সাক্ষাৎকার গ্রন্থন : নাসির আহমেদ-অতীত-কাতরতা নয়, ভবিষ্যতের দিকেই 'আনন্দবাজারে'র চোখ-সাক্ষাৎকার by অভীক সরকার
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা শুধু পত্রিকা মাত্র নয়, একটি ইনস্টিটিউশন। কালের সাক্ষী। আনন্দবাজার গ্রুপ অব পাবলিকেশন্স থেকে ইংরেজি দৈনিক টেলিগ্রাফ ছাড়াও দেশ, সানন্দা, আনন্দলোকসহ বেশ কয়েকটি সাময়িকী প্রকাশিত হচ্ছে। সবগুলোই পাঠকপ্রিয়।
এই গ্রুপের প্রাণপুরুষ
আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অভীক সরকার মাত্র তিনদিনের জন্য ঢাকা এসেছিলেন। নানা প্রসঙ্গে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে
উপমহাদেশে বাংলা ভাষায় সর্বাধিক প্রচারিত কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অভীক সরকার সস্ত্রীক ঘুরে গেলেন ঢাকা। মাত্র তিনদিনের সফরে দারুণ ব্যস্ততা। প্রধানমন্ত্রী, একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ঢাকা ক্লাবে এক আড্ডার আয়োজন করলেন তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক এলেন, তার মুখ থেকে গণমাধ্যম ও আনন্দবাজার সম্পর্কে কিছু শুনব না! দিলি্লতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে নিযুক্ত প্রেস মিনিস্টার এনামুল হক চৌধুরী সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের অনুরোধে হোটেল শেরাটনে প্রাতঃরাশ বৈঠকে অভীক সরকারের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করলেন। সেখানেই তার সঙ্গে নানা প্রসঙ্গে কথা হলো। সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী রাখী সরকার। শুরুতেই সংবাদপত্রের দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গ উঠল।
অভীক সরকার বললেন, সংবাদপত্রের কারও কাছে দায়বদ্ধতা থাকতে পারে না, দায়বদ্ধতা থাকবে তার নিজের কাছে। যদি কোনো সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চায়, তাহলে তার থাকা চাই পরিপূর্ণ পেশাদারিত্ব। জানতে চাওয়া হলো, আনন্দবাজারের মূল শক্তি কী? অভীক সরকার বললেন, পেশাদারিত্ব আর সার্বিক উৎকর্ষই প্রাণশক্তি।
রাজনৈতিক দর্শন প্রসঙ্গ উঠতেই একটু সিরিয়াস হলেন। আনন্দবাজার কোনো দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তির পক্ষে-বিপক্ষে নয়। আমরা একটি বিশ্বাস ও আদর্শের পক্ষে। সে বিশ্বাস কেউ সমর্থন করতে পারেন, আবার না-ও পারেন। সংবাদপত্রকে তার নিজস্ব দায়বদ্ধতা নিয়েই এগোতে হয়। আমরা অন্তত তা-ই বিশ্বাস করি।
গল্পগুজব থেকে শুরু করে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানা বিষয়ে আলাপ। এই আড্ডায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, সংবাদপত্র ও প্রযুক্তির ক্রমবিবর্তনের প্রেক্ষাপটসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আনন্দবাজার গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় এই ব্যক্তি।
১৯২২ সালে সান্ধ্য দৈনিক হিসেবে মাত্র ৪ পৃষ্ঠায় যে পত্রিকার যাত্রা শুরু, তার আজ এই বিশাল মহীরুহে পরিণত হওয়ার নেপথ্য শক্তি প্রসঙ্গে অভীক সরকার বলেন, আমার পিতার আমল থেকেই আমরা প্রফেশনাল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ শুরু করি। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাতিষ্ঠানিকতা ও পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের দিকেই আমাদের দৃষ্টি ছিল। কোনো রকম আবেগে আমরা তাড়িত হইনি। বাংলার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আনন্দবাজারকে আমরা ধরে রাখতে চাইনি। আমরা সবসময়ই আন্তর্জাতিক মানের দৈনিকের কথা মাথায় রেখেছি। সে কারণে উৎকর্ষ আর মানের নিরিখে নিউইয়র্ক টাইমস বা লন্ডন টাইমসকে আমরা এক কাতারে গণ্য করি।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, অতীত ঐতিহ্য, স্মরণীয় দিন নিয়ে কেন তেমন আলোচনা বা বিশেষ ক্রোড়পত্র করে না আনন্দবাজার? যেমন_ আমাদের এখানে একুশে, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, জাতির জনকের জন্ম-মৃত্যুদিন নিয়ে বিশেষ আয়োজন থাকে।
