নবীনের পদচারণায় মুখরিত ক্যাম্পাস- বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন। ভাবতেই অন্য রকম লাগে। স্কুল-কলেজের গ-ি পার হয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কৃতকার্য হয়ে নতুন এক অধ্যায় শুরু করা মেধাবী শিক্ষার্থীরা নিজেদের মেধার স্বাক্ষর দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পেরে অনেকেই ভাগ্যবান।
সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ওরিয়েন্টেশনের মাধ্যমে নবীন শিক্ষার্থীদের বরণ করা হয়। আগে স্কুল-কলেজে পড়ার সময় সবাই ছোট ভাবত। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর এখন সবাই বলে বড় হয়ে গিয়েছি। আমি বিশ্বাস করতে পারতেছি না আমি এত বড় হয়ে গেছি এবং আমার ওপর এত দায়িত্ববোধ। এভাবে নিজের আবেগ প্রকাশ করল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যায়ে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী।বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ এক শিক্ষার্থী হেমা বলেন, প্রকৃতিকন্যাখ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমি সত্যিই ভাগ্যবান। আরেক নবীন ভাবনা বলেন, প্রথমদিন ক্যাম্পাসে পরীক্ষা দিতে এসেই প্রেমে পড়ে গেছি। প্রথমদিন ক্লাসে ভয় পাচ্ছিলাম। স্কুল-কলেজের ক্লাস আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস কি এক হবে। অজানা এক শঙ্কা আমার মধ্যে কাজ করছিল।
ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়েই বহমান ভরা যৌবনের পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ। নদের পাড়ে রাখা বড় বড় পাথর খ- আর সিমেন্টের তৈরি বেঞ্চে বসে গল্প করতে করতে সময় যে কিভাবে যায় বুঝাই যায় না। নদের কিনারায় রয়েছে আপন মনে ভ্রমণের জন্য রঙবেরঙের পাল তোলা নৌকা। নৌকগুলোর নামও মজার যেমন টাইটানিক, মায়াজাল, প্রাণের উচ্ছ্বাস ইত্যাদি। ক্যাম্পাসে ঘুরতে ঘুরতে এ রকম বর্ণনা দিতে থাকে তানিয়া, স্মৃতি।
উদ্ভিদের সমাহার নিয়ে সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন। বর্তমানে গার্ডেনটি একটু যেন নতুন সাজে সেজেছে। বৃহৎ জায়গার গার্ডেনে বৃক্ষ ছায়ায় আর নির্মল বাতাসে মন ভরে ওঠে। সব ক্লান্তির অবসান এখানেই। প্রেমিক-প্রেমিকারা তাদের মধুর সময় কাটাতে গার্ডেনই প্রথম পছন্দ। মহুয়া বাগান, ঝাউ বাগান, বাঁশ বাগান গার্ডেনের চিরচেনা জায়গা। শুধু ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরাই নয়, প্রতিদিন বাইরে থেকে অনেক লোক আসে তাদের অবসর সময় নিরিবিলিতে কাটানোর জন্য এখানে। নবীনদের পদচারণায় আরও মুখরিত হয়েছে ক্যাম্পাসের এসব উপকরণ।
সকাল থেকেই শুরু হয় একে অপরের সঙ্গে হায় হ্যালো। সকালের নাশতার টেবিলের মজা, ক্লাসের ফাঁকে মার্কেটের খোকন ভাইয়ের দোকানের চা সঙ্গে আড্ডা, গোধূলি লগনের ক্যাম্পাসে বিভিন্ন জায়গার আড্ডা মনে ধরার মতো। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরেই মশা নামক প্রাণীটির কামড় আর ক্লাসের পড়া নয়তো ব্যবহারিক খাতার তৈরির চাপে রুমে ফেরা। রাতেও বিরাম নেই, পড়াশোনার ফাঁকে হলের বন্ধুকে রুমে ডেকে কত রকম আড্ডাই না হয়। এভাবেই কাটে প্রথমদিন রানা, কায়েস, আশরাফ, মারুফ, হাতেম, হাসান, সুভাদের।
বন্ধু কই তুই, আমরা মার্কেটে, তাড়াতাড়ি আয়! এভাবেই আড্ডার আসরে এক বন্ধুকে আরেক বন্ধুর ফোন প্রথমদিন থেকেই। সব কাজ ঝেরে ফেলা যেন দ্রুত মার্কেটে ছুটে যাওয়া, সকল ক্লান্তির অবসান আর কিছু সময়ের জন্য উল্লাসে মেতে থাকার জন্য এ রকমভাবেই চলবে নবীনদের ক্লাস ও ব্যস্ততা। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ধারাবাহিক আর ব্যবহারিক ক্লাস। ব্যবহারিক খাতা তৈরি, এসাইনমেন্টের কাজ, ক্লাস টেস্ট পরীক্ষা নয়ত সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। সারাদিনের ব্যস্ততম সময় এভাবেই পার করে কৃষি শিক্ষার অন্যতম বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা। তারপরও শত ব্যস্ততার মাঝে একটু সময় বের করে প্রাণের বন্ধুদের সঙ্গে মনের কথা খুলে বলার জন্য আড্ডায় যোগ দিতে কারও কার্পণ্য থাকে না। এভাবেই কাটবে প্রতিদিনের নবীনদের জীবন এবং তাদের পদচারণায় ক্যাম্পাস মুখরিত ও নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে।
২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিকৃত ভেটেরিনারি অনুষদের ছাত্র মাহাদি হাসান বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নতুন অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে বলে, আগে কখনও বাড়ির বাইরে নিজের পরিবার ছাড়া কখনও থাকিনি। প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগত কিন্তু বন্ধু-বান্ধব আর বড় ভাইদের সঙ্গে মিশে খারাপ লাগাটা কেটে গেছে। এক কথায় বলতে গেলে জীবনের সবচেয়ে অন্যতম একটি অভিজ্ঞতা হলো বিশ্বদ্যিালয়ের হল জীবন।
কৃষি অনুষদের নবীন ছাত্র শুভ্র সূত্রধর বলে, আমি সত্যিই খুব গর্বিত যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কৃষি শিক্ষার সর্ববৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। ভর্তি পরীক্ষা দিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি, কিন্তু এত বড় আরও সবুজে ঘেরা ছায়া-সুনিবিড় প্রাকৃতিক ক্যাম্পাস আর কোথাও পাইনি। জীবনানন্দের কবিতার বর্ণনার সঙ্গে মিল রেখে বলতে চাই আমাদের ক্যাম্পাস নৈসর্গিক এক নিভৃত পল্লী। মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের নবীন ছাত্রী সানজিদা আক্তার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নিজেকে বন্ধনহীন পাখির মতো উন্মুক্ত মনে হচ্ছে। বাসায় কখনও রান্না করিনি। এখানে এসে বড় আপুদের দেখে রান্না করা শুরু করেছি। আগে কখনও একা বাড়ির বাইরে যায়নি, এখানে একা একা বাইরে যাই নিজের বাজার নিজে করি, নিজেকে আজ স্বয়ংসম্পূর্ণা মনে হচ্ছে। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মৃতি আমার জীবন থেকে কখনও বিস্মৃত হবে না।
অমিত মালাকার
No comments