্থায় সভরিন বন্ড ছাড়তে হলে বেশি হারে সুদ দিতে হবে বলে বিনিয়োগ ব্যাংকাররা মনে করছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, ৭৫ কোটি ডলার সংগ্রহে এই বন্ড ছাড়া হবে। বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এই প্রতিবেদক বিশ্লেষণ করে দেখেছে যে পাঁচ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদ যদি ৮ শতাংশ হয় তাহলে প্রতিবছর পরিশোধ করতে হবে ১৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার। বন্ড সাত বছর মেয়াদি করা হলে পরিশোধ করতে হবে ১৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। তবে সুদ ১০ শতাংশ হলে পাঁচ বছর মেয়াদের ক্ষেত্রে পরিশোধ করতে হবে প্রতিবছর প্রায় ২০ কোটি ডলার এবং সাত বছরের ক্ষেত্রে সাড়ে ১৫ কোটি ডলার।
সূত্রগুলো মনে করছে, মাত্র ৭৫ কোটি ডলারের বন্ড ছেড়ে পদ্মা সেতু করা যাবে না। এ জন্য কম করে হলেও ২০০ কোটি ডলার লাগবে। যদি সরকার বন্ড ছেড়ে ১৮০ কোটি ডলার (এই পরিমাণ অর্থ বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা এডিবি দেওয়ার কথা) সংগ্রহ করে তাহলে প্রতিবছর ৪৫ কোটি ডলার থেকে ৪৮ কোটি ডলার পর্যন্ত অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
ঋণ পরিশোধের দায় বাড়ছে: বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কখনো ব্যর্থ হয়নি। নিয়মিতভাবে দায় পরিশোধ করে আসছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ মূলত সহজ শর্তে ঋণ নিয়েছে। এর জন্য সামান্য হারে সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। ২০১১ সালে বাংলাদেশকে বৈদেশিক ঋণ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৭৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। চলতি বছরে প্রায় ৭৫ কোটি ডলার দিতে হবে। সার্বভৌম বন্ড ছাড়লে এই দায় ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। সুতরাং বাংলাদেশকে এ সময় অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে হবে। তা না হলে বড় ধরনের সংকটে পড়তে হবে দেশকে।
মজুদের ব্যবহার: ২০০৪ সালে ভারতে সে সময়ের অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম তাঁদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) কাছে মাত্র পাঁচ বিলিয়ন ডলার চেয়েছিলেন। কারণ, সে সময়ে রিজার্ভ কেবলই বেড়ে যাচ্ছিল। অথচ দেশের ভেতরকার অবকাঠামো তৈরির পর্যাপ্ত তহবিল ছিল না। ওই সময়ে ভারতের রিজার্ভ ছিল ২১২ বিলিয়ন ডলার। এ নিয়ে তিন বছর ধরে দীর্ঘ আলোচনা হয়। আরবিআই শেষ পর্যন্ত রিজার্ভ ভেঙে কোনো ডলার সরকারকে দেয়নি। যুক্তি ছিল, রিজার্ভ কেবল আমদানি অর্থায়নের জন্য। দেশের ভেতরে এভাবে অর্থ খরচ করলে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ তৈরি হবে। আবার বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিলে আমদানি অর্থায়ন নিয়ে সংকট বাড়বে। এখন ভারতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরবিআইর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। মূলত কোনো দেশই রিজার্ভ ভেঙে অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে কোনো সময়ই অর্থ খরচ করে না।
পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশেও মজুদ থেকে অর্থ দেওয়ার কথা আলোচনা হচ্ছে। অথচ রিজার্ভ কমে যাওয়ায় অর্থনীতি বড় ধরনের চাপে পড়েছিল ২০১১ সালেই। গত জানুয়ারি মাসে প্রায় ১১ বিলিয়ন বা এক হাজার ১০০ কোটি ডলার থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভ নেমে এসেছিল সাড়ে ৯০০ কোটি ডলারে। তাতে ডলারের দর ৭১ টাকা থেকে লাফ দিয়ে হয়েছিল ৮৬ টাকায়। বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেল আমদানির ব্যয় বাড়ায় রিজার্ভের ওপর টান পড়ে। ফলে সরকারকে তেল আমদানি কমিয়ে দিতে হয়েছিল। মূলত, লেনদেনের এই চাপ সামলাতেই অর্থমন্ত্রী বাধ্য হয়ে সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে এসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছেন। এ জন্য জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি এবং মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার মতো শর্ত মানতে হচ্ছে।
