নাগরিক হওয়ার আগেই জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া কতটা যৌক্তিক? by ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন মুসা
এক. প্রত্যেক মানুষের জন্ম ঘটে প্রকৃতির একই নিয়মে। তাকে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে মানুষ হয়ে উঠতে হয়। সমাজের একজন হিসেবে সে প্রথমে স্থানীয় পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। তবে সেই পরিবেশ কেমন হবে, তা নির্ভর করে স্থানীয় শাসনের ওপর।
অর্থাৎ স্থানীয় সরকার জনগণকে নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে। ইউরোপের দেশগুলোয় স্থানীয় শাসন থেকে জাতীয় শাসনের উদ্ভব ঘটায় সেখানকার অধিবাসীদের কথায় ও কাজে সুনাগরিকতার আধিক্য লক্ষ করা যায়। একই কারণে সেখানকার জাতীয় সমস্যাগুলো গণতান্ত্রিক উপায়ে সহজ পথে সমাধান হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ঠিক সেটির বিপরীত চিত্র দেখা যায়। অবশ্য এর পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। অতীতে এ দেশে বারবার বহিঃশক্তির আক্রমণ ঘটেছে। জাতীয় শাসন রক্ষায় শাসকরা ব্যস্ত থাকায় স্থানীয় শাসনের সঙ্গে কেন্দ্রের সম্পর্ক সেভাবে গড়ে ওঠেনি। অর্থাৎ স্বাভাবিক নিয়মে এ দেশে জাতীয় শাসন আসেনি। জাতীয় শাসনের জন্য আমাদের ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বাধীন দেশের শাসকরা নাগরিক তৈরির জন্য স্থানীয় সরকারকে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে মনোযোগী হননি। তাঁরা জাতীয় শাসনের নামে সব কিছুকে কেন্দ্রীভূত করতে সচেষ্ট ছিলেন এবং এখনো আছেন। ফলে এ দেশের শতভাগ লোককে সব সময় জাতীয় সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা যায়। অনেক সময় তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সময় কাটায় একই কারণে বিভিন্ন দাবিতে প্রচারিত পোস্টারে জাতীয় নেতারা ও তাঁদের উত্তরাধিকারীদের ছবির সঙ্গে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ছবি দেখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এভাবে স্থানীয় জনগণকে জাতীয় রাজনীতিতে বিভাজিত করে লাভবান হচ্ছেন কারা?
দুই. সম্প্রতি বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের সঙ্গে বেলজিয়ামে বসবাসরত আইনজীবী ড. আহমদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ সংলাপ নিয়ে রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। কিন্তু ড. আহমদ জিয়াউদ্দিন আলোচনার প্রায় শুরুতে যে কথাটি বলেছেন সেটি নিয়ে কাউকে মতামত দিতে দেখা যায়নি। তিনি বলেন, 'বেলজিয়ামের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট দেওয়া কম্পালসরি। কম্পালসরি বলেই সেখানে সবাইকে ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়, না হলে মানুষ ভোট দিতে যেত না। ... স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মানুষের ইন্টারেস্ট থাকে বেশি। কারণ, এটা লোকাল গভর্নমেন্ট তো। এখানে রাস্তাঘাটের প্ল্যানিং থেকে শুরু করে সার্ভিস-টার্ভিস সবই প্রোভাইড করে লোকাল গভর্নমেন্ট।' (আমার দেশ, ৯ ডিসেম্বর '১২)। শুধু তাঁর মুখে কেন, ইউরোপ ভ্রমণকারী এ দেশের বহু লেখক-বুদ্ধিজীবীর মুখে শোনা গেছে- 'সেখানকার সবাই চমৎকার মানুষ। সবাই শৃঙ্খলা মেনে চলে। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে না। নিজ দায়িত্বে পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করে চলে।' তবে এসব ভ্রমণকারী কোনো সমাধানের কথা না বলে নিজ দেশ সম্পর্কে কেবল বিরূপ মন্তব্য করে থাকেন। সেখানে স্থানীয় কাজগুলো স্থানীয় সরকারের জন্য নির্দিষ্ট করা আছে এবং দীর্ঘকাল আগে থেকে স্থানীয় সরকারগুলো আলাদা সরকার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ইংল্যান্ডের ভোটাররা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রায় শতভাগ ভোট দিলেও জাতীয় নির্বাচনে সে হারে ভোট দেন না। তাঁদের মত হলো, স্থানীয় সরকারগুলো তাঁদের সব ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। কিন্তু জাতীয় সরকার বৈশ্বিক বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাঁটিতে ব্যস্ত থাকে। এর মানে এই নয়, ভোটাররা জাতীয় সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামান না।
