রঙ্গব্যঙ্গ-পিস্তল গিয়াস by মোস্তফা কামাল
গিয়াস উদ্দিন আহমেদ। 'পিস্তল গিয়াস' নামেই বেশি পরিচিত। তিনি ময়মনসিংহ-১০ আসনের এমপি। তাঁর একটি লাইসেন্স করা পিস্তল আছে। পিস্তলটি তিনি সব সময় সঙ্গে রাখেন। কথায় কথায় তিনি মানুষকে পিস্তল দেখান। গুলি করার হুমকি দেন। তাই কেউ কেউ তাঁকে 'গুলি গিয়াস'ও বলে থাকেন।
একবার তিনি ময়মনসিংহে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় জনগণের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। উল্টাপাল্টা কথার জের। মানুষ তো আর বোকা নয়; যদিও এমপি সাহেবরা জনগণকে বোকা ভাবেন। আর নিজেদের অতিমাত্রায় চতুর ভাবেন।
একবার এমপি গিয়াস নিজের এলাকায় জনগণের প্রতিরোধের মুখে পড়লেন। তারপর তাঁর আসল রূপ বেরিয়ে গেল। তিনি গাড়িতে বসেই জনতার উদ্দেশে গুলি ছুড়তে শুরু করলেন। একেবারেই ফিল্মি স্টাইলের কাণ্ড! তখন থেকেই তাঁর নাম হয়ে যায় পিস্তল গিয়াস।
এ সম্পর্কে এমপি গিয়াস সাহেবের কাছে মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, দেশে তাঁর শত্রুর অভাব নেই। তাই আত্মরক্ষার জন্য নাকি তিনি পিস্তল রাখেন। তবে তিনি এও স্বীকার করেছেন, তাঁর মেজাজ নাকি একটু বেশি চড়া! উল্টাপাল্টা কিছু দেখলেই তাঁর মেজাজ ঠিক থাকে না। উনিশ থেকে বিশ হলেই তিনি পিস্তল উঁচিয়ে হুমকি দেন!
কথায় আছে না, কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না! মানুষও ইচ্ছা করলেই তার স্বভাব পাল্টাতে পারে না। পিস্তল গিয়াসও ইচ্ছা করলেই তাঁর স্বভাব পাল্টাতে পারবেন না। সম্প্রতি তিনি নিজের কাজ করিয়ে নিতে মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য তিনি বলেছেন তাঁর এলাকার কাজের জন্য তিনি গিয়েছিলেন। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে তিনি নাকি নিজেকে জিয়াউর রহমানের খুনি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'আমি জিয়াউর রহমানকে খুন করেছি। আমি ফাঁসির আসামি। আমি কাউকে ভয় পাই না। আমার কাজ দ্রুত করে দেন।' মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, কাজ না করলে গুলি করবেন বলে নাকি তিনি হুমকি দিয়েছেন।
ব্যস, বিএনপি পেয়ে গেল মওকা। 'আত্মস্বীকৃত খুনির' বিচার দাবি করল বিএনপি। বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলাম সরকারের কাছে এই দাবি জানিয়ে বললেন, এমপি গিয়াস নিজের এলাকায় মানুষ খুন করেছেন। এতে গিয়াস সাহেব পড়ে গেলেন মহাবিপাকে। তিনি কী করবেন কিছুই ভেবে পান না। শেষমেশ তিনি নিজের মুখকে দোষেন। এই মুখটাই তো যত গণ্ডগোলের গোড়া। পিস্তলের চেয়ে আমার মুখটাই তো দেখছি বড় সমস্যা।
গিয়াস সাহেব আরো বললেন, আমি অন্য মানুষকে শত্রু মনে করি আর তাদের ঠ্যাঙানোর জন্য পিস্তল সঙ্গে রাখি। এখন তো দেখছি আমার মুখটাই বড় শত্রু! মুখটা সেলাই করে রাখব নাকি! তা না হলে নিজের মুখেই কবে গুলি করে দিই! জিয়াউর রহমানকে নিয়ে ব্যাখ্যা না দিলে তো আরো বিপদে পড়ব! সবাই বলবে, আমিই জিয়াউর রহমানের খুনি। নিজের মুখের কথা! অন্যরা তো এর সুযোগ নেবেই। ছি! এসব আমি কী বললাম!
