রাজনীতি-মাইনাস নয়, এবার পল্গাস... by অনিরুদ্ধ আহমেদ
অঙ্কে যোগ ও বিয়োগ বোধকরি সবচেয়ে সোজা হিসাব। তবে এর মধ্যে যোগটাই আমার কাছে সবচেয়ে পছন্দের প্রধানত দুটি কারণে; প্রথমত, যোগ হচ্ছে বিয়োগের চেয়ে সহজতর।
দ্বিতীয়ত, যদি দার্শনিকভাবে ব্যাখ্যা করি তা হলে বলতেই হবে যে, যোগের মধ্যে একটি ইতিবাচক দিক আছে, আছে বর্ধিষুষ্ণ ভাবও। গত কয়েক বছর ধরেই রাজনীতিতে বিয়োগের কথা শুনে আসছি। ইংরেজিতে বহুল ব্যবহৃত মাইনাস শব্দটি শুনে আসছি সেই বিগত সামরিক সরকার সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের সময় থেকেই। দুটি প্রধান দলের শীর্ষ নেত্রী, যাদের পশ্চিমের কোনো কোনো পত্রিকায় 'দ্য ব্যাটলিং বেগামস' বলে অভিহিত করা হয়েছে, তাদের জন্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করাটাই বোধহয় এই মাইনাস টু সূত্রের প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল। কিন্তু না, সেই সময়কার সামরিক সরকার কিংবা কথিত সংস্কারবাদীরা কেউই বিয়োগের সূত্রটি প্রয়োগ করতে সমর্থ হননি। তাদের এই ব্যর্থতা দুই নেত্রীকে করেছে আরও শক্তিশালী ও নিরাপদ। রাজনীতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে তাদের প্রতিদিনকার জীবন, ক্ষমতা এবং ক্ষমতার বাইরেও। তবে এখনও যেন শঙ্কামুক্ত নন দু'জনের কেউই। এই মাইনাস টুর প্রেতাত্মা এখনও তাড়িত করছে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী নেতা দু'জনকেই। এই তো কয়েকদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া তার ভাষণে আবারও হুশিয়ার করে দিলেন বিরোধী নেতা খালেদা জিয়াকে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাইলে আবার মাইনাস টুর দিকে দেশ চলে যাবে, আবারও কোনো অশুভ শক্তি হাসিনা-খালেদাকে পরিহার করে রাজনীতি শুরু করার চেষ্টা করবে। খালেদা জিয়াও সমান তটস্থ মাইনাস টু বিষয়টি নিয়ে। বিপরীত দিক দিয়ে তার যুক্তি হলো যে, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি, মহাজোট সরকার মেনে না নিলে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অগণতান্ত্রিক সরকার আবারও ক্ষমতায় আসবে এবং মাইনাস টু ফর্মুলা কার্যকর করবে। অতএব, এই মাইনাস টু হচ্ছে দুই নেত্রীরই শিরঃপীড়ার কারণ।
তবে এই বিয়োগ কেন, আসুন না যোগের কথা বলি আমরা। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া কিংবা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যিনিই হোন না কেন, তারা তো মাইনাসের কথা না বলে পল্গাসের কথা বলতে পারেন। বলতেই পারেন যে তাদের দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন নেতৃত্ব যুক্ত হবে রাজনীতির শীর্ষ ক্ষেত্রে। সেটা তো মাইনাস নয়, পল্গাসই বটে। বিয়োগের মতো বেদনাবিধুর ব্যাপার নয়, সৃজনশীল যোগের বিষয়। আমার তো মনে হয়, যারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্বের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা দেখতে চান, তারা মাইনাস নয়, পল্গাসের পক্ষের মানুষ। কারণ, কে কবে, কখন কার স্থলাভিষিক্ত হবেন, নেতা হিসাবে সেটা আগে থেকে অঙ্ক কষে ঠিক করা সম্ভব নয়। স্থান-কাল-পাত্রই সেটা ঠিক করবে। তবে কাজের মধ্য দিয়ে এক ধরনের প্রস্তুতির প্রয়োজন তো আছে বৈ কি। সে জন্য মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন-ইয়াজুদ্দিনদের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন চলমান নেতৃত্বের চৌকস বুদ্ধির। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ইংরেজিতে যাকে গ্রুমিং বলা হয়, সে রকম পূর্বপ্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে না কোনো দলের তরুণ নেতৃত্বকে। এই তো কয়েকদিন আগেই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়ে গেল, কই দলে তরুণ নেতৃত্ব যুক্ত করার কোনো প্রয়াসই লক্ষ্য করা যায়নি। শেখ হাসিনার পরে (তা সে যতই পরে হোক) নেতৃত্বের সারিতে এখনও যারা রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই হাসিনার চেয়ে বয়সে হয়তো বড়ই হবেন, ছোট তেমন কাউকে দেখছি না। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তো দলের নেতৃত্বে এসেছিলেন, আরও অনেক অল্প বয়সে। একটি জাতিকে জাতিরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করে, দেশের প্রশাসন পরিচালনা করে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে শেখ মুজিব নিহত হন।
ওই হিসাবটার দিকে নজর রাখলে বলতে বাধা নেই যে, এখনকার আওয়ামী নেতৃত্ব এ ব্যাপারে অনেক বেশি রক্ষণশীল। তারা তো নিয়ে আসতে পারতেন, সম্ভাবনাময় তরুণ নেতৃত্বকে। মাইনাস নয়, পল্গাস পয়েন্ট হয়ে থাকত সেটা দলের রাজনীতিতে। একই কথা প্রযোজ্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ক্ষেত্রেও। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব আসার অল্প পরেই খালেদা জিয়াও বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনিও দলের হাল ধরে রেখেছেন। কিন্তু এরপর তরুণ নেতৃত্ব কই? তার পরবর্তী সারির নেতা-নেত্রীদের অধিকাংশই, বয়সে তার বড়, চিন্তা-চেতনায় যেন আরও সেকেলে, পরিবর্তনশীল বিশ্বকে উপলব্ধি করতে অপারগ তারা। সত্য বটে, তারুণ্য কেবল বয়সের বিষয় নয়, চিন্তা-চেতনার বিষয়ও বটে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির বিজয়ের পর বলা হয়েছিল, বিএনপি হচ্ছে দ্য চয়েস অব নিউ জেনারেশন। জনসাধারণ আশান্বিত হয়েছিল যে, এই নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশকে সত্যিই নতুন কিছু দেবে। কিন্তু বিএনপির সেই সময়কার তরুণ নেতৃত্ব দেশকে বস্তুত সন্ত্রাস ও দুর্নীতি ছাড়া কিছুই দিতে পারল না। তারেক রহমান কেবল যে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়, তাই-ই নয়, সেই তারুণ্য গোটা দেশকে এক মৌলবাদী সন্ত্রাসের দিকে নিয়ে গিয়েছিল এবং তারেক তার সকল তারুণ্য সত্ত্বেও বিগলিত চিত্তে মতিউর রহমান নিজামীর পাশে বসে বলেছিলেন, বিএনপি ও জামায়াত একই পরিবারের সদস্য। নিজের তারুণ্যকে নিজেই যেন বিদ্রূপ করেছিলেন তারেক সেদিন। যখন নিজামী ও মুজাহিদকে বিএনপির মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হলো, তখন আরেকবার দ্য চয়েস অব নিউ জেনারেশন এই বাক্যাংশটি পরিহাসের মতো শোনাল। আওয়ামী লীগও একই ধরনের ভুলের মধ্যে রীতিমতো পরিবৃত রয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল, তখন মন্ত্রিসভার সিংহ ভাগ তরুণ এবং নতুন সে বিষয়টি দেখে দেশ আশান্বিত হয়েছিল। মনে হয়েছিল যে, দিনবদলের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শেখ হাসিনা তারুণ্যকে, নতুন মুখকে স্থান দিয়েছেন তার মন্ত্রিসভায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও দিনবদলের প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। অপেক্ষাকৃত তরুণ মন্ত্রী আবুল হোসেন (যিনি আওয়ামী লীগের পূর্বতন মন্ত্রিসভায় ও প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন) এবং সম্ভবত হাসিনাও আশা করেছিলেন যে, তার কাছ থেকে নতুন কিছু পাওয়া যাবে, তাকে বড় রকমের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সরে দাঁড়াতে হলো। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ মন্ত্রীই তাদের চৌকস বিদ্যাবুদ্ধি সত্ত্বেও দিনবদলের দিকে এগোতে পারেননি। এ জন্য মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যরা দায়ী, তেমন ঢালাও অপবাদ বোধহয় ঠিক নয়; কিন্তু তারা কাজ করতে পারেননি, সেই গতিশীলতার সঙ্গে যেমনটি প্রত্যাশা ছিল সকলের। কেউ কেউ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে মাথাভারি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছিলেন তার সরকারের কার্যক্রম বাস্তবায়িত করার জন্য, তারাই এ ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং বলাবাহুল্য একাধিক উপদেষ্টা যে দুর্নীতিমুক্ত নন, সে রকম অভিযোগও উঠে আসছে। সুতরাং দিনবদলের স্বপ্ন আর বুঝি সত্যে পরিণত হলো না, বাংলাদেশ সেই পুরনো দিনগুলোর আবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাফল্য সত্ত্বেও দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নামের এ দুটি কাঠ-পিঁপড়ে লাভের গুড় নিজেরাই খেয়ে নিচ্ছে। সুতরাং দিনবদল পঞ্জিকার পাতায় ঘটলেও বাংলাদেশে দিন যেন আর এগোতে চায় না।
সে জন্যই বলছিলাম হাসিনা-খালেদা কি চেষ্টা করবেন নতুন নেতৃত্বকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সামনের দিকে নিয়ে আসতে, সেটি মাইনাস নয়, তাদের পল্গাস টু কিংবা পল্গাস অনেক নীতি হতে পারে। এই নেতৃত্ব যে পরিবারের ভেতর থেকেই আসতে হবে এমন কোনো কথা নেই। দুঃখের কথা এই যে, তরুণ নেতৃত্ব উঠে আসার একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে পচন ধরেছে এখন। ছাত্রলীগই বলুন কিংবা ছাত্রদলই বলুন, তাদের নৃশংস তাণ্ডব আমরা দেখেছি বারবার। এক সময়ে ছাত্র নেতৃত্ব থেকেই আসত জাতীয় নেতৃত্ব। সেই উৎসটা এখন শুকিয়ে গেছে। তবু রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্ব আসতেই হবে। মাইনাস টু আতঙ্কে পল্গাস টু হবে না, এমনটি ভাবা আত্মঘাতী হবে, ব্যক্তি ও দল উভয়ের জন্যই।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দলের খুব দুঃসময়ে দলের হাল ধরেছিলেন। আজ যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অখণ্ডিত ও শক্তিশালী রাজনৈতিক দল, তার প্রায় সিংহভাগ কৃতিত্বই শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার। তারা তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, এতদিনে নিশ্চয়ই তাদের দল সাবালক হয়েছে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। এখন নিশ্চয়ই দুই নেত্রীই দেখতে চাইবেন যে, তাদের নিজেদের হাতে পুনর্গঠিত দল থেকে উঠে আসছে এমন সব নবীন প্রতিভা, যারা নতুন প্রজন্মের পছন্দের মানুষ হবে, হবে দিনবদলের কারিগর। পুরনো দিনের চেতনায় আবিষ্ট মানুষ দিয়ে নতুন দিনের সূচনা করা যায় না। রাজনীতি কেবল অতীত নস্টালজিয়ার বিষয় নয়, সামনে এগিয়ে চলার বিষয়ও। তাই আসুন, মাইনাস নয়, পল্গাস নিয়ে হোক আমাদের ভাবনা আর রাজনীতিতে এই পল্গাসের তত্ত্বটা তারাই বাস্তবায়ন করতে পারেন, যারা মাইনাস নিয়ে উদ্বিগ্ন।
অনিরুদ্ধ আহমেদ : যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী সাংবাদিক ও নিবন্ধকার
তবে এই বিয়োগ কেন, আসুন না যোগের কথা বলি আমরা। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া কিংবা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যিনিই হোন না কেন, তারা তো মাইনাসের কথা না বলে পল্গাসের কথা বলতে পারেন। বলতেই পারেন যে তাদের দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন নেতৃত্ব যুক্ত হবে রাজনীতির শীর্ষ ক্ষেত্রে। সেটা তো মাইনাস নয়, পল্গাসই বটে। বিয়োগের মতো বেদনাবিধুর ব্যাপার নয়, সৃজনশীল যোগের বিষয়। আমার তো মনে হয়, যারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্বের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা দেখতে চান, তারা মাইনাস নয়, পল্গাসের পক্ষের মানুষ। কারণ, কে কবে, কখন কার স্থলাভিষিক্ত হবেন, নেতা হিসাবে সেটা আগে থেকে অঙ্ক কষে ঠিক করা সম্ভব নয়। স্থান-কাল-পাত্রই সেটা ঠিক করবে। তবে কাজের মধ্য দিয়ে এক ধরনের প্রস্তুতির প্রয়োজন তো আছে বৈ কি। সে জন্য মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন-ইয়াজুদ্দিনদের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন চলমান নেতৃত্বের চৌকস বুদ্ধির। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ইংরেজিতে যাকে গ্রুমিং বলা হয়, সে রকম পূর্বপ্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে না কোনো দলের তরুণ নেতৃত্বকে। এই তো কয়েকদিন আগেই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়ে গেল, কই দলে তরুণ নেতৃত্ব যুক্ত করার কোনো প্রয়াসই লক্ষ্য করা যায়নি। শেখ হাসিনার পরে (তা সে যতই পরে হোক) নেতৃত্বের সারিতে এখনও যারা রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই হাসিনার চেয়ে বয়সে হয়তো বড়ই হবেন, ছোট তেমন কাউকে দেখছি না। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তো দলের নেতৃত্বে এসেছিলেন, আরও অনেক অল্প বয়সে। একটি জাতিকে জাতিরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করে, দেশের প্রশাসন পরিচালনা করে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে শেখ মুজিব নিহত হন।
ওই হিসাবটার দিকে নজর রাখলে বলতে বাধা নেই যে, এখনকার আওয়ামী নেতৃত্ব এ ব্যাপারে অনেক বেশি রক্ষণশীল। তারা তো নিয়ে আসতে পারতেন, সম্ভাবনাময় তরুণ নেতৃত্বকে। মাইনাস নয়, পল্গাস পয়েন্ট হয়ে থাকত সেটা দলের রাজনীতিতে। একই কথা প্রযোজ্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ক্ষেত্রেও। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব আসার অল্প পরেই খালেদা জিয়াও বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনিও দলের হাল ধরে রেখেছেন। কিন্তু এরপর তরুণ নেতৃত্ব কই? তার পরবর্তী সারির নেতা-নেত্রীদের অধিকাংশই, বয়সে তার বড়, চিন্তা-চেতনায় যেন আরও সেকেলে, পরিবর্তনশীল বিশ্বকে উপলব্ধি করতে অপারগ তারা। সত্য বটে, তারুণ্য কেবল বয়সের বিষয় নয়, চিন্তা-চেতনার বিষয়ও বটে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির বিজয়ের পর বলা হয়েছিল, বিএনপি হচ্ছে দ্য চয়েস অব নিউ জেনারেশন। জনসাধারণ আশান্বিত হয়েছিল যে, এই নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশকে সত্যিই নতুন কিছু দেবে। কিন্তু বিএনপির সেই সময়কার তরুণ নেতৃত্ব দেশকে বস্তুত সন্ত্রাস ও দুর্নীতি ছাড়া কিছুই দিতে পারল না। তারেক রহমান কেবল যে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়, তাই-ই নয়, সেই তারুণ্য গোটা দেশকে এক মৌলবাদী সন্ত্রাসের দিকে নিয়ে গিয়েছিল এবং তারেক তার সকল তারুণ্য সত্ত্বেও বিগলিত চিত্তে মতিউর রহমান নিজামীর পাশে বসে বলেছিলেন, বিএনপি ও জামায়াত একই পরিবারের সদস্য। নিজের তারুণ্যকে নিজেই যেন বিদ্রূপ করেছিলেন তারেক সেদিন। যখন নিজামী ও মুজাহিদকে বিএনপির মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হলো, তখন আরেকবার দ্য চয়েস অব নিউ জেনারেশন এই বাক্যাংশটি পরিহাসের মতো শোনাল। আওয়ামী লীগও একই ধরনের ভুলের মধ্যে রীতিমতো পরিবৃত রয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল, তখন মন্ত্রিসভার সিংহ ভাগ তরুণ এবং নতুন সে বিষয়টি দেখে দেশ আশান্বিত হয়েছিল। মনে হয়েছিল যে, দিনবদলের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শেখ হাসিনা তারুণ্যকে, নতুন মুখকে স্থান দিয়েছেন তার মন্ত্রিসভায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও দিনবদলের প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। অপেক্ষাকৃত তরুণ মন্ত্রী আবুল হোসেন (যিনি আওয়ামী লীগের পূর্বতন মন্ত্রিসভায় ও প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন) এবং সম্ভবত হাসিনাও আশা করেছিলেন যে, তার কাছ থেকে নতুন কিছু পাওয়া যাবে, তাকে বড় রকমের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সরে দাঁড়াতে হলো। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ মন্ত্রীই তাদের চৌকস বিদ্যাবুদ্ধি সত্ত্বেও দিনবদলের দিকে এগোতে পারেননি। এ জন্য মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যরা দায়ী, তেমন ঢালাও অপবাদ বোধহয় ঠিক নয়; কিন্তু তারা কাজ করতে পারেননি, সেই গতিশীলতার সঙ্গে যেমনটি প্রত্যাশা ছিল সকলের। কেউ কেউ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে মাথাভারি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছিলেন তার সরকারের কার্যক্রম বাস্তবায়িত করার জন্য, তারাই এ ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং বলাবাহুল্য একাধিক উপদেষ্টা যে দুর্নীতিমুক্ত নন, সে রকম অভিযোগও উঠে আসছে। সুতরাং দিনবদলের স্বপ্ন আর বুঝি সত্যে পরিণত হলো না, বাংলাদেশ সেই পুরনো দিনগুলোর আবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাফল্য সত্ত্বেও দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নামের এ দুটি কাঠ-পিঁপড়ে লাভের গুড় নিজেরাই খেয়ে নিচ্ছে। সুতরাং দিনবদল পঞ্জিকার পাতায় ঘটলেও বাংলাদেশে দিন যেন আর এগোতে চায় না।
সে জন্যই বলছিলাম হাসিনা-খালেদা কি চেষ্টা করবেন নতুন নেতৃত্বকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সামনের দিকে নিয়ে আসতে, সেটি মাইনাস নয়, তাদের পল্গাস টু কিংবা পল্গাস অনেক নীতি হতে পারে। এই নেতৃত্ব যে পরিবারের ভেতর থেকেই আসতে হবে এমন কোনো কথা নেই। দুঃখের কথা এই যে, তরুণ নেতৃত্ব উঠে আসার একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে পচন ধরেছে এখন। ছাত্রলীগই বলুন কিংবা ছাত্রদলই বলুন, তাদের নৃশংস তাণ্ডব আমরা দেখেছি বারবার। এক সময়ে ছাত্র নেতৃত্ব থেকেই আসত জাতীয় নেতৃত্ব। সেই উৎসটা এখন শুকিয়ে গেছে। তবু রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্ব আসতেই হবে। মাইনাস টু আতঙ্কে পল্গাস টু হবে না, এমনটি ভাবা আত্মঘাতী হবে, ব্যক্তি ও দল উভয়ের জন্যই।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দলের খুব দুঃসময়ে দলের হাল ধরেছিলেন। আজ যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অখণ্ডিত ও শক্তিশালী রাজনৈতিক দল, তার প্রায় সিংহভাগ কৃতিত্বই শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার। তারা তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, এতদিনে নিশ্চয়ই তাদের দল সাবালক হয়েছে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। এখন নিশ্চয়ই দুই নেত্রীই দেখতে চাইবেন যে, তাদের নিজেদের হাতে পুনর্গঠিত দল থেকে উঠে আসছে এমন সব নবীন প্রতিভা, যারা নতুন প্রজন্মের পছন্দের মানুষ হবে, হবে দিনবদলের কারিগর। পুরনো দিনের চেতনায় আবিষ্ট মানুষ দিয়ে নতুন দিনের সূচনা করা যায় না। রাজনীতি কেবল অতীত নস্টালজিয়ার বিষয় নয়, সামনে এগিয়ে চলার বিষয়ও। তাই আসুন, মাইনাস নয়, পল্গাস নিয়ে হোক আমাদের ভাবনা আর রাজনীতিতে এই পল্গাসের তত্ত্বটা তারাই বাস্তবায়ন করতে পারেন, যারা মাইনাস নিয়ে উদ্বিগ্ন।
অনিরুদ্ধ আহমেদ : যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী সাংবাদিক ও নিবন্ধকার
No comments