তাঁরা স্থানীয় কাজে দক্ষতা অর্জনকারী ব্যক্তিদের বাছাই করে জাতীয় কাজ করার জন্য পাঠান। জাতীয় নেতারাও জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজে তাঁদের অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান। শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকও প্রথম জীবনে মেয়র পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে এই ধারা গত কয়েক দশকে তিরোহিত হওয়ার পথে। ইদানীং ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও কেন্দ্রীভূত রাজনীতির চর্চা এত বেশি হচ্ছে যে এটির প্রাধান্য অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে কেউ তৃণমূলের নেতা দাবি করে গর্ব করবেন কি না সন্দেহ রয়েছে।
তিন. প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত বিশ্বজিৎকে নিয়ে 'প্রথম আলো' পত্রিকার অনলাইনের পাঠক শপথ গুহ লিখেছেন- ' ঢাকার জজ কোর্ট এলাকা। হঠাৎ একটি ছেলেকে কোপাতে শুরু করল কয়েকজন। পাশ দিয়ে যাওয়া ব্যাংকের ক্যাশিয়ার রিকশা থেকে নেমে হাত চেপে ধরলেন চাপাতি হাতের ছেলেটির। চায়ের দোকানে উৎসুক লোকগুলো চেপে ধরল অন্য আরেকজনের হাত। ছবি তুলতে থাকা সাংবাদিকরা হাতের ক্যামেরা ফেলে বিশ্বজিৎকে আড়াল করলেন তিন-চারটা রডের সামনে থেকে। দুজন পুলিশ দৌড়ে এসে কলার চেপে ধরল চাপাতি হাতের ছেলেগুলোর, লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করল রডধরা হাতের ওপর, ফুটপাতের চাওয়ালা তাঁর ছেলেকে নিয়ে বিশ্বজিৎ নামের ছেলেটির দিকে এগোলেন, কোপানোর ক্ষতগুলো হাত দিয়ে চেপে ধরলেন। ...রিকশাওয়ালা প্রচণ্ড গতিতে ছুটলেন মেডিক্যালের দিকে। ...বেঁচে গেলেন বিশ্বজিৎ।' (রস আলো, ১৭ ডিসেম্বর '১২)। কলাম লেখক সোহরাব হাসান 'রাষ্ট্র কার : বিশ্বজিৎ না বিকাশদের?' শীর্ষক এক কলামে বলেছেন, 'এই চিঠি ছিল শপথ গুহের কল্পনা। সেই কল্পনা বাস্তব হলে বাংলাদেশ একটি আদর্শ ও সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র হতে পারত।' (প্রথম আলো, ১৯ ডিসেম্বর '১২)। এটি কল্পনা হবে কেন! এ দেশে এ-জাতীয় ঘটনা বাস্তবিকই ছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে, কলাম লেখক সোহরাব হাসান গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে 'স্থানীয় সরকার সর্বরোগহারী বটিকা নহে' শীর্ষক একটি কলামে স্থানীয় সরকার আন্দোলনকে তুচ্ছ করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
চার. কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা বহাল থাকার কারণে ছাত্রসংগঠন, শ্রমিক-সংগঠনসহ অন্য অঙ্গসংগঠন নিজস্বতা হারিয়েছে বহু আগেই। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের লাঠিয়াল হতে ও লাঠিয়াল থাকতে আগ্রহী হয়ে থাকে। বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার বিবেচনায় জনৈক গবেষক আমাদের বলেছেন, 'বর্তমানে দেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেশ স্বাধীনতার পক্ষে ও বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এখন স্থানীয় সরকার নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই।' এর আগে বর্তমান সরকারের শুরুতে জনৈক এমপি আমাদের বলেছিলেন, 'আগে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার সম্পন্ন করা হবে। তারপর স্থানীয় সরকার কার্যকর করার কথা চিন্তা করা যাবে।' তাঁদের উদ্দেশে বলা আবশ্যক, গণতান্ত্রিক