বললেন, আমরা অতীত-কাতরতা বা অতীত-বিলাসে বিশ্বাস করি না। অতীত থাকবে ঐতিহ্য হিসেবে, আমাদের দৃষ্টি সবসময় থাকবে সামনের দিকে। তারুণ্যের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আমরা সম্পৃক্ত থাকতে চাই। দেশের বাইরে যারা আছেন, সেই তারুণ্যকেও আমরা সম্মাননা দিই, স্বীকৃতি দিই। বিশেষ করে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকি। পেশাগত উৎকর্ষের প্রসঙ্গটি এ কথার সূত্র ধরেই আবার তুললেন অভীক সরকার। উদাহরণ হিসেবে বললেন, যখন বাজেটের ওপর একটা সম্পাদকীয় হয় তখন যে কোনো আন্তর্জাতিক মানের অর্থনীতির কাগজের মানে সে বিশ্লেষণটা উপস্থাপন করতে চেষ্টা করে আনন্দবাজার। আমরা ছাড়া ভারতে অন্যদের মধ্যে এই দৃষ্টিভঙ্গিটা দেখি না। সর্বভারতীয় ভাষার সংবাদের প্রেক্ষাপটেই বলব, তারা ধরেই নেন যে, যেহেতু আঞ্চলিক ভাষার কাগজ, সুতরাং আমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর। বাংলাও আঞ্চলিক ভাষা। তাতে কী? এটা ভাবলে তো অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। বাংলা ভাষার কাগজ হলেও আনন্দবাজার পত্রিকাকে আমরা ভারতের আঞ্চলিক ভাষার পত্রিকা মনে করি না। বিশ্ব প্রেক্ষাপটেই আমরা সবকিছু দেখতে চাই।
আনন্দবাজার প্রকাশনা এবং সার্কুলেশন প্রসঙ্গে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করলে অভীক সরকার বলেন, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাসহ তিনটি জায়গা থেকে আমরা পত্রিকাটি প্রকাশ করি। এখন সার্কুলেশন ১৪ লাখ। ডেইলি টেলিগ্রাফ যখন এবিপি থেকে আমরা প্রকাশ শুরু করি, তখন সেখানেও আমরা একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করি। ফলে আমাদের আনন্দবাজার পত্রিকা, টেলিগ্রাফ, সানন্দা, পাক্ষিক দেশসহ ৮টি প্রকাশনায়ই আমরা পেশাদারি মনোভাব অক্ষুণ্ন রাখতে সচেষ্ট।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এবং শিল্প-সাহিত্যের বিনিময় প্রসঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক বলেন, আমাদের দু'দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়নে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ সূত্রেই প্রশ্ন এলো, তাহলে আনন্দ পাবলিশার্স বা দেশ-এ বাংলাদেশের লেখকরা অনুপস্থিত কেন? দেশ পত্রিকায় বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিফলন তেমন একটা নেই স্বীকার করে তিনি বলেন, আমি দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা এবং টেলিগ্রাফ সরাসরি দেখি। অন্যান্য পত্রিকা যারা দেখেন, তারা এতটাই যোগ্য যে আমার সেদিকে খুব একটা নজর দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। দেশ-এ বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের প্রতিফলন তেমন ঘটছে না। এটা দুঃখজনক। এটা দূর করার চেষ্টা করব। তবে আনন্দ পুরস্কারসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের আমরা যথেষ্ট মূল্যায়ন করে থাকি। আনন্দ পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে আমরা ড. আনিসুজ্জামানকে নির্বাচক কমিটিতে রেখেছি। শামসুর রাহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসহ গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের আমরা পুরস্কৃত করে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে চেষ্টা করেছি। তবে আমাদের বড় ব্যর্থতা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো শক্তিমান কথাশিল্পীর কোনো লেখা ছাপতে পারিনি। আমি মনে করি, সতীনাথ ভাদুড়ির পর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখক।
