আঁখির চোখে শুধুই পানি, মুখে তেমন কিছুই খেতে পারেন না- স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে কমপক্ষে ৩ মাস লাগবে ॥ কাল থেকে জরুরী অপারেশন শুরু by গাফফার খান চৌধুরী
এ্যাসিডদগ্ধ ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজছাত্রী আঁখির ডান চোখ ও মাথায় এ্যাসিডে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে দিনরাত চেষ্টা করে যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের মেডিক্যাল বোর্ড।
আগামী সোমবার থেকে শুরু হচ্ছে আঁখির অপারেশন। পর্যায়ক্রমে তাঁর ৫টি অপারেশন হবে। আঁখিকে কমপক্ষে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কমপক্ষে ৩ মাস বা আরও বেশি সময় লাগতে পারে। তারপরও আঁখি পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত নন। স্বাভাবিক খাবার খেতে পারছেন না আঁখি। বিষয়টি বুঝতে পেরে আঁখি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুধুই নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। কথিত প্রেমিকের ছুরিকাঘাত আর এ্যাসিড চিরদিনের জন্য কেড়ে নিল আঁখির স্বপ্ন। প্রেম বা বিয়ে তাঁর জন্য এখন দুঃস্বপ্ন। হারিয়ে গেছে রূপ। ক্ষীণ হয়ে আসছে আশা। মনের জোরও অনেকটা কমে গেছে। আঁখিকে দেখার পর সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এ্যাসিড নিক্ষেপকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। শনিবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আঁখিকে ছুরিকাঘাতের পর এ্যাসিড নিক্ষেপকারী দুই নরপশুর কেউই গ্রেফতার হয়নি। গত ১৫ জানুয়ারি মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় রাজধানীর বংশাল থানাধীন চাঁনখারপুল মোড়ে কাজী অফিসের দোতলায় রাজধানীর ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের (সম্মান) শিক্ষার্থী শারমীন আক্তার আঁখিকে (২৪) প্রথমে ছুরিকাঘাত করে কথিত প্রেমিক মনির। পরে মনিরের বন্ধু মাসুমও আখিকে ছুরিকাঘাত করে। ছুরিকাঘাতের পর দুই নরপশু আঁখিকে এ্যাসিডে ঝলসে দেয়। পুলিশ আঁখিকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করে। এ ব্যাপারে শারমীনের ভাই বাদী হয়ে রাজধানীর বংশাল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ঘটনাটি ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।বুধবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ হাসপাতালে আঁখিকে দেখতে যান। গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় সাংসদ ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, শুক্রবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী আঁখিকে দেখতে হাসপাতালে যান। শনিবার সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আঁখিকে হাসপাতালে দেখতে যান। এরা সবাই আঁখির পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেন। দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিও দেন। আঁখিকে সব ধরনের সহায়তা করারও আশ্বাস দেন তাঁরা।
সরকারের আন্তরিকতার ফলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতাল কর্তৃপক্ষ আঁখির চিকিৎসায় বৃহস্পতিবার ৫ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে। বোর্ড আঁখির সার্বিক বিষয়াদির খোঁজখবর রাখছেন। উন্নত চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে আঁখিকে।
আঁখিকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের পঞ্চমতলার ৫১৫ নম্বর কেবিনে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দরজা খুলে যথেষ্ট কাছ থেকে দেখা গেল আঁখিকে। আঁখিকে দেখলে যে কেউ আঁতকে উঠতে বাধ্য। যে মুখটি সদা হাস্যময় ছিল, সেই মুখটি পুড়ে কালো হয়ে গেছে। মুখের চামড়া উঠে গেছে। একই অবস্থা গলা, বুক, পেট, মাথা, ডান চোখ, তলপেট, পা, হাঁটুসহ প্রায় সারা শরীরেÑ দেখলে মনে হয় কোন মানুষ পুড়ে মারা গেছে।
