মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কাল প্রথম রায়

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য (রুকন) পলাতক আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আগামীকাল সোমবার রায় ঘোষণা করা হবে। ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা মামলায় এটিই হবে প্রথম রায়।
আজ রোববার বেলা ১১টার দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসির উদ্দিন মাহমুদ এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান।
রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসির উদ্দিন মাহমুদ বলেন, গত ২৬ ডিসেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ রায় অপেক্ষাধীন (সিএভি) রেখেছিলেন। আগামীকাল এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। এ জন্য আগামীকাল কার্যতালিকায় এ মামলার কার্যক্রমের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-২।

যুক্তিতর্ক
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২-এ গত ২৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ আযাদের বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন শেষ করে। এই ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও মো. শাহিনুর ইসলাম।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলী আইনি দিক ব্যাখ্যা করে বলেন, এই মামলায় আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে পাওয়া সাক্ষ্য-প্রমাণ রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে। এ জন্য আসামি সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।
এরপর ট্রাইব্যুনাল উভয় পক্ষের আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, যেকোনো দিন এই মামলার রায় হতে পারে।

একনজরে এই মামলার বিচার-প্রক্রিয়া
গত বছরের ৪ নভেম্বর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়। দুই মাসের কম সময়ে এই মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়। আযাদের বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল। চলতি বছরের ২৫ মার্চ তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তের বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল-২-এ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। ‘সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে’ ওই দিন রাষ্ট্রপক্ষ তাঁকে গ্রেপ্তারের আবেদন করে। ৩ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল আযাদকে গ্রেপ্তারের জন্য পরোয়ানা জারি করেন। কিন্তু সেদিন উত্তরখানে আযাদের বাসভবন ‘আযাদ ভিলা’য় গিয়ে পুলিশ তাঁকে পায়নি। এর আগেই তিনি পালিয়ে যান। ২৫ সেপ্টেম্বর দুটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আযাদকে সাত দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে বলা হয়। কিন্তু তিনি হাজির না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাঁকে পলাতক ঘোষণা করেন এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচার শুরু করেন। ৭ অক্টোবর পলাতক আযাদের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আবদুস শুকুর খানকে নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল।
৪ নভেম্বর আযাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের আটটি অভিযোগ গঠন করা হয়। ২৬ নভেম্বর থেকে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য নেওয়া শুরু হয়, চলে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নূর হোসেনসহ রাষ্ট্রপক্ষের ২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়। তবে আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবদুস শুকুর খান কোনো সাক্ষী হাজির করতে না পারায় ট্রাইব্যুনাল যুক্তি উপস্থাপনের জন্য ২৩ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন। দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর মামলার কার্যক্রম শেষ হয়।

আযাদের বিরুদ্ধে আট অভিযোগ
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২) ধারায় আযাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে ছয় ধরনের অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এগুলো হলো: গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, আটক রাখা ও নির্যাতন। প্রথম, দ্বিতীয় ও অষ্টম অভিযোগে আযাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে অপহরণ, আটক রাখা ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়। এগুলো হলো: একাত্তরের জুনে রণজিত্ নাথ ওরফে বাবু নাথকে অপহরণ করে আটকে রেখে নির্যাতন, ২৬ জুলাই আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে অপহরণ করে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আটকে রেখে নির্যাতন এবং ১৮ মে এক নারীকে আটকে রেখে নির্যাতন।
আযাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ অভিযোগে। যাঁদের হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁরা হলেন: কলারন গ্রামের জমিদার সুধাংশু মোহন রায়, পুরুরা নমপাড়া গ্রামের মাধবচন্দ্র বিশ্বাস ও ফুলবাড়িয়া গ্রামের চিত্তরঞ্জন দাস। পঞ্চম অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে নতিবদিয়া গ্রামের দুই নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়।
আযাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার একমাত্র অভিযোগটি আনা হয়েছে সাত নম্বর অভিযোগে। এ অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ১৭ মে তিনি ৩০-৩৫ জন সশস্ত্র রাজাকারকে নিয়ে ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার হাসামদিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় হামলা চালান। সেখানে নির্বিচারে গুলি করে শরত্চন্দ্র পোদ্দার, সুরেশ পোদ্দার, শ্যামাপদ পোদ্দার, জতীন্দ্র মোহন সাহা, নীল রতন সমাদ্দার, সুবল কয়াল ও মল্লিক চক্রবর্তীকে হত্যা করা হয়। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার জন্য এই হত্যাকাণ্ড চালানো হয় বলে তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.