নারী নির্যাতন : '... প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে...' by ড. মীজানূর রহমান শেলী

আমরা আজ এক অস্থির ক্রূঢ় সময়ের অসহায় শিকার। এমন অস্থিরতা ইতিহাসে আগেও দেখা গেছে। দিশাহীন, স্থিতিহীন ও ভারসাম্যরিক্ত বহু দেশ ও সমাজ সাধারণ মানুষকে দিয়েছে সীমাহীন দুঃখ, কষ্ট ও যন্ত্রণা। বিশৃঙ্খল পরিবেশে বলশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিষ্ঠুর অত্যাচার ও শোষণ চালিয়েছে দুর্বলের ওপর।
পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় শক্তির অক্ষমতা বা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অথবা কখনো তারই ছত্রচ্ছায়ায় সন্ত্রাসী পেশিশক্তি নিরীহ নর-নারীকে জর্জরিত করেছে হিংস্র পশুর চেয়েও নির্মম আক্রমণে ও অত্যাচারে।
সপ্তদশ শতাব্দীর স্বনামখ্যাত ইংরেজ রাষ্ট্র চিন্তাবিদ টমাস হবস উদ্ভাবন করেছিলেন রাষ্ট্র পত্তনের এক অভিনব সূত্র। তাঁর মতে, রাষ্ট্রবদ্ধ হওয়ার আগে মানুষ বসবাস করে এক 'স্বাভাবিক অবস্থায়' (state of nature)। এ পরিস্থিতিতে সুসংবদ্ধ ও শক্তিশালী এক কর্তৃপক্ষের অভাবে তারা নিয়ম-রীতিহীন বিশৃঙ্খল জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। হবসের মতে, রাষ্ট্র সংগঠনের পূর্বকালে স্বভাবত স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক মানুষ বল্গাহীনভাবে নিজ নিজ স্বার্থ পূরণে ব্যস্ত থাকে। কেউ কাউকে মানে না। যে যেমন করে, পারে বল প্রয়োগে বা ছলচাতুরীর মাধ্যমে নিজ নিজ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অন্যের ওপর চালায় আক্রমণ, নিপীড়ন ও নির্যাতন। এ অবস্থায় মানুষের জীবন হয়ে ওঠে পঙ্কিল, পশুসুলভ ও রস্য (nasty, brutish and short)। এই দুঃসহ পরিস্থিতির অবসানের জন্য মানুষ যার যার নিজের স্বাতন্ত্র্য ত্যাগ করে এক সামাজিক চুক্তিতে (social contract) আবদ্ধ হয়, এর ফলে সৃষ্টি হয় লেভিয়াথান বা এক বিশাল সত্তার, অর্থাৎ রাষ্ট্রের। এর কর্ণধার হয় এক সার্বভৌম, স্বরাট কর্তৃপক্ষ, যা কারো অধীন নয়, কিন্তু চুক্তিতে সম্মতি দানকারী অন্য সব ব্যক্তি তার অধীনস্থ থাকে। তার একমাত্র কাজ বিশৃঙ্খল প্রাকৃতিক অবস্থার নৈরাজ্য থেকে মানুষকে উদ্ধার করে সুসংহত, সুশৃঙ্খল, নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা।
হবস চিত্রিত মানুষের স্বভাবসুলভ অবস্থার বিশ্লেষণ নির্মম ও নিরাশাব্যঞ্জক হলেও এর মধ্যে যে বাস্তব সত্য নিহিত আছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। যখনই মানব সমাজে নৈরাজ্যময় উচ্ছৃঙ্খলতা চরমে পৌঁছে, তখনই এর প্রতিক্রিয়া ঘটে। দুঃশাসন বা সুশাসনহীনতার গর্ভে জন্ম নেয় সুসংগঠিত ও শক্তিশালী কোনো ব্যবস্থা।
এমনটি ঘটেছিল বাংলার ইতিহাসে সপ্তম শতাব্দীতে। প্রায় শতবর্ষ দীর্ঘ নৈরাজ্য বা মাৎস্যন্যায়ের সমাপ্তি এনে ঐক্যবদ্ধ সামন্তরা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে রাজা গোপালকে। তারপর প্রতিষ্ঠিত হয় ধারাবাহিক সুসংহত ও সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা।
এত দিন পর আজ শুধু আমাদের নয়, চারপাশের অন্যান্য দেশ ও সমাজেও দেখা যায় সুশাসন ও সুশৃঙ্খল পরিবেশের ঘাটতি বা অভাব, এমনকি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও নির্বিরাম চলে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। হাজারো আইনের বিধিবন্ধন উপেক্ষা করে সুসংগঠিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সুবিন্যস্ত বিচারালয়ের অস্তিত্ব সত্ত্বেও এসব সমাজে মানবতার ওপরে চলে বিরামহীন বিক্ষিপ্ত, চোরাগোপ্তা হামলা। অসংখ্য সন্ত্রাস, নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের হোতাদের ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। যদিবা যায় তাদের সঠিক বিচার ও সমুচিত শাস্তির ব্যবস্থা হয় না, 'প্রতিকারহীন শক্তির অপরাধে, বিচারের বাণী নীরবে, নিভৃতে কাঁদে।'