চার মাস ধরে দেশে রপ্তানি আয়ে ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ইউরোপের মন্দা কাটেনি। যুক্তরাষ্ট্রেও রপ্তানি কমছে। আবার জ্বালানি তেলের দাম খুব বেশি কমার লক্ষণ নেই। ফলে রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে পদ্মা সেতু করলে লেনেদেনের ভারসাম্যে বড় চাপ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ১০ জুলাই দেশে রিজার্ভ ছিল ৯৯৩ কোটি ১৩ লাখ ডলার। এই অর্থ দিয়ে মাত্র তিন মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব।
প্রবাসীদের জন্য বন্ড: ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর জন্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় বিপাকে পড়েছিল ভারত। রিজার্ভ নেমে হয়েছিল মাত্র ২৯ বিলিয়ন ডলার। পরিস্থিতি সামলাতে প্রবাসীদের জন্য ‘রিসারজেন্ট ইন্ডিয়া’ নামে একটি বন্ড ছেড়েছিল দেশটি। এ জন্য ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে দেশের পারমাণবিক শক্তি অর্জন নিয়ে দেশের পক্ষে এক ধরনের জাতীয়তাবাদী চেতনা উদ্বুদ্ধ করা হয়। ফলে তুলনামূলক স্বল্প সুদে চাহিদার তুলনায় দ্বিগুণ অর্থ পায় ভারত। সেবার ৪২০ কোটি ডলার এবং ২০০০ সালে ‘ইন্ডিয়া মিলেনিয়াম ডিপোজিটস’ নামের আরেক বন্ডের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয় ৫২০ কোটি ডলার।
ভারত তিন ভাবে এই অর্থ ব্যয় করেছিল। যেমন, এর ৪০ শতাংশ সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা হয়, ৫০ শতাংশ দেওয়া হয় ব্যাংকগুলোকে, যারা সম্পদ আহরণ ও সমাবেশ ঘটায় এবং বাকি মাত্র ১০ শতাংশ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করা হয়।
বাংলাদেশেও প্রবাসীদের জন্য এখন তিন ধরনের বন্ড চালু আছে। যেমন, প্রিমিয়াম, ইনভেস্টমেন্ট এবং ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমন্টে বন্ড। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এসব বন্ড থেকে খুব সামান্য অর্থই সংগ্রহ করা হয়। ২০১০ সালে সংগ্রহ হয়েছেল ৯৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা, আর ২০১১ সালে এর চেয়ে সামান্য বেশি। অর্থাৎ মাত্র ১৩ কোটি ডলার। এ দিয়ে পদ্মা সেতুর সামান্যই নির্মাণ করা যাবে।
যদি বিশ্বব্যাংকের অর্থ পাওয়া যায়: পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রুতি ছিল ১২০ কোটি ডলার, এডিবির ৬০ কোটি ডলার, জাপানের জাইকার ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং আইডিবির দেওয়ার কথা ১৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি ঋণ বাতিল করেছে।
বিশ্বব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এসব ঋণের সুদের হার কম। বিশ্বব্যাংকের শর্ত হচ্ছে এর জন্য বাংলাদেশকে সার্ভিস চার্জ দিতে হবে দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর জন্য প্রথম ১০ বছর কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। নিয়ম হচ্ছে ১১ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত সময়ে মোট নেওয়া ঋণের ২ শতাংশ হারে পরিশোধ করতে হয়, পরবর্তী ২০ বছরে দিতে হবে ৪ শতাংশ হারে। এই হিসাবে ১১ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত সময়ে প্রতিবছর পরিশোধ করতে হতো তিন কোটি ৩০ লাখ ডলার। এর মধ্যে মূল ঋণ দুই কোটি ৪০ লাখ ডলার এবং সার্ভিস চার্জ ৯০ লাখ ডলার। পরবর্তী বছরগুলোতে দিতে হবে পাঁচ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এর মধ্যে মূল ঋণ চার কোটি ৮০ লাখ ডলার এবং সার্ভিস চার্জ ৯০ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে মোট সার্ভিস চার্জ দিতে হবে দুই কোটি ৭০ লাখ ডলার।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, দেশীয় সম্পদ বিকল্প হতে পারে না। কম করে হলেও ১৫০ কোটি ডলার বাইরে থেকে আনতে হবে। এখন সরকারের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে জাপানকে অনুরোধ করা। সমর্থন ছাড়া জাপান এগোবে না। জাপান এগোলে এডিবিও এগিয়ে আসবে। সব মিলিয়ে একটি সুচিন্তিত অর্থায়ন প্যাকেজ নিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.