প্রসঙ্গ পাল্টে সমকাল সম্পাদক আলোচনা নিয়ে গেলেন সাহিত্য থেকে সাংবাদিকতার দিকে। নিউজের ট্রিটমেন্ট গুরুত্বের দিক নিয়ে কথা শুরু হলে অভীক সরকার বললেন, রাজনীতিবিদরাই শুধু সংবাদ শিরোনাম হবে না, জনসাধারণের আগ্রহ যেখানে, সেখানেই প্রাধান্য। সেটাই আমাদের শিরোনাম। আপনাদের মনে থাকতে পারে, কুলি ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে অমিতাভ বচ্চন গুরুতর আহত হয়েছিলেন। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তিনি তখন। পরপর আনন্দবাজার পত্রিকার লিড হয়েছিলেন অমিতাভ বচ্চন। বাংলাদেশের সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন পশ্চিমবঙ্গে দেখা না গেলেও ইন্টারনেটে সংবাদপত্র পড়া যায় বলে জানালেন তিনি।
অভীক সরকার বলেন, এখানকার বাংলা পত্রিকার মান ভালো। তবে ইংরেজি পত্রিকার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। দু'দেশের বাংলা কাগজের ভাষার প্রশ্নে তিনি বলেন, বানানরীতি এবং ভাষারীতি নিয়ে আনন্দবাজার নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, এটা সর্বত্রই থাকা উচিত। আমরা 'অবগুণ্ঠন' শব্দটির মুদ্রিত রূপ কেমন দেখাবে, যুক্তবর্ণের টাইপটা এমন হলে ী-দীর্ঘ-'ই'কারটা কেমন দেখাবে, এ নিয়েও রিসার্চ করে থাকি। এ রকম বহু খুঁটিনাটি দিক নিয়ে আমরা চিন্তা করি।
সমকাল সম্পাদক বললেন, আমাদের দুই দেশের পত্রিকায় পার্থক্য তো অনেক। আপনাদের পৃষ্ঠাসংখ্যা বেশ কম। অভীক সরকার হেসে বললেন, প্রতিযোগিতার মধ্যে অনেক সস্তায় কাগজ দিতে হয়। পৃষ্ঠা এর বেশি বাড়ানো অসম্ভব। তবে বাংলাদেশের সংবাদপত্র আর আমাদের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। আমাদের কাগজে মন্ত্রীদের বক্তৃতা খুব একটা ছাপা হয় না। প্রেস রিলিজ ছাপার তো প্রশ্নই আসে না। স্বাধীনতা দিবস কিংবা রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীসহ বিভিন্ন বিশেষ দিবসে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের মতো আবেগ দিয়ে আমরা সবকিছু দেখি না। আমরা আমাদের অতীত এবং ঐতিহ্য নিয়ে গৌরব করি, শ্রদ্ধা পোষণ করি; তবে আমাদের দৃষ্টি থাকে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের দিকে। দুই দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে কথায় কথায় অভীক সরকার বলেন, আপনাদের সমস্যা হলো_ এখানে অনেক রাজনৈতিক ধকল গেছে। আমাদের ওখানে গণতন্ত্রটা অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে আমাদের কাগজের সঙ্গে বাংলাদেশের কাগজের চরিত্রগত একটা পার্থক্য তো আছেই। সেটাই স্বাভাবিক।
আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় নীতি প্রসঙ্গে তিনি বললেন, আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় নীতি স্পষ্ট। আমরা দক্ষিণপন্থি। বাজার অর্থনীতি বলেন, ধনতন্ত্র বলেন, আমরা পশ্চিমা গণতন্ত্র আর অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি।
বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ওখানে সংবাদপত্রের সামাজিক ভূমিকা কী? এবারও সরাসরি বললেন, সমাজকর্ম সংবাদপত্রের দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি না। আমরা সংবাদপত্রকে একটা ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে বিবেচনা করি। ইন্ডাস্ট্রির কাজ হলো উৎপাদন আর বাণিজ্য। লাভ-লোকসানের হিসাব ছাড়া কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক ইন্টারেস্ট থাকা উচিত নয়। সংবাদপত্র শিল্পের মালিকানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসঙ্গে অভীক সরকার