অনেক ভাবনাচিন্তার পর গিয়াস সাহেব সংবাদ সম্মেলন (কাল্পনিক) ডাকলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি তাঁর বক্তব্য তুলে ধরবেন। কিন্তু তাঁর ডাকে সাংবাদিকরা কোনো সাড়া দিলেন না। সবার ভয়, যদি গুলি করে দেন! গিয়াস সাহেব সমস্যাটা কী, তা বুঝতে পারলেন! তিনি অনেক অনুনয়-বিনয় করে বললেন, 'সাংবাদিক ভাই, আমি কথা দিচ্ছি ভাই। মনের ভুলেও গুলি করব না। পিস্তলও সঙ্গে রাখব না। প্লিজ আমার কথাগুলো শুনুন! আপনারা যা খুশি প্রশ্ন করবেন। আমি রাগব না। মাথাও গরম করব না। আর যদি মাথা গরম করেই ফেলি, তাহলে আইসক্রিমের পানি আমার মাথায় ঢেলে দেবেন। আমি টুঁ শব্দটি করব না।'
অবশেষে কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিক তাঁর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হলেন। সবার মধ্যে ভয়, আতঙ্ক। এই বুঝি গুলি করার হুমকি দেওয়া হয়। গিয়াস সাহেব শুরুতে ঠাণ্ডা মেজাজেই ছিলেন। বুঝলেন সাংবাদিক ভাইরা, কথায় বলে না, 'সব দোষ নন্দ ঘোষ!' আমার অবস্থা নন্দ ঘোষের মতো। আমি কথা বললেও নাকি দোষ! কী করব বলেন তো! আপনারাই আমাকে বুদ্ধি দেন। আপনারা যেভাবে বলবেন আমি সেভাবেই করব। আমি মন্ত্রণালয়ে গেলাম। কর্মকর্তাদের বললাম, আমার কাজটা করে দেন। তাঁরা আমাকে পাত্তাই দিলেন না! খুবই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেন। আমার খুব খারাপ লাগল। আমি এমপি মানুষ। কোথায় আমার অবস্থান আর কোথায় একজন ছাপোষা কর্মচারী! তাঁদের আচরণে আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। আমি বললাম, আমাকে চেনেন, আমি কে? আমার নাম গিয়াস, পিস্তল গিয়াস। বাড়াবাড়ি করলে গুলি করে দেব! হ, এই কথাই বলছি। অথচ আমাকে জিয়ার খুনি বানিয়ে দিল! ছি ছি! মানুষ এত খারাপ! সব ষড়যন্ত্র, বুঝলেন! সব ষড়যন্ত্র! আমি নিজের কথা নিজেই স্বীকার করি, আমি ভাই রগচটা মানুষ। উল্টাপাল্টা দেখলেই মেজাজ বিগড়ে যায়। এটাই আমার দোষ। এ ছাড়া আমার কোনো দোষ নেই। সত্যি বলছি, আমি মানুষটা অত খারাপ না। মেজাজ গরম হলেও মনটা খুব নরম। কিন্তু আমাকে সবাই ভুল বোঝে। আপনারা আমাকে ভুল বুঝবেন না! ভাই, আপনারা আমার কথাগুলো লিখবেন তো!
সাংবাদিকরা চুপ করে আছেন। কেউ কোনো কথা বলছেন না। সাংবাদিকরা নীরব থাকার কারণে গিয়াস সাহেবের মেজাজ আস্তে আস্তে গরম হতে থাকে। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, 'সাংবাদিক ভাইরা, আপনারা চুপ করে আছেন কেন? কথা বলেন। আপনারা কি আমার কথাগুলো লিখবেন?'
