নকশী কাঁথার কবি by মফিজ ইমাম মিলন
'পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে নকশী কাঁথার মাঠ অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে আল্পনার দিন, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে পুঁথি পাঠের আসর এবং বিদায় নিয়ে যাচ্ছে এসব সনাতন ধারার বাহক বহু শিল্পী, কবি এবং সাহিত্যিক।'
এই চিরায়ত সত্যগুলো নতুন করে মনের ভেতর মোচড় খেয়ে উঠল, যখন মনে পড়ল ১৪ মার্চ কবি জসীমউদ্দীনের ৩৬তম তিরোধান দিবস। সেই শৈশব থেকে পাঠ্যপুস্তকের পাতাতেই কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে পরিচয়। 'কবর' কবিতার প্রথম আট লাইন মুখস্থ অথবা 'নিমন্ত্রণ' শব্দার্থ লেখ_ এই প্রচলিত পড়া থেকেই জসীমউদ্দীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। কবি কিংবা কবিতা নিয়ে ভাবার বয়স হয়নি। শুধু 'কবর' কবিতার সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত থাকায় বারবার পড়তে হয়েছে।
মধুমালা, বেদের মেয়ে, সোজন বাদিয়ার ঘাট, নকশী কাঁথার মাঠ-এর এই কবির সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচয় ঘটে। জসীমউদ্দীনকে চেনার-জানার পথটিকে সহজ করেছিলেন আমার মা। মায়ের একটি 'এনইসি' ট্রানজিস্টার ছিল। তা তিনি চায়না পপলিন প্রিন্ট কাপড়ের কভার দিয়ে সযত্নে রাখতেন। আমার নানি ট্রানজিস্টার উচ্চারণ করতে পারতেন না, বলতেন 'রেডুও'। সপ্তাহে কোন কোন দিন কোন সেন্টারে কী নাটক হবে, তা ছিল তাদের মুখস্থ। বেদের মেয়ের ছোট বাইদানির কষ্টে মা কাঁদতেন। নাটক শুনে মায়ের চোখে অশ্রু দেখেছি। চোখের কান্না কখনও মিথ্যা হয় না। সত্যি সত্যিই জসীমউদ্দীন মানুষকে কাঁদাতে পারতেন। নিজেও ব্যক্তিজীবনে সহজ-সরল ছিলেন। অপরের দুঃখে হাউমাউ করে কাঁদতেন। এসব ষাটের দশকের শেষের দিকের কথা। তখনও জসীমউদ্দীন ছাপার অক্ষরে লেখা একটি নাম। যার লেখা পড়ে পরীক্ষা দিই, নাটক শুনে মাকে কাঁদতে দেখি, সেই মানুষটিকে এমন করে স্বচক্ষে কাছ থেকে দেখতে পাব, তা ছিল ভাবনার বাইরে। আমরা তখন ময়েজউদ্দীন হাইস্কুলের ছাত্র। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার শ্রীশ চন্দ্র ঘোষ। একদিন শ্রীশ স্যার ঘোষণা দিলেন, আমার দু'জন বন্ধু এসেছেন, তোমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটাবেন। যতদূর মনে পড়ে একজন ছিলেন আনোয়ারুল হক মেঘদূত। কিছুক্ষণ পর শ্রীশ স্যার মঞ্চে বসা অপর মেহমানকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, আমার এ বন্ধুর ডাক নাম 'সাধু', ভালো নাম জসীমউদ্দীন। আমরা সমস্বরে আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম_ কবি এসেছে কবি এসেছে। লম্বা একহারা চেহারা, পরনে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। পা দু'খানা লম্বা। বড় বড় পা ফেলে হাঁটছিলেন আর কবিতা পড়ছিলেন 'কবর'। কিছুক্ষণ পরেই কবি কাঁদতে শুরু করলেন। শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আমরাও সবাই 'কবর' কবিতা কবির স্বকণ্ঠে শুনে কেঁদেছিলাম।
অনেকদিন পর কবিকে আরেকবার দেখলাম ফরিদপুরের 'চেরাগ আলী বুক ডিপো'তে। কবির কাঁধে মশারি, কবি বসে আছেন চেয়ারে। রউফ চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম ওই লোকটাকে চেনা চেনা লাগে। তিনি কে! উনি কবি জসীমউদ্দীন আর ভুল করে চাদর ভেবে মশারি নিয়ে এসেছেন_ আমাকে বুঝিয়ে বললেন তিনি।
ঘটনা দুটি উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, এতে জসীমউদ্দীনের চরিত্রের একটি বিশেষ দিক স্পষ্ট হয়। তিনি ছিলেন সোজা-সরল কথা বলা ও সাদামনের মানুষ। সারা জীবনই খুঁজে আনতে চেষ্টা করেছেন সবচেয়ে আদিম মনের রঙ, তার সাদামাটা স্বাভাবিক চেহারা, নির্ভেজাল অনুভূতির নির্যাস।