বললেন, বাংলাদেশের সঙ্গে এখানেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। আনন্দবাজার অন্য কোনো ব্যবসা করে না। সংবাদপত্রের বাইরে আমরা অন্য কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তাই করি না। আমাদের যা কিছু কর্মকাণ্ড, তা প্রকাশনা আর গণমাধ্যমভিত্তিকই। কারণ মিডিয়ার বাইরে আর পাঁচটা ব্যাপারে আমরা মনোযোগ দিতে চাই না। কেননা এর একটা পিওরিটির প্রশ্ন আছে। ২৪ ঘণ্টা আমাদের ভাবনার মধ্যে এই একটা বিষয়ই থাকে। অন্যদিকে মন দিলে ফোকাসটা মিডিয়ার ওপর পুরোপুরি রাখা সম্ভব নয়।
চলমান বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রসঙ্গ তুললেন সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। ক্রিকেট নিয়েও বেশ আগ্রহী অভীক সরকার। এ প্রসঙ্গে বললেন, খেলাধুলার নিউজটাকে আমরা সবসময়ই গুরুত্ব দিতে চাই। আপনারা ভালো খেললে ৮ কলামে প্রশংসা করেন। খারাপ খেললেও ৮ কলামেই নিন্দা করুন না। খেলাকে হাইলাইট করলে ক্ষতি কী।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশতবর্ষ চলছে এখন। এ বিষয়ে সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমের ব্যাপক আয়োজন আমাদের, পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমে বিশেষ করে প্রিন্ট মাধ্যমে কেন যেন সেটা দৃশ্যমান নয়। এর কারণ কী? অভীক সরকার বললেন, রবীন্দ্রনাথ অনেক বড় কবি; কিন্তু আমরা আবেগমুক্ত দৃষ্টি দিয়ে দেখলে আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিৎ শ্রেষ্ঠ পরিচিতি নয়। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমাদের কাছে জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু (সত্যেন বোস) অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আনন্দবাজার পত্রিকার পক্ষ থেকে ভারতের স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ভারতের শ্রেষ্ঠ ১০ জন ব্যক্তিত্ব নির্বাচন করেছিলাম। তাতে প্রথমে সত্যেন বোস, এরপর জগদীশ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ, মাদার তেরেসা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, পণ্ডিত রবিশঙ্কর_ এভাবেই ক্রম সাজিয়েছিলাম।
সাহিত্য থেকে হঠাৎ ভারতের বর্তমান রাজনীতি এবং পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের উত্থান-পতন প্রসঙ্গ এসে গেল। অভীক সরকার বললেন, আগামী মাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচন। বামফ্রন্ট দীর্ঘদিন ক্ষমতায়। মানুষ পরিবর্তন চায়। আনন্দবাজারও পরিবর্তনের পক্ষে।
বাংলাদেশের খবর ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রায়ই থাকে না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এ প্রসঙ্গে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। আমরা বাংলাদেশের পত্রিকা পড়তে চাই, টিভি চ্যানেল দেখতে চাই, কিন্তু পাই না। এ বাধা দূর করতে দু'পক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি স্বীকার করলেন, ঢাকায় আনন্দবাজারের একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যুরো অফিস রাখা উচিত। বর্তমান ইন্টারনেট প্রযুক্তি আর স্যাটেলাইট টেলিভিশন সংবাদপত্রের জন্য হুমকি কি-না জানতে চাইলে অভীক সরকার বলেন, এটা শুধু বাংলাদেশ বা ভারতের নয়, সারা পৃথিবীর প্রিন্ট মাধ্যমের জন্যই প্রযোজ্য। তবে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এটা ভালো। এরপরও ইন্টারনেট বা টেলিভিশন সংবাদপত্রের বিকল্প হবে না। হতে পারে না। টেলিভিশন সংবাদপত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। সংবাদপত্র ছাড়া জীবন চলবে না।