গত ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বরের রাতে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অসহায় এক তরুণী মেডিক্যাল ছাত্রীর যে নির্মম গণধর্ষণ ও এর পরিণতিতে মৃত্যুর শিকার হন তা এই শ্রেণীর হামলার এক নিকৃষ্ট নজির। নির্যাতিতা এই তরুণী ও তাঁর পুরুষ সঙ্গীকে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দেওয়ার পর তাঁদের তাৎক্ষণিকভাবে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। বিলম্বে পৌঁছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নানা টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ করে- এ অভিযোগও রয়েছে। আরো অভিযোগ আছে, হাসপাতালেও দ্রুত প্রয়োজনীয় সেবা ও চিকিৎসাও তাঁদের ভাগ্যে জোটেনি। ধর্ষিতা তরুণীর মর্মান্তিক মৃত্যু ভারতজুড়ে জন্ম দেয় জনতার প্রচণ্ড ও ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন। নড়েচড়ে ওঠে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসন। মনে হয়, সে দেশে দুর্বলের পক্ষে, বিশেষত বঞ্চিতা, নিপীড়িতা নারী সমাজের পক্ষে সূচিত হচ্ছে এক বিপুলভাবে ইতিবাচক মোড় পরিবর্তনের।
কিন্তু ঝড়ের রাতে হঠাৎ ঝিলিক দেওয়া বিজলির মতোই এই আশার ক্ষণান্তিক আলো ঘন আঁধারে মিলিয়ে যায়, যখন পাঞ্জাবের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক ৩০ বছর বয়স্ক একাকিনী নারী বাসযাত্রীর জীবনেও নেমে আসে গণধর্ষণের নির্মম অভিশাপ। এ দুর্ঘটনাগুলো গণমাধ্যমের সক্রিয়তায় সারা দেশ ও দুনিয়ার গোচরে এসেছে। এর বাইরে যে কত এ ধরনের অপরাধ হিংস্র পশুরও অধম মানুষ ঘটিয়ে চলছে তার খোঁজ কে রাখে?
নির্যাতন, হত্যা ও লুণ্ঠনসহ ধর্ষণের মতো ঘৃণিত অপরাধের প্রতিরোধ ও প্রতিকারে রাষ্ট্রশক্তি কী ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং তা কত দূর কার্যকর হচ্ছে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে এবং সারা বিশ্বে রয়েছে সংশয় ও সন্দেহ। ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য, উত্তর খণ্ডে গৃহীত হয়েছে এক অকল্পনীয় নেতিবাচক ব্যবস্থা। নারীর নির্যাতন, নিগ্রহ ও ধর্ষণ রোধে সেখানকার রাজ্য সরকার জারি করেছে নারীদের জন্য 'সান্ধ্য আইন'! সরকারি নির্দেশে ওই রাজ্যে সন্ধ্যার পর নারীদের ঘরের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যেন চার দুয়ারের মধ্যে বন্ধ হয়ে থাকলেই তাদের সুরক্ষা হবে দুর্ভেদ্য। এই বিকৃত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সেই অঞ্চলে এবং ভারতের অন্য অঙ্গরাজ্যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই রুখে দাঁড়িয়েছে। ভারতের রাজনীতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। এ বিশাল ও বৈচিত্র্যময় রাষ্ট্রে নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্র বহু দশক ধরেই প্রতিষ্ঠিত। এখানে পারস্পরিক রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সাংবিধানিক বিরোধী দলকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার প্রথা দৃঢ়ভাবে স্থাপিত। এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সামগ্রিক প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও দক্ষতা রাজনৈতিক দলীয়করণের কারণে বিঘি্নত হয়নি। বিচার বিভাগের, বিশেষ করে উচ্চতর আদালতের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা ধারাবাহিকভাবেই অক্ষুণ্ন রয়েছে। তার পরও এমন সব মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে চলছে, যা মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, হবস বর্ণিত পশুসম মানুষের 'স্বাভাবিক অবস্থার' কথা যখন রাষ্ট্রহীন মানুষ অমানবিক ও যন্ত্রণাদায়ক নৈরাজ্যকর জীবনের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট থাকে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মতো সমস্যাজর্জরিত দেশে মানবপীড়ন ও নারী নির্যাতনের পরিস্থিতি বিচার করলে হতাশা আরো তীব্র হয়। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পুনরুজ্জীবিত সংসদীয় গণতন্ত্রিক ব্যবস্থা দৃশ্যত চালু রয়েছে। সংবিধানে নির্ধারিত মেয়াদান্তে জাতীয় নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে, ঘটেছে ক্ষমতার পালাবদল। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিমূল যে মানবাধিকার ও নিরাপত্তা, তা আজও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইয়াসমিন ও সীমাসহ বহু অসহায় নারী নির্যাতিতা ও ধর্ষিতা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনকারীরা ছিল সরকারি ও প্রশাসনিক কর্তৃত্বের কাতারের লোক। ভারতে সাম্প্রতিক মর্মন্তুদ নারী ধর্ষণের ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশে ঘটেছে আরেক জঘন্য ও অমানবিক কন্যাশিশু নির্যাতন ও হত্যার ভয়াবহ ঘটনা। সাড়ে চার বছরের এই নিষ্পাপ শিশুর মর্মান্তিক পরিণতি শুধু অসহনীয় নয়, চরম বেদনাসিক্তও বটে। এ ছাড়া হরহামেশাই নারী নির্যাতন ও নারীদের শরীরে এসিড নিক্ষেপে তাদের বিকৃত জীবনের অভিশাপে নিক্ষিপ্ত করার অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলছে। এতে সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে উঠছে।
অনেকেই বলেন, নারীদের ওপর এই নির্যাতন ও নিপীড়ন রোধ করতে হলে প্রয়োজন ব্যাপক সামাজিক জাগরণ ও প্রতিরোধের। এর সত্যতা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু মনে রাখতে হবে- নিরস্ত্র, নিরীহ ও দুর্বল মানুষের পক্ষে শুধু সচেতন হয়ে এ ধরনের অপরাধ রোধ করা সম্ভব নয়। পেশিশক্তির অধিকারী দলীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীদের আশ্রয়পুষ্ট এ অপরাধীরা শুধু বাহুবলে নয়, আশ্রয়-প্রশ্রয়ের, শক্তিতেও বেপরোয়া। এদের প্রতিরোধ ও দমনের একমাত্র উপায় স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনীতি এবং নিরপেক্ষ, নির্দলীয়, সুসংগঠিত ও বিধিরীতি মোতাবেক পরিচালিত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল পূর্বশর্ত পারস্পরিক সহনশীলতা, ভিন্ন মত ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও মর্যাদা প্রদর্শন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই রাষ্ট্রের মূলদর্শনবিরোধী কোনো মতবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় দর্শন, মূলনীতি ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় জাতীয় বিষয়ে ঐকমত্য ছাড়া সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলা যায় না। বরং তৈরি হয় সঠিক আদর্শ ও চেতনাবিবর্জিত ক্ষমতার লড়াইয়ের রাজনীতি, যা আমাদের রাজনৈতিক জীবনকে করে রেখেছে অস্থির ও স্থিতিশীলতাহীন। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্র দুর্বল হয়েছে, নির্জীব হয়েছে প্রশাসন। অপরিণামদর্শী দলীয়করণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং বৃহত্তর সমাজকে করেছে বিভক্ত ও পঙ্গু। এই পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু রাজনীতি ও কার্যকর প্রশাসন গড়ে তুলতে না পারলে নারী নির্যাতনের মতো দুর্বলের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন থামবে না। সে অবস্থায় সমাজকে আক্ষেপ করে বলতে হবে :
'আমি যে দেখেছি কপট হিংসা
গোপন রাত্রি ছায়ে,
হেনেছে নিঃসহায়ে।
আমি যে দেখেছি
প্রতিকারহীন শক্তির অপরাধে
বিচারের বাণী
নীরবে নিভৃতে কাঁদে।'
লেখক : চিন্তাবিদ ও কলাম লেখক
mrshelley43@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.