শাসনের মধ্যে কি বঙ্গবন্ধু হত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যবস্থা নেই? গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এ-জাতীয় অপরাধের বিচারের জন্য কি গণতন্ত্র বিনির্মাণের কাজ বন্ধ রাখে? তাঁদের কাছে আরো প্রশ্ন ছিল, যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন হওয়ার পর তাঁরা আর কী কী ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করবেন, কিংবা কী কী উপায়ে গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করবেন? দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ আমাদের জানা রয়েছে, স্থানীয় জনগণ ক্ষমতায়িত হওয়া মানে গণতন্ত্র ভিত্তিমূল পাওয়া। আবার জনগণ ক্ষমতায়িত হওয়া মানে মৌলবাদী চেতনা দূরীভূত হওয়া। আগে তৃণমূলের নাগরিক সমাজের উদ্যোগে অসাম্প্রদায়িকতার একটা চর্চা চালু ছিল। কালক্রমে সেটি আরো গণতান্ত্রিক হওয়ার পরিবর্তে বরং সাম্প্র্রদায়িক হওয়ার দিকে যাচ্ছে। এখন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় এজেন্টদের তৎপরতার কাছে স্থানীয় নাগরিক সমাজ প্রায় ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করে। বস্তুতপক্ষে এর পেছনে ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসা কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থাই দায়ী।
পাঁচ. সব দিক বিবেচনা করে সিডিএলজি মনে করে, দুই প্রকারের সরকারব্যবস্থা তথা 'কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা' ও 'স্থানীয় সরকারব্যবস্থা'- এ দুই ধারায় সরকারব্যবস্থাকে বিন্যস্ত করে স্থায়ী সমাধান পাওয়া সম্ভব। জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজগুলো জাতীয় সরকারের জন্য এবং স্থানীয় কাজগুলো স্থানীয় সরকারের জন্য নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। অব্যাহত নগরায়ণের চিন্তাকে সামনে রেখে স্থানীয় সরকারগুলোর স্তরবিন্যাস করে উচ্চতম ইউনিট ও নিম্নতম ইউনিট বিবেচনা করে স্থানীয় সরকারগুলোকে সাজালে সেটি হবে বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। সেই সঙ্গে প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটে 'সরকার কাঠামো' প্রতিস্থাপন করে (তথা ইউনিয়ন সরকার, জেলা সরকার, নগর সরকার ইত্যাদি) প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিয়ে এর পরিচালনার ভার স্থানীয় লোকজনের হাতে ছেড়ে দিলে গণতন্ত্র ধীরে ধীরে তৃণমূলে ভিত্তি অর্জন করবে। সে রকম ব্যবস্থা গৃহীত হলে আমাদের দেশের তৃণমূলের বাসিন্দারাও সমান সুবিধা ও মর্যাদা লাভ করবে এবং নাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে শুরু করবে। তখন জাতীয় স্তরের রাজনীতি ও শাসনের বিষয়টি নাগরিকদের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে পড়বে।
লেখকবৃন্দ : চেয়ারম্যান, জানিপপ; রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বিসিএস শিক্ষা; এবং সদস্য, সিডিএলজি
janipop1995@gmail.com
দুই. সম্প্রতি বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের সঙ্গে বেলজিয়ামে বসবাসরত আইনজীবী ড. আহমদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ সংলাপ নিয়ে রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। কিন্তু ড. আহমদ জিয়াউদ্দিন আলোচনার প্রায় শুরুতে যে কথাটি বলেছেন সেটি নিয়ে কাউকে মতামত দিতে দেখা যায়নি। তিনি বলেন, 'বেলজিয়ামের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট দেওয়া কম্পালসরি। কম্পালসরি বলেই সেখানে সবাইকে ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়, না হলে মানুষ ভোট দিতে যেত না। ... স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মানুষের ইন্টারেস্ট থাকে বেশি। কারণ, এটা লোকাল গভর্নমেন্ট তো। এখানে রাস্তাঘাটের প্ল্যানিং থেকে শুরু করে সার্ভিস-টার্ভিস সবই প্রোভাইড করে লোকাল গভর্নমেন্ট।' (আমার দেশ, ৯ ডিসেম্বর '১২)। শুধু তাঁর মুখে কেন, ইউরোপ ভ্রমণকারী এ দেশের বহু লেখক-বুদ্ধিজীবীর মুখে শোনা গেছে- 'সেখানকার সবাই চমৎকার মানুষ। সবাই শৃঙ্খলা মেনে চলে। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে না। নিজ দায়িত্বে পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করে চলে।' তবে এসব ভ্রমণকারী কোনো সমাধানের কথা না বলে নিজ দেশ সম্পর্কে কেবল বিরূপ মন্তব্য করে থাকেন। সেখানে স্থানীয় কাজগুলো স্থানীয় সরকারের জন্য নির্দিষ্ট করা আছে এবং দীর্ঘকাল আগে থেকে স্থানীয় সরকারগুলো আলাদা সরকার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ইংল্যান্ডের ভোটাররা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রায় শতভাগ ভোট দিলেও জাতীয় নির্বাচনে সে হারে ভোট দেন না। তাঁদের মত হলো, স্থানীয় সরকারগুলো তাঁদের সব ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। কিন্তু জাতীয় সরকার বৈশ্বিক বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাঁটিতে ব্যস্ত থাকে। এর মানে এই নয়, ভোটাররা জাতীয় সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামান না।
তাঁরা স্থানীয় কাজে দক্ষতা অর্জনকারী ব্যক্তিদের বাছাই করে জাতীয় কাজ করার জন্য পাঠান। জাতীয় নেতারাও জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজে তাঁদের অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান। শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকও প্রথম জীবনে মেয়র পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে এই ধারা গত কয়েক দশকে তিরোহিত হওয়ার পথে। ইদানীং ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও কেন্দ্রীভূত রাজনীতির চর্চা এত বেশি হচ্ছে যে এটির প্রাধান্য অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে কেউ তৃণমূলের নেতা দাবি করে গর্ব করবেন কি না সন্দেহ রয়েছে।
তিন. প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত বিশ্বজিৎকে নিয়ে 'প্রথম আলো' পত্রিকার অনলাইনের পাঠক শপথ গুহ লিখেছেন- ' ঢাকার জজ কোর্ট এলাকা। হঠাৎ একটি ছেলেকে কোপাতে শুরু করল কয়েকজন। পাশ দিয়ে যাওয়া ব্যাংকের ক্যাশিয়ার রিকশা থেকে নেমে হাত চেপে ধরলেন চাপাতি হাতের ছেলেটির। চায়ের দোকানে উৎসুক লোকগুলো চেপে ধরল অন্য আরেকজনের হাত। ছবি তুলতে থাকা সাংবাদিকরা হাতের ক্যামেরা ফেলে বিশ্বজিৎকে আড়াল করলেন তিন-চারটা রডের সামনে থেকে। দুজন পুলিশ দৌড়ে এসে কলার চেপে ধরল চাপাতি হাতের ছেলেগুলোর, লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করল রডধরা হাতের ওপর, ফুটপাতের চাওয়ালা তাঁর ছেলেকে নিয়ে বিশ্বজিৎ নামের ছেলেটির দিকে এগোলেন, কোপানোর ক্ষতগুলো হাত দিয়ে চেপে ধরলেন। ...রিকশাওয়ালা প্রচণ্ড গতিতে ছুটলেন মেডিক্যালের দিকে। ...বেঁচে গেলেন বিশ্বজিৎ।' (রস আলো, ১৭ ডিসেম্বর '১২)। কলাম লেখক সোহরাব হাসান 'রাষ্ট্র কার : বিশ্বজিৎ না বিকাশদের?' শীর্ষক এক কলামে বলেছেন, 'এই চিঠি ছিল শপথ গুহের কল্পনা। সেই কল্পনা বাস্তব হলে বাংলাদেশ একটি আদর্শ ও সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপদ রাষ্ট্র হতে পারত।' (প্রথম আলো, ১৯ ডিসেম্বর '১২)। এটি কল্পনা হবে কেন! এ দেশে এ-জাতীয় ঘটনা বাস্তবিকই ছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে, কলাম লেখক সোহরাব হাসান গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে 'স্থানীয় সরকার সর্বরোগহারী বটিকা নহে' শীর্ষক একটি কলামে স্থানীয় সরকার আন্দোলনকে তুচ্ছ করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