কথায় কথায় কখন ঘণ্টা পার হয়ে গেল। ঘড়ি দেখলেন অভীক সরকার। রাখী সরকার হাসলেন। সমকাল সম্পাদক জানতে চাইলেন, বৌদি, বাংলাদেশের কী ভালো লাগল? দু'চোখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে রাখী সরকার বললেন, এখানকার মিষ্টি, ইলিশ চমৎকার। এখানকার মানুষ খুব অতিথিপরায়ণ।
আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অভীক সরকার মাত্র তিনদিনের জন্য ঢাকা এসেছিলেন। নানা প্রসঙ্গে তিনি কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে
উপমহাদেশে বাংলা ভাষায় সর্বাধিক প্রচারিত কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অভীক সরকার সস্ত্রীক ঘুরে গেলেন ঢাকা। মাত্র তিনদিনের সফরে দারুণ ব্যস্ততা। প্রধানমন্ত্রী, একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ঢাকা ক্লাবে এক আড্ডার আয়োজন করলেন তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক এলেন, তার মুখ থেকে গণমাধ্যম ও আনন্দবাজার সম্পর্কে কিছু শুনব না! দিলি্লতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে নিযুক্ত প্রেস মিনিস্টার এনামুল হক চৌধুরী সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের অনুরোধে হোটেল শেরাটনে প্রাতঃরাশ বৈঠকে অভীক সরকারের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করলেন। সেখানেই তার সঙ্গে নানা প্রসঙ্গে কথা হলো। সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী রাখী সরকার। শুরুতেই সংবাদপত্রের দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গ উঠল।
অভীক সরকার বললেন, সংবাদপত্রের কারও কাছে দায়বদ্ধতা থাকতে পারে না, দায়বদ্ধতা থাকবে তার নিজের কাছে। যদি কোনো সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চায়, তাহলে তার থাকা চাই পরিপূর্ণ পেশাদারিত্ব। জানতে চাওয়া হলো, আনন্দবাজারের মূল শক্তি কী? অভীক সরকার বললেন, পেশাদারিত্ব আর সার্বিক উৎকর্ষই প্রাণশক্তি।
রাজনৈতিক দর্শন প্রসঙ্গ উঠতেই একটু সিরিয়াস হলেন। আনন্দবাজার কোনো দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তির পক্ষে-বিপক্ষে নয়। আমরা একটি বিশ্বাস ও আদর্শের পক্ষে। সে বিশ্বাস কেউ সমর্থন করতে পারেন, আবার না-ও পারেন। সংবাদপত্রকে তার নিজস্ব দায়বদ্ধতা নিয়েই এগোতে হয়। আমরা অন্তত তা-ই বিশ্বাস করি।
গল্পগুজব থেকে শুরু করে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানা বিষয়ে আলাপ। এই আড্ডায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, সংবাদপত্র ও প্রযুক্তির ক্রমবিবর্তনের প্রেক্ষাপটসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আনন্দবাজার গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় এই ব্যক্তি।
১৯২২ সালে সান্ধ্য দৈনিক হিসেবে মাত্র ৪ পৃষ্ঠায় যে পত্রিকার যাত্রা শুরু, তার আজ এই বিশাল মহীরুহে পরিণত হওয়ার নেপথ্য শক্তি প্রসঙ্গে অভীক সরকার বলেন, আমার পিতার আমল থেকেই আমরা প্রফেশনাল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ শুরু করি। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাতিষ্ঠানিকতা ও পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের দিকেই আমাদের দৃষ্টি ছিল। কোনো রকম আবেগে আমরা তাড়িত হইনি। বাংলার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আনন্দবাজারকে আমরা ধরে রাখতে চাইনি। আমরা সবসময়ই আন্তর্জাতিক মানের দৈনিকের কথা মাথায় রেখেছি। সে কারণে উৎকর্ষ আর মানের নিরিখে নিউইয়র্ক টাইমস বা লন্ডন টাইমসকে আমরা এক কাতারে গণ্য করি।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, অতীত ঐতিহ্য, স্মরণীয় দিন নিয়ে কেন তেমন আলোচনা বা বিশেষ ক্রোড়পত্র করে না আনন্দবাজার? যেমন_ আমাদের এখানে একুশে, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, জাতির জনকের জন্ম-মৃত্যুদিন নিয়ে বিশেষ আয়োজন থাকে।