এবারও সাংবাদিকদের মুখে কোনো কথা নেই। তাঁরা চুপ করে বসে আছেন। এতে গিয়াস সাহেব খেপে গেলেন। তিনি মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করার অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, এই! তোরা কথা বলবি, নাকি গুলি করব?
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
একবার এমপি গিয়াস নিজের এলাকায় জনগণের প্রতিরোধের মুখে পড়লেন। তারপর তাঁর আসল রূপ বেরিয়ে গেল। তিনি গাড়িতে বসেই জনতার উদ্দেশে গুলি ছুড়তে শুরু করলেন। একেবারেই ফিল্মি স্টাইলের কাণ্ড! তখন থেকেই তাঁর নাম হয়ে যায় পিস্তল গিয়াস।
এ সম্পর্কে এমপি গিয়াস সাহেবের কাছে মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, দেশে তাঁর শত্রুর অভাব নেই। তাই আত্মরক্ষার জন্য নাকি তিনি পিস্তল রাখেন। তবে তিনি এও স্বীকার করেছেন, তাঁর মেজাজ নাকি একটু বেশি চড়া! উল্টাপাল্টা কিছু দেখলেই তাঁর মেজাজ ঠিক থাকে না। উনিশ থেকে বিশ হলেই তিনি পিস্তল উঁচিয়ে হুমকি দেন!
কথায় আছে না, কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না! মানুষও ইচ্ছা করলেই তার স্বভাব পাল্টাতে পারে না। পিস্তল গিয়াসও ইচ্ছা করলেই তাঁর স্বভাব পাল্টাতে পারবেন না। সম্প্রতি তিনি নিজের কাজ করিয়ে নিতে মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য তিনি বলেছেন তাঁর এলাকার কাজের জন্য তিনি গিয়েছিলেন। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে তিনি নাকি নিজেকে জিয়াউর রহমানের খুনি হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'আমি জিয়াউর রহমানকে খুন করেছি। আমি ফাঁসির আসামি। আমি কাউকে ভয় পাই না। আমার কাজ দ্রুত করে দেন।' মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, কাজ না করলে গুলি করবেন বলে নাকি তিনি হুমকি দিয়েছেন।
ব্যস, বিএনপি পেয়ে গেল মওকা। 'আত্মস্বীকৃত খুনির' বিচার দাবি করল বিএনপি। বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলাম সরকারের কাছে এই দাবি জানিয়ে বললেন, এমপি গিয়াস নিজের এলাকায় মানুষ খুন করেছেন। এতে গিয়াস সাহেব পড়ে গেলেন মহাবিপাকে। তিনি কী করবেন কিছুই ভেবে পান না। শেষমেশ তিনি নিজের মুখকে দোষেন। এই মুখটাই তো যত গণ্ডগোলের গোড়া। পিস্তলের চেয়ে আমার মুখটাই তো দেখছি বড় সমস্যা।
গিয়াস সাহেব আরো বললেন, আমি অন্য মানুষকে শত্রু মনে করি আর তাদের ঠ্যাঙানোর জন্য পিস্তল সঙ্গে রাখি। এখন তো দেখছি আমার মুখটাই বড় শত্রু! মুখটা সেলাই করে রাখব নাকি! তা না হলে নিজের মুখেই কবে গুলি করে দিই! জিয়াউর রহমানকে নিয়ে ব্যাখ্যা না দিলে তো আরো বিপদে পড়ব! সবাই বলবে, আমিই জিয়াউর রহমানের খুনি। নিজের মুখের কথা! অন্যরা তো এর সুযোগ নেবেই। ছি! এসব আমি কী বললাম!