আঁখি স্বাভাবিকভাবে মুখ দিয়ে তেমন কিছু খেতে পারেন না। সারাদিনে হয়ত একবার বা দুইবার সামান্য দুই এক চামচ খাবার খান। এছাড়া অন্য সময় নল দিয়ে খাওয়ানো হয়। মানুষ দেখলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আর তখন দুই চোখ দিয়ে অঝোরে পানি বের হয়ে তা গন্ড বেয়ে বিছানায় পড়ে। তাঁর এমন নীরব করুণ আর্তনাদ পুরো কেবিনসহ আশপাশের পরিবেশকে সারাক্ষণ ভারি করে রেখেছে।
আঁখির ছোট ভাই মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে জানান, আপা খেতে পারেন না। নল দিয়ে খাওয়াতে হয়। খাওয়াতে গেলে শুধুই কান্নাকাটি করেন। চিকিৎসকরা নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছেন। কিন্তু অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হচ্ছে বলে বাহ্যিকভাবে মনে হয় না। নরপশুরা গ্রেফতার না হওয়ায় মহিউদ্দিন চরম হতাশা প্রকাশ করেন। তবে সরকারের আন্তরিকতায় তারা খুশি।
আঁখির সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেনের কাছে। তিনি যা জানালেন তা রীতিমতো চমকে ওঠার মতো। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, আঁখিকে প্রথমে ছুরিকাঘাত করেছে দুর্বৃত্তরা। তাঁর পিঠে ২টি, শরীরের পেছনের দিকে কোমরের সামান্য উপরে একটি এবং বাম হাতে আরেকটি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করায় ছুরিকাঘাতের ক্ষত গভীর হয়েছে। ছুরিকাঘাতের পর দুর্বৃত্তরা আঁখির মাথায় এ্যাসিড ঢেলে দিয়েছে। এ্যাসিডে মাথার চামড়া পুড়ে ভেতরে ঢোকে। মাথার ভেতরেও এ্যাসিডে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। আঁখির মাথায় জরুরী অপারেশন করতে হবে, যা খুবই স্পর্শকাতর এবং জটিল। ঢেলে দেয়া এ্যাসিড মুখম-লের চামড়া পুড়ে দেয়। চামড়া পুড়ে এ্যাসিড চলে গেছে মুখের চামড়ার ভেতরে। চামড়ার নিচে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। ঢেলে দেয়া এ্যাসিড শরীর বেয়ে নিচের দিকে গিয়ে ছুরিকাঘাতের ক্ষতস্থানে পৌঁছে। ছুরিকাঘাতের ছিদ্র দিয়ে এ্যাসিড শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে। এ্যাসিড ভেতরে প্রবেশ করে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে পিঠে ও কোমরের উপরের ক্ষতে খুবই গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। এসব জায়গায়ও জরুরী অপারেশন করা প্রয়োজন। কিন্তু আঁখির শরীর অপারেশন সহ্য করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী অবস্থায় নেই। এ্যাসিডে আঁখির ডান চোখের কর্নিয়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চোখের সার্বিক পরিস্থিতি মনিটরিং করতে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞকেও রাখা হয়েছে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের মেডিক্যাল বোর্ডে।
সোমবার থেকে আঁখির অপারেশন শুরু হবে। প্রথমেই আঁখির মুখের অপারেশন করা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে আরও ৪টি অপারেশন করা হবে। প্রাথমিকভাবে আঁখির ৫টি অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অপারেশনসহ আঁখিকে খানিকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কমপক্ষে ৩ মাস বা আরও অধিক সময় লাগতে পারে। বাহ্যিকভাবে আঁখি মানসিকভাবে সুস্থ আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারপরও আঁখি আশঙ্কামুক্ত নন। এ ধরনের রোগীদের আশঙ্কা থেকেই যায়। যথেষ্ট স্বাভাবিক হওয়ার পরও ভবিষ্যতে আঁখির নানা ধরনের জটিলতায় ভোগার আশঙ্কা থেকেই যায়। এজন্য সবদিক বিবেচনা করে ভবিষ্যতে আঁখি যাতে কোন সমস্যা বা জটিলতায় না ভোগেন এজন্য উন্নত চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এ্যাসিডে আঁখির শরীরের ২১ ভাগ দগ্ধ হয়েছে। এ পরিমাণ বার্নে সাধারণত সমস্যা হয় না। কিন্তু ছুরিকঘাতের ক্ষতস্থান দিয়ে এ্যাসিড প্রবেশ করে শরীরের ভেতরে ক্ষত হওয়ায় কিছুটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। তবে এমন জটিলতা উন্নত চিকিৎসায় নিরসন করা সম্ভব। আঁখিকে পুরোপুরি সুস্থ করে তুলতে সব ধরনের চেষ্টা ও চিকিৎসা অব্যাহত আছে। সরকারীভাবে আঁখির চিকিৎসা চলছে। অর্থের কোন সমস্যা নেই বলেও তিনি জানান।
No comments