‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্য’
একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তার ব্যালেন্স অব পেমেন্টের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বড় ভূমিকা পালন করছে।
ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বলতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোন একটি দেশের সাথে অন্যান্য দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের সমষ্টিকে বোঝায়। ২০১০-২০১১ অর্থবছরে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ছিল নেতিবাচক ($৬৩৫ মিলিয়ন) বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য মতে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত ব্যালেন্স অব পেমেন্ট দাঁড়ায় $১০৬৪ মিলিয়ন। আমাদের বাণিজ্য উদ্বৃত্তের মূল দুটি উপাদান হলো আমদানি ও রফতানি। আমাদের অর্থনীতি মূলত আমদানিনির্ভর। এবং এই আমদানিনির্ভরতাই আমাদের অর্থনীতির প্রধান দুর্বলতা। দিন দিন আমাদের আমদানি ও রফতানির ঘাটতি বেড়েই চলছে। এতে করে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের আমদানির পরিমাণ রফতানির চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। ২০১০-১১ সালে যা ছিল $৭৩২৮ এবং বর্তমান বছর অর্থাৎ ২০১২ সালের জানুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত সময়ে আমাদের রফতানি বাড়ে $২১৪ মিলিয়ন বা ২.৮% আবার এপ্রিল-জুন পর্যন্ত সময়ে রফতানি কমে $৪২০ মিলিয়ন বা ৬.৯%। এটি হয়েছিল বৈদেশিক বিনিময় হার পরিবর্তনের কারণে। অন্যদিকে ২০১২ অর্থবছরে আমদানি জানুয়ারি-মার্চ ও এপ্রিল-জুন সময়ে হ্রাস পেয়েছে $৫৭৯.৪ মিলিয়ন এবং এপ্রিল-জুনে রফতানি $৮৫৬৯.৫ মিলিয়ন। বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস করতে হলে আমাদের রফতানি বাড়াতে হবে এবং একই সাথে আমদানি কমাতে হবে।সুসংবাদ হচ্ছে আমরা এখন কিছু কিছু পণ্যে আমদানি নির্ভরতা কমাতে পেরেছি। যেমনÑইলেকট্রনিক্স পণ্য। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে আমাদের রফতানির অবস্থা খুবই ভাল। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের মোট রফতানির ৭৭.৭৭% আসে পোশাকশিল্প থেকে। পোশাক রফতানিতে আমরা বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে আছি। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। কিন্তু এই সফলতার সাথে সাথে কিছু অনিশ্চয়তাও আছে। আমাদের রফতানির সিংহভাগ দখল করে আছে গার্মেন্টস শিল্প। তাই এর সামান্য অবনতিতে আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ধস নেমে আসবে। আমাদের উচিত এই নির্ভরশীলতা কমানো। আমাদেরকে নতুন নতুন রফতানি পণ্য খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন প্রচুর গবেষণা। নতুন পণ্যের পাশাপাশি আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে গবেষণা ও সরকারী সহায়তা বাড়াতে হবে। যা এই সেক্টরের উন্নতিকে ত্বরান্বিত করবে। আমরা ২০১১-১২ সালের আমদানির চিত্র লক্ষ করলে দেখতে পাই যে, আমাদের মোট আমদানির মাত্র ১৪% হল মেশিনারি ও মেকানিক্যাল এ্যাপ্লাইয়েন্সÑযা নির্দেশ করে যে দেশে বিনিয়োগের হার কম।
আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে রেমিটেন্স। রেমিটেন্স আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য মতে, জানুয়ারি ২০১২তে আমাদের রেমিটেন্স প্রবাহ দাঁড়ায় $১.২২ বিলিয়ন এবং ফেব্রুয়ারিতে দাঁড়ায় $১.১১ বিলিয়ন। এবং আশা করা হচ্ছে এ বছরের শেষ নাগাদ রেমিটেন্স প্রবাহ দাঁড়াবে $১.৪ বিলিয়ন। এই রেমিটেন্স প্রবাহ বাংলাদেশের রেমিটেন্স আয়ের ইতিহাসের শীর্ষে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় আমাদের বিপুল জনসংখ্যা। এই বিপুল জনসংখ্যাই আবার আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে আমাদের প্রায় ৮০ লাখ শ্রমিক কাজ করছে। আমরা আমাদের এই রেমিটেন্স আয় বাড়াতে পারি। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন দ্বিমুখী কার্যক্রম। প্রথমত, আমাদেরকে নতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের জন্য সুখবর হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে মালয়েশিয়ার সাথে নতুন শ্রমিক নিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রায় ৫০,০০০ হাজার শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যাবার সুযোগ পাবে। পৃথিবীতে এমনও অনেক দেশ আছে যাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নেতিবাচক। যেমন-রাশিয়া, ইউক্রেন, বুলগেরিয়া, লিথুনিয়া, হাঙ্গেরি, জার্মানি। তাছাড়া জাপান, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ইত্যাদি দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূন্য। এই সকল দেশে আমাদের বিপুল শ্রমিক পাঠানোর সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের শ্রমিকদের কারিগরি দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমেও আমরা রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াতে পারি। এজন্য সরকারীভাবে বৈদেশিক বাজার গবেষণা ও দক্ষতা উন্নয়ন একাডেমী খুলতে পারি। শ্রমিকদেরকে বাইরে পাঠানোর পূর্বে তাদের কারিগরি দক্ষতা যেমন বাড়াতে হবে তেমনি পাশাপাশি তাদেরকে ভাষা শিখাতে হবে। এবং এটি আমাদের শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে। সর্বোপরি এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা যদি রেমিটেন্স বাড়াতে পারি তবে রেমিটেন্সের সাথে সাথে আমাদের রফতানিও বাড়বে। এর মাধ্যমে নতুন বৈদেশিক বাজার উন্মোচিত হবে। কারণ বাঙালী প্রবাসীরা বাংলাদেশের পণ্য ব্যবহারে অভ্যস্ত তাই বিদেশে বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদা বাড়বে। প্রবাসী যত বাড়বে বাংলাদেশী পণ্য রফতানি তত বাড়বে।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত এমন সব পদক্ষেপের কারণে বিপুল পরিমাণ শ্রমিক রফতানি করছে। বর্তমানে পৃথিবীতে রেমিটেন্স আয়ের ক্ষেত্রে ভারত দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। কারিগরি শিক্ষার পাশাপাশি যদি শ্রমিকরা ভাষা শিখে তাহলে তারা বেশি উপার্জন করতে পারবে। পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকার ‘এড়ষফসধহ ঝধপযং’-এর গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ পৃথিবীর পরবর্তী ১১টি উদীয়মান অর্থনীতির দেশের মধ্যে অন্যতম। এ গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হতে পারে, যদি এটি তার বিপুল সম্ভাবনাময় জনসংখ্যার সঠিক ব্যবহার করে।
বৈদেশিক বাণিজ্যের রিজার্ভ আমাদের অর্থনীতির জন্য একটি সুসংবাদ। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তার তিন মাসের আমদানির সমান হওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ তিন মাসের বেশি আমদানি করতে সক্ষম। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল $১০.০৭ বিলিয়নÑযা জুলাইতে দাঁড়ায় $১০.৫৭ লঞ্চ অব পেমেন্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন উপাদান হলো সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ। আমাদের দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ তেমন আশাব্যাঞ্জক নয়। ২০০৪-২০০৫ অর্থবছরের পর ২০০৮-২০০৯ ছাড়া প্রতিবছর বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমছে। ২০০৪-২০০৫ সালে জিডিপিতে বৈদেশিক বিনিয়োগের অবদান ছিল ১.৩৩% যা ২০১০-১১ সালে দাঁড়ায় ০.৭০% এবং এই ধারা চলতে থাকলে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এটি .৬৬% গিয়ে দাঁড়াবে।
দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এফডিআই ম্যাগাজিন অনুসারে আমাদের আছে পৃথিবীর তৃতীয় কম ব্যয়বহুল রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল। তারপরও আমাদের বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ছে না। আর এর পেছনে প্রধান কারণ হলো প্রয়োজনীয় গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোর অভাব, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রয়োজনীয় প্রচারণার অভাব।
বিশ্বমন্দার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি মাত্র ৫% প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। যেখানে আমাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.৭% যা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি ইতিবাচক দিক। বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ। আমাদের আছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকতÑযা থেকে আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারি। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং, এস অ্যান্ড পি এবং মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস বাংলাদেশকে পরপর দুই বার (২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে) ইই এবং ইধ৩ রেটিংস দিয়েছে। যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সুষ্ঠু ও স্থির ধারাকে নির্দেশ করে এবং সাথে সাথে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে একটি উপযোগী দেশ হিসেবে বিশ্ব অর্থনীতিতে উপস্থাপন করে।
অপার সম্ভাবনার অর্থনীতির দেশকে একটি উন্নত ও সুখী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। এই প্রবৃদ্ধির ধারা সচল রাখতে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের অবদান সর্বাধিক। ব্যালেন্স অব পেমেন্টের অবদান বাড়াতে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারী সব মহলের সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। আর এই প্রয়াস বাংলাদেশকে একটি প্রতিনিধিত্বকারী অর্থনীতির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করবে।
লেখক : মোঃ আনিসুর রহমান শ্রাবণ, মোঃ সাকিব চৌধুরী, অনন্যা চৌধুরী, সানজিদা হাওলাদার, সাবরিনা ইসলাম (সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ফিন্যান্স বিভাগ, ম্যাক্রোইকোনমিক্স ল্যাব)
No comments