বললেন, আমরা অতীত-কাতরতা বা অতীত-বিলাসে বিশ্বাস করি না। অতীত থাকবে ঐতিহ্য হিসেবে, আমাদের দৃষ্টি সবসময় থাকবে সামনের দিকে। তারুণ্যের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আমরা সম্পৃক্ত থাকতে চাই। দেশের বাইরে যারা আছেন, সেই তারুণ্যকেও আমরা সম্মাননা দিই, স্বীকৃতি দিই। বিশেষ করে জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকি। পেশাগত উৎকর্ষের প্রসঙ্গটি এ কথার সূত্র ধরেই আবার তুললেন অভীক সরকার। উদাহরণ হিসেবে বললেন, যখন বাজেটের ওপর একটা সম্পাদকীয় হয় তখন যে কোনো আন্তর্জাতিক মানের অর্থনীতির কাগজের মানে সে বিশ্লেষণটা উপস্থাপন করতে চেষ্টা করে আনন্দবাজার। আমরা ছাড়া ভারতে অন্যদের মধ্যে এই দৃষ্টিভঙ্গিটা দেখি না। সর্বভারতীয় ভাষার সংবাদের প্রেক্ষাপটেই বলব, তারা ধরেই নেন যে, যেহেতু আঞ্চলিক ভাষার কাগজ, সুতরাং আমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর। বাংলাও আঞ্চলিক ভাষা। তাতে কী? এটা ভাবলে তো অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। বাংলা ভাষার কাগজ হলেও আনন্দবাজার পত্রিকাকে আমরা ভারতের আঞ্চলিক ভাষার পত্রিকা মনে করি না। বিশ্ব প্রেক্ষাপটেই আমরা সবকিছু দেখতে চাই।
আনন্দবাজার প্রকাশনা এবং সার্কুলেশন প্রসঙ্গে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করলে অভীক সরকার বলেন, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাসহ তিনটি জায়গা থেকে আমরা পত্রিকাটি প্রকাশ করি। এখন সার্কুলেশন ১৪ লাখ। ডেইলি টেলিগ্রাফ যখন এবিপি থেকে আমরা প্রকাশ শুরু করি, তখন সেখানেও আমরা একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করি। ফলে আমাদের আনন্দবাজার পত্রিকা, টেলিগ্রাফ, সানন্দা, পাক্ষিক দেশসহ ৮টি প্রকাশনায়ই আমরা পেশাদারি মনোভাব অক্ষুণ্ন রাখতে সচেষ্ট।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এবং শিল্প-সাহিত্যের বিনিময় প্রসঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক বলেন, আমাদের দু'দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়নে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ সূত্রেই প্রশ্ন এলো, তাহলে আনন্দ পাবলিশার্স বা দেশ-এ বাংলাদেশের লেখকরা অনুপস্থিত কেন? দেশ পত্রিকায় বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিফলন তেমন একটা নেই স্বীকার করে তিনি বলেন, আমি দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা এবং টেলিগ্রাফ সরাসরি দেখি। অন্যান্য পত্রিকা যারা দেখেন, তারা এতটাই যোগ্য যে আমার সেদিকে খুব একটা নজর দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। দেশ-এ বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের প্রতিফলন তেমন ঘটছে না। এটা দুঃখজনক। এটা দূর করার চেষ্টা করব। তবে আনন্দ পুরস্কারসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের আমরা যথেষ্ট মূল্যায়ন করে থাকি। আনন্দ পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে আমরা ড. আনিসুজ্জামানকে নির্বাচক কমিটিতে রেখেছি। শামসুর রাহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসহ গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের আমরা পুরস্কৃত করে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে চেষ্টা করেছি। তবে আমাদের বড় ব্যর্থতা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো শক্তিমান কথাশিল্পীর কোনো লেখা ছাপতে পারিনি। আমি মনে করি, সতীনাথ ভাদুড়ির পর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখক।