অনেক ভাবনাচিন্তার পর গিয়াস সাহেব সংবাদ সম্মেলন (কাল্পনিক) ডাকলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি তাঁর বক্তব্য তুলে ধরবেন। কিন্তু তাঁর ডাকে সাংবাদিকরা কোনো সাড়া দিলেন না। সবার ভয়, যদি গুলি করে দেন! গিয়াস সাহেব সমস্যাটা কী, তা বুঝতে পারলেন! তিনি অনেক অনুনয়-বিনয় করে বললেন, 'সাংবাদিক ভাই, আমি কথা দিচ্ছি ভাই। মনের ভুলেও গুলি করব না। পিস্তলও সঙ্গে রাখব না। প্লিজ আমার কথাগুলো শুনুন! আপনারা যা খুশি প্রশ্ন করবেন। আমি রাগব না। মাথাও গরম করব না। আর যদি মাথা গরম করেই ফেলি, তাহলে আইসক্রিমের পানি আমার মাথায় ঢেলে দেবেন। আমি টুঁ শব্দটি করব না।'
অবশেষে কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিক তাঁর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হলেন। সবার মধ্যে ভয়, আতঙ্ক। এই বুঝি গুলি করার হুমকি দেওয়া হয়। গিয়াস সাহেব শুরুতে ঠাণ্ডা মেজাজেই ছিলেন। বুঝলেন সাংবাদিক ভাইরা, কথায় বলে না, 'সব দোষ নন্দ ঘোষ!' আমার অবস্থা নন্দ ঘোষের মতো। আমি কথা বললেও নাকি দোষ! কী করব বলেন তো! আপনারাই আমাকে বুদ্ধি দেন। আপনারা যেভাবে বলবেন আমি সেভাবেই করব। আমি মন্ত্রণালয়ে গেলাম। কর্মকর্তাদের বললাম, আমার কাজটা করে দেন। তাঁরা আমাকে পাত্তাই দিলেন না! খুবই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেন। আমার খুব খারাপ লাগল। আমি এমপি মানুষ। কোথায় আমার অবস্থান আর কোথায় একজন ছাপোষা কর্মচারী! তাঁদের আচরণে আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। আমি বললাম, আমাকে চেনেন, আমি কে? আমার নাম গিয়াস, পিস্তল গিয়াস। বাড়াবাড়ি করলে গুলি করে দেব! হ, এই কথাই বলছি। অথচ আমাকে জিয়ার খুনি বানিয়ে দিল! ছি ছি! মানুষ এত খারাপ! সব ষড়যন্ত্র, বুঝলেন! সব ষড়যন্ত্র! আমি নিজের কথা নিজেই স্বীকার করি, আমি ভাই রগচটা মানুষ। উল্টাপাল্টা দেখলেই মেজাজ বিগড়ে যায়। এটাই আমার দোষ। এ ছাড়া আমার কোনো দোষ নেই। সত্যি বলছি, আমি মানুষটা অত খারাপ না। মেজাজ গরম হলেও মনটা খুব নরম। কিন্তু আমাকে সবাই ভুল বোঝে। আপনারা আমাকে ভুল বুঝবেন না! ভাই, আপনারা আমার কথাগুলো লিখবেন তো!
সাংবাদিকরা চুপ করে আছেন। কেউ কোনো কথা বলছেন না। সাংবাদিকরা নীরব থাকার কারণে গিয়াস সাহেবের মেজাজ আস্তে আস্তে গরম হতে থাকে। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, 'সাংবাদিক ভাইরা, আপনারা চুপ করে আছেন কেন? কথা বলেন। আপনারা কি আমার কথাগুলো লিখবেন?'
এবারও সাংবাদিকদের মুখে কোনো কথা নেই। তাঁরা চুপ করে বসে আছেন। এতে গিয়াস সাহেব খেপে গেলেন। তিনি মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করার অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, এই! তোরা কথা বলবি, নাকি গুলি করব?
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
No comments