চার. কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা বহাল থাকার কারণে ছাত্রসংগঠন, শ্রমিক-সংগঠনসহ অন্য অঙ্গসংগঠন নিজস্বতা হারিয়েছে বহু আগেই। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের লাঠিয়াল হতে ও লাঠিয়াল থাকতে আগ্রহী হয়ে থাকে। বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার বিবেচনায় জনৈক গবেষক আমাদের বলেছেন, 'বর্তমানে দেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেশ স্বাধীনতার পক্ষে ও বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এখন স্থানীয় সরকার নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই।' এর আগে বর্তমান সরকারের শুরুতে জনৈক এমপি আমাদের বলেছিলেন, 'আগে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার সম্পন্ন করা হবে। তারপর স্থানীয় সরকার কার্যকর করার কথা চিন্তা করা যাবে।' তাঁদের উদ্দেশে বলা আবশ্যক, গণতান্ত্রিক শাসনের মধ্যে কি বঙ্গবন্ধু হত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যবস্থা নেই? গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এ-জাতীয় অপরাধের বিচারের জন্য কি গণতন্ত্র বিনির্মাণের কাজ বন্ধ রাখে? তাঁদের কাছে আরো প্রশ্ন ছিল, যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন হওয়ার পর তাঁরা আর কী কী ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করবেন, কিংবা কী কী উপায়ে গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করবেন? দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ আমাদের জানা রয়েছে, স্থানীয় জনগণ ক্ষমতায়িত হওয়া মানে গণতন্ত্র ভিত্তিমূল পাওয়া। আবার জনগণ ক্ষমতায়িত হওয়া মানে মৌলবাদী চেতনা দূরীভূত হওয়া। আগে তৃণমূলের নাগরিক সমাজের উদ্যোগে অসাম্প্রদায়িকতার একটা চর্চা চালু ছিল। কালক্রমে সেটি আরো গণতান্ত্রিক হওয়ার পরিবর্তে বরং সাম্প্র্রদায়িক হওয়ার দিকে যাচ্ছে। এখন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় এজেন্টদের তৎপরতার কাছে স্থানীয় নাগরিক সমাজ প্রায় ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করে। বস্তুতপক্ষে এর পেছনে ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসা কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থাই দায়ী।
পাঁচ. সব দিক বিবেচনা করে সিডিএলজি মনে করে, দুই প্রকারের সরকারব্যবস্থা তথা 'কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থা' ও 'স্থানীয় সরকারব্যবস্থা'- এ দুই ধারায় সরকারব্যবস্থাকে বিন্যস্ত করে স্থায়ী সমাধান পাওয়া সম্ভব। জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজগুলো জাতীয় সরকারের জন্য এবং স্থানীয় কাজগুলো স্থানীয় সরকারের জন্য নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। অব্যাহত নগরায়ণের চিন্তাকে সামনে রেখে স্থানীয় সরকারগুলোর স্তরবিন্যাস করে উচ্চতম ইউনিট ও নিম্নতম ইউনিট বিবেচনা করে স্থানীয় সরকারগুলোকে সাজালে সেটি হবে বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। সেই সঙ্গে প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটে 'সরকার কাঠামো' প্রতিস্থাপন করে (তথা ইউনিয়ন সরকার, জেলা সরকার, নগর সরকার ইত্যাদি) প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিয়ে এর পরিচালনার ভার স্থানীয় লোকজনের হাতে ছেড়ে দিলে গণতন্ত্র ধীরে ধীরে তৃণমূলে ভিত্তি অর্জন করবে। সে রকম ব্যবস্থা গৃহীত হলে আমাদের দেশের তৃণমূলের বাসিন্দারাও সমান সুবিধা ও মর্যাদা লাভ করবে এবং নাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে শুরু করবে। তখন জাতীয় স্তরের রাজনীতি ও শাসনের বিষয়টি নাগরিকদের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে পড়বে।
লেখকবৃন্দ : চেয়ারম্যান, জানিপপ; রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বিসিএস শিক্ষা; এবং সদস্য, সিডিএলজি
janipop1995@gmail.com
No comments