প্রসঙ্গ পাল্টে সমকাল সম্পাদক আলোচনা নিয়ে গেলেন সাহিত্য থেকে সাংবাদিকতার দিকে। নিউজের ট্রিটমেন্ট গুরুত্বের দিক নিয়ে কথা শুরু হলে অভীক সরকার বললেন, রাজনীতিবিদরাই শুধু সংবাদ শিরোনাম হবে না, জনসাধারণের আগ্রহ যেখানে, সেখানেই প্রাধান্য। সেটাই আমাদের শিরোনাম। আপনাদের মনে থাকতে পারে, কুলি ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে অমিতাভ বচ্চন গুরুতর আহত হয়েছিলেন। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তিনি তখন। পরপর আনন্দবাজার পত্রিকার লিড হয়েছিলেন অমিতাভ বচ্চন। বাংলাদেশের সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন পশ্চিমবঙ্গে দেখা না গেলেও ইন্টারনেটে সংবাদপত্র পড়া যায় বলে জানালেন তিনি।
অভীক সরকার বলেন, এখানকার বাংলা পত্রিকার মান ভালো। তবে ইংরেজি পত্রিকার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। দু'দেশের বাংলা কাগজের ভাষার প্রশ্নে তিনি বলেন, বানানরীতি এবং ভাষারীতি নিয়ে আনন্দবাজার নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, এটা সর্বত্রই থাকা উচিত। আমরা 'অবগুণ্ঠন' শব্দটির মুদ্রিত রূপ কেমন দেখাবে, যুক্তবর্ণের টাইপটা এমন হলে ী-দীর্ঘ-'ই'কারটা কেমন দেখাবে, এ নিয়েও রিসার্চ করে থাকি। এ রকম বহু খুঁটিনাটি দিক নিয়ে আমরা চিন্তা করি।
সমকাল সম্পাদক বললেন, আমাদের দুই দেশের পত্রিকায় পার্থক্য তো অনেক। আপনাদের পৃষ্ঠাসংখ্যা বেশ কম। অভীক সরকার হেসে বললেন, প্রতিযোগিতার মধ্যে অনেক সস্তায় কাগজ দিতে হয়। পৃষ্ঠা এর বেশি বাড়ানো অসম্ভব। তবে বাংলাদেশের সংবাদপত্র আর আমাদের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। আমাদের কাগজে মন্ত্রীদের বক্তৃতা খুব একটা ছাপা হয় না। প্রেস রিলিজ ছাপার তো প্রশ্নই আসে না। স্বাধীনতা দিবস কিংবা রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীসহ বিভিন্ন বিশেষ দিবসে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের মতো আবেগ দিয়ে আমরা সবকিছু দেখি না। আমরা আমাদের অতীত এবং ঐতিহ্য নিয়ে গৌরব করি, শ্রদ্ধা পোষণ করি; তবে আমাদের দৃষ্টি থাকে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের দিকে। দুই দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে কথায় কথায় অভীক সরকার বলেন, আপনাদের সমস্যা হলো_ এখানে অনেক রাজনৈতিক ধকল গেছে। আমাদের ওখানে গণতন্ত্রটা অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে আমাদের কাগজের সঙ্গে বাংলাদেশের কাগজের চরিত্রগত একটা পার্থক্য তো আছেই। সেটাই স্বাভাবিক।
আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় নীতি প্রসঙ্গে তিনি বললেন, আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় নীতি স্পষ্ট। আমরা দক্ষিণপন্থি। বাজার অর্থনীতি বলেন, ধনতন্ত্র বলেন, আমরা পশ্চিমা গণতন্ত্র আর অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি।
বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ওখানে সংবাদপত্রের সামাজিক ভূমিকা কী? এবারও সরাসরি বললেন, সমাজকর্ম সংবাদপত্রের দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি না। আমরা সংবাদপত্রকে একটা ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে বিবেচনা করি। ইন্ডাস্ট্রির কাজ হলো উৎপাদন আর বাণিজ্য। লাভ-লোকসানের হিসাব ছাড়া কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক ইন্টারেস্ট থাকা উচিত নয়। সংবাদপত্র শিল্পের মালিকানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসঙ্গে অভীক সরকার বললেন, বাংলাদেশের সঙ্গে এখানেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। আনন্দবাজার অন্য কোনো ব্যবসা করে না। সংবাদপত্রের বাইরে আমরা অন্য কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তাই করি না। আমাদের যা কিছু কর্মকাণ্ড, তা প্রকাশনা আর গণমাধ্যমভিত্তিকই। কারণ মিডিয়ার বাইরে আর পাঁচটা ব্যাপারে আমরা মনোযোগ দিতে চাই না। কেননা এর একটা পিওরিটির প্রশ্ন আছে। ২৪ ঘণ্টা আমাদের ভাবনার মধ্যে এই একটা বিষয়ই থাকে। অন্যদিকে মন দিলে ফোকাসটা মিডিয়ার ওপর পুরোপুরি রাখা সম্ভব নয়।