মানুষের জাগতিক দুঃখের রূপকার ছিলেন জসীমউদ্দীন; গ্রাম-বাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজে জীবনপ্রবাহ যিনি উপস্থাপন করেছেন সমান দরদ দিয়ে। কবির সব সৃষ্টিকর্মে তার মানবপ্রেমের সার্থক অভিব্যক্তি ঘটিয়েছেন। কবিতা, গান, লোকনাট্য, ভ্রমণকাহিনী ও শিশুসাহিত্য লিখেও যিনি যশস্বী হয়েছেন। অমর হয়েছেন পল্লীজীবনের কবিতা ও কাহিনী লিখে। লোকজীবন থেকে সংগ্রহ করেছেন কাব্যের উপকরণ। শুধু কবিতার বস্তু সম্পদে নয়, শব্দ সম্পদে কবি ছিলেন গ্রামনিষ্ঠ। তাই তিনি ছিলেন পল্লীকবি।
মধুমালা, বেদের মেয়ে, সোজন বাদিয়ার ঘাট, নকশী কাঁথার মাঠ-এর এই কবির সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচয় ঘটে। জসীমউদ্দীনকে চেনার-জানার পথটিকে সহজ করেছিলেন আমার মা। মায়ের একটি 'এনইসি' ট্রানজিস্টার ছিল। তা তিনি চায়না পপলিন প্রিন্ট কাপড়ের কভার দিয়ে সযত্নে রাখতেন। আমার নানি ট্রানজিস্টার উচ্চারণ করতে পারতেন না, বলতেন 'রেডুও'। সপ্তাহে কোন কোন দিন কোন সেন্টারে কী নাটক হবে, তা ছিল তাদের মুখস্থ। বেদের মেয়ের ছোট বাইদানির কষ্টে মা কাঁদতেন। নাটক শুনে মায়ের চোখে অশ্রু দেখেছি। চোখের কান্না কখনও মিথ্যা হয় না। সত্যি সত্যিই জসীমউদ্দীন মানুষকে কাঁদাতে পারতেন। নিজেও ব্যক্তিজীবনে সহজ-সরল ছিলেন। অপরের দুঃখে হাউমাউ করে কাঁদতেন। এসব ষাটের দশকের শেষের দিকের কথা। তখনও জসীমউদ্দীন ছাপার অক্ষরে লেখা একটি নাম। যার লেখা পড়ে পরীক্ষা দিই, নাটক শুনে মাকে কাঁদতে দেখি, সেই মানুষটিকে এমন করে স্বচক্ষে কাছ থেকে দেখতে পাব, তা ছিল ভাবনার বাইরে। আমরা তখন ময়েজউদ্দীন হাইস্কুলের ছাত্র। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার শ্রীশ চন্দ্র ঘোষ। একদিন শ্রীশ স্যার ঘোষণা দিলেন, আমার দু'জন বন্ধু এসেছেন, তোমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটাবেন। যতদূর মনে পড়ে একজন ছিলেন আনোয়ারুল হক মেঘদূত। কিছুক্ষণ পর শ্রীশ স্যার মঞ্চে বসা অপর মেহমানকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, আমার এ বন্ধুর ডাক নাম 'সাধু', ভালো নাম জসীমউদ্দীন। আমরা সমস্বরে আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম_ কবি এসেছে কবি এসেছে। লম্বা একহারা চেহারা, পরনে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। পা দু'খানা লম্বা। বড় বড় পা ফেলে হাঁটছিলেন আর কবিতা পড়ছিলেন 'কবর'। কিছুক্ষণ পরেই কবি কাঁদতে শুরু করলেন। শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আমরাও সবাই 'কবর' কবিতা কবির স্বকণ্ঠে শুনে কেঁদেছিলাম।
অনেকদিন পর কবিকে আরেকবার দেখলাম ফরিদপুরের 'চেরাগ আলী বুক ডিপো'তে। কবির কাঁধে মশারি, কবি বসে আছেন চেয়ারে। রউফ চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম ওই লোকটাকে চেনা চেনা লাগে। তিনি কে! উনি কবি জসীমউদ্দীন আর ভুল করে চাদর ভেবে মশারি নিয়ে এসেছেন_ আমাকে বুঝিয়ে বললেন তিনি।
ঘটনা দুটি উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, এতে জসীমউদ্দীনের চরিত্রের একটি বিশেষ দিক স্পষ্ট হয়। তিনি ছিলেন সোজা-সরল কথা বলা ও সাদামনের মানুষ। সারা জীবনই খুঁজে আনতে চেষ্টা করেছেন সবচেয়ে আদিম মনের রঙ, তার সাদামাটা স্বাভাবিক চেহারা, নির্ভেজাল অনুভূতির নির্যাস।
মানুষের জাগতিক দুঃখের রূপকার ছিলেন জসীমউদ্দীন; গ্রাম-বাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজে জীবনপ্রবাহ যিনি উপস্থাপন করেছেন সমান দরদ দিয়ে। কবির সব সৃষ্টিকর্মে তার মানবপ্রেমের সার্থক অভিব্যক্তি ঘটিয়েছেন। কবিতা, গান, লোকনাট্য, ভ্রমণকাহিনী ও শিশুসাহিত্য লিখেও যিনি যশস্বী হয়েছেন। অমর হয়েছেন পল্লীজীবনের কবিতা ও কাহিনী লিখে। লোকজীবন থেকে সংগ্রহ করেছেন কাব্যের উপকরণ। শুধু কবিতার বস্তু সম্পদে নয়, শব্দ সম্পদে কবি ছিলেন গ্রামনিষ্ঠ। তাই তিনি ছিলেন পল্লীকবি।
No comments