চলমান বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রসঙ্গ তুললেন সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। ক্রিকেট নিয়েও বেশ আগ্রহী অভীক সরকার। এ প্রসঙ্গে বললেন, খেলাধুলার নিউজটাকে আমরা সবসময়ই গুরুত্ব দিতে চাই। আপনারা ভালো খেললে ৮ কলামে প্রশংসা করেন। খারাপ খেললেও ৮ কলামেই নিন্দা করুন না। খেলাকে হাইলাইট করলে ক্ষতি কী।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশতবর্ষ চলছে এখন। এ বিষয়ে সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমের ব্যাপক আয়োজন আমাদের, পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমে বিশেষ করে প্রিন্ট মাধ্যমে কেন যেন সেটা দৃশ্যমান নয়। এর কারণ কী? অভীক সরকার বললেন, রবীন্দ্রনাথ অনেক বড় কবি; কিন্তু আমরা আবেগমুক্ত দৃষ্টি দিয়ে দেখলে আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিৎ শ্রেষ্ঠ পরিচিতি নয়। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমাদের কাছে জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু (সত্যেন বোস) অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আনন্দবাজার পত্রিকার পক্ষ থেকে ভারতের স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ভারতের শ্রেষ্ঠ ১০ জন ব্যক্তিত্ব নির্বাচন করেছিলাম। তাতে প্রথমে সত্যেন বোস, এরপর জগদীশ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ, মাদার তেরেসা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, পণ্ডিত রবিশঙ্কর_ এভাবেই ক্রম সাজিয়েছিলাম।
সাহিত্য থেকে হঠাৎ ভারতের বর্তমান রাজনীতি এবং পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের উত্থান-পতন প্রসঙ্গ এসে গেল। অভীক সরকার বললেন, আগামী মাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচন। বামফ্রন্ট দীর্ঘদিন ক্ষমতায়। মানুষ পরিবর্তন চায়। আনন্দবাজারও পরিবর্তনের পক্ষে।
বাংলাদেশের খবর ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রায়ই থাকে না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এ প্রসঙ্গে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। আমরা বাংলাদেশের পত্রিকা পড়তে চাই, টিভি চ্যানেল দেখতে চাই, কিন্তু পাই না। এ বাধা দূর করতে দু'পক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি স্বীকার করলেন, ঢাকায় আনন্দবাজারের একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যুরো অফিস রাখা উচিত। বর্তমান ইন্টারনেট প্রযুক্তি আর স্যাটেলাইট টেলিভিশন সংবাদপত্রের জন্য হুমকি কি-না জানতে চাইলে অভীক সরকার বলেন, এটা শুধু বাংলাদেশ বা ভারতের নয়, সারা পৃথিবীর প্রিন্ট মাধ্যমের জন্যই প্রযোজ্য। তবে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এটা ভালো। এরপরও ইন্টারনেট বা টেলিভিশন সংবাদপত্রের বিকল্প হবে না। হতে পারে না। টেলিভিশন সংবাদপত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। সংবাদপত্র ছাড়া জীবন চলবে না।
কথায় কথায় কখন ঘণ্টা পার হয়ে গেল। ঘড়ি দেখলেন অভীক সরকার। রাখী সরকার হাসলেন। সমকাল সম্পাদক জানতে চাইলেন, বৌদি, বাংলাদেশের কী ভালো লাগল? দু'চোখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে রাখী সরকার বললেন, এখানকার মিষ্টি, ইলিশ চমৎকার। এখানকার মানুষ খুব অতিথিপরায়ণ।
No comments